সুমনের গান, ইতিহাস এবং কয়েকটি সন্দর্ভ | শিমূল সেন

||
 ||
Weekly-EditionWeekly
|| এই লেখার শুরুতেই একটা অনিবার্য সতর্কতার প্রয়োজন, যার জন্য আমরা শরণ নেব স্বয়ং এই লেখার বিষয়ের কাছেই, যিনি গানবাজনা-সংক্রান্ত যে কোনও আলোচনার আগেই স্বীকার করে নেন যে সংগীত একটি নন-ভার্বাল মাধ্যম, নিছক কথায় তাকে ধরা অসম্ভব। কখনও কখনও এমনও হয়, তাঁর নিজের একটি লেখায় কবুল করেছিলেন কবীর সুমন, এক জন শ্রোতা একটি গানের অন্ধকারে আচমকা আবিষ্কার করে ফেলেন কোনও অন্তর্ঘাতী কোমল স্বরকে, আর অসহায়ের মত তাঁর রাধার জন্য খুলে দেন ডাকবাক্স-- এটা জেনেই যে সেই চিঠি আর আসবে না কখনও। সুর যে অতলে ঘাই মারে, আমাদের বুদ্ধিসঞ্জাত প্রগলভ বক্তিমে তার হদিশ দিতে পারবে না কখনওই। তবুও এই অনিবার্য লেখার কারণ তাঁর গানের শরীরে সম্পৃক্ত একটি মাত্রার আবিষ্কার, যা খুব জরুরি, এমন কী, তাঁর গানের অগুনতি উচ্চারণকেও যা করে তোলে রাজনৈতিক অর্থবহ।

একটু ব্যক্তিগত কথা বলা যেতে পারে। আমি ইতিহাসের ছাত্র। ইতিহাসবোধ বা ইতিহাসচেতনা আমি কোনও পণ্ডিতের বা তাত্ত্বিকের বই পড়ে প্রথম পাই নি, বরঞ্চ যতটা সুমনের গানে পেয়েছি। ২০১৪-র জানুয়ারি, রিলিজ করল জাতিস্মর। সেই সময়টায় আমার মাধ্যমিক। পরীক্ষা শেষ হল, শো থেকে জাতিস্মরও চলে গেল, থাকার মধ্যে রয়ে গেল আমার ক্লাস ইলেভেন আর তখনকার বাণিজ্যসফল গান 'এ তুমি কেমন তুমি'। সেই গান তত দিনে রাষ্ট্রীয় অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে, সকাল পৌনে এগারোটার ভিড় ট্রামে সহযাত্রীর কলার টিউনে বেজে উঠছে 'এ কেমন কান্না তুমি আমায় যখন আদর করো'। ইলেভেনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে আমাদের পাঠ্য ছিল পদাবলি সাহিত্য নিয়ে সামান্য আলোচনা, আর, আমার সংস্কৃতে ছিল গীতগোবিন্দ। এমন সময় হঠাৎ ঘা দিয়ে গেল দুটি লাইন, 'জন্মের আগেও জন্ম পরেও জন্ম তুমিই এমন/ সুরেরও গভীর সুরে পদাবলির ধরন যেমন।'


যে জন্মান্তরের কথা বলেন নাগরিক কবিয়াল, যে সহস্র বছরের সংশ্লেষ তাঁর ওই একটি গানের মধ্যে উপ্ত থাকে, তা অজান্তে হয়ে ওঠে একটা স্থানীয় ইতিহাসের হাজার হাজার বছরের ইতিবৃত্ত। একটা সমগ্র জাতির পরিচিতিকে ডিটারমিন করে দেয় একটা গান, আর সেতু হয়ে জেগে থাকে স্রেফ 'পদাবলি' শব্দটি। এর পরের লাইনে যখন প্রেমিক বিনতি করবেন, 'কথা নয় নীরবতায় সজলতার আখর ভরো,' তখন 'আখর' কথাটা জলপ্রপাতের মত ভাসিয়ে নিয়ে যায় কীর্তনের সোহাগে। এবং, কী আশ্চর্য, এই গানটাও বাঁধা হয়েছে কীর্তনের আঙ্গিকেই, যেমন, কে যেন একটা এই গান শুনে বলেছিলেন, 'শেষ কোন বাংলা গানে সঞ্চারী শোনা গেছে? এমন সঞ্চারী?' এমন আবিল পচ্যতার যুগে সুমনের গানে আখর শব্দটি, অথবা সঞ্চারীর ব্যবহার, পদাবলি শব্দটির ঐতিহাসিক উল্লেখ হয়ে দাঁড়ায় সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের নিঃশব্জ নজির, যা গর্বিত ভাবে তুলে ধরতে চায় শিকড়ের পরিচিতিকে। সুমন নিজেও একান্ত ভাবে বিশ্বাস করেন, 'কীর্তন আর রামপ্রসাদ ছাড়া কোনও আধুনিক বাংলা গান তৈরি করা সম্ভব নয়।'


'এ তুমি কেমন তুমি'র সঞ্চারীতে তার পরেই পাওয়া যায় একটি নাম। পদ্মাবতী। সুমন বলেন, 'এসেছি আগেও আমি যখন তুমি পদ্মাবতী।' কে এই পদ্মাবতী? বলা হয়, ইনি গীতগোবিন্দের রচয়িতা কবি জয়দেবের স্ত্রী, জয়দেব নিজেকে বহু বার পেশ করেছেন 'পদ্মাবতীচরণচারণচক্রবর্তী' বলে। সুমন এর পরে নিজের একটি ফেসবুকের লেখায় লিখেছেন, জয়দেব আর পদ্মাবতী তাঁকে ঘায়েল করে ছেলেবেলা থেকেই, যখন তিনি দিদিমার মুখে জয়দেবের নাম শুনতেন আর চমকে উঠতেন অকারণে। ধীরে ধীরে একটা ইতিহাস এই ভাবে নির্মিত হয়ে ওঠে, যার কেন্দ্রে থাকেন এক প্রেমিক, এবং যে ইতিহাসে অনায়াস যাতায়াত করে কল্পনা এবং বিশ্বাস। সুমন আসলে একটা বহুপ্রজ সভ্যতার চিরকালের অনড় ও প্রাচীন সেই মানুষ হিসেবে নিজেকে দেখেন, যিনি বার বার সুরের টানে, নদীর টানে গল্প বলতে আসেন এই পৃথিবীর কাছে, আর একটা অঞ্চলের ইতিহাসসত্তা রঙিন হয়ে ওঠে গানের ভেতর।

এই গান নিয়ে ভাবনাটা যখন প্রথম আসে, তখন এই বিষয়গুলোই বিভিন্ন ভাবে পাঠ্য হিসেবে পড়তে হচ্ছে, অথচ কোথাও গিয়ে সুমনের শিল্প সেই পাঠ্য ইতিহাসের পরিমিতিতে আবদ্ধ থাকছে না। ভীষণ বিখ্যাত জাতিস্মর গানটির কথাই বলা যেতে পারে। এখানে বহু ঐতিহাসিক চরিত্রের আনাগোনা, প্রেমের খুব স্বাভাবিক কিছু উচ্চারণেও সুমনের গান ছুঁয়ে যায় সহস্রাব্দের মনীষা ও চেতনাকে, যা এলোমেলো করে দেয় সমসময়ের আর্তিকে। ঐতিহাসিক অনুষঙ্গ হিসেবে রয়েছে ছেঁড়া তালপাতা পুথি, কালকেউটে, লখিন্দর, বেহুলা, তথাগত, এবং অগুনতি নদীর কথা। লক্ষ্যণীয়, ইতিহাসের ভরকেন্দ্র হিসেবে যে শক্তি সব সময় ঘোরাফেরা করে, তাদের কথা সুমন বলেন না, তিনি সজোরে বলেন 'মুখে মুখে ফেরা মানুষের গানে শুধু তোমাকেই চাই', এবং আলতো ভাবে ছুঁয়ে যান মুখের ভাষাকে, ক্ষমতার ভাষাকে নয়, বা লিখিত ভাষাকে নয়। সংস্কৃতর ব্রাহ্মণ্য অচলায়তনকে তিনি পরিত্যাগ করেন, চলে আসেন বুদ্ধ-প্রবর্তিত পালি বা প্রাকৃতের মত মুখের ভাষায়। সুমন যে সময় এই গান বাঁধছেন, তখন চার পাশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে নব্য হিন্দুত্ববাদী শক্তির উল্লম্ফন। এই বিশেষ মুহূর্তে লখিন্দর, বেহুলারা হয়ে ওঠেন প্রতিরোধের হাতিয়ার। উপমহাদেশের বিভিন্ন টুকরো টুকরো আঞ্চলিক সত্তা এই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে চান তিনি আর এমন করেই সমকাল এবং সভ্যতা তাঁর প্রেমের আয়ুধ হয়ে ওঠে, যখন তিনি আটষট্টির সরবোন-কে মনে রেখে, যেখানে ছাত্রনেতা কন বাদিত বিদ্রোহীদের বলেছিলেন, যুগলে রাস্তার ওপর শুয়ে পড়তে সটান পুলিশের সামনে, কারণ 'ভালবাসার ওপর গুলি চালানো যায় না', ডাক দেন ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ব্যারিকেড গড়ার। আবহমান প্রতিরোধের ইতিহাস এই ভাবে কবীর সুমনের নিখাদ প্রেমের উক্তিকেও করে তোলে আদ্যন্ত রাজনৈতিক।


আঞ্চলিক ইতিহাস ব্যক্তি সুমনেরও অনেকখানি আগ্রহের জায়গা, এ-কথা তিনি নিজেই বহু বার জানিয়েছেন। সত্তরের দশকের গোড়ায় এই ইতিহাসের চর্চাও করতেন তিনি। ২০১৪-য় বৈষ্ণবঘাটার একটি পুজোর থিমভাবনায় ছিলেন সুমন, যেখানে তিনি ওই পল্লির অতীত-ইতিবৃত্ত নিয়ে একটি গান বাঁধেন। তাঁর ভাবনার কেন্দ্রে ছিল একটি নদী, আদিগঙ্গা, যাকে তিনি মনে করেন গাঙুর। তাঁর প্রত্যয়, ওই আদিগঙ্গা অর্থাৎ গাঙুরের ওপর দিয়েই শতাব্দ আগে মৃত স্বামীকে বাঁচাতে বয়ে গিয়েছিলেন ভেলায় ভাসমান বেহুলা। সেই গাঙুর, যেখানে সত্তরের সময় নকশাল আন্দোলন চলাকালীন এক বিপ্লবী যুবককে নদীর জলে আবিষ্কার করেন তিনি, যার পিঠে ছুরি গাঁথা, দেহ রক্তাক্ত, নদীর ঘোলাটে জলে ভেসে চলেছে আস্তে আস্তে। বৈষ্ণবঘাটা পুজোর জন্য তৈরি এই গান সুমন এই নদীটাকে নিয়েই বাঁধেন, তুলে ধরেন নদীর দুই পাশের কৌম মানুষের জীবনছবি।


'মনসার ছয় ছেলে গেল
তবু ঢিঁঢে সদাগর চাঁদ
কঠোর শৈব সেই বেনে
মানবে না মনসার ফাঁদ।
পুজো দেব শিবের পায়েতে
মনসা তো চ্যাংমুড়ি কানি
তাই কালনাগিনীর বিষে
লখিন্দরের প্রাণহানি।...'

এই ভাবে খুব অলস স্রোতের ছন্দে গানটা এগোতে এগোতে একটা বাঁকের সামনে দাঁড়ায়। সুমন লেখেন:
'যে বাংলা মনসাকে চেনে
সে কখনও বৈদিক নয়
পরাজিত হন চাঁদ বেনে
মনসার এখানে বিজয়।'

গানের মধ্যে এই অকস্মাৎ ঘোষণার পরে বেহুলারা আবার ব্রাহ্মণ্যবাদী সন্দর্ভের উল্টো দিকে কৌম বাংলার স্বপক্ষে আঞ্চলিক একটি সনদ তুলে ধরে, সুমনের অন্য অনেক গানের মতই। বাংলাদেশ সম্পর্কে গান বাঁধতে গিয়েও তাই চলে আসে বেহুলার কথা, বাঙালির জাতি-পরিচয়ে একটি জরুরি চিহ্ন হয়ে ওঠে বেহুলার নাম।


এ ভাবে স্থানীয় ইতিহাসকে গান ছেড়ে দিলাম, লেখালিখির জগতেও এমন ভাবে ব্যবহার করেছেন বললে জীবনানন্দ ছাড়া কারুর নাম এখন মাথায় আসছে না। জীবনানন্দ তাঁর অন্বিষ্টকে চেয়েছিলেন বনলতা সেনের মত, আর সুমনের মননে বেহুলাই হয়ে ওঠেন তাঁর প্রার্থিত প্রেমিকা। যে বেহুলা শুধু রক্তমাংসের মুহূর্ত নন, তাকে ছাপিয়েও একশো, হাজার বছরের অনেক সময় দিয়ে তৈরি সমুদ্রের মত।


বৈষ্ণবঘাটা-সংক্রান্ত এই গান যখন প্রায় শেষের পথে, আবার মুখে মুখে ফেরা মানুষের ভাষাকে টেনে আনেন সুমন।
'স্মৃতি ধরে বৈষ্ণবঘাটা
আদ্যিকালের সে' কথক
সাধারণ মানুষের কথা
স্রোতের পাঁচালি হয় হোক।'

কীর্তনের মত পাঁচালিও একটি লোক মাধ্যম, জনতার হাতে হাতে যে ঘুরে চলে নিশানের মত। এই চারটি লাইনে স্মৃতি এবং কথক, দুটি শব্দ খুব দরকারি, যা লিখিত প্রাতিষ্ঠানিক ও আধিপত্যবাদী ইতিহাসের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে এক বিকল্প ইতিহাসবোধের দাবি জানায়। কথ্য ইতিহাসকে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে বহন করার আরও একটি চমৎকার কাজ সুমন করেছিলেন তাঁর 'দশরথ গেলেন মৃগয়ায়' গানে, যা মধ্যপ্রদেশের গোন্দ সম্প্রদায়ের একটি উপকথা।


এই গানে দশরথের ভোজের জন্য তিরবিদ্ধ হরিণ-হরিণী কথা বলে ওঠে। লোককাহিনির কল্পনা সুমনের গানে মস্ত বড় রাজনৈতিক দ্যোতনা নিয়ে আসে। ব্যঙ্গ করে যে গান বলে, 'দশরথ বড় তিরন্দাজ/ দু' চোখে দুরন্ত আন্দাজ/ বেচারা হরিণ-হরিণী/ তোমরা জানতে পারো নি/ আমার রামচন্দ্র ডুগডুগি বাজাবে।'  এই ডুগডুগি আজ সহস্র বছর পরেও দেশ জুড়ে বাজছে। মারা যাচ্ছেন সংখ্যালঘু তকমাবন্দিরা। এই শক্তিকে আটকাতেই গানে গানে রচিত হয় এই বিকল্প ইতিহাসের আখ্যান, যে ইতিহাস মানুষের স্মার্ত মৌখিকতায় মিশে থাকে, আবার কখনও কখনও যার কেন্দ্রে বসত করে একটি নদী। এই নদীর গল্প কখনও কখনও সুমনের গানে হানা দেয় এক নীরব দর্শকের মত, যে আদ্যিকাল থেকে দেখে চলেছে পরিবেশে নানা ঢেউ।


সেই নদী একটা আস্ত সভ্যতার তরফে সাক্ষ্য দেয়, বিস্তৃত ইতিহাসের মেটাফর হয়ে ওঠে। এই নদীর দু' পাশে, কলকাতার আশেপাশে মফসসলে ভারতীয় শিল্পস্থাপনের সময় বিভিন্ন পুঁজিতে গড়ে উঠতে থাকে বহুবিধ কারখানা, পাটের কল। সেখানে মালিক উদ্বৃত্তটুকু হজম করে নেয়, আর শ্রমিকরা ধুঁকে মরে। হুগলি নদীর ঘোলা জলে মিশে বিলীন হয়ে যায় সেই নামহারা অগুনতি মুখ।



সুমন গান:
'...পাটের কলে    মানুষ ফেলে    মাথার ঘাম
  পরের ঘামে     মালিক জপে   টাকার নাম'

লক্ষ্যণীয় যে শিল্পী সুমনের ইতিহাস-বোধ মালিক শব্দটির উল্টো দিকে বসাতে চায় মানুষ শব্দটিকে।
'ঘামের জলে    নৌকো চলে     দেখবি চল
ছলাৎছল
          ছলাৎছল         ছলাৎছল।
নৌকো ছিল    নৌকো আছে    নৌকো যায়
কাদের ঘাম
     শ্যাওলা হল      ঘাটের গায়ে
বল না নদী
      তাদের কিছু      গল্প বল
ছলাৎছল         ছলাৎছল          ছলাৎছল।'

মানুষের শ্রম আত্মসাৎ করে যে নৌকো চলছে, সুমন মনে করেন, সেই নৌকোয় কখনও শ্রমিকের নাম লেখা থাকে না। ইতিহাসের যে নৌকো আবহমানের মফসসল ছুঁয়ে বহতা, তাতে এই লোকগুলোর কথা নেই, যাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'সভ্যতার পিলসুজ'। যারা, মানুষের সব নির্মাণের অংশী, অথচ যাদের নাম ইতিহাস লেখে না। কারণ সেই ইতিহাস মহাফেজখানার ক্ষমতার ইতিহাস। এই গানের শেষ লাইনে সুমন আবার সেই মৌখিক ইতিহাসকে দাবি করেন, চান যে এই নদী কিছু 'গল্প' বলুক সেই হিসেবে বাদ পড়ে যাওয়া লোকগুলোর, যা অনেক বাস্তব, জীবন্ত ও টাটকা। যারা সত্যিই সর্বহারা, তাদের ইতিহাসকে শিল্পীর ইনটিউশনে আমেরিকায় বসে থেকে পাখির মত উড়াল দেওয়া সকালেও ছুঁতে পারেন তিনি, স্বগতোক্তি করেন 'তাদের খিদের ইতিহাস এক বিশ্রী অন্ধকারা'।


সুমন তাঁর যৌবনে বের্টোল্ট ব্রেখটের একটি কবিতাকে বাংলায় অনুবাদ করে গানে আত্মস্থ করেন। তখন তিনি সবে গান লিখতে শুরু করেছেন। সেই সময়টা নকশালবাড়ি, জরুরি অবস্থা পেরোনো দু' দশকের ভারতীয় গণতন্ত্রের এক অমোঘ পরীক্ষার সময়। ঘুরেফিরে সেই ইতিহাসে বাদ পড়ে যাওয়া মানুষগুলোর স্বীকৃতির দাবিতে সরব হয়ে ওঠে তাঁর গান--

'কে তৈরি করেছিল তাজমহল, সে কি শাজাহান
আহা শাজাহান সারা দিন সারা রাত সারা মাস
ছেনি-হাতুড়ির ঘায়ে লড়েছিল কি?
না না, তাজমহল, সে তো শ্রমিকের সৃষ্টি, শিল্পীর সৃষ্টি
শয়ে শয়ে মানুষের মহান সৃষ্টি
ইতিহাসে সেই কথা লেখা নেই
মানুষের ইতিহাস লিখতে হবেই।'

ঘটনাচক্রে তিনি এই নামহীন শ্রমিকদের শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি দেন, এবং শেষ স্তবকে গান চলে আসে সমসময়ে।
'এ দেশের ইতিহাসে পড়ি শুধু নেতাদের নাম
তারাই বিশেষ্য বিশেষণ ক্রিয়া সর্বনাম
এই নামী লোকেদের দেশ তোমায় সেলাম।
যারা নামীদামী লোক নয় তাদের কাহিনি মনে পড়ে
যারা জরুরি অবস্থায় কয়েদ লোপাট ঘরে ঘরে
সেই অনামী মানুষদের, বেরঙা মানুষদের নতুন ইতিহাস লিখতে হবেই।'

তা হলে, সংগীতের মত একটি শিল্পমাধ্যম যখন পুরোপুরি বাঙ্ময় হয়ে ওঠে, তার সরবতার সঙ্গে ইতিহাস কোথায় আলাদা থাকে? থাকে, যে জায়গাটা ইতিহাসবিদ অশীন দাশগুপ্ত তাঁর একটা বক্তৃতায় তুলে ধরেছিলেন, যে, ইতিহাস কথা বলে সমগ্রের হয়ে, এককের কথা, ব্যক্তিগতের কথা, যে গাছটা পাতা ঝরিয়ে দিয়ে শূন্য হতে চায় অথবা একলা হতে চাওয়া বিষণ্ণ রাত যখন তারার জড়োয়ার ভেতর লুকিয়ে থাকে, তার কথা ইতিহাসে উপেক্ষিতই থেকে যায় দিনের শেষে।


একলা চরিত্রগুলো ইতিহাসের অন্দরে অধিকার পায় না। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, 'কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশকুসুমচয়নে/ সব পথ শেষে মিলে গেল এসে তোমারই দু'খানি নয়নে,' তখন সেই একলা বিরহীটি যুগপুরুষ হতে পারে, তাঁর নাম হতে পারে শ্রীচৈতন্য। সুমন, কী আশ্চর্য, এই চরিত্রটা নিয়ে ইতিহাসেই ঘাঁটি গাড়েন। 'তথাগত তাঁর নিঃসঙ্গতা দিলেন অস্তরাগে,' এত নিবিড় হয়ে ন্যারেট করে ফেলেন সুমন, আমার মনে হয়, তথাগত সত্যিই হয়তো গোধূলিতে কোনও এক বোধিবৃক্ষের তলায় তপস্যা করছেন, তাঁর আধবোজা চোখের তারায় একটা সভ্যতা ঝিকমিক করছে। সুমন সৌভাগ্যবশত তা দেখে ফেলেছেন। সেই একলা তথাগত নিশ্চল। সুমন বলেন:

'...পাথর তুমি কেঁদো না
তথাগত তিনি স্থাণু
তাঁর ধ্যানস্থ রক্তে

চরাচর নতজানু'


সূর্যাস্তের ভেতর দার্শনিকের অপার প্রজ্ঞামাখা চোখ থেকে সুমন কুড়িয়ে নেন ধূসর নীলাভ এক জোনাকিকে।
তাঁর জীবন জুড়ে খেলা করে বেরিয়েছে অনেক নদীর নাম। জন্মেছিলেন কটকে, কাটজুড়ি নদীর ধারে। তার পর ক্রমশ গাঙুড়, সেইন, মিসিসিপি ধরে আবার গাঙুড়ের ধারে ফিরে আসা। তিনি সেই প্রাচীন পুরুষ, যাঁর ব্যক্তিগত সংরাগে নদীরা এসে মিশে যায়। নদী, কখনও কখনও একটা অনন্ত সভ্যতার ভেতর একটু মানুষী পরিসর তৈরি করে দেয়, ব্যক্তির জীবনকে হয়তো নির্দিষ্ট করে দেয়। অপুর সংসারে অপু যখন গ্রামে ফিরে আসে, সে পুকুরের জলে দেখতে পায় কালপুরুষের স্থির ছায়াকে। ভারতীয় দর্শনে বলা হয়, কালপুরুষ যার ওপর ভর করে, সে ঘরছাড়া হয়, জীবনভর পালিয়ে বেড়ায়, বিবাগী হয়ে ওঠে। কোনও এক গানওলা তাকে জিগ্যেস করেন, 'কোথায় ফিরিস পরম শেষের অণ্বেষণে?'

'টুক করে আলো দেখা
টুকি দেওয়া রোদ্দুরে আমি
শৈশবে ফিরে আজও
কাঠজুড়ি নদীতেই নামি
বেগতিক বান এলে
ঢেউ আসে ঢেউ চলে যায়
খোদার কসম জান
আমি ভালবেসেছি তোমায়।'


সুমন হয়তো জানাতে চান এই ঢেউয়ের ভেতর আস্ত সভ্যতা লুকিয়ে। ইতিহাস হল সেই পদ্ধতি যা দিয়ে তিনি সভ্যতাকে পড়েন। ব্যক্তিগত সভ্যতা এবং সমগ্র সমাজের সভ্যতাকেও। তিনি বুড়ো হলেন, বললেন, 'আমার কিন্তু স্বপ্ন দেখতে আজও ভাল লাগে,'


তিনি বিশ্বাস রাখেন এক দিন এই ইমারত ভেঙে পড়বে, বদল আসবে।


ইতিহাসকে কাছে ডেকে নেন তিনি। বন্ধুর মত আদর করেন আর সান্ত্বনা দেন। বলেন, 'ইতিহাস তুমি কেঁদো না/ পরিবর্তন আসে/ চিরক্রান্তির ভাবনা/ তোমাকেই ভালবাসে।'

অবাক হই নি যখন দেখলাম এ-বছর একটি পুজোর থিম সং বাঁধতে গিয়ে সুমন ইতিহাসের চলনটাকে বেঁধেছেন অদ্ভুত দুলুনির ছাঁদে। যেন বা, একটা বিকেল উপনীত, সেই নামহীন শ্রমজীবীরা এক-এক করে অবসৃত হচ্ছেন, বিকেল থেকে সন্ধে চুঁইয়ে পড়ছে, দিনের শেষে তাঁরা প্রস্থান করছেন অগম্য অনন্তের পথে। সুকান্তের রানার লাল পূর্ব কোণকে গানের সফর শেষ হলে দেখেছিল, কিন্তু এই গানে যাঁরা বাঁক বইছেন, তাঁদের কোনও সঙ্ঘ নেই। তাদের কণ্ঠ নেই। অদ্ভুত নির্লিপ্তিতে এই গান শেষ হয় ও সন্ধের অন্ধকার ক্রমশ ঘনিয়ে ওঠে। 

''কাঁধে বাঁক ব্যাঁকার উপায় নেই
ইতিহাস দুই পাশে ঝুলছেই।
মেহনত পরের ওজন বয়
যেখানে মানুষ শ্রমিক হয়।
দুটি পা চলছে তো চলছেই
কাঁধে বাঁক ব্যাঁকার উপায় নেই।

বাঁশ থেকে বাঁখারি আর বাঁক
ইতিহাস ঝুলছে ঝুলতে থাক
দু'পাশে মাটি পাথর চাঁই
দু'পায়ে পৌঁছে দেওয়া চাই।
দুটি পা চলছে তো চলছেই
কাঁধে বাঁক ব্যাঁকার উপায় নেই।

বাড়িঘর রাস্তা পুকুর কাটা
জোগাড়ের বাঁক কাঁধে পথ হাঁটা।
চাকা ঠ্যালা গরুর গাড়ির আগে
কাঁধে বাঁক হাঁটার হক্ক লাগে।
দুটি পা চলছে তো চলছেই
কাঁধে বাঁক ব্যাঁকার উপায় নেই।

ইতিহাস শুরু সময় থেকে
বাঁখারির বাঁক রয়েছে বেঁকে
সিধে কাঁধ কাঁধের ওপর রাখা
দু'পাশে ওজন ঝুলে থাকা।
দু'পাশে ঝুলছে তো ঝুলছেই
কাঁধে বাঁক ব্যাঁকার উপায় নেই।


মেহনত পরের ওজন বয়
যেখানে মানুষ শ্রমিক হয়।
দুটি পা চলছে তো চলছেই
কাঁধে বাঁক ব্যাঁকার উপায় নেই।

কাঁধে বাঁক ব্যাঁকার উপায় নেই

জানি না, বিশ্বসংগীতেই এমন প্রখর ইতিহাসচেতনা কেউ গানে ফেরি করেছেন কি-না। কিন্তু সেই অন্তিম অ্যাম্ফিথিয়েটারের একটি কোণ চিরকালীন দখল করেছেন সুমন, যে প্রতিরোধের ইতিহাসে ব্যারিকেডে তিতুমিরের নাম লেখা হয়, যে ইতিহাসে পরস্পর নিশান ভাগাভাগি করে রেখে, 'আদ্যিকালের স্পার্টাকাস/ গ্যালারিতে বসে এক দিকে/ কী যেন বলেন চুপিচুপি শঙ্কর গুহনিয়োগীকে',


এবং তার পরেই লালন, রামপ্রসাদ বাংলার জলহাওয়ায় গেয়ে ওঠেন, বলেন, 'হাতের কাছে হয় না খবর/ কী দেখতে যাও দিল্লি লাহোর?' নদীরা ঢেউ তোলে। উজান। সন্ধে নামে। প্রথম তারাটির জন্ম হয়। আমার ইচ্ছে আছে, আমাদের ইতিহাস ক্লাসঘরে কখনও গ্রাফিতি করে রাখব এই সব লাইন। হবে, নিশ্চয়ই হবে কখনও!

 ||

Comments

  1. ধন্যবাদ, সোমেন রায়।

    ReplyDelete
  2. Eto kom boyose eto sundor lekha. Vabai jay na

    ReplyDelete
  3. Eto kom boyose eto sundor lekha. Vabai jay na

    ReplyDelete
  4. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  5. অসাধারণ। অপার মুগ্ধতা। ভালোবাসা।

    ReplyDelete
  6. বড় ভালো লিখেছিস শিমুল।

    ReplyDelete
  7. সকলকে ধন্যবাদ। এখানে একটি কথা বলার: যে নীল হরফের লেখাগুলো রয়েছে, ওগুলি ক্লিক করলেই সংশ্লিষ্ট গানগুলি শোনা যাচ্ছে।

    ReplyDelete
  8. অনিমেষদা, সায়ন্তন, সুপ্রিয়দা, সায়ন চক্রবর্তী... সকলকে, সকলকে ধন্যবাদ ও ভালবাসা।

    ReplyDelete
  9. যে ব্লগার নামহীন হয়ে কমেন্ট করেছেন, তাঁকে কি আমি চিনি? ;) টোকা মেরো। ভালবাসা।

    ReplyDelete
  10. নামহীন ব্লগার কি 'চাইছি তোমার বন্ধুতা'?

    ReplyDelete
  11. শিমুল
    তোমার বয়সের কমতি তোমার চেতনায় ধরা পরে না ।
    অগুনতি প্রত্যাশার জন্ম দিলো তোমার এই লেখা
    ১৯৯২-৯৩ তে আমার বয়স ৬ কি ৭ বছর, তখন থেকে আমার সুমন শোনার শুরু, তারপর এতোগুলো বছর ধরে বহু সুমন শুনেছি বহু সুমন প্রেমীর লেখা পরেছি কিন্তু তোমার মতো বিশ্লেষক পাইনি।
    নতুন একটা দৃষ্টিকোণ পেলাম ।
    সমৃদ্ধ হলাম ।
    সুখ হলো মনে ।
    তোমার নাম টিও বেশ সুন্দর , বারবার ডাকতে ইচ্ছা যায় ।
    ভালোথেকো শিমুল.......

    ReplyDelete
  12. ভালবাসা নেবেন এক রাশ, দেবাংশু কুমার!ভাল থাকবেন, কথা হবে।

    ReplyDelete
  13. ধন্যবাদ, আশিকুর রহমান।

    ReplyDelete
  14. বাহ দারুণ লাগলো

    ReplyDelete
  15. বাহ দারুণ লাগলো

    ReplyDelete
  16. *সনকার ছয় ছেলে গেল

    ReplyDelete
  17. হ্যাঁ শৌভিকদা, এটা কপি করা ।

    ReplyDelete
  18. হ্যাঁ শৌভিকদা, এটা কপি করা ।

    ReplyDelete
  19. Advut sundor laglo.....oneek suvechha roilo...

    ReplyDelete
  20. এক্সেলেন্ট। এই লেখাটার দরকার ছিল।

    ReplyDelete
  21. Sumaner gan nie ato bhalo bisleson age konodin keu likhechen bole amar mone hoi name. Ami prai sumaner samaboisi, onar gan sona ar ganer lyrics anudhaban Kora amar neshar moto. Khub bhalo laglo pore Shimul bhai.

    ReplyDelete
  22. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  23. মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ে গেছি, যেমন বরাবর তোর লেখা পড়ি। এ লেখা আগেও পড়েছি। এ লেখার মধ্যে দিয়েই তোর সাথে প্রথম পরিচয় হয়। আজ আবার পড়লাম। আর একটা কথাই মনে হয়, সুমনের গানের প্রতি অসম্ভব একাত্মবোধ থেকে এমন সুন্দর বিশ্লেষণমূলক লেখা শিমূল ছাড়া আর কেই বা লিখবে। ভালোবাসা নিস।

    ReplyDelete

Post a Comment