ডiary : শুক্রাণু ৮ : অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়


DIARY
AUTHOR

শুক্রাণু ৮ : অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
একটি ছোট্ট ও তুচ্ছ ঘটনা

আসলে, নেহাতই কাকতালীয় ভাবে পেয়ে যাই চলচ্চিত্রনির্মাতা মখমলবাফের একটি নাটক।  অথচ পড়ছিলাম, ইরানের ফারসি ভাষার কবি মরিয়ম হুলিহ্‌-র কবিতা। মরিয়মের জীবন ও ব্যক্তিত্ব একেবারেই আর পাঁচটা মেয়ের মতো নয়। যখন ওঁর সতেরো বছর বয়েস, পায়ে হেঁটে একা পালিয়ে গেছিল গ্রিসে। বেআইনি অনুপ্রবেশ। এখন আর ইরানে থাকে না মরিয়ম। তো, যাই হোক, যখন পড়ছিলাম ওঁর লেখাগুলো, তখন আমাদের দেশে কেন্দ্র সরকারে বিজেপি সরকার আসবে আসবে করছে। ভোট শেষ। ফলাফল তখনও না বেরোলেও, বোঝাই যাচ্ছে। আর মরিয়মের কবিতাগুলো খুব ভীষণ স্পষ্টভাবে রিলেট করছিল আমার দেশকেও। আমার মনে হচ্ছিল এ-ও যেন এক অনুপ্রবেশকারী। পাসপোর্ট-ভিসা-রাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়াই ঢুকে পড়েছে। ঠিক যেভাবে একজন বেআইনি অনুপ্রবেশকারী ঢুকে পড়ে। মরিয়মের লেখা থেকেই জানতে পারি মনসুরী সবূরী নামে এক চলচ্চিত্রনির্মাতার কথা। ইনিও ইরানের মেয়ে। এঁরও অদ্ভুত জীবন। অদ্ভুত তাঁর কাজ। মনসুরীর বাবা ছিলেন ইরানের একজন ফিজিসিয়ান। এবং কমিউনিস্ট। ইরানে তখন শাহ্‌-র শাসন চলছে। কমিউনিস্ট পার্টিগুলো নিষিদ্ধ। আজও অবশ্য তাই। মনুসুরীর যখন উনিশ বছর বয়েস, বাড়িতে রেড করে পুলিশ। মনসুরী নিজে লিখছেন সেই স্মৃতি। পড়ছিলাম। রাশিয়ান বইগুলো ওলোটপালোট করে কি সব খুঁজছে পুলিশ। তারপরে নিয়ে গেল বাবাকে। সাথে বইগুলোও। অনেকদিন পর্যন্ত ওদের পরিবারের কেউ জানতোই না ভদ্রলোককে নিয়ে গিয়ে কোথায় রেখেছে পুলিশ। এই জেল থেকে ঐ জেল, ওরা খুঁজছে। শেষে একসময় খোঁজ পাওয়া গেল তাঁর। ছাড়াও পেলেন জেল থেকে। দেশ ছেড়ে সবাই চলে এলেন অ্যামেরিকায়। জনসংযোগ ও সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করলেন মনসুরী। কিন্তু মন তো দেশেই পড়ে। একসময় শুরু করলেন ফিল্‌ম্‌ বানানো। সেবার সূর্যগ্রহণ হবে। ইরান থেকে খুব স্পষ্ট দেখা যাবে সেই গ্রহণ। মনসুরী ঠিক করলেন দেশে যাবেন। গ্রহণের সময় ইরানের মেয়েরা ধর্মীয় ও সামাজিক যে রিচুয়ালগুলো মানেন তাঁদের সংসারে, পরিবারে সেগুলোকে তুলবেন তাঁর ক্যামেরায়। সাথে সূর্যগ্রহণ। মনসুরী বলছেন, এটা ঠিক যে আমি নিজে এই রীতি-আচারগুলো মানি না। কিন্তু এটাও তো ঠিক, এর মধ্যেই তো আমার পারস্য লুকিয়ে রয়েছে। একটা হ্যাণ্ডিক্যাম নিয়ে শ্যুট করা হয়েছিল ফিল্‌ম্‌টা। যাতে কেউ সন্দেহ না করে। কেউ জিগ্যেস করলে, মনসুরীর টীমের লোকেরা পরিচয় দিয়েছিল, ওরা ট্যুরিস্ট। ফিল্‌ম্‌টার নাম দ্য চিল্ড্রেন্‌স্‌ অফ সান
একটা নদীর জলে যেমন আরেক নদী এসে মেশে, মেশে অবলীলায়। পড়াশোনা করতে করতে সেইভাবে এক গল্প থেকে আরেক গল্প এসে যায়। এক মানুষ থেকে আরেক মানুষ ঢুকে পড়ে পড়ার মধ্যে। তখন সত্যিই আর খেয়াল থাকে না কাকে কবের মধ্যে কোন্‌ লেখা পাঠাতে হবে। সেইভাবেই মরিয়মের হাত ধরে মনসুরী, মনসুরী থেকে লীড্‌স্‌ বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ হবিবল্লাহ্‌ লজগীর গবেষণা। ইরানের থিয়েটার নিয়ে। এবং মখমলবাফের নাটকের অনুবাদ। পুরো নাটকটা পড়ে আমি সত্যিই মারাত্মক চমকে যাই। এটা লেখা ১৯৮১ সালে। মখমলবাফের তখন মাত্র চব্বিশ বছর বয়েস। ১৯৮০-৮২ এই সময় পর্বে পরপর ন' খানা নাটক লিখে ফেলেছিলেন উনি, যেটা ইরানের ইসমালিক রেভোলিউশন ঘটার (১৯৭৯) পরমুহূর্তযখন শাহ্‌কে সরিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন ইমাম খোমেইনিবামপন্থী গ্রুপগুলো এক এক ক'রে খোমেইনির ইসলামিক আইনে পিছু হটছেহয় তারা জেলে, নয়তো নির্বাসনেনইলে রাষ্ট্রের সাথে হাত মেলাতে হচ্ছে বামপন্থী গ্রুপগুলো থেকে যাতে কোনোরকম বিদ্রোহ-বিপ্লব দানা না-বাঁধতে পারে, তাদের ঠেকাতে নিয়মিত সামরিক বাহিনীর সাথে সিপাহ্‌ পাসদারান এনঘেলাব ইসলামী (দ্য ইসলামিক রেভোলিউশান আর্মি) নামে আরো একটা আলাদা সামরিক বাহিনীই তৈরি করে ফেলেছেন খোমেইনি, ১৯৭৯ সালেইঅথচ  Communist Tudeh Party, Organizations of Iranian People’s Fedai Guerrillas (OIPFG), Iranian People’s Fedai Guerrillas (IPFG) এইরকম ছোট-বড় আরো বেশ কয়েকটি বামপন্থী মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী (সশস্ত্র-নিরস্ত্র দুই-ই) সংগঠনের সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল ইরানের রেভোলিউশনে। যারা স্টুডেন্ট মুভমেন্টগুলো অর্গানাইজ করেছে। স্ট্রীট কর্ণার করেছে। মিছিল করেছে। সরকারী অফিস, থানা ও জেলগুলো ঘেরাও করেছে, দখল করেছে। যারা ইরানে শাহ্‌কে হটিয়ে খোমেইনির শাসনের পথ সুগম করেছিল। কিন্তু খোমেইনি ক্ষমতায় এসেই একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেন। এদের ব্যান করলেন। এদের নেতারা গ্রেপ্তার হলেন। নির্বাসিত হলেন। মৃত্যুদণ্ডের সাজা পেলেন। থিয়েটারে আইন চালু হ--- মেয়েরা মঞ্চে অভিনয় করলে তাদের হিজাব'রে আসতে হবে মঞ্চে, পুরুষ অভিনেতাদের সাথে মঞ্চে কোনো রকম শারীরিক সংযোগ বা সংস্পর্শ দেখানো যাবে না, নাটকে নাচ থাকবে না, পপ গান থাকবে না, কমিউনিজম কিম্বা ক্যাপিটালিজম-এর কোনো বিষয় বা ঐ ভাবধারা নিয়ে নাটক করা যাবে না, ইসলাম বিরোধী কোনো কথা থাকবে না, কোনো স্ল্যাং ওয়ার্ড তো নৈব নৈব চএগুলো থাকলে সেন্সর বোর্ড সে নাটক ব্যান ক'রে দেবেএবং দিয়েওছে ব্যান ক'রে বহু বহু এর'ম দুষ্টু নাটকসেই ১৯৮১ সালে, মাত্র চব্বিশ বছর বয়েসে লেখা, মখমলবাফের এই নাটক, লেফটিস্ট গ্রুপগুলোর লিমিটেশনসগুলো নিয়ে লেখাইরানে মঞ্চস্থও হয়েছিল কি সৌভাগ্যক্রমে নাটক...  দ্য ফেন্স উইদিন দ্য ফেন্স, অথবা দ্য ইনভিজিব্‌ল্‌ ফেন্স যেখানে স্বনির্মিত আত্মকারাগারে একজন বামপন্থী চোখ বুঁজে থাকছেন কিভাবে, খাঁচার গরাদে হাত না-রেখে তিনি কিছু চিন্তা করতে পারছেন না, সহবন্দীর পায়ের শেকল জং ধ'রে আলগা হয়ে গেলে বৃদ্ধ মার্ক্সবাদী বলছেন 'আমার শেকলটা নাও'। বলছেন, শেকলগুলো যাতে আলগা না হয়ে যায় সে জন্য আমি আমাদের খাবারের থেকে অল্প অল্প করে তেল আর চর্বি  তুলে ঘষে ঘষে মাখিয়ে রাখতাম শেকলে। যাতে ওগুলোতে মরচে না ধরে। খুলে না যায়। কিন্তু আমার পা দুটো বড্ড সরু হয়ে গেছে। হাঁটলেই শেকলগুলো পা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু আমি কক্ষনো জেলখানার নিয়ম ভাঙবো না। তোমার সেলে ঢুকে পড়ো কমরেড। দরকার হলে তুমি আমার শেকলটা নিতে পারো। নাও, আমার শেকলটা পরে নাও তুমি। আমরা দুজনে দুজনের শেকল অদল বদল করে পরবো। কিন্তু নিয়ম ভেঙো না কমরেড। ডিসিপ্লিন ডিসিপ্লিন...ফুটতে থাকা সময়কে কাজে না-লাগিয়ে তাঁরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন কিভাবে.. নিয়েই মখমলবাফের এই নাটক আমি দেখতে পাচ্ছি আরো এক বেআইনি অনুপ্রবেশকারী ঢুকে পড়ছে কারোর কোনো অনুমতির তোয়াক্কা না-করেই। একসময় গুলিয়ে যাচ্ছে, আলাদা করা যাচ্ছে না কোন্‌টা ইরানের জেলবন্দী বৃদ্ধ মার্ক্সবাদীর মুখ, আর কোন্‌টাই বা আমার দেশের বামপন্থী নেতার।  স্রেফ নিজের ভেতরের তাগিদেই তখন বসে গেছি নাটকটা অনুবাদ করতে। আমাকে যেন এটা করতেই হত। অন্যান্য যে লেখাগুলো তখন চলছিল, সবগুলোকে থামিয়ে এটায় হাত দিয়ে ফেললাম। দুদিন পরে খেয়াল করি, আমি অনুবাদে হাত দিয়েছি, ২৯শে মে। সমাপতন এমনই আশ্চর্য, মখমলবাফের জন্মদিন ছিল সেদিন।    





Comments