ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন | বালি




| |                                সব চরিত্র বাস্তবিক | বালি


[স্ক্রিনশট: পদাতিক, মৃণাল সেন]

“শোনো মেয়ে, অনেক হয়েছে- এবার মাকে রেহাই দাও দিকি! বিয়েটা করো। বাবাও মরল তো আগলাবে কে?
হুম্‌, আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মত আমাকেও এসব শুনতে হয়েছে শ্মশানে বসেই। আমি, জানেন, বাবাকে কোনদিন অজ্ঞান পর্যন্ত হতে দেখিনি। বরাবর এক স্বতঃস্ফূর্ত ও গাম্ভীর্য মিশ্রিত স্বরে ডাকত “কই আমার ছোট মেয়ে কই? হাঁ হয়ে থাকা মুখটা বেশ কিছুক্ষণ চোখ আটকে রাখল আমার! এই মুখ থেকেই প্রথম নামতা শেখা আমার; আর কিছুক্ষণ পর এই মুখেই আগুন ঠুসে দেবো? বুকটা ছ্যাত্‌ করে উঠল! বাবার লম্বা-চওড়া শরীরটা বেজায় শক্ত হয়ে গেছে, বিজ্ঞানের ভাষায় রাইগর মর্টিস। মুখটা তাই বন্ধ করা গেল না। যদিও আমার বাবা বরাবরই বেশ বক্তিয়ার, শুরু করলে আর থামায়- কার সাধ্যি! বিরক্ত হতাম কখনো কখনো.. তবু মনে হল একবার যদি ডাকে “কই ছোট মেয়ে কই”... আমি জানি বাবা ডাকার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না বা ডাকছে, আমি শুনতে পাচ্ছি না। সব বাবার ইচ্ছে থাকে সন্তান ডাক্তার-বদ্যি গোছের কিছু হোক, কিন্তু আমার বাবা চাইত আমি নকশাল হই। এইতো কদিন আগেও বলল “হ্যাঁরে, ওরা কি সব হারিয়ে গেল? এখন আর মিটিং হয় না? নিয়ে যাস তো একদিন আমায়” আগুন দেওয়ার সময়ে দেখলাম চোখের পাতাগুলো গুটিয়ে যাচ্ছে। কাচাঁ-পাকা চুল চামড়ার প্রতিটি আস্তরণের সাথে সাথে আগুনের ছ্যাঁকায় পুড়ে যাচ্ছে- আমার জন্ম, আমার শৈশব, আমার ইস্কুলে যাওয়া, পুজোর জামা, যত তাবড় তাবড় সার্টিফিকেট, ‘বাবা’ ডাক, সবকিছুর রং ছাই! মনে পড়ে ইস্কুলে চাকরি পেতে বাবা কি খুশি! ঢালাও মিষ্টি এনে খাওয়ালো, যদিও নিজের হাই ব্লাড সুগার। তাঁর অপেক্ষা ছিল শিক্ষক দিবসের- “তুই কত পেন পাবি! একটা দিস আমায়!” এলোও সেই দিনটা। কিন্তু জ্বর আসায় ইস্কুলই যেতে পারলাম না। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছি। বাবা এল। বললুম, কাল যাবো তো। সব পেন্ডিং গিফ্‌ট পেয়ে যাব। তোমায় দুটো পেন দেব। কিছু উত্তর দিল না। মাথার কাছে দু’দন্ড বসে চলে গেল। হয়তো আমার জ্বর নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু বুঝিনি, যে মানুষটা না জানিয়ে বাগানে গেলেও রাগ করে; সে সেই রাত্রেই না বলে চলে যাবে! ডাক্তার বিধান দিলেন ব্রেনস্ট্রোক। স্পন্দনহীন বাবার মাথায় অনেকক্ষণ হাত বোলালাম। এত যন্ত্রণা ছিল হোথায়? কোনোদিন বুঝতে দেয়নি তো? যে মানুষটা নকশাল করতে গিয়ে বহুবার আধমরা হয়েছে, তবু মেয়েকে বলেছে নকশাল হোয়ো; সে কি না হার মেনে গেল এইভাবে? তবে যখন চুল্লিতে ঢোকানোর আগে আমার খাদ্যরসিক বাবার আলতো ফাঁক হওয়া মুখে কাচা চাল ঠেস্‌ছিলাম, তারপর অন্ধকার জঙ্গলে তাঁর জন্য খাবারের থালা রেখে এসেছিলাম কুকুরের মত, সেদিনই হিন্দু ধর্মের মুখে সহস্রাধিকবার প্রস্রাব করি। যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে তবে যেন হিন্দু ধর্মের বাইরেও নকশাল বলে কোন ধর্ম থাকে। শুধু তোমার জন্য বাবা। আজও পেন গুলো পড়ে আছে বাক্সবন্দী.. আলো নিভিয়ে রাতের পর রাত দাঁড়িয়ে থাকি, ঠিক যেমন তুমি থাকতে আমার ফেরার অপেক্ষায়... পাঁজর ভাঙার শব্দ প্রখর হতে থাকে। রক্ত পড়ছে কোথাও। নখগুলো উপরে নিচ্ছে কেউ আমার। আমি তোমায় ছেড়ে আছি সেটা বড় কথা নয়, তুমি আমায় ছেড়ে আছ কি করে? নিজের অজান্তেই বলে ফেলি- ফিরে এসো। একবার। বিশ্বের সেরা জায়গায় চিকিৎসা করাবো তোমার.. ফিরে এসো বাবা। দূর থেকে হঠাৎ সেই একঘেয়ে সুরটা ভেসে আসে ‘আমি আবার তোমার আঙুল ধরতে চাই’।| |

Comments