নবারুন ভট্টাচার্য্য অন ঋত্বিক কুমার ঘটক





CINEMA
| |
সত্যিই কি পরশপাথরে তুলসী চক্রবর্তী কিছু করেছিলেন নাকি হ্যামলেটে আমরা স্মোকতুনোভস্কিকে দেখেছি, সেটা কি খুব ভাল ছিল? কীরম কনফিউজড হয়ে যাই। এই যে আমাদের দেশে এইভাবে একটা লুম্পেন কালচার তৈরি হয়ে গেছে যেখানে বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক টেলিভিশনে এই কথাও কবুল করেন 
যে উনি মেঘে ঢাকা তারার রিমেক করবেন, মানে, অসভ্যতা অভব্যতা যে পর্যায়ে গিয়ে পৌছেছে এই সময়ে সত্যিই উনি যে বললেন ঋত্বিক আবিষ্কার...
এই আবিস্কার যত বেশি করে করানো যায় ততোই মঙ্গল আমার একটা কথা আজকে মনে পরে যাচ্ছে,সেই অসামান্য সিকোয়েন্সটি তোলা হচ্ছে কোমল গান্ধারে যেখানে গিয়ে সেই বাফারের ট্রেনের ধাক্কাটা... সেই যে বাংলাদেশ বর্ডার
তো ঐখানে আমি তখন খুব ছোট... আর ঐ যে ট্রলিটা করে ক্যামেরা যাচ্ছে, ট্রলিতে আমি বসে আছি তা লালগোলার কোন ফিল্ম দেবতা এসে হঠাৎ আমাকে বললো, আচ্ছা খোকা শোনো তুমি দেড়শো খোকার কান্ডতে ছিলে না?

ঐ ধরের সিনেমা কোম্পানির সঙ্গে এসেছে সিনেমা করেই বেড়ায়। আমি খুব স্মার্টলি উত্তর দিলাম, হ্যাঁ ছিলাম।

কথাটা কিন্তু খুব একটা মিথ্যে নয় কারণ, আমার বন্ধু লোকনাথ দেড়শো খোকার কান্ডের একটি খোকা, আমরা একসঙ্গে পড়তাম অতএব সেই বন্ধুর গর্বে আমিও গর্বিত। যাই হোক, সেইখানে সেই লোকটি ঋত্বিককে এরম একটা কথা বলেছিল... আচ্ছা এই যে ফিল্মের এখানে কোন ক্যারেক্টার নেই আপনার ক্যামেরা এগোচ্ছে... তা...

ঋত্বিক বলেছিল, কি বল্লে...  ফিল্মে... তখন বলছিলো... হোয়াট ড্যু ইউ মিন বাই ফিল্ম

এইটা একটা মারাত্মক প্রশ্ন কিন্তু। ন্যাচারাললি সে কোন উত্তর দিতে পারেনি। পালাতে পারছে না।
কিন্তু হোয়াট ড্যু ইউ মিন বাই ফিল্ম?
ফিল্ম বলতে আমরা কি বুঝি?
ফিল্ম কি?
ফিল্ম একটা স্টেটমেন্ট হতে পারে। ফিল্ম একটা দার্শনিক তাৎপর্য বহন করতে পারে। ফিল্ম একটা ট্রিটিজ হতে পারে। ফিল্ম একটা দাস ক্যাপিটাল হতে পারে। ফিল্ম অনেক কিছু হতে পারে। যেটা মুষ্টিমেয় চলচ্চিত্র পরিচালকই এই যায়গাটায় উত্তীর্ণ হোন। সবাই হোন না, এবং সেই যায়গায় ঋত্বিক একজন।
যেমন তারকোভস্কি একজন, বার্গম্যান একজন, শকুরাও একজন। যাঁরা এই দর্শনের যায়গায় গিয়ে, ইতিহাসের যায়গায় গিয়ে, অদ্ভুত একটা অবস্থান গ্রহণ করে। যেখানে সমস্ত শিল্প মাধ্যম গুলে যায়... গুলিয়ে যায় ..



তা আমি ইদানিং একটা তত্ত্বে এসেছি। যেই লোকটা ঋত্বিক ঘটক বা তার পাশাপাশি আমরা যাদের দেখতাম, সেই বিজন ভট্টাচার্য, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, চিত্ত প্রসাদ, দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য এরা কারা...
আজকে কোনো লোক এদের চেনে না, দু'দিন পর ঋত্বিককেও চিনবে না, সেটা ঠিক। কারন আমাকে যে নেমনতন্নটা করা হয়েছিল, সেখানে বলা হয়েছে যে, বাঙালির আধুনিকতা ক্লোন ঋত্বিককুমার ঘটক। এখন এই বাঙালি যে রেটে আধুনিক হয়ে উঠেছে। হ্যাঁ তাতে আর তার ঋত্বিক ঘটক তার কাছে একটা উদ্বৃত্ত মানুষ, বাকিরা উদ্বৃত্ত মানুষ। তা আমি উদ্বৃত্ত মানুষটাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমি সোভিয়েত দেশে চাকরী করতাম। আমার ঘরের পাশের ঘরে বসতেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। হেমাঙ্গ বিশ্বাস ছিলেন পিকিংপন্থী, মানে, মস্কোর হেড কোয়ার্টারের পিকিংপন্থী মানুষ। অতএব কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলতো না। তা আমি তো জন্ম থেকেই ওকে দেখে আসছি... তা আমি গিয়ে গল্প করতাম
কথা বলতাম আর ঋত্বিক প্রায়ই আসতেন পয়সায় জন্য একটু মদ খাওয়ার পয়সা দরকার। এলেই সিদ্ধেশ্বর সেন কাছ থেকে কিছু, আমার কাছ থেকে কিছু, হেমাঙ্গ'দার কাছ থেকে কিছু নিয়ে বেড়িয়ে  যেতেন। খুব কম সময়ের জন্য আসতো। তা এই মানুষটাকে কাছ থেকে দেখতে দেখতে একদিন হল কি...  একসময় ঋত্বিক এই যুক্তি তক্কো গপ্পোর ফেইজটাতে... তার আগে  ঋত্বিক ফুটপাতে থাকতো, রাস্তায় থাকতো, আমার বাড়ির উল্টাদিকে একটা বাড়ি ছিল তার রক ছিল... তার উপরে থাকত...

শুধু ঋত্বিক নয়, ঋত্বিকের মতো আরও কিছু লোক। যাদের পরিপূর্ণ উদ্বৃত্ত বলা যায়। দে ওয়্যার লুম্পেনস। ঋত্বিক সেই লুম্পেনদের একজন।

থাকতো এবং সে ঘুরে বেরাচ্ছে... আমার মনে আছে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আমি সিগ্রেট কিনতে গিয়েছি
ঋত্বিক আমার কাছে পয়সা চেয়েছে। আমি এক পেকেট চারমিনার কেনার পরে আমার কাছে কত আঠারো না আঠাশ এরম কিছুএকটা পয়সা আছে। আমি বললাম, এইটা নেবে? ও বললো দে। তা আমি দিলাম পয়সাটা। দিয়ে বললাম, এই পয়সায় কি হবে? ও বললো...  চলে গেল... এই চোলাই টোলাই খাবে...

তা... ঋত্বিককের মৃত্যুর পর একটা স্মরণ সভায় আমার বাবা একটা কথা বলেছিল। ঋত্বিককে খুন করা হয়েছে।এই যে ঋত্বিককে খুন করা হয়েছে, এই কথাটা যেন আমরা না ভুলি। কারণ এই খুন নানাভাবে করা যায়। জাফর পানাহিকে যখন বলা হয় যে, কুড়ি বছর তুমি ছবি করতে পারবেনা স্ক্রিপ্টও লিখতে পারবেনা, এটা তাকে খুন করা। বিনায়ক সেনকে যখন বলা হয়, তুমি ডাক্তারি করতে পারবে না কিছুই করতে পারবেনা, সেটাও তাকে খুন করা। এবং
ঋত্বিক ছবি করার কি সুযোগ পেয়েছিল তাঁর সময়ে একটা স্ট্রাগলিং ফাইটিং আর্টিস্ট বলতে যা বোঝায়
ঋত্বিক পরিপূর্ণ তাই ছিল।

আমি আপনাদের বলছি, সুবর্ণরেখার আউটডোর চাকুলিয়ায় হয়েছিল। সেখানে রোজ রাত্রির সাড়ে নয়টায় একটা কোলকাতা থেকে ট্রেন গিয়ে পৌছতো। এবং সাড়ে ন'টার আগে থেকে আমি ঋত্বিককের মধ্যে একটা অদ্ভুত টেনশন লক্ষ্য করতাম। সেই টেনশনটা হচ্ছে। ঐ ট্রেনটা এসে পৌছুবে কিনা। ট্রেনটা এলে তার থেকে কোন চেনা লোক নামবে কিনা এবং সে ফিল্মের র'স্টক আনবে কিনা। সেইটা না আসলে শুটিং করা যাবে না... তাঁর মাথায়... এবং দিনের পর দিন শুটিং এইভাবে বন্ধ হয়ে গেছে... র'স্টক আসেনি।

এইভাবে একটা মানুষকে কাজ করতে হয়েছে এবং সেখানেও তাঁর ছবিতে যেমন ঋত্বিক ছবির যখন শুট করতেন... মাথায় তো একটা এ্যালকেমি একটা ক্যালকুলেশন সবই থাকতো। কিন্তু আরেকটা জিনিস করতেন। অনেক এক্সেস শুট করতেন। ওগুলো সব এডিটিং টেবিলে ঠিক হবে। তা... সুবর্ণরেখার সেই দূর্মূল্য বহু বহু ফুটেজ সেগুলো টালিগঞ্জে গুলিয়ে ফেলে... তার থেকে রুপো বার করা হতো... সেই কাজে ব্যাবহার হয়...

আমাদের দেশে সত্যিই কোন আর্কাইভ... সত্যি কিছু থাকলে এগুলো অমূল্য সম্পদ... আইজেনস্টাইনের এই ধরনের বহু কাজ তাঁরা নষ্ট করেনি, সেগুলো নিয়ে পরে এডিট করে অনেক কিছু বেরিয়েছে। কিন্তু ঋত্বিককের ভাগ্য সেটা জোটেনি। এই যে বললাম ঋত্বিককে যে খুন করা হয়েছে...

আমার ঋত্বিকের কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ছে... ঋত্বিক যাদের বাজনা শুনতে খুব পচ্ছন্দ করতো তার মধ্যে একজন মোৎসার্ট । তা... মোৎসার্টের একটা জীবনী পড়েছিলাম, সেখানে আছে যে, মোৎসার্ট  কোথাও একটা অর্কেষ্ট্রা দিয়ে টিম দিয়ে একটা সঙ্গীত পরিবেশন করছেন, একটা সিম্ফোনি কম্পোজিশন, সামনে লোকের প্রচন্ড ওভেশন সেই সময় তারা চিৎকার করছে... লং লিভ মোজার্ট, আর মোৎসার্ট কানে শুনছেন লং স্টার্ভ মোৎসার্ট। তুমি না খেতে পেয়ে মরো...

এইটা আমাদের দেশে হয়েছে। একাধিক শিল্পীর ক্ষেত্রে হয়েছে। আমি যাদের কথা বললাম, এদের প্রত্যেকের হয়েছে। যেমন ধরুন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, তিনি কি মাপের একজন শিল্পী! এটা কেউ ভাবতে পারেনা, তাঁর কাছে যখন কোন অর্কেষ্ট্রা নেই, কোন বাদ্যবিন্দ্র নেই কিচ্ছু নেই, তিনি ফুটপাতের বস্তির বাচ্চাদের দিয়ে একটা অর্কেষ্ট্রা বানালেন। সেখানে ইন্সট্রুমেন্ট কি? একটা পাউডারের কৌটর মধ্যে ইট ভরে সেইটা দিয়ে একটা ইফেক্ট। অসামান্য ইফেক্ট এবং সেটার নাম দিলেন কি জগঝম্প। তা এই জগঝম্পের সঙ্গে ঋত্বিকের যে সম্পর্ক, এই লোকটার সঙ্গে বিজন ভট্টাচার্যের যে সম্পর্ক... যেমন ধরুন একটা ঘটনা বলি... সুবর্ণরেখার ফাইনাল স্ক্রিপ্ট লেখা হচ্ছে, পরদিন শুটিং হবে...
তা উনি হরপ্রসাদ, মানে যে চরিত্র আমার বাবা করেছিলেন, উনি সেই ডায়ালগগুলিকে আবার লিখেছেন কি করছেন। তখন ওকে একজন জিজ্ঞেস করছে যে, এই ডায়ালগগুলি তো কালকে লেখা হয়ে গেছে আবার কেনো করছেন? বলেন, থামো, এশিয়ার গ্রেটেস্ট আর্টিস্ট তাঁকে আমায় প্রজেক্ট করতে হবেনা? এই বোধটা... এইগুলি কিন্তু সবই সুপার ফিউরিয়াস মানুষদের নিয়ে কথা। উদ্বৃত্ত মানুষদের নিয়ে কথা। তাঁরা কি ছিল, আর বাঙালির জানার কোন উপায় নেই। এবং যে সিকোয়েন্সগুলোর কথা ও বর্ণনা করেছে সঞ্জয়,সেগুলোর সঙ্গে এগুলো বলেছে কিনা আমি জানি না...

আমি একটা ছোট্ট কথা বলছি, আপনারা সুবর্ণারেখা যখন দেখছেন, দেখবেন যে সীতা যখন বড় হয়, সীতা এয়ারপোর্টে বসে গান করছে এবং ক্যামেরা খুব স্লোলি প্যান করে... সেইসময় দেখা যায়, একটা পাথর থেকে আরেকটা পাথরের ফাঁকে ছোট অভিরাম চলে যায় চাদর মুরি দেওয়া... আরেকটা জিনিস, আজকেই আমি স্বীকার করছি, আপনাদের মধ্যে যারা আমার হারবার্ট উপন্যাসটা পড়েছেন, হ্যাঁ , তা সেই হারবার্টকে ঐ নকশালি বুদ্ধি টুদ্ধি শিখিয়েছিল বিনু বলে একজন এবং সুবর্ণরেখার বিনু,ছোট বিনু, যে আমার ভাই, যে মারা যায় লেকের জলে ডুবে। সে... সুবর্ণরেখার শেষ হচ্ছে সে মামার সঙ্গে যাচ্ছে । সে বলছে, আমরা নতুন বাড়িতে যাবো, সেখানে প্রজাপতি আছে, গান হয়, সেখানে গেলে মাকে পাবো, বাবা আছে। এই নতুন বাড়িতে যাচ্ছিল বিনু, এখানেই ছবিটা শেষ হয়
এবং এর পরবর্তী যে বিনু, আমি যাকে কনশাসলি হারবার্টে নিয়ে এসেছিলাম... সেই বিনু তখন বড় হয়েছে... এবার সে নতুন বাড়িটা নিজে বানাবার চেষ্টা করছে এবং আজকেও এই চেষ্টাটা ফুরিয়ে যায়নি।

আজকে আমার যে মাওয়াবাদী বন্ধুরা জঙ্গলে বা জেলে রয়েছেন তাঁরা ঐ নতুন বাড়িটার জন্যেই ভাবছেন আর কিছু না। এবং প্রত্যেক যুগে সমস্ত সময়ে বিনুদের এটা অধিকার। বিনুরা এটা করবে, সেটা ঠিক হোক কি ভুল হোক। এবং
সেইটাই ক্যামেরায় এবং কলমে ধরবার লোকও থাকব।

যেমন... সত্যি সত্যি... ঐ যে মুভমেন্টটা, ঐ যে মেরিটাইলারদের দলের সঙ্গে অমূল্য বাবুদের দলের সঙ্গে... ঐ যে কনফ্রন্টেশন ঋত্বিকের.. এটা একটা ঐতিহাসিক ডকুমেন্ট, অসামান্য ডকুমেন্ট। পার্টলি আপনারা এই রকম ডকুমেন্ট
নাটকে পাবেন। বিজন ভট্টাচার্যের চলো সাগরে নাটকে একটা ডায়ালগ আছে, যে ডায়ালগটা একচুয়ালি নকশালবাড়িতে হয়েছিল হরে কৃষ্ণ কোঙারের সঙ্গে। ওখানকার নেতৃবৃন্দের, জঙ্গল সাঁওতাল, চারু বাবু এদের আলোচনা...

হ্যাঁ। এই ডকুমেন্টশন। এই ডকুমান্টশনের যে কাজটা ঋত্বিক করে গেছেন এটার মূল্য অপরিসীম। যেটা বলছিলো আজকেও টপিক্যাল। ঐ যে বলছেন, তোমরা সফল ও নিস্ফল এবং সেখানে তিনি মোটামুটি একটা মানে প্র্যাকটিসিং সোশালিজমের একটা ইতিহাস বলছেন... যেখানে ইফ আই আর নট রং, পরমারি নামটাও আছে বোধহয়। সোভিয়েত থিওরীটেশিয়ান। ঋত্বিক কিন্তু সবটা জানতেন। তিনি সুসলভ থিসিস পড়েছিলেন। তিনি চেগুয়েভারার অন গেরিলা ওয়্যারফেয়ার জানতেন। এগুলো জেনে এই জিনিসটাকে করা এবং কতটা তার ডিটেইলের সেন্স! অনন্যর একটা সিকোয়েন্স আছে। অনন্য একটা ঐ কি বলে ... ব্রেনগান ফ্রেনগান কিছু একটা নিয়ে উল্টে উল্টে যায়... একচুয়ালি, দ্যাট ইজ দ্য ওয়ে দ্যাট গান ইজ টু বি ট্যাকলড..

এবং অনন্যর সঙ্গে একটা ছেলে ছিল যে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে ঐ বন্দুকটা নিয়েই লড়াই করেছিল। হি ক্যাম ওভার উইথ হিজ গান। এবং সে জয়েন করেছিল... এবং... দে ওয়্যার প্রোপারলি ট্রেইন্ড। এর সবটা আবেগের বিষয় নয়। এর মধ্যে একটা গভীর... মানে একটা.. সায়ান্টিফিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে।

এবং... এই যে আমরা ব্লাক এন্ড হোয়াইট ফটোগ্রাফার ফটোগ্রাফির এই যে সিদ্ধি দেখছি, এই যে আশ্চর্য জায়গা এরও কিন্তু একটা গুরু শিষ্য পরম্পরা আছে। ঋত্বিকের এই কাজের অনেকটাই শেখা বিমল রায়ের কাছে যার মতো একটা টেকনিশিয়ান তখনকার যুগে কেন, এখনো নেই। বিমল রায় কি মানের টেকনিশিয়ান,তার একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই-

বিমল রায় শুটিং করছেন, মীনা কুমারীকে নিয়ে। এমন সময় পাশের স্টুডিও থেকে কে আসিফ একটা নোট পাঠায়, বিমল দা একবার আসবে। উনি গেলেন, আর সেটে বলে গেলেন, থাকো আমি আসছি. ওখানে গিয়ে দেখেন, সব্বনাশে ব্যাপার। মুঘলে আযমের শুটিং হচ্ছে, ঐ যে সিকোয়েন্সটা, আয়নার মধ্যে মধুবালা... হ্যাঁ... ঐটা ঐটা শুট করবার সময়... ক্যামেরাটা চলে আসছে আয়নার মধ্যে। তো... কে আসিফ বলছে... এখন আমি কি করে ঐটা করবো? তা উনি... উনিও নানা জায়গায় ক্যামেরা বসাচ্ছেন... রাধু কর্মকারকে নিয়ে... হচ্ছে না.. তখন উনি
নিজের ফ্লোরে একটা নোট পাঠালেন। শুটিং প্যাকআপ করে দাও, মীনাকে বাড়ি চলে যেতে বলো। হি স্টেট ওভার দ্য আর ফর সিক্স অর এইট আওয়ারস এন্ড সলভ দ্য প্রবলেম। সেই ফিনিশড প্রোডাক্ট আমরা দেখি এখন। সেই লোকের সঙ্গে কাজ করেছেন... এদের ট্রেনিং... এদের অউকাত... এদের ঘরানা... সবগুলোই অন্যরকম। 

কারন, ঋত্বিক সমন্ধে একটা ইমেজ বাজারে দেওয়া হয়।  পলিটিক্যালই কারেক্ট বাঙালিরা করে। ঐ যে, হ্যাঁ, আরেকটা কথা বলি, ঋত্বিক সেই লোক যে ইংরেজি জানা ক্রিটিকদের কাল্টিভেট করতো না। বেশি তালেবড় লোক তার কাছে গেলে লাথ মেরে বার করে দিতেন। সোজা কথা, হ্যাঁ, এবং আমি বাকি ডিরেক্টরদের জানি, তারা এই হাফ সাহেবদের কালটিভেট করেছিলেন। কারন তারা তখনই বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাহেবদের বাজারে কল্কে না পেলে কিছু হবে না।
হ্যাঁ, ঋত্বিকের মাথায় এসব ছিলো না। একটা এ্যাওয়ার্ডও পায়নি, একটাও না। কোথায় বিএফজে একটা ফালতু... মানে কিচ্ছু পায়নি... কোন ফেস্টিভ্যালে না... কিচ্ছু না... এবং আজকে সমস্ত ফেস্টিভ্যালের বাইরে চলে গেছে,
অন্য জায়গায় চলে গেছে...

তা এই যে.. কি বলছিলাম... হ্যাঁ এই যে মানে কালটিভেট করেনি... কালটিভেট করেনি... এবং এই যে ফাইটিং স্পিরিট... ঠিক আছে... ছবি করতে পারছি না... থিয়েটারের উপর ম্যাগাজিন করছে সেটাও উইথ ইকুয়াল অনেস্টি
আমি নিজের চোখে দেখেছি। করছে, অভিনয় দর্পণ। হ্যাঁ, থিয়েটার করবো সেই সেই হলো। প্রফেশনাল থিয়েটার করবো। শালা সিনেমা করতে দিবি না দিবি না, যাহ! উনি উনি প্রফেশনাল থিয়েটার করবেন। এবং সেই প্রজেক্টও এগিয়েছিল। তার সঙ্গে আরো ছিল তিনটা ছবি করা। কিন্তু প্রত্যেকটা জিনিসকে নাকচ করে দেওয়া, প্রত্যেকটা বানচাল হয়ে যায়। ঐ মিসেস গান্ধী একটু স্পেশালি ফেভার করতেন বলে... ঐ পুণার কাজ টাজ.. তারপর বাংলাদেশ থেকে... ঐ ইমার্জেন্সি ফ্লাইটে নিয়ে আসা এগুলো হয়েছিল... আদারওয়াইজ, কোন জায়গা থেকে কোন সহায়তা লোকটা পায়নি...

এই আমাদের সো কোল্ড ইন্ডাস্ট্রি। সো কোল্ড বিগ নেইমস, কেউ তার পাশে এসে দাঁড়ায়নি। এবং, তিনি যেমন
তার সময়েও কেউ বুঝতো না। ছবি তো ফ্লপ। ছবি যখন রিলিজ করতো, ফ্লপ, কেউ নেই হলে...

তা এই যে অবস্থাটা... বাঙালি তখন শুধু বোঝেনি তা নয়... তার সঙ্গে যারা কাজ করেছে। ঋত্বিক ওয়াজ দ্য ওনলি ম্যান। যার হাতে দিয়ে কোন ডিরেক্টর তৈরি হয়নি। যারা এসিস্ট্যান্ট ছিলো, তারা কোন কাজ করতে পারেনি। এইটা একটা পিকুলিয়ার ঘটনা কিন্তু, লোকে গিয়ে শেখে। অত বড় একটা লোকের কাছ থেকেও শিখতে পারেনি, কারন, তাঁরা তার অওরাতে এতো বেশি আচ্ছন্ন হয়তো ঐ মদ খাওয়াটা শিখে নিলো। কিন্তু কাজের কাজটা শিখলো না। যার ফলে কিছুই হয়নি। মানে, এটলিস্ট মিডিয়াক্রিটিকও তৈরি হয়নি। আর, আমি ঋত্বিকের কাজের কতগুলো ধারার সাথে পরিচিত। একটা হচ্ছে,স্পট ইম্প্রোভাইজেশন। ঐ যে অসামান্য কাঁদিয়ে বহুরূপী এয়ারপোর্টে... যার সামনে সীতা গিয়ে পরে... এই বহুরূপীর কোন সিকোয়েন্স স্ক্রিপ্টে ছিল না।

আমরা গিয়েছিলাম। ওখানে একটা বাজারে, একটা হাটে। সেইখানে... মানে... এই বহুরূপী ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তখন,
ওকে দেখে ইম্প্রোভাইজ করে। ওকে তুলে নিয়ে যায় এয়ারপোর্টে। নিয়ে গিয়ে ঐ জায়গাটায় শুট করা হয়। এবং আমি তখন প্রথম অবাক হয়ে গেছলাম। ছবিটা এতো ছোটবেলায় দেখা। ওরে বাবা! ওত বড় এয়ারপোর্টে আমি ঘুরে বেড়ালাম! কই প্লেনটা তো দেখিনি। একটা প্লেনের রেকেজ আছে। এইটা বোধহয়...ডানকুনি বা কোথায় ছিল... সিনেমায় তো এটাই মজা। কিসের সাথে কি জুড়ে দেয়! কিভাবে দেয়! বোঝা যায় না...

তবে, ঐ যে জায়গা। চাকুলিয়ার এয়ারপোর্ট, ওখানে ব্রিটিশ এয়ারফোর্স রয়েল এয়ারফোর্সেরে আরকি... ঐ চাদঁমারি ছিল প্র্যাকটিস করার। যেখানে ওরা মেশিনগান বা ঐযে মানে পোর্টেবল যেসব মেশিনগান টেশিনগান থাকে... ঐগুলো নিয়ে প্র্যাকটিস করতো। তা আমি ওখান থেকে মেশিনগানের অনেকগুলো বুলেট খুলে এনেছিলাম। কিন্তু বুলেট গুলো মরচে পরে পরেখুলে খুলে নষ্ট হয়ে গেছে। এটা সুবর্ণরেখার আউটডোরের সময়েও সব দেখা যেত রয়েল এয়ারফোর্সের ইন্সিগ্নিয়া ওপরে লাগানো ছিল।অনেক কিছু...কিন্তু সবই নষ্ট হয়ে গেছে... এখন আর কিচ্ছু নেই।
এয়ারপোর্টটাই আছে। এবং এটাও ঠিক যে বাংলায় ঋত্বিকের কোন ঘরানা তৈরি হলো না কেন... হুঁ... অন্য জায়গায় কিন্তু অন্ধ ভক্ত ফিল্মমেকার জুটলো। যাদের কথা বলেছি, বিশেষত জন আব্রাহাম। হ্যাঁ এ ও তো জুটলো কিন্তু বাংলায় কিছু হলো না। কারন, এই বাঙালি আধুনিক। এই এতো আধুনিক বাঙালি, এই সুপার ফ্লুয়াস উদ্বৃত্ত মানুষটাকে আর রাখার দরকার মনে করেনি। কেননা, এই লোকটা খুব ঝামেলা। হ্যাঁ এবং এই আপনারা লক্ষ্য করবেন এটা এই ঝামেলাবাজ লোকগুলোর হাতে আর বাঙালি কুক্ষিগত হয়ে থাকতে চাইছে না। এখন তার ফ্লাইট এতো বেশি, এখন তার বহুমুখী ইয়ে এতো বেশি ...তার সাহিত্যই বলুন... তার চলচ্চিত্রই বলুন... ঐ যে বলছিল
হরমোনাল ডিজঅর্ডার না কি... হ্যাঁ... তো যাই হোক... এই ধরনের, মানে, প্রব্লেম বলবো না এগুলোর কোন সোশ্যাল রিলেভেন্স এটাচ আছি কিনা। মানে এক পার্সেন্ট লোকের মধ্যে... কে হোমোসেক্সুয়াল... কে নয় তার রাইট নিয়ে উচ্চবাচ্য হচ্ছে। আর এদিকে, ওয়ার্কারদের রাইট নিয়ে কোন কথা হবে না, কেউ কোন ফিল্ম করবে না। এটা মানে...
লাখের ওপর কারখানা বন্ধ। তাই নিয়ে কোন ফিল্ম হবে না! চা বাগানে হাজার হাজার মানুষ কাজ করে মরে গেলো
কিচ্ছু হবে না! হোমোসেক্সুয়ালে সমস্যা! এই সমস্যা, সেই সমস্যা... এইসব ননসেন্স! ইডিয়োটিক...

আসলে কথা কি... একটা সোসাইটি যখন ডি-পলিটিসাইজড হয়ে যায়, তখন এইসব হয়। মানে, আজকে হচ্ছে
মরা নিয়ে মিছিল। হুম এবং হ্যান ত্যান... এই ধরনের নন ইস্যুজ... ফলস থিয়েট্রিক্যালস... ফলস কি বলবো, 
স্পেক্টাকলস... এইভাবে তখন রাজনীতিটা এগোয় এবং শিল্পীরও এই গড্ডলিকায় ভিড়ে পরে পয়সা খেয়ে এবং না খেয়ে।

তা এই যে কারবার... এই কারবারের মধ্যে ঋত্বিকের কথা এ্যাট অল আলোচনা করা সম্ভব কি... আমি ঋত্বিকের রাজনীতি নিয়ে দু একটা কথা বলছি। মেঘে ঢাকা তারার দুই ছেলে, অনিল কন্ঠশিল্পী হবে, হয়ও, প্রতিষ্ঠিত হয়।
আরেক ছেলে দ্বিজু। দ্বিজু ভাওয়াল যে রোলটা করেছিল, সে ফুটবলার হবে, হতে পারে না। মন্টু কারখানায় চাকরি নেয় এবং সেখানে তার অঙ্গহানি ঘটে। ঐ যে আমার বাবার একটা ডায়ালগ আছে... ঐ যে... যন্ত্র গ্রাস করতে পারে নাই। এইটা হ্যাঁ... ষাটের দশকে, পঞ্চাশের দশকের পর থেকে আমাদের দেশে এইটা একটা নতুন ঘটনা এলো। এবার চিন্তা করুন সুবর্নরেখায় অভিরাম, যে লেখক হবে, তাকে হতে হলো বাস ড্রাইভার।

হুম...  একটা বিরাট মধ্যবিত্তের জীবনে একটা  পরিবর্তন এসে গিয়েছিল। অসংখ্য বাঙালি ছেলে ওয়ার্কার হয়ে দুর্গাপুর চলে গিয়েছিল। সেই পুরো পিকচারটা, সমস্ত কিছু ঋত্বিকের ছবিতে রয়েছে। ঋত্বিকের মার্কস এঙ্গেলস প্রীতি,
যেটা সে বলছে, এটা কিন্তু ফেলনা নয়। মানে প্র্যাকটিক্যাল যেটা। আমি আরেকদিন বলেছিলাম, যে একমাত্র ডিরেক্টর
যার প্রত্যেকটা ফ্রেম পলিটিক্যাল, প্রত্যেকটা ফ্রেম বারুদে ভর্তি। সে যখন একটা অপমানিত মানুষকে দেখায়, সে এই বার্তাই আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়, যে মানুষের অপমানকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে এবং এই সাঙ্ঘাতিক দায়িত্ববোধ থেকে কাজগুলো করা তার দায়িত্ববোধের চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে যুক্তি তক্কো গপ্পো। আমার মজাটা হচ্ছে, ছবিটা যখন তৈরি হয়, আমি তখন ছবিটা কিচ্ছু বুঝতে পারিনি। বরং আমি ঋত্বিকের সঙ্গে একটা ফ্যানাটিক ঝগড়া করেছি, আমি বলেছি, এনাফ ইজ এনাফ, তুমি এই ক্যামেরার ফ্রেমে মদ ঢেলে দেবে আর যা ইচ্ছে তাই করবে?

হ্যাঁ মানে... ইন ডিফেন্স অফ ইওর অ্যালকোহলিজম... এটা আমি মানবো না। প্রচন্ড ঝগড়া হয়েছিল এবং তখনকার মতো ঋত্বিক কিন্তু কনন্সিডারড ডিফিট। বলে যে, আমি আর পারছি না। শেষ কথাটা মনে আছে, সেটা কোট করছে কিং লিয়ার থেকে, বলছে, দ্যান মামস দ্য ওয়ার্ড। হ্যাঁ, দ্যান মামস দ্য ওয়ার্ড।

আমি বললাম, হ্যাঁ চুপ করেই থাকো। আর কিচ্ছু বলবে না। যা করেছ... এবং তারপর আমি যতবার ছবিটা দেখেছি আমি শুধু তার আধুনিকতার দিকটা আমাকে পাগল করে দিয়েছে। কোথায় নিয়ে গেছে একটা ছবিকে। একেকটা ইমেজ কোথায় চলে গেছে। এবং তৎকালীন বাংলায় যা কিছু ঘটেছে পলিটিক্যাল তৎকালীন বিশ্বে যা কিছু ঘটেছে পলিটিক্যাল সমস্ত কিছু ঐ ছবিটার মধ্যে সারৎসার হয়ে ঢুকে গেছে। এবং ঋত্বিকের ফ্রেমের এই এপিক কোয়ালিটি
এটা আমাকে একটা অসম্ভব মোটিভেট করে...

যে কোলকাতা শহরে রোজ রোজ অনেক মেয়ে নতুন করে বেশ্যা হয় তাদের কাছে তাদের দাদারা গিয়ে পৌঁছয় প্রমত্ত অবস্থাতেই গিয়ে পৌঁছয় কিন্তু এটা ক্যামেরার ফ্রেমে অরকম একটা বোল্ড সিকোয়েন্সে দেখানো এটা ঋত্বিক ছাড়া আর কারো পক্ষে করা সম্ভব ছিলো না। কারন, ঋত্বিক, গ্রেট আর্টিস্টরা খুব নিষ্ঠুর হয়। হ্যাঁ, ঋত্বিকও নিষ্ঠুর। মারাত্মক নিষ্ঠুর। এবং তার নিষ্ঠুরতার দিয় ঐ চাবুক মেরে মেরে মেরে মেরে... সে সম্বিৎ ফেরাবার চেষ্টা করেছে মানুষের কতটা ফিরেছে আমরা জানি না। কিন্তু আজকে আমার নিজের খুব ভালো লাগছে যে, এই ধরনের একটা আলোচনা সম্ভব হয়েছে। এতটা ভালোবাসা, এতটা রেস্পেক্ট, এতটা রেভারেন্স নিয়ে ঋত্বিকের ব্যাপারটা ডিস্কাসড হচ্ছে এবংসত্যিই ঋত্বিকের জীবনদর্শন, ঋত্বিকের রাজনৈতিক আদর্শ, প্লাস তার মানে বহু বিশ্রুত ইয়ং প্রীতি... হ্যাঁ... এইসবগুলি নিয়ে আরো বিশদ গবেষণা আলোচনা। ঋত্বিকের দুটো বই ইনফ্যাক্ট আমার কাছে আছে। একটা হচ্ছে এ যুগের, মর্ডান ম্যান ইন সার্চ অভ স্যোওল। সেটা কেউ গবেষণা করলে আমি দিতে পারি। কারন তার পাশে ঋত্বিকের কমেন্টস আছে এবং আমার পরিচিত এক বন্ধুুর কাছে আছে। দ্য গ্রেট মাদার, এরিখ নিউম্যান। এবং বই গুলো, সত্যি কথা বলতে কি, ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলে এই অন্তর্জগতের রহস্য এবং বহির্জগতের যা সমস্যা এদের মধ্যে কিন্তু কোনো ভয়ঙ্কর বিরোধ কিছু নেই। একটা ইন্ডিভিজুয়ালকে বুঝতে গেলে তার প্রব্লেমসকে বুঝতে গেলে, সে কিভাবে তার রিয়েলিটির সঙ্গে লড়াই করছে, সেটা বুঝতে গেলে তার এক্সিজটেনশিয়াল ফ্রেমটাকে বুঝতে গেলে, আমাদের ইয়ুংকে দরকার, ফ্রয়েডকে দরকার, অ্যাডলারকে দরকার, প্রত্যেককে দরকার। ইভেন আব্রাহাম ম্যাসলোকেও দরকার।

ম্যাসলো যে সাতটা ক্যাটাগরি বলছেন, অর্থাৎ সাতটা ক্রাইসিস আছে মানুষের। একটা শেল্টারের ক্রাইসিস, একটা সান্নিধ্যের ক্রাইসিস, একটা খাবারের ক্রাইসিস... এগুলো মিটতে মিটতে একটা মানুষ...প্রতিটি স্তরে তার একটা লড়াই চলে। কাজেই এই যে ট্রেন্ডটা ঋত্বিক আনলেন , এটারও একটা অপরিসীম মূল্য। কারন, এই মেকানিজম মার্ক্সিজম দিয়ে বোঝা যাবে না। কারন, ইটালিতে মার্ক্সবাদের প্রতিষ্ঠাতা যিনি, ল্যাব্রিওয়ালা, তিনি একটা কথা বলেছিলেন যে, দান্তের সময়ে গম কত দামে বিক্রি হতো আর সিল্কের কাপড়ের কি দাম ছিলো, এইগুলো জানলেই সেই সোসাইটিকে এক্সপ্লেইন করা যাবে না। দান্তেকে তো নয়ই। হ্যাঁ, এই ভুল মার্ক্সবাদ। আমাদের দেশের অনেক বারোটা বাজিয়েছে, যার ফলে একটা সময়এই তথাকথিত মার্ক্সিস্ট ক্যাম্পে আমরা দেখেছি যেটাকে আজকে ভুল রাজনীতির জন্য এক্সপ্লোয়েট করা হচ্ছে। যে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে শিল্পীদের বিরোধের প্রেসনোট... তা সেখানে মজাটা ছিলো
শিল্পীরা অনেক অ্যাএডভান্স লুকিং ছিলেন... এগিয়ে ভেবেছিলেন...  আর কমিউনিস্ট পার্টি ছিলো ব্যাকওয়ার্ড। কমিউনিস্ট পার্টি ছিলো অজিফায়েড চিন্তাধারার বাহক। কাজেই তারা সেই শিল্পীকে বুঝতে পারেনি। এই একই একুয়েশন। এই অভিযোগ ঋত্বিকের বিরুদ্ধেও এসেছে। উনি এই গ্রেট মাদার কিসব করেন। আমার বাবার সমন্ধে এসেছে, উনিও তো মাদারকাল্টে বিশ্বাসী।

আরে মাদারকাল্ট আবার কি! মাদার কাল্ট আবার কি! মাদার মানে তো দেশ। দেশটা কাল্ট হবেনা তো কি হবে! হ্যাঁ পরে এই মেকানিক্যাল মার্ক্সিজমে যেটাকে আমি ভালগার মার্ক্সিজমই বলি  এটা নিজেকে এনরিচ করতে পারেনি। এনরিচ করতে না পেরে দিনের পর দিন নতুন নতুন গাড্ডায় গিয়ে পরেছে এবং তারপরে প্রচুর ভুল ব্যাখ্যা এবং ইন্টারপ্রিটেশনের সুযোগ ঘটেছে। আমি আর কিছু বলবো না...


সাম্প্রতিক একটি নাটক দেবব্রত বিশ্বাসকে নিয়ে, সেখানে কতটা ঐতিহাসিক ফ্যাক্ট আছে... হ্যাঁ... এবং সেখানে যা যা বলা হয়েছে সেই সমস্যার গুলো কোন লেভেলের সমস্যা এগুলো একটু ভাববার দরকার। এ্যাকচুয়ালি ঋত্বিকের সঙ্গে কি হয়েছিল? হোয়াট শর্ট অভ ডিফারেন্স হি হ্যাড এবং সো ফার মাই নলেজ গোজ...জর্জ বিশ্বাসের সঙ্গে এরকম ভয়ঙ্কর কিছু টাসেল হয়েছিল বলে আমার জানা নেই। আমি জানি না।

আমি অনেক... এই ইতিহাসের অনেকটার সঙ্গেই জড়িত খুব কাছ থেকে জড়িত। আমার বাবাও একজন ভুক্তভোগী
প্লাস আমি বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে এসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন চট্টোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র বিষ্ণু দে। আমি কোথাও বাবা এসব পাইনি...


হ্যাঁ, এখন সব অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস উঠে আসছে। আসছে এবং আমি দেখছি এটাকে কিন্তু রাজনৈতিক কারনে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই অস্ত্র, সমস্ত অস্ত্র যদি প্রতিপক্ষের হাতে চলে যায়, আমরা কি নিয়ে লড়বো এটাও একটা সমস্যা। কাজেই ঋত্বিক আজকে চান যে আমরা তাকে সেভগার্ড করি। আমি চাই আজকের ইয়ং ফিল্মমেকাররা
মানে এ্যাটলিস্ট একটা অটোগ্রাফস কাজ করুক যেখানে বলা যাবে যে ঋত্বিক ঘটক বেঁচে আছেন। সেরকম একটা অবস্থা  কি আসবে কখনো কখনো কি দেখতে পাবো? নাকি বাঙালি আরো আধুনিক হতে থাকবে?

এ একটা জটিল সংকটের সময়। জটিল সংকটের সময়... সংকটটাকে আমি অস্বীকার করি না। ম্যাসিভ একটা মার্কেটের ব্যাপার আছে, একটা কালচার ইন্ডাস্ট্রি আছে। কালচার ইন্ডাস্ট্রির যে খেলা, মুনাফার খেলা... সেখানে ঋত্বিক চলে না। বরং বলা হয় ঋত্বিকের ছবির কদর এখন হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কি যারা তাদের সময় অনেক এগিয়ে থাকে তাদের লেখার কদর পরে হয় বা শিল্পকর্মের। যেমন,সেইদিন সবাই কাফকাকে কেউ বুঝতে পারেনি
কাফকার রেলেভেন্স প্রত্যেকদিন বাড়ছে। এই নতুন ম্যানুস্ক্রিপ্টগুলো বেরোলে আর কি দাঁড়াবে তাই জানি না। যেমন আন্তোনিও গ্রামসি। তাকে কুড়ি বছরের জন্য এই ব্রেনটাকে কাজ করতে দেবো না, এই বলে জেলে দেয়া হলো। সেখানে সে কয়েকটা পেন্সিল আর নোট বই জোগাড় করে প্রিজনারস নোট বুকস লিখলো। কিন্তু সেটার রেলেভেন্স ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে যাচ্ছে। সমাজকে দেখার বোঝার চোখগুলো পালটে যাচ্ছে। সারা বিশ্বজুড়ে। এই যে চিন্তা ভাবনার ক্ষেত্রে রদবদল। এই রদবদলে যে দর্শন, সেখানে, ঋত্বিক একজন প্রথম সারির সৈনিক হিসেবেই থাকবেন। এবং আমি সত্যি কথা বলতে কি... এই মানুষটাকে এতো কাছ থেকে দেখেছি... তিনি আমাকে এতো কিছু জানিয়েছেন, বুঝিয়েছেন, শিখিয়েছেন, যেমন ধরুণমিউজিক শোনা। এই লোকটা,ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত থেকে শুরু করে ওয়েস্টার্র্ন ক্লাসিক্যাল ইভেন জ্যাজ, ইভেন বিং ক্রসবির গান, এ সমস্ত কিছুর উপরে, মানে একটা এন্সাইক্লোপিডিক নলেজ থাকতো। সেই লোকটা আমাকে মদেস মুশোভস্কির মিকজিক শেখালো। বললো এইটা শোন লং প্লেয়িং রেকর্ডের উপর মদের গেলাস রাখতো ফলে গোল গোল গোল গোল দাগ হয়ে যেত। তা সেই একটা বাজিয়ে একদিন শোনালো নাইট অন দ্য বেয়ার মাউন্টেন। পরে যখন চাকরি বাকরি করেছি, এগুলো সংগ্রহ করেছি। হ্যাঁ এবং এইযে এন্সাইক্লোপিডিক নলেজ একবার একটা জায়গায় গিয়ে... বসুশ্রী কফি হাউসে ক্রিকেট নিয়ে কিছু কথা বলেছিলো সেখানে তো ক্রিকেটের বাঙালির নিয়ে বিশাল আড্ডা তা একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে। এগুলো জানেই না ক্রিকেটের ওপর সবথেকে বড় বিশ্বের যিনি  লেখক সি এল আর জেমস, ওয়েস্ট ইন্ডিজের। হি ওয়াজ প্রোটস্টান্ট অ্যান্ড আ জায়ান্ট ইন্টেলেকচুয়াল। সে সি এল আর জেমসের লেখারও হদিশও ঋত্বিক জানত।

এই যে ব্যাপারটা... ঋত্বিক সত্যি কি জানতেন কি জানতেন না... আমি তাকে কন্ঠস্থ শেক্সপিয়ার বলতে শুনেছি
কিং লিয়ার থেকে... আমি ঋত্বিককে স্টেজে আশ্চর্য আলোর কাজ করতে দেখেছি। কিচ্ছু না জেনে। ঐ নাটক দেখতে গেছেন। সেই নাটক, আমার বাবার নাটক। তাতে আলোর কাজ করেছেন তাপস সেন। ঋত্বিক গিয়ে তাপস সেনকে গলায় এক ধাক্কা। বেরো তুই এখান থেকে। আমি করবো আলো। যা, ভাগ...

কি করবে, বাধ্য হয়েছে। ইয়ে মদটদ খেয়ে এসেছে। কিন্তু তারপর যে কাজ করলো। সেটা একটা অকল্পনীয় কাজ।
জাস্ট একটা ডিমার। একটা স্পট লাইট কমিয়ে বাড়িয়ে পুরো ডাইমেনশনটা পালটে দিলো। এবং ঋত্বিক থিয়েটারেরও লোক... ঋত্বিক থিয়েটারেরও লোক... ঋত্বিক ছবি আঁকারটার লোক... স্কেচ করতে পারতেন... গানের লোক.. মিউজিকের লোক

এইবার বলি, ঋত্বিকের ছবির ক্যামেরা। দেখবেন ক্যামেরাম্যানের নাম আছে। নাইনটি পার্সেন্ট। অনেক সময় বেশি কাজ ঋত্বিকের করা... নিজের... ও ক্যামেরায় যে লুক থ্রু করছে। ওখানেই ও বলেছে, স্টার্ট ক্যামেরা এ্যাকশন...

চললো। একটা লোক সবকিছু করতে পারতো। এবং এডিটিংটা তো রমেশ যোশীর সঙ্গে বসে একদম ফ্রেম বাই ফ্রেমে ইয়ে করে করা...যাই হোক... এই যে সত্যি কথা বলতে কি ঋত্বিক ঘটক কি ছিলেন... তার বন্ধুবান্ধব কয়েকজন আছেন... অনেকে নেই। দুই একজনের কাছ থেকে... তারা কতটুকু বলবেন তাও জানি না। কিন্তু, আবার নতুন করে তথ্য যদি কিছু পাওয়া যায় সেগুলো জোগাড় করার এটা হাইটাইম। যেমন, ঋত্বিকের সিনেমার মেকআপম্যান। মেকআপের কাজটা করতেন মূলত শক্তি দা। শক্তি সেন। শক্তি দা নেই। আমি নিজে দেখেছি, ঋত্বিক একেকটা শেড বলে দিচ্ছেন। এই মারো... ঐটা করো...

মানে এই লোকটা... কি জানতো আর কি জানতেন না এইটাই একটা রহস্য। কিন্তু এ্যাপারেন্টলি কিচ্ছু জানতো না... এ্যাপারেন্টলি কিচ্ছু জানতো না... সরোদ বাজাতে পারতো... বাঁশি বাজাতে পারতো। কিন্তু কিচ্ছু নয়। আর বাঙালি ক্রিটিকরা লিখলোএনার একটু ডিসিপ্লিনের অভাব আছে। এনার সিনেমায় কোন গ্রামার নেই। আরে শালা, ও গ্রামার বানাচ্ছে... ও গ্রামার বানাচ্ছে... ওর গ্রামারটাকে শেখ।

হ্যাঁ, চিরকাল এরা গোল গোল জিনিস, নিটোল জিনিস, মানে ঐ ক্যালেন্ডার ফটোগ্রাফি। এইসব নিয়ে এরা মাথা ঘামিয়ে গেলো। জিনিসটা কত নিটোল হবে। আরে! একটা বীভৎস ভাঙ্গাচোরা জিনিসকে নিটোল করা যায় না। দ্যাট ইজ নট দ্য নিউ এস্থেটিক, নিউ এস্থেটিক হচ্ছে, মন্তাজের নিউ এস্থেটিক। সেটাও কিন্তু পলিটিক্যাল কারনেই ওয়ার্ক করেছে।

ঐ যে বললো... ঐ সিকোয়েন্সটা... ঐ যে... মা বলছে, ক্যামেরা উপরে ঘুরছে... সেখানে আরেকটা জিনিস আছে ,একটা বাচ্চা ছেলে একটা দোলনায় দুলছে। এই বাচ্চা ছেলেটা হচ্ছে এই অনন্ত সময়ের মধ্যে একটা মানে পেন্ডুলাম
সে কোথায় যাচ্ছে? ডাইনে বায়ে সে জানে না... দুলছে... কারন, ঐ ছেলেটার এখন কেউ নেই, ওর মা নেই, বাবা নেই, প্রেমিকা নেই, কেউ নেই... ওর লেখা নেই। কিচ্ছু নেই। হিজ লস্ট।  যেকোনো সময় ও পেন্ডুলাম থেকে ছিটকে বেরিয়ে চলে যাবে। ও তখন ট্রাপিজের খেলোয়াড়। হ্যাঁ এই অবস্থায় একটা সিকোয়েন্স তোলেন আরেকটা সিকোয়েন্সে ওখানে হরপ্রসাদ যখন ঈশ্বরকে বলছে, তুমি আমাকে কোলকাতায় নিয়া যাবা কোলকাতায় এখন মজা সে যে কি বীভৎস মজা, তখন বলছে যাবো।

কাট করছে রেসের মাঠ। একটা ঘোড়া লাফ দিয়ে বেরোচ্ছে। দৌড়টা শুরু হলো। সীতার গলায় একটা পোকার আ...
চিন্তা করা যায় না। বিশ্ব সিনেমাতে নেই। কোথাও নেই, কোথাও নেই। আমাদের যা বড় বড় নাম, যাদের নামে একাডেমী, ইন্সটিটিউট সব হয়েছে, তাদের কোন কাজে নেই, কিচ্ছু নেই। এই লোকটার আছে, এই লোকটা বিশ্বসিনেমাতে, মানে রুথলেসলি অটোগ্রাফ করে গেছে। কারন নিজের নাম খোদাই করে দিয়ে  গেছে এবং আমাদের এটা গর্বের বিষয়। যে তিনি আমাদেরই লোক, আমরা তাকে দেখেছি, আমরা তাকে কাছ থেকে পেয়েছি, এই বিশ্ববিদ্যালয় তাকে পেয়েছে। এবং এই কাজ গুলো খুব সহজ কথা! কিন্তু, মানুষের প্রতি বিশ্বস্ত হওয়া, মানুষের, গরীব মানুষের প্রতি অনেস্টি বজায় রাখা, বেশি বড়লোকের সঙ্গে মাখামাখি করার দরকার নেই। তাতে কখনো শিল্প হয় না, দালালি হয়।

এবং এগুলো হচ্ছে প্রত্যক্ষ শিক্ষা। এবং পলিটিক্যালি এ্যালাইভ হওয়া। এবং আই স্ট্যান্ড ফর লেফট উইং আর্ট বাট নো ফারদার লেফট ইন দ্য হার্ট। হ্যাঁ, এই জায়গায় দাঁড়িয়ে কবুল করা এবং কবুল করতে করতে করতে করতে মরে যাওয়া একসময়। এইটাই স্বাভাবিক এইটাই একটা শিল্পীর জীবন। এইখানেই সে বাঁচে।

এবং শিল্পীরা পৃথিবীর কোন দেশে কখনো খুব একটা আনন্দে বসে বসে খেয়েছে আর থেকেছে এরম কেউ দেখাতে পারবে না। কেউ দেখাতে পারবে না। এই মদলিয়ানির মত শিল্পীকে একটা ব্রেডরোল খাবার জন্য ঐ ক্যাফেতে বসে
ঐ সাদা কাপড়গুলোর ওপর ছবি এঁকে দিতেন... দে একটা রুটি দে খাই... সেইগুলো পরে কোটি ডলারে বিক্রি হয়েছে এই মার্কেট তো রয়েছে চারদিকে... যাইহোক... আমাদের এই পলিটিক্যাল কারেক্ট ও কালচারালি কারেক্ট  বাঙালিরা নিপাত যাক। তাদের আধুনিকতা নিপাত যাক। আমরা যারা প্রিমিটিভ, পুরোনোপন্থি, আমরা থাকবো।
আমরাও বুঝি... আমরাও বুঝি... এই হোমোসেক্সুয়ালিটি নিয়ে দেবেশ রায়ের দাদা দীনেশ রায় একটা গল্প  লিখেছিলেন। অসামান্য গল্প।  সেই গল্পকে আমরা প্রোমোট করেছিলাম। আমরা হোমোসেক্সুয়ালিটিকে প্রোমোট করিনি, আমরা প্রোমোট করেছিলাম একটা অসামান্য শিল্পকর্ম। যার বিষয় হোমোসেক্সুয়ালিটি হতেই পারে। আমরাও কিছু জানি না, বুঝি না, এরকম নয়। আমরা রামছাগল মনে করো না। আমরা ডেথ ইন ভেনিস দেখেছি, উই ক্যান টিচ ইউ, হোয়াট ইজ হোমোসেক্সুয়ালিটি। একটা আর্টিস্টের সাবলিমেন্টারে কোথায় যেত পারে। এরা যেন আজকে আবিস্কার করলো, এগুলো অনেক প্রিমিটিভ ব্যাপার। এসব হয়ে গেছে অনেক আগে। এগুলো আমরা জানি। কাজেই, হারাবার কিছুই নেই, শৃঙ্খল এবং পলিটিক্যালি কারেক্টনেস ছাড়া।

থ্যাঙ্কিউ....

অনুলিখন : কামরুল হাসান মিথুন
 | |

Comments