যে জন আছে মাঝখানে | তৃষা বিশ্বাংগ্রী
মাইগ্রেশন। বাংলা অনুবাদে অর্থ দাঁড়ায় ‘দেশান্তর’। দেশান্তর ঘটেছে আমার। তবে ‘দেশান্তর’ বললেই কাঁটাতার ডিঙনোর যে ছবিটা ফুটে ওঠে, সেই অর্থে দেশান্তরিত নই আমি। পাসপোর্ট-ভিসা হাতে রীতিমতো ঠান্ডা গাড়িতে চেপে দেশান্তরিত হয়েছিলাম। তাও প্রায় আজ থেকে বছর পনেরো আগের কথা।
এটুকু জেনে বা পড়ে প্রশ্ন জাগতে পারে, এতে আলাদা করে বলার কী আছে! পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে বর্ডার পার হওয়াতে তো কোনও বাহাদুরি নেই! নেই কোনও টানাপোড়েনও। তাহলে? আসলে যখন কোনও বস্তুকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়, বস্তুটির চরিত্রেরও বদল ঘটে। আর, একটা জলজ্যান্ত মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে এসেছে এক্ষেত্রে – পরিবর্তন তো ঘটবেই! সেই পরিবর্তনগুলো বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও, কতটা যে সত্যি, তা যার হয়েছে সে-ই বোঝে। পূর্ববঙ্গে ‘জল’-কে ‘পানি’ বলা হয়। ‘বাড়ি’ না বলে বলা হয় ‘বাসা’। এদেশে পাড়ি জমানোর আগে বেশ কয়েকজন আত্মীয় আমাকে এদেশি রীতিতে অভ্যস্ত করে তোলার দায়িত্ব নেন, আর এই ক’টি শব্দের ব্যবহারগত পরিবর্তন সম্পর্কে আমায় জানিয়ে বেশ নিখুঁতভাবেই নিজেদের কাজ সারেন। যাইহোক, আজ থেকে প্রায় পনেরো বছর আগে ওদেশ থেকে এদেশে এসে থিতু হই। দেশান্তরিত হই আমি। ক্লাস থ্রি-তে ভর্তি হয়েছিলাম এখানে এসে। ভর্তির সময় পরীক্ষা নিতে পারে ভেবে মা কিছু প্রশ্নের উত্তর শিখিয়ে দিয়েছিলেন – - ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’... আর একটু হলেই বোধহয় টানের চোটে আমার কান ছিঁড়ে মায়ের হাতে চলে যেত। কিন্তু প্রথমবারের ভুল বলে আমি আর আমার কান সে-যাত্রায় রক্ষে পেয়েছিল। তারপর আরও কয়েকপ্রস্থ ধমক-ধামক আর কানমলার পর অবশেষে সঠিক উত্তর দিলাম – - আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের নাম ‘জনগণমন’... এখনও বেশ স্পষ্ট মনে আছে, স্কুলে ভর্তির সময় অনেকগুলো প্রশ্নের মধ্যে যখন একটা প্রশ্ন এল – - বল তো মা, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত কী? - ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’... মনে মনে কিন্তু ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ আওড়েছিলাম। হয়তো এখনও আওড়াই। সত্যি বলতে কী, পূর্ববঙ্গের সেই গানটিতে যে বড় মধু! আহা! অমন কথা, অমন সুর! গাইবারও দরকার নেই। স্রেফ চোখ বুজে কথাগুলো ভাবলেই কেমন সুন্দর একখানা ছিমছাম সুজলা-সুফলা শান্ত ছবি ফুটে ওঠে। বড্ড মন ভালো করা এক আটপৌরে গ্রামের ছবি। সেই গ্রামে পড়ন্ত দুপুরে আমের বোলের গন্ধে মন যেন কেমন একটা হয়ে যায়। আর অঘ্রানের সেই ভরা ক্ষেত, সেই সবুজ! চোখ জুড়ানো সেই স্নিগ্ধতা! ‘সোনার বাংলা’ আজও আমায় হাত ধরে সেসবের কাছে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায়। অনেকবার চোখ বুজে এখনকার জাতীয় সঙ্গীতটি গেয়ে দেখেছি। কই, অমন তো হয় না! হয়নি একবারও। একবারের জন্যও তো হাত ধরে আমায় বাড়ি নিয়ে যেতে পারেনি! আর পারেনি বলেই ‘জনগণমন' জাতীয় সঙ্গীত হয়েই রয়ে গেছে; ‘সোনার বাংলা’-র পরতে পরতে যে মায়ের গন্ধ, কেন যে ওতে পাই না! শুরুর দিকে বেশ খটমট ঠেকত ‘জনগণমন’। সেই প্রাণ বা আবেদন তেমন ধরা পড়ত না ওতে। পরে যখন ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় ঘটতে শুরু করল, নতুনভাবে ধরা দিল যেন। এ-গান একটা গোটা দেশকে বেঁধে রাখে। বেঁধে রাখে প্রত্যেকটা মানুষের মন। মনে পড়ায় একসঙ্গে অনেক সন্তান পালন করেও মায়ের ক্লান্ত না-হওয়ার গল্প। অন্যদিকে, ‘আমার সোনার বাংলা’ কিন্তু মায়ের ভালবাসার কথা বলে। বলে মা-কে ভালবাসার কথা। আরে না না! ভাববেন না যে আমি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত-কে কোনওরকম অসম্মান করছি। কিন্তু একবার ভাবুন দেখি, দেশান্তরিত না হলে এ-গান কি আমার গলায় জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্থান পেত? নাকি প্রতিবার গানটা শোনামাত্র উঠে দাঁড়াতাম? কোনটা? তবুও কিন্তু আমি রবিঠাকুরের ‘জনগণমন’-কেই মনেপ্রাণে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মানি। মানতে হয়। শোনামাত্র উঠে দাঁড়িয়ে পড়ি। নইলে জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি যে যথাযথ সম্মান দেখানো হয় না! ‘সোনার বাংলা’ শুনলে কিন্তু উঠে দাঁড়াই না আমি। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, ‘এতে বলার কী আছে! জাতীয় সঙ্গীত নয়, তাই উঠে দাঁড়াও না।’
বাড়িতে যখন মাতৃস্থানীয়া কোনও আত্মীয়া আসেন, সবার আগে তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করি। তারপর কুশল জিজ্ঞাসা ও অন্যান্য। আর মা যখন অন্য ঘর থেকে আমার ঘরে আসে, মা-কে কি উঠে দাঁড়িয়ে প্রণাম করি, নাকি কুশল বিনিময় করি? বরং ঝগড়া-আবদার-বায়নায় জেরবার করে তুলি মা-কে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে মা-কে কম সম্মান করি বা ওই মাতৃস্থানীয়া আত্মীয়াটিকে কম ভালোবাসি। হয়তো আত্মীয়াটিকেও মায়ের চোখেই দেখি। কিন্তু তা-বলে মায়ের জায়গা দেওয়া অসম্ভব।
ঠিক তেমনই ‘সোনার বাংলা’ আর ‘জনগণমন’-এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক। মা আর মাতৃস্থানীয়া। মায়ের চেয়ে কোনও অংশে কম ভালোবাসিনি অন্যকে। তবু, মায়ের সঙ্গে কি কারোর তুলনা চলে! |
Comments
Post a Comment