জীবাশ্ম | অয়ন ঘোষ (১)




ডিসকভারি চ্যানেলে বেশ কিছুদিন আগে অ্যান্টার্ক্টিকার উপর একটা ডকুমেন্টারি দেখেছিল সোম--তাতে হিমশৈল, আগ্নেয়গিরি, সীল ডুবুরিদের পাশাপাশি ছিল এক পুরুষ পেংগুইনের উন্মাদ হয়ে যাওয়ার দৃশ্য দল থেকে নিজেকে বিছিন্ন করে কিছুক্ষণ বিভ্রান্ত হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে সে হঠাৎ পাড়ি দেয় দূর পাহাড়ের দিকে, যেদিকে খাবারের চিহ্ন নেই, নেই সঙ্গিনীর খোঁজ; শুধু বরফে ঢাকা এবড়োখেবড়ো পাথর তবু সেদিকেই হেলেদুলে আকাশের দিকে মুখ করে প্রাণপণে ছুটতে থাকে পেংগুইনটা, নিশ্চিত মৃত্যুর অভিমুখে নেপথ্যে বর্নয়িতা জানান যে এই অবস্থায় প্রাণীটিকে জোর করে দলে ফিরিয়ে আনা হলেও সে বারবার ওই পাহাড়ের দিকেই যেতে চাইবে; মহাদেশের অভ্যন্তরে সকলের আড়ালে মৃত্যুবরণ করবে ধু ধু সাদা তুষার মরুভুমির মাঝে একলা পেংগুইন ছোট হতে হতে কালো বিন্দু হয়ে যায়

কিসের ডাকে?

তার উত্তর দিতে অক্ষম হয় প্রাণীবিজ্ঞানী

শহরে নিম্নচাপ ঘনিয়ে এসেছিল চৌরঙ্গীর স্যাঁতস্যাঁতে নোংরা গলির দুর্গন্ধের মধ্যে, আবর্জনার স্তুপের ফাঁকে রাস্তার অতল গহ্বর আর পচা নর্দমার চারপাশে যে সমস্ত প্রকান্ড ধাড়ি ধাড়ি ইঁদুর ঘুরে বেড়ায় তাদের সাথে পলিথিনের ছাউনি বিছিয়ে থালা-বাসন সহকারে সহবাস করে যে একদল মানুষ, যাদের অপুষ্ট ন্যাংটো বাচ্চাগুলো ধুলোর মধ্য একটা চামচ বা একটা বাটি নিয়ে আপন মনে খেলা করতে থাকে, সেই পল্লীর বাসিন্দা মফিজুলের বাপকে সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছিল না তার এই নিরুদ্দেশ-যাত্রা অবশ্য অভূতপুর্ব নয়, কালেভদ্রে এমন হয়েই থাকে, আবার প্রতিবারই কাছেপিঠের মধ্যে থেকেই কেউ না কেউ ধরে আনে, বিশেষ কিছু ঘটবার আগেই কোনো ঝামেলা হয় না; ময়লা গেঞ্জি আর ছেঁড়া লুঙ্গি পরা খাঁদু-ক্ষ্যাপা চুলে মুঠো মুঠো ধুলো মেখে চোখ পাকিয়ে রাস্তার লোককে ভয় দেখায়, আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে হেসে লুটিয়ে পড়ে, কখনো বা পথচারিদের ফেলে দেওয়া কোনো আধপোড়া বিড়ি-সিগারেট পরম মেজাজে বসে টানতে থাকে লোকটা আগে সিমেন্ট-মিস্ত্রির কাজ করতো; আড়াই বছর আগে ভারা থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট লেগে মানসিক ভারসাম্য হারায় তারপর থেকেই এরকম; ওদের গল্প যেমন হয় আর কি সেই নিয়ম মাফিক পড়শি সালমা মফিজুলের মা-কে শান্তনা দেওয়ার ফাঁকে ছোট্ট তোবড়ানো ভাতের হাঁড়িটা কাঠকয়লার নামকাওয়াস্তে উনুনের উপর সদ্য চাপানো মাত্র আলু দৌড়তে দৌড়তে কোত্থেকে যেন খবর আনে যে খাঁদুকে নাকি টিভিতে দেখা গেছে ফুটন্ত ফ্যানের নির্যাস আর হালকা সাদা ধোঁয়ার সাথে কয়েক মিনিটের মধ্যে গোটা কলকাতা শহরে সেই বার্তা ছড়িয়ে পড়ে; প্রকাশ্য দিবালোকে হাওড়া ব্রিজের চুড়ায় উঠে যাওয়া এক পাগলের কীর্তিকলাপের কথা জানতে উৎসুক হয় কয়েক হাজার মানুষ

---

রনির কাছে সোহিনীর ফোনটা আসে ঠিক সকাল এগারোটা দশে সোমকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না গতকাল রাতে কাউকে না বলে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে গুরুত্বপুর্ণ কাজের দরুণ সোমকে প্রায়ই অনেক রাত অবধি অফিসে থাকতে হয়, মাঝেমধ্যে সারা রাত দফতরেই কেটে যায় মাল্টিন্যাশানাল ফার্ম, ক্যাম্পাসে থাকা-খাওয়ার কোনো ব্যবস্থারই কমতি নেই তবে প্রতিবারই সোহিনীকে জানিয়ে দেয় সোম ফোন না হলেও অন্তত একটা মেসেজ কিন্তু গতকাল রাতে কোনো খবর না পেয়ে জরুরি ক্লায়েন্ট মীটিং- ব্যাস্ত এমনটা অনুমান করে সোহিনী অপেক্ষা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে যায় ভোররাতে ঘুম ভাঙার পরেও সোমের ফোন নট্ রিচেবল্ পেয়ে এবার হন্য হয়ে অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে সোম সেখানেও নেই শেষে নেহাতই অসহায় বোধ করে সোমের খুড়তুতো ভাই রনিকে ফোন করে জানায় খবর পাওয়ার ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে রনি বেরিয়ে পড়ে

বৃষ্টি ভেজা ব্র্যাবোর্ন রোড ফ্লাইওভারে জ্যামে আটকে থাকা মিনিবাস-অটো-বাইক-প্রাইভেট গাড়ির ঠাসাঠাসির মধ্যে লজঝড়ে হলুদ ট্যাক্সিতে বসে রনি দরদর করে ঘামছিল দু পাশে জীর্ণ বিল্ডিং-এর সারি আর প্রকান্ড বিলবোর্ডের ফাঁক দিয়ে ছাইরঙা আকাশটা দেখতে দেখতে একঘেয়ে বিরক্তি চাগাড় দিয়ে ওঠে

কেসটা কি বলো তো কাকা?” ড্রাইভারকে অধৈর্য স্বরে প্রশ্ন করে রনি

ট্যাক্সি ড্রাইভার ঘাড়টা সিকিভাগ পিছনের দিকে ঘুরিয়ে উত্তর দেয়: “আরে স্যার, একটা পাগল

কি হয়েছে? ট্রামে কাটা পড়েছে?”

আরে না, না হাওড়া ব্রিজে উঠেছে

উফফফবলে রনি সীটে হতাশ ভাবে পিঠ এলিয়ে দেয় আজকের দিনটাই শালা খারাপ আর অভিদারও আজকেই যত গন্ডগোল হতে হলো একে এই ভ্যাপসা গরম, তার উপর বৃষ্টি গাড়ির ভিতর বসে গলদঘর্ম হতে থাকে রনি পাশে একটা মিনিবাস দাঁড়িয়ে ভক ভক করে গর্জন করতে করতে ধোঁয়া ছাড়ে, এক-পা, দু-পা করে এগোয় কন্ডাক্টর কখনোআস্তে লেডিজবলে দরজা থাবড়ায়, তেরচা ভাবে লেন চেঞ্জ করে রনির ট্যাক্সির সামনে গলিয়ে দেয় এদিক ওদিক থেকে প্যাঁ পোঁ করে নানা সুরে হর্ন বাজতে থাকে

হলুদ ট্যাক্সিগুলোয় এসি নেই সুতরাং এই গরমে জানালার কাঁচ তুলে শান্তিতে বসারও উপায় নেই আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রনি এটাতে ওঠাই ভুল হয়েছে, নেহাত তাড়াহুড়োয় কিছু পাওয়া গেলো না তাই

পুরো জাম স্যার,” ড্রাইভারটা বলেসেই ওদিকে বঙ্কিম সেতু অবধি

রনি ভাবে অভিদা, অর্থাৎ সোম ব্যানার্জি, তার খুড়তুতো দাদার এই ব্যারামটা নতুন না আজ বেশ কয়েক বছর ধরে সোমের এই ডিপ্রেশান অ্যাটাকগুলো শুরু হয়েছে দু-তিন মাস বাদে বাদেই আসে-যায় গত বছর প্রথম বার বেশ বাড়াবাড়ি হওয়ায় একরকম জোর করেই ডাক্তার দেখানো হয়সায়কায়াট্রিস্ট বলে স্কিৎজোফ্রেনিয়া অ্যাডভান্সড্ স্টেজ উইথ ডেলিবারেট সেল্ফ হার্ম অ্যান্ড সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি

খবরটা যতটা সম্ভব চেপে রাখতেই উপদেশ দিয়েছিল রনি আজকেও সোহিনীকে সে না পৌঁছোনো পর্যন্ত পুলিশকে জানাতে বারণ করেছিল গুটিকয়েক লোক ছাড়া এই ব্যাপারে কেউ বিশেষ কিছু জানে না, এমনকি সোমের বাবা-মাকেও ঠিক ভাবে কিছু বলা হয়নি বাইরে কানাঘুষো হলে বিপদ--চাকরিবাকরি নিয়ে টানাটানি হবে, হাজার লোকে হাজার কথা বলবে, পাগলের লেবেল চিপকাবে তাতে আরো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা এমনিতে সোমকে দেখলে কে বলবে এমন অসুখ--প্রচন্ড সোশ্যাল, জলি প্রকৃতির মানুষ যেখানে যায় জমিয়ে দেয়, যে কোনো আড্ডা বা গ্যাদারিং- মাতিয়ে রাখে সবাইকে কিন্তু আদতে খুবই চাপা স্বভাবের

মাস পাঁচেক আগে মনে আছে একদিন এইভাবেই সোহিনী তাকে বাড়িতে ডেকেছিল বউদির গলা শুনেই রনি বুঝেছিল বেশ চিন্তিত

একবার আসতে পারবি?”

কেন? কি হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?”

তোর দাদার আবার একটু বাড়াবাড়ি হয়েছে

ওহ! ওষুধ খাচ্ছে না?”

খেলে তো আমি ধন্য হতাম! একবার আসবি প্লিজ?”

সেবারও রনি ছুটেছিল এক ঘন্টার মাথায় সোমের ফ্ল্যাটে হাজির হয় দরজা খোলে সোহিনী বৌদিকে দেখে রনির মনে হয় যেন ঝড় বয়ে গেছে একটা

এখন একটু স্টেবল্ টেরেসে বসে আছে

বহুতলের সাতাশ নম্বর ফ্লোরে সোমের ফ্ল্যাটটা, দক্ষিণ দিকে অনেকটা খোলা টেরেস, ছাউনি নেই বিন্দাস লাগে রনির আর হবে নাই বা কেন, চাকরিটাও তো জম্পেশ বাগিয়েছে একটা; অনেক টা প্রাইভেট জব চেঞ্জ করে তবে মনে ঈর্ষা নেই রনির অভিদার খুবই কাছের , আর সোমের পার্সোনালিটিটাও একদম টিপিকাল বাংলা গল্পের দাদাদের মতই সোম আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে তা শুধুমাত্র নিজের যোগ্যতাতেই, সেটার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা আছে রনির

টেরেসের দিকে পা বাড়াতেই দেখে ডেক চেয়ারগুলোর একটায় সোম শুয়ে পায়ের কাছে সোমের কুকুরটা গুটিসুটি মেরে বসে আছেআয়

কি ব্যাপার, অভিদা?”

রনিকে দেখে লেজ নেড়ে এগিয়ে আসে কুকুরটা রনি ওর লোমে হাত বুলিয়ে দেয়

অনেক থেমে থেমে আস্তে কথা বলে সোম অন্য সময়ের টগবগে প্রাণবন্ত সোম ব্যানার্জির সাথে এর মিল কোথায়? বড়ই অপরিচিত লাগে

বোস

রনি একটা বেতের মোড়া টেনে নিয়ে দাদার কাছে বসে

আর পারছি না রে

কি হয়েছে?”

আই অ্যাম সাফারিং প্রচন্ড আওয়াজ

ওষুধ খাচ্ছো না?”

পিছন থেকে ব্যঙ্গপুর্ণ সোহিনী বলে ওঠে, “খেয়ে উদ্ধার করে দিচ্ছে আমায়!”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোমওই ওষুধ আমি খেতে পারবো না রে সারাক্ষণ ঘুম পায় কাজ করতে পারছি না অ্যান্ড আই হ্যাভ লস্ট মাই লিবিডো বিকজ অফ দোজ ব্লাডি মেডিসিনস্

রনি কিছু বলে না

আড়ালে সোহিনীর সাথে কথা হয়

আমি কিছু বুঝতে পারছি না,” বলে সোহিনী

ওষুধগুলো খাচ্ছে না কেন? তুমি জোর করতে পারো না?”

তুই তো জানিস কিরকম জেদি আমার কোনো কথাটা শোনে?”

রনি কি বলবে ভেবে পায় না

রনি, আমার খুব ভয় করছে যদি কিছু করে বসে? ডাক্তার বলেছিল আগেরবার--”

আমি কথা বলছি ওর সাথে

আচ্ছা, বলে দেখ তো আর ডাক্তারও দেখাতে চাইছে না

দেখাতে চাইছে না বললে হবে? দরকার পড়লে বাড়িতে ডাক্তার আনতে হবে

বৌদির মুখটা হঠাৎ কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়কি হবে রে রনি, যদি অ্যাসাইলাম হয়ে যায়?”

রনি বলে, “চিন্তা কোরো না আমি ওর কাছে একটু বসি

খেয়ে যাবি তো?”

হ্যাঁ

ট্যাক্সিতে বসে রনি হিসেব করে: আজকের ঘটনা নিয়ে এই তিন নম্বর মেজর অ্যাটাক দ্বিতীয় বারের বার ব্লেড নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে হাত কেটেছিল সোম ডাক্তার ওষুধের ডোজ ডবল করে দেয়

তুমি ওষুধগুলো না খেলে কি করে চলবে, অ্যাঁ?” শাসনের সুরে বলেছিল রনি

বললাম তো, ভাবে মানুষ বাঁচে না

তাহলে কি করে হবে?”

সোমের চোখের দৃষ্টিটা হঠাৎ করে অত্যন্ত ধারালো হয়ে উঠেছিল, প্রায় অস্বস্থিকরতোর বৌদি আমায় বিশ্বাস করে না বলে আমি ঢঙ করছি বাট্ আই অ্যাম নট প্রিটেন্ডিং! আমি তিন দিন ধরে অফিস যাইনি বলেছি শরীর খারাপ আই অ্যাম লুজিং কন্ট্রোল, রনি! শুক্রবার রাতে--”



Comments