জাফর পানাহি - ক্যামেরাই যাঁর হাতিয়ার

 


cinema
| |

- ঊষক রহমান



৩০ শে জুলাই, ২০০৯- সারা পৃথিবীর চলচ্চিত্রপ্রেমীরা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মানবাধিকার কর্মী মোজ্তবা সামিনেজাদ-এর করা একটি ব্লগ দেখে মোজ্তবা লিখেছেন, সরকার বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণের সময় গুলিতে নিহত তরুণী আগা-সোলতানের প্রতি শোকজ্ঞাপনের জন্য বিখ্যাত ইরানী চিত্রপরিচালক জাফর পানাহি এবং আরো কয়েকজন আগার সমাধির কাছে জড়ো হয়েছিলেন, সেই সময় পুলিশ জাফরকে গ্রেফতার করে


জাফর পানাহি সমগ্র পৃথিবীর চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষের কাছে একটি পরিচিত নাম। প্রধানত ইরানীয় নিও-রিয়্যালিস্ট ঘরানার এই পরিচালকের নাম তাঁর পূর্বসূরী এবং গুরু আব্বাস কিয়োরাস্তামির (জাফর কিছুদিন কিয়োরাস্তামির সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন।) সঙ্গে একযোগে উচ্চারিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইতালিতে এই নিও-রিয়্যালিস্ট ঘরানার চলচ্চিত্র শুরু হয়। যুদ্ধবিদ্ধস্ত, অর্থনৈতিক সঙ্কটে জর্জরিত সে দেশের পরিচালকরা বুঝতে পারছিলেন যে প্রচলিত বাণিজ্যিক ছবিগুলোতে দেশের প্রকৃত অবস্থা ফুটে উঠছে না। রবার্তো রোসেলিনি, ভিত্তোরিও ডি সিকা, ফেলিনির মতো পরিচালকেরা বিশ্বাস  করতেন সিনেমাই একটা জাতির প্রকৃত চরিত্র তুলে ধরতে পারে। এই ধরণের ছবির মূল বৈশিষ্ট্য ছিল আসল ‘লোকেশন’-এ গিয়ে চিত্রগ্রহণ এবং মূলত অপেশাদার শিল্পীদের অভিনয়। ডি সিকার ‘বাইসাইকেল থিভস্‌’-এ মুখ্য ভূমিকায় কোনো পেশাদার শিল্পী অভিনয় করেননি। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র আন্তনিও, তাঁর স্ত্রী (মারিয়া) এবং ছেলে ব্রুনোর চরিত্রে অভিনেতাদের সকলেরই এটি ছিল প্রথম ছবি। এই ধরণের ছবিতে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের জীবনের কথা বারবার উঠে আসতে থাকে।


১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামীয় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আয়াতল্লা খোমেইনি ক্ষমতায় এলে সে দেশে চলচ্চিত্র শিল্পের ভবিষ্যত নিয়ে সন্দেহ দেখা যায়। ইরানের শাহ্‌-এর শাসনের শেষদিকে খোমেইনির নেতৃত্বে মৌলবাদীদের আন্দোলনের একটি মূল দিক ছিল সিনেমা হলগুলির বিরুদ্ধে আন্দোলন। দেশের ৪৩৬ টি সিনেমা হলের মধ্যে ১৮০টি হল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে সব থেকে ভয়ানক ছিল আবাদনের রেক্স থিয়েটারের অগ্নিকাণ্ড। প্রায় ৪০০ মানুষ এতে নিহত হন। ইরানের বংশপরম্পরায় চলে আসা একনায়ক শাহ্‌ শাসনের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে। কিন্তু ক্রমশ আন্দোলনের নেতৃত্বর রাশ চলে যায় মৌলবাদীদের হাতে। শাহ্‌ শাসন উৎখাতের পর দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জিতে খোমেইনি ক্ষমতায় আসেন। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন নেমে আসে কমিউনিস্টদের উপর। লাগাম পড়ানো হয় ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং মহিলাদের অধিকারের উপর। এইরকম পরিস্থিতিতে ইরানের চলচ্চিত্র শিল্পও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। ইসলামিক রাজত্বে চুম্বন এবং যৌনতা চলচ্চিত্র থেকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ হল।  


কিন্তু এক দশকের মধ্যে ইরানীয় সিনেমা এক নতুন মাত্রা পেল। আব্বাস কিয়োরাস্তামি, মোহসেন মখমল্বাফ, মজিদ মজিদি প্রমুখ পরিচালকের কাজে শুধুমাত্র ইরানী সিনেমা নয়, সমগ্র পৃথিবীর সিনেমা এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছোলোইরানীয় পরিচালকদের সৃষ্টিশীলতা নতুন উৎসমুখ খুঁজে নিতে লাগল, তাঁরা অনাবিষ্কৃত চলচ্চিত্রভাষার সন্ধানে উদ্বুদ্ধ হলেন। ছবির বিষয়বস্তুতে অভিনবত্ব এলো। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা মানুষের সুখ, দুঃখ, আশা, সমস্যা হয়ে উঠল চলচ্চিত্রের বিষয়। নিও রিয়্যালিস্ট ধারাকে ইরান নিজের মত করে আত্মীকরণ করে নিল। জাফর পানাহি এই নতুন ইরানীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী। 


১৯৬০ সালে ইরানের মিয়ানেহ প্রদেশে জাফরের জন্ম। দশ বছর বয়সে তিনি তাঁর প্রথম বইটি লেখেন। ১৯৮০-৯০ এর ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় তিনি কিছুদিন সেনাবাহিনীতে কাজ করেন। এইসময় তিনি যুদ্ধের উপর একটি তথ্যচিত্র বানান। সেনাবাহিনী থেকে বেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশুনা করেন। এরপর কিছুদিন কিয়োরাস্তামির সহকারী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৯৫ সালে কিয়োরাস্তামির একটি চিত্রনাট্য নিয়ে তিনি তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র “The White Balloon” নির্মাণ করেন। 


জাফরের নিজের কথায় তাঁর ছবিতে সমস্ত জিনিসের মানবিক দিকগুলো ফুটে ওঠে। স্টিফেন টিওকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন তাঁর কাজ ‘মানবতা ও তার লড়াই’-এর উপরে। নিও-রিয়্যালিজ্‌ম বলতে তিনি বোঝেন মানবিক ঘটনাগুলোকে কাব্যিক বা শৈল্পিকভাবে দেখা। জাফরের ছবির বিষয়বস্তু তাঁর দেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা থেকে উঠে আসে। একটা দশ বছরের কম বয়সী মেয়ে, যে এক ডলারের কম মূল্যে একটা মাছ কিনতে চায়- সেই হয়ে ওঠে জাফরের ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র। কখনও আবার তাঁর ছবি নারীকেন্দ্রিক। ইসলামী মৌলবাদী দ্বারা শাষিত ইরানে মানবতার অপমান বারবার তাঁর ছবিতে উঠে আসে। কিন্তু মানবতার অপমান ইসলামী মৌলবাদিদের একচেটিয়া নয়। তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক চীনও এই বিষয়ে পিছিয়ে নেই। পঁচিশতম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে জাফরের ছবি The Circle আমন্ত্রিত হয়। কিন্তু তেহরানের চীনা দূতাবাস জাফরকে ভিসা দিতে অস্বীকার করে। শেষ পর্যন্ত উৎসব কমিটির হস্তক্ষেপের পর চীনা বিদেশ দপ্তরের কাছে পরিষ্কার হয় যে জাফর একজন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক এবং তাঁর হংকং যাওয়া নেহাতই সাংস্কৃতিক উদ্দেশ্যে। পুঁজিবাদী আমেরিকাও এই বিষয়ে পিছিয়ে নেই। ২০০১-এর ১৫ জুলাই হংকং-এর উৎসবে অংশগ্রহণের পর বুয়েনস্‌ আয়ার্সে অনুষ্ঠিত International Festival of Independent Cinema তে অংশগ্রহণ করতে যাওয়ার পথে নিউইইয়র্ক সিটির জে এফ কে বিমানবন্দরে ট্র্যানজিট ভিসা না থাকার অভিযোগে জাফরকে গ্রেফতার করা হয়। আঙুলের ছাপ পরীক্ষা করতে অসম্মত হলে তাঁকে হাতকড়া পড়িয়ে, পায়ে চেন বেঁধে একটি বিমানে চাপিয়ে হংকং এ ফেরত পাঠানো হয়। এই ঘটনা আমেরিকার প্রধান সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশ পায়নি। মজার বিষয় The Circle-এর জন্য US National Board of Review of Motion Pictures তাঁকে Freedom of Expression Award দেয়।


জাফর নিজের ছবিকে রাজনৈতিক বলতে চাননা। তিনি মনে করেন রাজনৈতিক ছবির স্থায়িত্ব সীমিত। কিন্তু তা স্বত্বেও তাঁর ছবির রাজনীতিকে অস্বীকার করা যায়না। এই রাজনীতি অবশ্যই কোনো দলীয় রাজনীতি নয়। এই রাজনীতি মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এবং সেখানে চলতে থাকা শ্রেণী, লিঙ্গ, স্বত্বা এবং রাষ্ট্রর মধ্যেকার দ্বন্দ্বের রাজনীতি।  জাফরের Offside ছবিতে আমরা দেখতে পাই ইরান এবং বাহারিনের মধ্যে ফুটবল ম্যাচ দেখতে কিছু মেয়ে পুরুষের ছদ্মবেশে স্টেডিয়ামে ঢুকতে চায়। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র মেয়েদের প্রকাশ্য স্টেডিয়ামে পুরুষদের সঙ্গে বসে খেলা দেখার অনুমতি দেয়না। রাষ্ট্র অর্ধেক নাগরিককে অনুমতি দেয়না দেশের হয়ে গলা ফাটাতে। অচিরেই এই মহিলারা পুরুষ নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে ধরা পড়ে। রাষ্ট্রর প্রতিনিধি হিসেবে সৈন্যবাহিনী তাদের আটক করে রাখে। ক্রমশ সৈনিকদের সঙ্গে এই মেয়েদের কথোপকথোনে উঠে আসে এই সৈনিকদের ব্যক্তিগত কথা। রাষ্ট্রর মুখ এই সৈনিকরা স্বেচ্ছায় সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেয়নি। ব্যক্তি হিসেবে তারা এই মহিলাদের আটকে রাখতেও চায়না। ছবি যত এগোয়, আমরা বুঝতে পারি, রাষ্ট্র কিরকম ভাবে দুজন মানুষকে পরষ্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়। কিভাবে এই সৈনিকরা, মেয়েরা রাষ্ট্রর হাতে ব্যবহৃত হয়। এই অভিজ্ঞান গভীর রাজনৈতিক বোধ ছাড়া আসেনা। 


জাফরের ছবি নিয়ে কথা বলতে গেলে তাঁর বানানো আমার প্রিয় ছবি The Circle-এর কথা বলতে হয়। ছবিটি শুরু হয় একটি জানলা খোলার মধ্য দিয়ে, শেষও হয় একটি জানলা খোলায়। জাফরের সমস্ত ছবিতেই বৃত্তের ধারণা ঘুরে ফিরে আসে। তাঁর নিজের মতে The White Balloon, The Mirror এবং The Circle, এই তিনটি ছবির দর্শনেই বৃত্তের ধারণা আছে। তিনটি ছবিতেই চরিত্ররা সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং নিজেদের সীমানা ছাড়িয়ে সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। এর মধ্যে The Circle-এই বৃত্তের ধারণা সব থেকে বেশী কার্যকর। এই ছবির আইডিয়া অনেকটা ৪০০ মিটার রিলে রেসের মত। একটি চরিত্রের গল্প চলতে চলতে আরেকটি চরিত্রের প্রবেশ ঘটে। ক্যামেরা আগের চরিত্রকে ছেড়ে নতুন চরিত্রকে অনুসরণ করতে শুরু করে। নতুন চরিত্রটি গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এইরকম করে গল্পে ঢুকতে থাকে নতুন নতুন মানুষ তাদের জীবনের নতুন গল্প, নতুন আকাঙ্ক্ষা, নতুন সমস্যা নিয়ে। ৪০০ মিটার রিলে রেসে যেমন কোনো প্রতিযোগী একক ভাবে জেতেনা বা হারেনা। তারা জিতলেও একসঙ্গে জেতে, হারলেও একসঙ্গে হারে, ঠিক তেমনি এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলির (যারা সবাই মহিলা) একক লড়াইকে তাদের সমষ্টিগত লড়াই থেকে আলাদা করা যায়না। এমনি করে চরিত্রগুলির লড়াই সমগ্র ইরানের (এমনকি বিশ্বের) নারীদের লড়াই এর সঙ্গে এক হয়ে যায়। ছবিতে প্রধান  নারী চরিত্ররা কোনো অবস্থাতেই হাল ছেড়ে দেয়না। প্রথম কিশোরি মেয়েটি হাজারো বাধার সম্মুখীন হয়েও নিজের গ্রামে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা ছাড়েনা। শেষ বাস মিস করলে শহরে এসে পরিচিত কাউকে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।
পরের ‘পরি’ নামের মেয়েটি নিজের পিতৃপরিচয়হীন গর্ভস্থ সন্তানকে নষ্ট করে ফেলা অসম্ভব জেনেও হাল ছাড়েনা। এমনকি তার নার্স্‌ বন্ধুর কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরেও না। তৃতীয় মেয়েটি কন্যাসন্তানের দায় থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তার বাচ্চা মেয়েটিকে বারবার রাস্তায় ফেলে আসে। কিন্তু শেষবার মেয়েটিকে রাস্তায় ফেলে আসার পর গাড়ি থেকে নেমে যেদিকে মেয়েকে ফেলে এসেছে, সেদিকে ছুটে যায়। আর শেষ দেহব্যবসায়ী মেয়েটি জীবনের প্রতি তাপ উত্তাপহীন। হাজি নামের লোকটি যখন জিজ্ঞেস করে সে স্বেচ্ছায় ট্যাক্সিতে ঊঠেছে কিনা, তখন ব্যঙ্গের সুরে বলে “Will you pay honey?” জেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুলিশের বাসে তোলার পর সিগারেট ধরালে, অন্য পুরুষরা তাকে সিগারেট নিভিয়ে ফেলতে বলে। কিন্তু নিজেদের সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছে হলে, তারাই সিগারেট জ্বালায়। মেয়েটিও তখন সিগারেট ধরিয়ে আরামের টান দেয়। ভাবখানা এমন, “যেটুকু পেয়েছি, ছাড়ব না।” ছবির শেষ দৃশ্যে এই মেয়েটিকে জেলখানায় নিয়ে আসার পর যে ঘরে ঢোকানো হয়, ক্যামেরা বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে। আমরা অবাক হয়ে দেখি ছবির সবকটি নারীচরিত্র  সেই ঘরে উপস্থিত। প্রথম দৃশ্যের হসপিটালের জানলা খোলার মত এই জেলের ঘরের একটি জানলা খোলে। একটা ফোন বেজে ওঠে এবং একজন রক্ষী এসে সোলমাজ্‌ ঘোলামির খোঁজ করে। দর্শকের মনে পড়ে, প্রথম দৃশ্যে এই একই নামের মহিলার খোঁজ করা হয়েছিল একইরকম একটি জানলার মধ্য দিয়ে। ছবিতে বৃত্তের ধারণা সম্পূর্ণ হয়। ছবির শেষে দর্শক ভাবতে বসে কোনটা হসপিটাল আর কোনটা জেলখানা। আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সমগ্র সমাজটাই মেয়েদের কাছে জেলখানা- জাফর কি এই কথাই বলতে চেয়েছেন?


২০০৯ এ জাফরকে গ্রেফতারের পর মুক্তি দেওয়া হয় কিন্তু পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়। ২০১০ এ বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ইরানীয় চলচ্চিত্র বিষয়ক আলোচনায় যোগদানের আবেদন করে সরকারের কাছে প্রত্যাখ্যাত হন। ২০১০ এর পয়লা মার্চ জাফরকে তাঁর স্ত্রী, মেয়ে এবং আরো পনেরোজন সহ গ্রেফতার করা হয়। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বেশীরভাগকে মুক্তি দিলেও জাফরকে আটকে রাখা হয়। ইরান সরকার তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ স্পষ্ট করেনি। আব্বাস কিয়োরাস্তামি, ব্রায়ান কক্স, Federation of European Film Directors, বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব সহ কয়েকটি সংস্থা তাঁর মুক্তির দাবী জানিয়ে আবেদন করেন। মার্টিন স্করসেসে, রবার্ট ডি নিরো, স্টিভেন স্পিলবার্গ-এর মত ৫০ জন বিশিষ্ট আমেরিকান চলচ্চিত্র শিল্পী জাফরের মুক্তির আবেদন করে লেখা একটি চিঠিতে সই করেন। কিন্তু এসব স্বত্বেও ইরানের আদালত তাঁকে ছয় বছরের জেল এবং কুড়ি বছরের জন্য ছবি প্রযোজনা বা পরিচালনা করা, চিত্রনাট্য লেখা এবং ইরানীয় বা বিদেশী সংবাদমাধ্যমে কোনোরকম সাক্ষাৎকার দেওয়া নিষিদ্ধ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ হিসেবে বলা হয় - দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা এবং ইসলামী সাধারণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার। 


কিন্তু এতকিছু করে জাফর পানাহিকে দমিয়ে রাখা যায়নি। ২০১১ তে তিনি শাস্তির বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেন। আপিলের রায়ের জন্য অপেক্ষা করার সময় তিনি তাঁর দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ক্যামেরায় ধরে রাখতে শুরু করেন এবং তা থেকে বানিয়ে ফেলেন This Is Not A Film একটা পেনড্রাইভ কেকের ভিতর লুকিয়ে, তার মধ্য দিয়ে ছবিটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাঠানো হয়। ২০১১ কান চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটির প্রিমিয়ার হয়। ১৫ অক্টোবর, ২০১১ তে উচ্চ আদালত জাফরের শাস্তির আদেশ বহাল রাখে। কিন্তু এরপরও ২০১৩ তে জাফরের ছবি Closed Curtain বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ার হয়। ২০১৫ তে বার্লিনেই তাঁর Taxi ছবির প্রিমিয়ার হয় এবং জাফর সেরা ছবির জন্য Golden Bear জেতেন। 


আজ যখন আমাদের দেশে এবং সমগ্র উপমহাদেশে ধর্মীয় উগ্রতা মাথা চারা দিয়ে উঠছে, দক্ষিণপন্থী মৌলবাদী শক্তি আমাদের দেশে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে, নরেন্দ্র দাভলকার, গোবিন্দ পানসারে বা অভিজিৎ রায়-এর মত বামপন্থী, যুক্তিবাদী মানুষকে ধর্মীয় মৌলবাদের (কখনও কখনও তার সঙ্গে পুঁজিবাদী আঁতাত) হাতে নিহত হতে হচ্ছে, সারা দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা বিপন্ন হচ্ছে, শ্রমজীবী মানুষের জীবন ও জীবিকার উপর আঘাত নেমে আসছে, কাশ্মীরে রাষ্ট্রের হাতে নিহত হচ্ছে নিরীহ কিশোর - সেই সময় জাফর পানাহির লড়াই আর শুধুমাত্র ইরানের মানুষের লড়াই থাকে না। জাফর পানাহি হয়ে ওঠেন অভিজিৎ, পানসারে, অথবা নাম না জানা কোনো এক আদিবাসী বা কাশ্মীরী কিশোর। এক গুণমুগ্ধ ভারতীয় অনুরাগীর তরফ থেকে জাফর পানাহিকে সংগ্রামী অভিবাদন।
 | |

Comments

Post a Comment