এটা গল্প হলেও পারত | অয়ন
বুলেটপ্রুফ | অয়ন ঘোষ
[চিত্রণ: ফ্রান্সেসকো রুসপলি, ইউ.কে.]
এক ক্ষুধার্ত শ্মশানে মৈথুনরত দুই শৃগাল। এইখানেই না হয় শুরু করা যাক গল্পটা। আর্ট এক্সিবিশনের হলঘরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একমনে ওই একটি আশ্চর্য চিত্রকলাই দেখে চলেছিল ইম্যানুয়েল, চোখ সরছিল না তার, আর মনের মধ্যে যেন অহরহ বয়ে চলেছিল বিশ্বব্রহ্মান্ডের চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। সেই আর্ট গ্যালারিতেই আমার প্রথম পরিচয় এই অদ্ভূত মানুষটির সাথে।
“আমায় করুণা করিস? বল না রে! বল না শালা! আমার জন্য চোখের জল ফেলিস?” মা কালীর ভেসে আসা খোবলানো মূর্তিটার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করেছিল ইম্যানুয়েল। ঠিক যেমনি প্রাপ্তবয়সের প্রাতঃকালে কৈশোরের খেলার সাথী থেকে ক্রমে হয়ে ওঠা প্রেমিকা-কে ইম্যানুয়েল বলেছিল: “তোর জন্য আমি সবটুকু দিতে পারি, এমনকি নিজের প্রাণও।”
“সত্যি? আর যদি ব্যথা পাও?”
“সহ্য করে নেব।”
“আর যদি ওরা তোমায় গুলি করে মারে?”
“বুলেটপ্রুফ হয়ে যাব।”
অবশ্য এই অসাধ্যের কোনটাই তাকে সাধন করতে হয়নি, কারণ তার কিছুদিনের মধ্যেই ইম্যানুয়েল গভীর অসুখে আক্রান্ত হয়, এবং চিকিৎসার জন্য অন্যত্র পাঠানো হয় তাকে। বেশ কিছুদিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করার পর একেবারে যায়-যায় অবস্থা থেকে সবাইকে প্রায় চমকে দিয়ে সটান সুস্থ হয়ে ওঠে ইম্যানুয়েল, কিন্তু বাড়ি আর ফেরা হয় না তার। কারও কারও মতে সেই সাংঘাতিক অসুখের দাপটেই তার মস্তিষ্কে বিকার দেখা দেয়; অবশ্য তা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক এক ভিন্ন ইতিহাস।
ইম্যানুয়েল একবার আমাকে বলেছিল, “লোকে যাই বলুক, মৃত্যু কিন্তু আমার কাছে বড়ই কৌতুকের বিষয়। মৃত্যুতে চরম ছোটলোকও মহিমান্বিত হয়। সারা জীবন যারা গাল পাড়ল, পশ্চাতে ছুরিকাঘাত করে গেল, মরা মাত্র তারাই মনেপ্রাণে সব ক্ষমাঘেন্না করে, ছবিতে ফুল-মালা চড়িয়ে, ধুপ জ্বালিয়ে, কিছু কুমিরাশ্রু ফেলে, নেশায় চুর হয়ে বমি-টমি খিস্তি-খেউর করে-টরে, শেষমেষ লাশ পুড়িয়ে, ‘লোকটা কিন্তু আদতে খারাপ ছিল না’ বলে কেমন দিব্যি দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যায় বলুন। অবশ্য পাওনাদাররা ব্যতিক্রম।”
বলা বাহুল্য, ইম্যানুয়েলের কোনো পাওনাদার ছিল না; ছিল শুধু ভয়। প্রেমিকাকে যে প্রশ্নটা করতে ভয় পেত ইম্যানুয়েল তা ছিল: “আমি মরে গেলে কাঁদবে তো তুমি?”
সে বলেছিল: “স্বপ্ন দেখো?”
“দেখি।”
“কি স্বপ্ন?”
“দেখি আমি একটা মই বেয়ে উপরের দিকে উঠে চলেছি, উঠেই চলেছি, চারিদিকে খালি অন্ধকার…”
“কখনো ভেবে দেখেছ এর কি মানে হতে পারে?”
“না। তুমি বল।”
কিন্তু সে কিছুই বলেনি। শুধু হেসেছিল। রাতে সেই মুখটাই শ্মশানকালী হয়ে ফিরে এল বিছানা ভেজানো দুঃস্বপ্নে।
“আমার ভীষণ ভয় করে, মা!”
“কিসের ভয় তোর?”
“আমি যদি একা একাই মরে যাই, আমার ভয়গুলো শোনার কেউ থাকবে না, আমার ব্যথা ভোলানোর কেউ থাকবে না, মা।”
“দুর পাগল! দোকা আবার কে মরে রে?”
“তোমায় আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, মা।”
ডানাকাটা পরীর মত গদ্যময় প্রেমিকাকেও বুঝে উঠতে পারেনি কাব্যসর্বস্ব ইম্যানুয়েল। “তোমার জন্য আমি না থাকার বেদনাটা উপলব্ধি করি, এই অসমাপ্ত জীবনের মানেটা ঠাহর করার চেষ্টা করি, হে মানবী।”
সে বলেছিল: “আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?”
ইম্যানুয়েলের চতুর্থ প্রেম জনৈক লেডি ডাক্তারের সাথে একদিন কফি খেতে খেতে আগের রাতে পড়া সেই উদ্ভট বইটার কথা জানিয়েছিল।
“কির’ম উদ্ভট? শুনি গল্পটা।”
“কিছুটা কল্পবিজ্ঞানের অয়দিপাউসের মত। একটা লোক, অতীতে ফিরে গিয়ে নিজের মাকে বিয়ে করে নিজেরই জন্ম দিচ্ছে। কি নিদারুণ অদৃষ্ট-চক্র!”
লেডি ডাক্তার কিছুমাত্র বিস্মিত বলে মনে হল না। বরং উল্টে প্রশ্ন করেছিল: “ধর তুমি একটিবারের জন্য তোমার অতীতে ফিরে গেলে? কি বদলাবে তখন?”
এক মুহূর্ত চিন্তা করে ইম্যানুয়েল। “নিজেকে।”
“তোমার বিশ্বাস তাতেই সব সমাধান হবে?”
সেই লেডি ডাক্তারের সাথেই ছাড়াছাড়ি হওয়ার সময় সে ইম্যানুয়েলকে শুধু বলেছিল, “ভালো থেকো।”
“আমায় করুণা করিস?”
সন্ধ্যার দিকটায় ইম্যানুয়েলের একটু হাঁটাহাঁটি করার স্বভাব ছিল। অন্যমনস্ক ভাবে ঘুরে বেড়াত শহরের রাস্তায়; ঘন্টার পর ঘন্টা চুপচাপ বসে থাকত বিভিন্ন বাস স্টপে। ঠিক যখন প্রতিদিন মন্দিরের কাঁসর-ঘন্টা মসজিদের আজানের সাথে রেষারেষিতে মগ্ন হত, ইম্যানুয়েল দেখত বিষাদ শহরের ভঙ্গুর দৈনতা, আর তা বয়ে নিয়ে বেড়ানো কয়েকটা ছোট ছোট কালো মাথার ঝাঁক। ওরা হাসত, খেলত, খেলতে খেলতে মারপিট করত। কখনো কখনো উপরের দিকে তাকিয়ে একফালি মৃত আকাশে দেখত এক কাটা ঘুড়ির এরোপ্লেন হয়ে যাবার স্বপ্ন। ওরা ঘুমানোর সময় ওদের বালিশের নিচে টাকা গুঁজে রাখতে শখ হত ইম্যানুয়েলের, কিন্তু পারত না। হঠাৎ হঠাৎ আবার খুব রাগ হত, মনে হতো একটা বিস্ফোরণে উড়ে যাক সমস্ত কিছু—একদল ঘেমো বদগন্ধ শুয়োরের বাচ্চা, রাতদিন ঠেসাঠেসি করছে দুনিয়ায় শুধুমাত্র এক ইঞ্চি জায়গার জন্য। ছোটলোকদের ছোট ছোট ঘুপচি ঘরবাড়ি, আর তাদের যত ঘেয়ো শখের নেড়িকুত্তা—দশ হাজার বছরের সভ্যতা যাক ধোঁয়ার ব্যাঙের ছাতায় মিলিয়ে ছাই হয়ে। আহ, সেই কল্পনাতেও কি পরম শান্তি! ঠিক যেই শান্তি পেত ইম্যানুয়েল রোজ স্নানঘরে আনুষ্ঠানিক আত্মমৈথুনে। নিজেকে এত পরিপূর্ণ আর কখনো মনে হত না।
রোজ সন্ধ্যায় একটা বিশেষ জায়গায় যেত ইম্যানুয়েল। এক অল্পবয়স্কা গর্ভবতী গৃহবধুকে নবজাতকের মত অকাট বিস্ময়ে একটু দূর থেকে তাকিয়ে দেখত। কাছে যেতে সাহস পেত না।
“মা।”
এখানেই সমস্যার মূল। এখানেই সমাধান সব অঙ্কের।
দিনের পড়ন্ত আলোয় ছাদে দাঁড়িয়ে আনমনে হাসতেন তিনি কখনো কখনো। জগত আলোকিত করা সেই হাসি দেখত ইম্যানুয়েল, আর বুকের ভিতরটা যেন সহসা শূন্য হয়ে যেত। মূল বস্তুর সাড়া পাওয়া যেত সেই হাসিতে। সময়ও থমকে দাঁড়িয়ে যেত বুঝি তখন। এক মৃত বুভুক্ষু জগতের মাঝে প্রাণ সঞ্চার করা সেই হাসি।
“মা! আমার মা! আমি আসছি।”
রাতে দুটো যুগ্মতারার জন্ম দেখেছিল ইম্যানুয়েল।
ভাসানের সেই প্রায় কাঁপুনি ধরা ঠান্ডায় উদ্দাম নাচানাচি আর মাতলামির মধ্যে শ্মশানকালী তাকে বলেছিল, “এই যেমন হুল্লোড় দেখছিস, ঠিক এমনি প্রতি অমাবশ্যায় জ্বলন্ত মৃতদেহ কে ঘিরে শ্মশানের ছাই মেখে নাচতে থাকে একদল ভাড়া করা খান্কী। আর সবাই তখন ভয় পায় এদিক মাড়াতে।” ইম্যানুয়েলের চোখে অবিশ্বাস দেখে শ্মশানকালী হাসে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। “তোর জন্যেও নাচবে রে হারামজাদা। কি বলবে একে উগ্রবাদী চটুল সমাজ?” অট্টহাস্যে ফেটে পরে কালী। “তুই বলি হবি আমার? হবি?” হাসি যেন ধরতে চায় না তার লকলকে জিভে।
সেই স্বেদার্দ্র দুঃস্বপ্নের মতই একদিন দাঙ্গায় জ্বলে উঠলো শহর। রাস্তা পেরোতে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে ইম্যানুয়েল দেখল গর্ভবতী মায়ের মুখ। একাকী, সন্ত্রস্ত, অসহায়।
পাগলের মত ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে লাগলো সে। চারিদিক থেকে অসংখ্য কিল, ডান্ডা, লাথি বর্ষিত হতে থাকলো তার উপর। একসময় পড়ে গেল ইম্যানুয়েল। শত্রুকে আবিষ্কার করেই যেন রক্তের লালসায় মেতে উঠলো মত্ত জনতা।
“মার শালাকে, মার!”
পদপৃষ্ঠ হয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে রাস্তার উপর পড়ে রইলো ইম্যানুয়েলের বুলেটপ্রুফ দেহ, চোখদুটো তখনও খোলা, অনুসন্ধিৎসু। এক গর্ভবতী তরুণীকে নবজাতকের ন্যায় অকাট বিস্ময়ে অনুসন্ধিৎসু।
“তোর জন্য আমি সবটুকু দিতে পারি, এমনকি নিজের প্রাণও।”
“সত্যি? আর যদি ব্যথা পাও?”
“সহ্য করে নেব।”
“আর যদি ওরা তোমায় গুলি করে মারে?”
“আমার ভীষণ ভয় করে, মা!”
“কিসের ভয় তোর?”
সেই একা-একাই মরতে হলো ইম্যানুয়েলকে। মৃত্যুকালে ভারী একটা অদ্ভূত স্বপ্ন দেখেছিল সে। দেখল এক প্রশস্ত পালকের বিছানায় সে শুয়ে আছে, আর জীবনের যত প্রেমিকারা তাকে ঘিরে ফোঁপাচ্ছে। সেই একদম শুরু থেকে—কৈশোরের প্রথম প্রণয়িনী যার জন্য অতিমানবিক অসাধ্য সাধন করতে রাজি ছিল সে, গলায় স্টেথোসস্কোপ ঝোলানো লেডি ডাক্তার থেকে ডানাকাটা পরী, শ্মশানকালী, সে যে কিনা তাকে পুরোপুরি পুরুষ করে তুলেছিল। উফফ, কি সুখ, কি সুখ—শরীর ও মনের খিদে যেন একাকার হতে চাইছে! প্রচন্ড বেদনায় কুঁকড়ে যাওয়া অবস্থায় অন্তিম অন্ধকার ঘনিয়ে আসার ঠিক আগের মুহুর্তে ললাটে গর্ভধারিণী মায়ের স্নেহময়ী কোমল হাতের ছোঁয়া অনুভব করেছিল বুলেটপ্রুফ মানুষ ইম্যানুয়েল।
সূচীব্যথাপত্র
Pain-একটু হোক ইংরিজি
অনুগল্প
এটা গল্প হলেও পারত
কী-ওয়ার্ডে ব্যথা
ব্যথার অ্যাবস্ট্রাক্ট
Bong Pen-এর মডেল পৃথিবী
পার্ট ভুলে গিয়ে
সি রি য়া স ঋ সা র্চ
আড্ডা, সাবেকী ভাষায় Interview
আমার জীবন থেকে উঠে আসা সুর
এখনো অ্যানাউন্সমেন্ট হয় নাই, আসবে কি না জানা নাই
Comments
Post a Comment