আত্মানাং বিদ্ধি | তন্ময় ভট্টাচার্য


Photograph by Raymond Depardon


।।প্রথম পর্ব।।

এইসব মুহূর্তে কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না নিজের ওপর। তোয়াক্কা না-করেই ভাবনা ছুটে আসে, টুকরো ঝড়ের মতো এলোমেলো করে দিয়ে পালিয়ে যায় অন্য কোথাও। আমি বসে থাকি। এই বসে থাকা মান্যতা পায় না কারোর কাছে। শুধু নিজের ভিতরেই সবুজ একটা গাছ দুলতে থাকে শুধুআমি সেই গাছের চলন লক্ষ করি, সমস্ত বদলে ফেলার ইচ্ছে নিয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে কবে থেকে। সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে মনে পড়ে জয় গোস্বামীর সেই পঙক্তি – ‘কী হয়, কী হতে পারত, এসবে কি কিচ্ছু এসে যায়!না, সত্যিই কিছু এসে যায় না আজ আরগেলেও, তাকে ভুলে থাকা যায়। আমার চোখ বিভ্রান্ত হতে গিয়েও সামলে নেয় নিজেকে। না, আর নয়। এবার বড় হও। চারপাশে তাকিয়ে দ্যাখো, শান্ত হয়ে এসেছে সব। মানিয়ে নিয়েছে সবাই। তুমি কেন একা-একা কষ্ট পাও এতদিন পর?

একা? আর কারোর ভিতরে কি নেই সে-গাছ? আর কেউ কি গাছ দেখতে দেখতে নিজেকে খুঁজে পায় না শিকড়ে? বিশ্বাস করি না। মন দিই মানুষে। সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন শুধুমাত্র উচ্চারণের সূত্রে আমার আত্মীয় হয়ে উঠছেন বুঝতে পেরে, না, কাছে যাই না তাঁর। দূর থেকে সেই উচ্চারণটুকু পুষে ফিরে আসি ডেরায়। আমি তাঁকে জানান দিতে চাই না কিছুই। এ-আবিষ্কার আমার নিজের। এটুকু আত্মীয়তায় ভর করে আমি আরও হাজার বছর কাটিয়ে দিতে পারি। একা নই; একা হব না কোনওদিন।

মন আসলে উত্তর কলকাতার সন্ধেবেলা। আলোআঁধারি বেয়ে কোন গলি থেকে কোন গলিতে এনে ফেলবে ঠাহর করা যায় না কিছুই। জানা থাকলেও গুলিয়ে যায় প্রায়ই। বিভ্রান্তির সামনে দাঁড়িয়ে তাই প্রশ্ন জাগে। এই যে বলছি একা হব না কোনওদিন’, আমার নিজের চেষ্টা কতটুকু সৎ? সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে নিজেকেও কি ঠেলে দিইনি ক্ষয়ের দিকে? আমি বলব ক্ষয়’, তুমি বলবে জয়এই দ্বিমত আমাদের কোথায় পৌঁছে দেবে? কীসের জয়? বর্তমানের সঙ্গে অতীত যদি ধারণই না করতে পারি, তুমি কি সত্যিই পূর্ণ হবে, বল তো মন?

আমাকে একজন বলেছিলেন, ‘এই অতীত না থাকলেই বা কী ক্ষতি! তর্কে আমার অনীহা ভীষণ। হাসিমুখে সরে এসেছিলাম তাঁর থেকে। জন্মসূত্রে পেয়েছি যা, লাভ-ক্ষতির হিসেবে তাকে ঠেলে দিতে চাই না আমি। থাকুক, যেমনটি সে চায়। পরিণত বয়সে পৌঁছে হারিয়ে ফেলার ব্যথা যেন গ্রাস না করে আমায়।

(১)

-আহ! অবুঝের মতো কইরো না!
-যাম না, যাম না, যাম না আমি। কিছুতেই আমি যাব না! যাম না, যাম না!
-কইলকাত্তায় গেলে গঙ্গাস্নান করতে পারবা! পুণ্য হইব!
- গঙ্গা আমার মাথায় থাউক! আমি কিছুতেই যাব না। যাম না, যাম না!
- ...অক্ষয় স্বর্গলাভ হইব!
- চুপ কর! আমার শ্বশুরের ভিটায় বাত্তি দিতো কেউ থাকব না। পরাণ গেলেও আমি বেচুম না।
- অমত কইরো না জ্যেঠি! আমরা বেবাক চইল্যা গেলে, তুমি থাকবা কেমন কইরা, একলা!
- তরা যা। আমি যাম না, যাম না, যাম না!
- আরে, শিয়ালে টাইন্যা খাইব যে!
- পোড়ারমুখা, ভয় দ্যাখাস কারে! আমি যাম না, তরা যা। বিক্রি আমার বাড়ি আমার জাগা আমার, স্বামীর ভিটা ছাইড়া যাম না। আমি যাম না, যাম না। তরা যা!

বৃদ্ধা দাওয়ায় বসে দুহাতে আঁকড়ে ধরেছেন খুঁটি। হাতের ওপর নুয়ে পড়েছে মাথা। তাঁর প্রতিটা যাম নাআমার বুকে আঘাত করছে। আমার এতক্ষণের সংযত চোখ ভেঙে পড়েছে এবার। মুছতে ইচ্ছে করছে না সে-জল। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি পর্দার দিকে। মনে পড়ছে না, অভিনয় আর কখনও এমন দুর্বল করেছে কিনা আমায়! দেশভাগ নিয়ে প্রথম বাংলা ছায়াছবি ছিন্নমূল’(১৯৫০; পরিচালনা নিমাই ঘোষ) কেন মনে হচ্ছে, -ঘটনার সাক্ষী আমি নিজেও? সবাই বৃদ্ধাকে বলছে ভিটে বিক্রি করে দিয়ে তাদের সঙ্গে কলকাতায় চলে যেতে, আর বৃদ্ধার জেদ কিছুতেই যাবেন না তিনি। ভুল হতে পারে, তবু অনুমান আমাকে বারবার বলছে, ওই বৃদ্ধা সত্যিই দেশ ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। নইলে এত সহজে আমার আত্মীয় হয়ে উঠতে পারতেন না তিনি। দেশভাগের তিনবছর পর মুক্তি পাওয়া এই ছায়াছবি যে-ব্যথা ধরেছে পরতে পরতে, তার পায়ে আমি নব্বইয়ের দশকে জন্ম নেয়া এক যুবক যার গায়ে প্রায় আঁচই লাগেনি দেশভাগের - শুয়ে রয়েছি চুপচাপ।

লিখতে লিখতে মনে হল হঠাৎ, আমার অনুভূতি কি বানানো? সত্তর বছর আগের একটা ঘটনা নিয়ে মনের এই উথালপাথালের কারণ কি শুধুই ছায়াছবিটির আবেগ? চোখ গেল ওপরে। দেখলাম, ‘যার গায়ে আঁচই লাগেনি দেশভাগের’ – লিখতে পারিনি আমি। অবচেতনেই একটা প্রায়ঢুকে পড়েছে সেখানে। এই প্রায়’-এর বিপরীতে যা-কিছু, নিতান্ত কম নয়। চাইলে এড়িয়ে যাওয়াই যেত, কিন্তু আমার বড় হওয়া তা এড়াতে পারেনি বলেই আজও একটা দীর্ঘশ্বাস চুপিচুপি আমার কাঁধে টোকা মেরে জিজ্ঞেস করে, ভালো আছি কিনা!

ওই ছায়াছবিরই আরেকটি দৃশ্য গাঁয়ের লোকের সঙ্গে বৃদ্ধাও শেষ পর্যন্ত কলকাতায় এসে ঠাঁই নিয়েছেন শিয়ালদা স্টেশনে। কয়েকদিন পর, বীতশ্রদ্ধ হয়ে পরিচিত এক মহিলাকে বলছেন – ‘বউ, চল আমরা দ্যাশে চইল্যা যাই! অরা আমাগো দুঃখ বুঝব না। পারবি না?’ আমি দেখা থামিয়ে জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছি বাইরের দিকে। পারবি না?’ – এই প্রশ্নটার সামনে নুয়ে পড়ছি। লজ্জায় মুখ লুকোতে ইচ্ছে করছে আমার। পারিনি তো আমিও! মনে পড়ছে দেশভাগের ছেষট্টি বছর পরের একটা দৃশ্য, যেখানে ঠাম্মার পাশে শুয়ে আছি আমি, আর ঠাম্মা আমার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলছে, ‘ভাই, আমায় দ্যাশের বাড়িত লইয়া চল একবার। পারবি না?’ আমি কোনও উত্তর দিইনি সেদিন। হেসে এড়িয়ে গেছি প্রসঙ্গ। শুধু, ঠাম্মা যেদিন মারা গেল, বুকের ওপর জড়ো করা হাতদুটোয় নিজের হাত রাখতে রাখতে এ-কথাই মনে পড়ছিল বারবার জীবনে একটাই ইচ্ছে জানিয়েছিল আমার কাছে, পারিনি, সেটাও পূরণ করতে পারিনি!

আজ মনে হয়, ঠাম্মার এই দীর্ঘ তিরানব্বই বছর বেঁচে থাকার শেষ দিকটায় এটুকু স্বপ্নই হয়তো জীবিত ছিল ছাব্বিশ বছর বয়সে যে দেশ ছেড়ে চলে এসেছে, সেখানে একবার অন্তত ফিরে যাবে, যাবেই...

(২)

সত্তর বছরের পুরনো বাসন
ঘষেমেজে চকচকে করেছি। এবার
ভোগ দেয়া যেতে পারে। রুষ্ট হবেন কিনা
জানা নেই
, তবে ভরসা, পুঁটুলি গুছিয়ে
তিনিও তো এসেছেন
, সেবারেই, একই ট্রেনে চেপে
                                               (কুলদেবতা)

শালগ্রাম শিলা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে যাওয়ার কিছু নিয়ম আছে। যিনি বহন করবেন, তাঁকে গরদ পরে, খালি পায়ে অতিক্রম করতে হবে পথ। বুকের কাছে ধারণ করতে হবে শিলা, এবং সম্পূর্ণ নির্বাক থাকতে হবে সে-সময়। অন্য কেউ যেন স্পর্শ না করতে পারে বহনকারীকে, খেয়াল রাখতে হবে সেদিকেও। শালগ্রামের বাহ্যিক পবিত্রতা রক্ষার জন্যই এই নিয়ম।

অনেকের বাড়িতেই কুলদেবতা হিসেবে অধিষ্ঠিত শালগ্রাম শিলা। কবিতাটি লেখার সময় আমার মন পড়েছিল সেইসব পরিবারের কাছে, যাঁরা দেশভাগের পর এপারে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। কেউ কেউ নিশ্চই ভরসা করে অন্য কোনও শরিকের কাছে নিত্যপূজার ভার দিয়ে আসতে পারেননি; কীভাবে শালগ্রামের মান রক্ষা করেছিলেন তাঁরা? ভিটেমাটি ছেড়ে এলেও, কুলদেবতাকে ত্যাগ করা অসম্ভব। ট্রেনে আসার সময় কোনও নিয়মই যে যথার্থ পালন করা যায়নি, তা বলাই বাহুল্য। মনে হয়েছিল, ভগবানও যখন পরিবারের অঙ্গ হয়ে ওঠেন, তিনি তো একই সঙ্গে ভক্তের সন্তানও! মানুষের ভিড়ে তিনিও মানুষ হয়ে উঠেছিলেন, দেশভাগ রেহাই দেয়নি তাঁকেও। তাই সমস্ত ছুঁৎমার্গের ঊর্ধ্বে গিয়ে উদ্বাস্তুর জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন যিনি, রুষ্ট হওয়া কি সত্যিই সাজে আর!

একা-একা হাঁটতে বেরোলে অবচেতন আমাকে মাঝেমাঝে নিয়ে যায় কলোনির দিকে। ঝিলের পাশে বসে থাকি চুপচাপ। বেশিরভাগ বাড়িই পাকা, মাঝেমধ্যে দুচারটে বেড়ার দেয়াল টালির ছাদ চোখে পড়ে এখনও। ঝিলের সিঁড়িতে কাপড় কাচতে আসা মহিলাদের গল্প শুনি। শুনতে পাই লাগোয়া বাড়ি থেকে পুরুষের হাঁক, বাচ্চাদের চেঁচামিচি। আমার মনে হয়, বেলঘরিয়া নয়, পূর্ববঙ্গের কোনও এলাকায় আছি যেন। শহুরে প্রভাব ওখানে পৌঁছোয়নি ততটা। নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় ওঁরা এখনও দেশের ভাষারই আশ্রয় নেন। ভেতর থেকে মায়ের ডাক শুনে, খেলতে থাকা সাত-আট বছরের শিশু যখন বলে ওঠে – ‘কও কিডা’, বড় শান্তি পাই আমি। নিশ্চিন্ত হই এখানে অন্তত আমাদের পরের প্রজন্মও ভুলে যাবে না ভাষাটুকুনইলে শহর গ্রাস করেছে পুরো মফঃস্বল, নিজস্বতা ধরে রাখতে কজনই বা চায় আর! এখানে বাঙালভাষা বলা লজ্জার। অথচ ওই ঝিলপাড়ে শনিমন্দিরের পাশে বসে থাকা প্রৌঢ়ার কিংবা চায়ের দোকানের বৃদ্ধটির চোখ বড় আপন লাগে আমার। দেশের সবটুকু মায়া, ছেড়ে আসার ব্যথা এখনও মুছে ফেলতে পারেননি তাঁরা। এই মায়াটুকুই তো সম্পদ! আর কীই বা আনতে পারা গেল!

                                কিছুই যায়নি আনা; লোহার ট্রাঙ্কে লেখা আজও
                                ঠিকানা মোমিনসিং
, ব্র্যাকেটে হোসেনপুর থানা

মাত্র কদিন আগে, হঠাৎই হাতে এল ফিনফিনে একটুকরো কাগজ। হলদে হয়ে এসেছে। আরও কিছু বছর পর ছুঁলেই গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে যাবে। সেই কাগজে লেখা অসম্পূর্ণ কিছু বর্ণনাপড়ে চমকে উঠলাম

রাজনীতির দাবা খেলায় বোড়ের চালে বলিষ্ঠ নেতৃত্ববিহীন বাঙ্গালী জাতির কপাল ভাঙ্গলো ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্টে। গান্ধী প্রভৃতি নেতাগণ অখণ্ড ভারত’ ‘অখণ্ড ভারতবলে চেঁচিয়ে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করে রাজত্ব করার লোভে লর্ড কার্জ্জনের নীতি কার্যকরী করার গোপন সর্ত্তে চরম আঘাত হানলো বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনে। বাঙ্গালী গৃহহীন ভিখারীর জাতিতে পরিণত হলো।

৩রা অক্টোবর চলে এলাম পশ্চিম বাঙ্গলায়। পিছনে ফেলে এলাম পৈতৃক বাড়িঘর, বিষয়-আশয়। সঙ্গে স্ত্রী আর দুই কন্যাবহু বাধা বিঘ্ন এলচাকুরী নিলাম, চাকুরী গেল। ব্যবসায়ে বহু প্রচেষ্টা নিলাম, সবই প্রায় বিফলে গেল। এমনি করে ভাড়া বাড়ীতে ঘুরে ঘুরে কাটলো দীর্ঘকাল। ১৯৫৫ সাল থেকে ইচ্ছা করতে লাগলাম নিজস্ব একটু বাস্তুভূমির জন্য...হঠাৎ ৫৬ সালের অক্টোবরের দিকে হয়ে পড়লাম গুরুতর অসুস্থ। ভাবনা এলো যদি হঠাৎ মরে যাই তো এরা দাঁড়াবে কোথায়! ভাড়া দিতে না পারলে পরদিনই তো বাড়ীওয়ালা দেবে তাড়িয়ে। কোথায় দাঁড়াবে এরা?...”

আপাত আবেগহীন এই বর্ণনার পিছনে অনুচ্চারিত যে কষ্ট, হাতের লেখাটি দেখে অনুমান করতে অসুবিধা হয়নি আমার। এই হাতের লেখা আমার চেনা। ছোটবেলা থেকেই দেখছি, মানুষটিকে না দেখলেও। তিনি, নগেন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য্য, আমার ঠাকুরদা...

(৩)

‘...অদ্য হইতে আপনারা উক্ত বিক্রীত সম্পত্তির ষোল আনাতে আমাদের সম্পূর্ণ স্বত্ত্বে স্বত্ত্ববান হইয়া বর্ত্তমান বর্গাদার হইতে ফসলাদি প্রাপ্তে অথবা তাহা নিজ দখলে নিয়া, কি অন্যত্র বর্গা পত্তনাদি করতঃ পুত্র-পৌত্রাদি ওয়ারিসান ও স্থলবর্ত্তীগণ ক্রমে যদৃচ্ছা ভোগ তছরূপ করতে রহেন।...

মুখোমুখি হতে না চাইলেও, কেন যে আমার হাতেই এসে পড়ে এসব! হয়তো মনের ভেতরে লুকিয়ে আছে জানার যে ইচ্ছে, সেই প্রবৃত্তিই আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, উদাস করে দেয় বারবার। নইলে কী প্রয়োজন ছিল, ঠাকুরদার মৃত্যুর পঁচিশ বছর পর পুরনো আলমারি ঘেঁটে এসব বের করে আনার! এই পঁচিশ বছরে কেউ ছুঁয়েও দ্যাখেনি যা, আমার হাতে এসে এমন করুণ হয়ে ওঠে কেন! ঠাকুরদার দুঃসম্পর্কের এক খুড়তুতো ভাই নিজস্ব জমি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যাবেন; ঠাকুরদা সেই জমি কিনে নিয়েছিলেন তৎকালীন নগদ ২৮০ টাকায়। সেই জমি ক্রয়ের দলিল আজ আমার সামনে। হাতে লেখা সেই দলিলের শেষে উল্লিখিত তারিখ ১৯৪০ সনের ২২ এপ্রিল। বয়ানে পুত্র-পৌত্রাদি ওয়ারিসান ও স্থলবর্ত্তীগণ ক্রমে যদৃচ্ছা ভোগ তছরূপ করতে রহেনপড়ে কেঁপে উঠেছি আমিদেশভাগের সাতবছর আগে, যখন কারোর কল্পনাতেও ছিল না সব ছেড়ে আসার কথা, সেই সময়ে লেখা পুত্র-পৌত্রাদিআমাকে আর আটকে রাখতে পারছে না। চুনখসা দেয়ালের দিকে অপলক তাকিয়ে ভেবে চলেছি শব্দবন্ধটির সততা সম্পর্কে। আমার জ্যেঠা-বাবা-কাকা প্রত্যেকেরই জন্ম এপার বাংলায়। বড় আর মেজো পিসি ছাড়া কেউই স্পর্শ পায়নি দেশের বাড়ির। অথচ এই শব্দবন্ধটি আমাকে দাঁড় করিয়ে দিল আদিগন্ত এক ধানজমির বুকেযদি দেশভাগ না হত, যদি আমরা এখনও থাকতাম ওখানে, কী হত? আলপথ কি সারাদিন হেঁটেও ফুরোত?

আজ, এই আড়াই কাঠার বাড়িতে বসে আমার কল্পনা থই না পেয়ে ফিরে এল নিজের কাছেই। মাত্র একটা তো নয়, এমন অসংখ্য জমির দলিল ঠাকুরদা নিয়ে এসেছিলেন সঙ্গে। আমি কোনওদিনই দেশের বাড়িতে আমাদের এত জমি ছিল ইত্যাদি নিয়ে ভাবিনি, কেননা জানতামই না এ-সম্পর্কে কিছু। ঠাম্মার মুখেও কিছুই শুনিনি এ-বিষয়ে। আমার ধারণায় খুব সাধারণ গৃহস্থ ছিলাম আমরা; কিন্তু দেশভাগের সত্তর বছর পর খুঁজে পাওয়া এইসব দলিল পড়তে পড়তে জমির পরিমাণ জেনে যদি হতবাক হয়ে যাই আজ, দোষ দেব না নিজেকে। হ্যাঁ, সামান্য আফশোস দিনকতক ঘুরে বেড়াবে মনের আনাচেকানাচে যদি এখনও... তবে আমল দেব না সে-চিন্তা। আমার বড় হয়ে ওঠার পিছনে কোনও প্রভাব ফেলেনি এইসব পরিসংখ্যান। যা নিয়ে আছি, তা আমার প্রয়োজনের চেয়েও বেশি।

আমি শুধু ভাবছি ঠাকুরদার কথা। দেশের বাড়ি ছেড়ে চলে আসার সময়, নিজের সমস্ত জমির দলিল এত গুছিয়ে নিয়ে এসেছিলেন কেন? কেনই বা যত্নে রেখে দিয়েছিলেন মৃত্যু অবধি? আনার সময়, একদিন ফিরে যাবেনই এমন ইচ্ছা কি লুকিয়ে ছিল মনে? পিসিদের মুখে শুনেছি, এখানে চলে আসার পর প্রথম-প্রথম ঠাকুরদা বলতেন, ‘নাহ্‌, দ্যাশে ফিইরা যাওনই লাগব!অথচ সামান্য কয়েক বছর পরেই যখন শুনলেন বাড়ি ও জমির কিছুই অবশিষ্ট নেই আর, দখল হয়ে গেছে পুরোটাই, ‘সব ফালাইয়া থইয়া আইয়া পড়লাম’ – তাঁর এই বক্তব্যে কতটা শূন্যদৃষ্টি মিশে, ভাবতে গেলে ঘোলাটে হয়ে আসে চারপাশ। আন্দাজ করতে পারি শুধু, ভাগ নেয়ার কোনও সাধ্যই নেই পুত্র-পৌত্রাদির।

ঠাকুরদার বাবা মারা গেছিলেন অল্প বয়সেই। কাকার তত্ত্বাবধানেই জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন দেশে। সেই কাকা, হরেন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য্য ছিলেন কিশোরগঞ্জ সদরে উকিল। আর আমাদের দেশের বাড়ি ছিল কিশোরগঞ্জেরই হোসেনপুর থানার বর্শিকুড়া গ্রামে। দেশভাগের পর ঠাকুরদা বাড়িতে তালা লাগিয়ে চলে এসেছিলেন কলকাতায়। হরেন্দ্র চন্দ্র কিন্তু আসেননি কোনওদিন। তিনি যখন ঠাকুরদাকে চিঠিতে ডাকছেন দেশে এসে জমি ও বসতবাড়ির বিক্রির ব্যবস্থা করতে, ঠাকুরদা তাঁর কাছে রেজিস্ট্রি করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন চাবি। জানিয়েছিলেন, ‘প্রাণে ধইরা কিছুতেই জমি-বাসা বিক্রি করতে পারবাম না আমি। আপনেই যা ভালা বোঝেন, ব্যবস্থা করেন।অথচ ডাইরির পাতায় তিনিই লিখেছেন পরবর্তীকালে – ‘বন্ধনই ব্যাধি।তবে দেশের বাড়ির বেলায় কেন মায়ায় জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি? কেন নিজেই উদ্যোগ নিতে পারেননি বিক্রির?

ছিন্নমূলছায়াছবির একটি চরিত্র ঠাকুরদার হয়ে উত্তর দিল আমার সমস্ত প্রশ্নের  – ‘বাস্তুভিটার টান রক্তে রক্তে, গিটায় গিটায়, বুঝলি রে!

(৪)

ঝাপসা চোখের কাছে
আর কিছু লুকোনোর নেই


বাঁধানো পুকুরঘাট, শিবমন্দির, খাল
              গতজন্মের ছবি যেন


দু'একটা চিঠি আসে
সাতপুরুষের ভিটে ক্রমে বেদখল হয়ে যায়


কুপার্স ক্যাম্প কি জানে
নারায়ণগঞ্জ থেকে
      একটি পালকি এসে থেমেছিল আমার বাসায়!
                                                 (উদ্বাস্তু)

কাকে খুঁজে বেরিয়েছিলাম লেখার সময়? কবিতার এই আমিটি কে? ঠাকুরদা, নাকি আমারই কোনও পূর্বজন্ম আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছেন এটি? নারায়ণগঞ্জই বা কেন? সে কি শুধু মাত্রার প্রয়োজনে? ঠাম্মার বাপের বাড়ি তো ছিল কিশোরগঞ্জেরই যশোদল গ্রামে! কোনওদিন কুপার্স ক্যাম্পেও থাকিনি আমরা। আর, শেষে পালকি এসে থামার দৃশ্যকল্প কোন প্রেমের কথা বলতে চাইল? ফেলে আসা কোনও সুখী জীবনের কি?

বহুদিন আগে লেখা এই কবিতা ফিরে পড়তে গিয়ে এইসব প্রশ্নই আমাকে নাড়া দিচ্ছে বারবার। সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে নামকরণ। উদ্বাস্তুনাম কেন দিয়েছিলাম, বুঝতে পারি। একজন উদ্বাস্তুর চোখে লেগে থাকা সুখস্মৃতি লেখাটার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল বলেই বোধহয়। কিন্তু এই সূত্র ধরে যে প্রশ্ন এল মনে, তা আরও রহস্যের। আমরা কি উদ্বাস্তু ছিলাম? আমাদের কি সত্যিই উদ্বাস্তু বলা যায়?

অভিধান বলছে, ‘নিজের বাস্তুভিটা বা বসতবাড়ি ত্যাগ করতে বাধ্যকিন্তু যতদূর শুনেছি, আমাদের প্রত্যক্ষভাবে তখনও বাধ্য করা হয়নি বাড়ি ছেড়ে যেতে। বরং প্রতিবেশী মুসলমানেরা ঠাকুরদাকে বলেছিলেন, মাস্টারবাবু, আমাদের ছাইড়া চইল্যা যাইতাসেন ক্যারে? যাইয়েন না। আমরা তো আছি! কুনু ভয় নাই!ঠাকুরদা ছিলেন হোসেনপুরের একটি প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার। সে-কারণে আশেপাশের প্রায় সবাই শ্রদ্ধা করত তাঁকে। তবু কেন চলে এলেন তিনি? পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও দেশের তৎকালীন গতিবিধির আশঙ্কাই কি তাঁকে বাধ্য করেছিল এপারে আসতে? আমার বিশ্বাস, স্ত্রী ও দুই কন্যার নিরাপত্তার চিন্তা এক্ষেত্রে একটি বড় কারণ। কেননা, চলে আসার বছর দুয়েকের মধ্যেই সব দখল হয়ে যাওয়ার খবর এসে পৌঁছেছিল এপারে।

তবু, ‘উদ্বাস্তুবলতে যে-দৃশ্য চোখে ভাসে আমাদের, সেই অবস্থার কবলে কোনওদিনই পড়তে হয়নি আমাদের পরিবারকে। গোয়ালন্দ হয়ে পার্বতীপুর থেকে ট্রেনে শিয়ালদা এসে ঠাকুরদা উঠেছিলেন টালিগঞ্জে মেজোভাইয়ের বাড়িতে, যিনি তখন কলকাতায় চাকুরিরত। টালিগঞ্জে কিছুদিন থেকে বিহারের চাইবাসায় পরিবার নিয়ে চলে যান তিনি, যেখানে ঠাম্মার ছোড়দা থাকতেন। চাইবাসায় বছর দুয়েক থাকার পর পরিবার নিয়ে চলে আসেন শ্রীরামপুরের এক জমিদারবাড়িতে ভাড়ায় থাকতে। মোট এগারো ঘর ভাড়াটে ছিলেন সেখানে, পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন এলাকার। ঠিকানাও খুঁজে পেয়েছি পুরনো একটি চিঠিতে১৮/১৮এ, রাজা কে এল গোস্বামী স্ট্রিট, শ্রীরামপুর। পিসিদের স্মৃতি থেকে সেই দিনগুলোর কথা টুকরো টুকরো সঞ্চয় করেছি এতদিন। বেলঘরিয়ায় যতীনদাস নগর কলোনিতে সরকার থেকে জমি বিলি করা হচ্ছে শুনে অন্যান্য ভাড়াটেরা শ্রীরামপুর থেকে নৌকোয় গঙ্গা পেরিয়ে চলে যাচ্ছেন ব্যারাকপুরের ধোবিঘাটের দিকে এ-দৃশ্যের বর্ণনা শুনেছি তাদের মুখে। শুনেছি, ঠাকুরদা কোনওদিন কলোনিতে থাকতে চাননি বলেই ভাড়াবাড়িতে বদলে-বদলে কাটিয়েছেন অনেকটা সময়। শ্রীরামপুর থেকে শ্যামবাজার, সেখান থেকে বেলঘরিয়ার চারটে বাড়িতে ভাড়ায় থেকে অবশেষে ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে সাড়ে ৩২৫০ টাকায় সাড়ে চার কাঠা জমি কেনেন, বেলঘরিয়াতেইমাটির ভিটের ওপর বেড়ার দেওয়াল আর টালির ছাদ তৈরি হয় এপারের নিজস্ব বসত। আর আমি, সেই ঘটনার ষাট বছর পর, ’৫৯ সালে ঠাকুরদারই তৈরি পাকা বাড়িতে বসে সামান্য কটা শব্দ ছাড়া কিছুই বুনতে পারছি না আর। চোখে ভাসছে ছোটবেলায় দেখা সেই বেড়ার দেওয়াল টালির ছাদের ঘর, আমার ছয়-সাত বছর বয়সে যা ভেঙে ফেলা হয়েছিল। মনে পড়ছে, উঠোনে ছোটাছুটি করতে গিয়ে একবার পায়ে বেলকাঁটা ফুটে যাওয়ায় সেই ঘরের দালানে বসে চিৎকার করে কেঁদেছিলাম। মা ছুটে এসেছিল। ছুটে এসেছিল ঠাম্মা।

ছবিতে দেখা ঠাকুরদার সামনে আজও কি নত হতে পেরেছি যথাযথ? কলোনিতে থাকবেন না এই জেদ বজায় রেখেছিলেন যিনি শেষ পর্যন্ত, স্ত্রী আর সন্তানদের কথা ভেবে যিনি দীর্ঘদিন প্রাণান্ত খেটেছিলেন, চাকরির পাশাপাশি অতিরিক্ত রোজগারের প্রয়োজনে নিজের ব্যবসাও খুলেছিলেন যিনি প্রৌঢ় বয়সে সেই ভদ্রলোকের লড়াইয়ের পাশাপাশি পূর্ববঙ্গে থাকাকালীন তাঁরই স্বচ্ছ্বলতার কথা মনে পড়লে, নাহ্‌, কাউকে দোষ দিই না আর। শুধু বেলঘরিয়ার এই বাড়িটাকেই আপ্রাণ জড়িয়ে রাখি বুকের ভিতর এটাই আমার দেশ, এটাই আমার সর্বস্ব...

(৫)






- আমাগো দ্যাশটা নাকি দুইভাগ হইব? একভাগ যাইব... কী জানি কয়...
- পাগল নাকি তুমরা! এ কি তুমার মাচানের লাউ না কুমড়া যে এক কোপে দুইভাগ করলেই হইল!

গ্রামের লোকেদের কথোপকথন। ছায়াছবির হাত ধরে যাদের কাছে পৌঁছে গেছি আমি। দেখছি, কী অদ্ভুত সারল্য তাঁদের চোখেমুখে। দেশভাগ কী জিনিস, জানে না ওরা। জানে না, প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেখানে জীবন কাটিয়েছে, সেই ঠাঁই হারালে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। কী এমন হল, যাতে নিশ্চিন্ত দিনগুলো পলকে উবে যেতে বসেছে! ভারত-পাকিস্তান বোঝে না কেউই। চেনে শুধু নিজের গ্রামটুকু। ওটাই ওদের দেশ। বড়জোর জেলার নামে পরিচয় দেয় নিজেদের। এর থেকে বড় গণ্ডির প্রয়োজন হয়নি কোনওদিন। আজ হঠাৎ প্রাণ বাঁচাতে সব ছেড়ে বহুদূরে একটা অচেনা জায়গায় গিয়ে পড়তে হবে, যেখানে থাকা-খাওয়ার কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। এতদিন একসঙ্গে পাশাপাশি থেকেছে, এটা কি হিন্দুদেরও দেশ নয়! দেশের আবার ধর্ম হয় নাকি!

পরবর্তী ঘটনা সবারই জানাবিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের মুখে নিজেও শুনেছি সেসব। শিয়ালদা স্টেশনে পা ফেলার জায়গা নেই, থিকথিক করছে মানুষ। পুব বাংলা থেকে আসা প্রতিটা ট্রেন আরও মানুষ নিয়ে আসছে রোজ। হাওড়ায় যে ট্রেন এসে পৌঁছোচ্ছে, জুতো আর রক্তে ভর্তি। পিসিদের মুখে শুনেছি, আমাদের পরিবার যে ট্রেনে শিয়ালদায় এসে নেমেছিল, সেই ট্রেনেই একজন ছিলেন, যিনি নিজের কোপ-পড়া হাত চেপে ধরে কাটিয়েছিলেন সারাটা পথ। রেললাইনের ধারে-ধারে অসংখ্য ঝুপড়ি, মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই। সরকার থেকে ব্যবস্থা করা হল দলে-দলে আন্দামান আর দণ্ডকারণ্যে পাঠানোর। রিফিউজি ক্যাম্প গড়ে উঠল জায়গায়-জায়গায়। কোথাও প্রতিকূল এলাকায় জল-জঙ্গল কেটে মানুষ কলোনি বানাল, কোথাও বা সম্মুখীন হল সেইসব জমির মালিকের আক্রমণের। নিশ্চিন্দি নেই এতটুকু।

এত বছর পর, সেই দিনগুলো ভাবনায় কতটুকুই বা ধরা পড়ে! ঠাকুরদার সামান্য সংস্থান ছিল বলে আমাদের পরিণতি হয়নি অমন। কিন্তু যাঁদের ছিল না কিছুই, কীভাবে লড়াই করে বেঁচে ছিলেন সম্পূর্ণ অচেনা পরিবেশে উল্লেখ দেখি না আজ আর। পূর্ববঙ্গের মানুষদের নিয়ে যখন ব্যঙ্গ শুনি, প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা নিয়ে যখন হাসাহাসি করে কেউ কেউ, এসব ঘটনা জানাতে বড় ইচ্ছে করে। আমাদেরও কত আত্মীয় বিভিন্ন ক্যাম্পে আর কলোনিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কী কঠিন পরিস্থিতি হলে দেশের বাড়ির সব সমৃদ্ধি ছেড়ে কপর্দকশূন্য হয়ে আরেক জায়গায় এসে নতুন করে শুরু করতে হয় সব যাদের পরিবার মুখোমুখি হয়নি এর, বুঝতে পারবে না। ক্ষমা করে দিই। প্রার্থনা করি, এমন দুর্দিন যেন আর কখনও না আসে কারোর জীবনে।

যে প্রার্থনা আজ ধ্বনিত হচ্ছে আমার ভিতরে, সত্তর বছর আগে একই প্রার্থনা বেজেছিল সেইসব ভুক্তভোগী মানুষের মনেও। সফল হয়নি সে-প্রার্থনা। চব্বিশ বছর পর, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য মানুষ ভিটে হারালেন আবার। যাঁরা জেদ করে দেশ ছেড়ে আসেননি ৪৭-এ, ধর্মীয় হিংসার কাছে এবার হেরে গেলেন তাঁরা। আবার রিফিউজি ক্যাম্প, আবার উদ্বাস্তু কলোনি। আমার পরিচিত অনেকের পরিবারই সেই সময় এসেছিলেন এপারেঠাকুরদার এক দুঃসম্পর্কের খুড়তুতো বোন, যমুনা, রাজাকারদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে পনেরো দিন লুকিয়ে ছিলেন পানাপুকুরে, ছেলেকে নিয়েতারপর, কোনওক্রমে দর্শনা পেরিয়ে রানাঘাটে পৌঁছে কারও কাছে খবর পান, বেলঘরিয়ায় তাঁর দাদা থাকেন। আমাদের বাড়িতে এসে ওঠেন তাঁরাদিনদুয়েক এখানে কাটিয়ে চলে যান অন্য কোথাও। এসব শুনতে শুনতে আমার স্নায়ু নতুন করে উত্তেজিত হয় না আর। যেমন হয় না যমুনা দেবীর সেই ছেলে আমাদের বাড়িতে খেতে বসে সামান্য ভাত আর বাচা মাছের ঝোল পেয়ে আহা রে, কতদিন পর বাচা মাছ খাইতাসিবলে উঠেছিলেন আনন্দে, তা শুনেও। হোক পরোক্ষ, এত স্মৃতির ভার বইতে বইতে আমি ক্লান্ত। তবু প্রস্তুত রাখি নিজেকে, কেননা তৃতীয় প্রজন্ম হিসেবে ইতিহাস বহনের দায় খানিক বর্তায় আমার ওপরেও।

আমার ক্লান্তি আরাম পেতে ফিরে যায় সেই খাতার কাছে, যেখানে ঠাকুরদা লিখে রেখেছেন বিক্ষিপ্ত কিছু কথাতাঁর কলম আমার মনে ছবি তৈরি করে, দর্শক হয়ে উঠি আমি। আঙুল বোলাই অক্ষরের শরীরে

দেশে অর্থাৎ বর্শিকুড়ায় (ময়মনসিংহ কিশোরগঞ্জে) আমাদের পাকা বাড়ী ছিল না। ১০।২০টা গ্রামের মধ্যে এক-আধখানা পাকা বাড়ী, বাকি সব কাঠ বা বাঁশের খুঁটির উপর ছন বা টিনের চাল; বাঁশের চটা, কাঠ বা টিনের বেড়া অথবা পাট শোলার বা ধারির বেড়া; মাটির ভিট।
...ইদানীন্তন কালে এতদ্দেশে পাকা বাড়ীই বেশীর ভাগ। কারণ, মানুষ ধনবান বলিয়া নহে। মিল কারখানার কল্যাণে শ্রমজীবী ঘরামি দুর্লভ বিধায় কাঁচা ঘরের পুনঃপৌনিক সংস্কার অসম্ভব বলিয়াই মানুষ মরিবাঁচি করিয়া কোন মতে একবার পাকা ঘর করিয়া লইয়াই স্বস্তি অনুভব করে।...

আর, সমস্ত তরঙ্গ একেবারে শান্ত হয়ে এলে, চোখের সামনে মেলে ধরি সংগ্রহে থাকা একটি তালিকাইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির ভাড়া ও সময় নিরূপণের। যে-আমলে শিয়ালদহ উল্লিখিত হত কলিকাতা স্টেশন নামে, যখন কলিকাতা থেকে রোজ সকাল ৭.৪০ মিনিটে ট্রেন ছেড়ে কুষ্টিয়ায় পৌঁছোত দুপুর ১২.৪৫-এ, তখনকার। এই তালিকা আমাকে অন্যমনস্ক করে দেয় বারবার। দেশভাগ আসলে ভ্রম, এক্ষুনি দুঃস্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠব সবাই এমন এক অনুভূতি খেলা করে নিঃশ্বাসে। কেননা, কলিকাতা থেকে কুষ্টিয়া যাওয়ার পথে যেসব স্টেশন ছুঁত ট্রেনটি, তালিকার সেই নামগুলি থেকে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে আজন্ম-পরিচিত একটি শব্দ – ‘বেলঘরিয়া’...


---------------------------

‘...তোমার-আমার শহর আলাদা। সবচেয়ে বড় কথা, দেশ আলাদা। আমি কলকাতায় বসে যখন তোমায় ভাবি, তোমার হিসেবে আধঘণ্টা সরে-সরে যাও। তাই বুঝি কোনওদিন সময় মেলেনি আমাদের।...

দীর্ঘ একটা চিঠির মধ্যে থেকে সামান্য কিছু লাইন কীই বা গুরুত্ব পেতে পারে! কিন্তু আজ, এতদিন পর প্রতিলিপির কাছে ফিরে গিয়ে এই ধারণাই উঁকি দিচ্ছে বারবার, মূল প্রাণটুকু লুকিয়ে আছে ওপরের লাইনগুলোতেই। যে-চিঠি লিখেছিলাম উত্তর পাওয়ার আশা না-করেই, তার প্রতিটা স্পন্দন আমাকে বাধ্য করছে সেদিনের অসহায়তার কথা ভাবতে। আজকের প্রজন্মের ওপর দেশভাগ সত্যিই কোনও প্রভাব ফেলে কিনা এই প্রশ্নের জবাব হিসেবে নিজেকে দাখিল করতে এতটুকু কুণ্ঠা নেই আমার।

ভাষা তো সীমানা মানে না! যে-ভাষা বহন করে এনেছিলেন আমার পূর্বপুরুষ, তারপর হয়তো সময়ের নিয়মে অনেক বদল হয়েছে চলনের, কিন্তু আমার স্বভাবে আটকে আছে সত্তর বছরের পুরনো ময়মনসিংহের সেই ডায়লেক্টই। বলেছিল, ‘কলকাতার ভাষায় তোমারে কেমন পর-পর লাগে।আমি সেই দূরত্ব মুছে ফেলার চেষ্টা করি আজও। উচ্চারণ দিয়ে ছুঁতে চাই না-দেখা বাড়িটিকে। উঁহু, বাড়ি নয়, বাসা। বাসা হল যেখানে সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকে। আর বাড়ি হল একটা বিল্ডিং, সেখানে আপনজনেরাও কেমন পর হয়ে যায়’ – তার এই উপলব্ধির সামনে নত হই। নতি ছাড়া মুগ্ধতা আসে না। আর, মুগ্ধতা না এলে, টান প্রবল হবে কী করে!

আমাদের হোসেনপুরের বুকে বয়ে যেত দুটো নদী ব্রহ্মপুত্র আর নরসুন্দা। গঙ্গার ছলাৎছল আমাকে তাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়। জলের এই ভাব নিয়ে ফিরে আসি ডেরায়আমি কোনওদিন বাংলাদেশ যাইনি। মনে পড়ে, ইছামতীর বুকে দাঁড়ে-টানা নৌকোয় ভেসে বেড়ানোর কথা। মাঝি আঙুল তুলে দেখিয়েছিল ওই যে বাংলাদেশ! গাছপালার ফাঁকে-ফাঁকে একটা হাঁটাপথ ঢুকে গেছে ভিতরে টালির ছাউনি দেয়া বাসায় একটা শাড়ি জল ঝরাচ্ছে টুপটাপ আমার দুচোখ বুভুক্ষুর মতো শুষে নিয়েছিল সেসব দৃশ্য। আবার, পেট্রাপোলে দাঁড়িয়ে যেদিন দেখেছি কী অনায়াসেই না সবাই পৌঁছে যাচ্ছে ওপারে, দূরের একটি গাছ চোখ দিয়ে ছোঁওয়া ছাড়া কিছুই পারিনি আমি। ফেরার সময় আলাপ হয়েছিল বাংলাদেশের তিনজন মানুষের সঙ্গে। বেড়াতে এসেছেনবললেন, ‘আমরা তো ঠিক ওপারেই থাকি, যশোরেদুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে বেরিয়েছি একেবারে, হেঁটেই বর্ডারে এলাম, পার হয়ে গেলাম। কলকাতা বেড়াতে যাচ্ছি আজ। কালই ফিরে যাব। সামনেই আবার আসব দীঘায়।ওঁদের কথা শুনতে শুনতে বড় তুচ্ছ মনে হয়েছিল এই সীমানা। যেন এতই সহজ, তবু বেদনায় নিজ হাতে রাখি/ মৃত্যুর প্রস্তর, যাতে কাউকে না ভালোবেসে ফেলি। বাংলা ওঁদের কাছে ভাঙেনি। ভাঙলেও তার পরোয়া করেন না ওঁরা। এক আমিই সীমান্তের সামনে দাঁড়িয়ে বিহ্বল হয়ে যাই, দুপা এগোতে চাইলেও অন্যের অনুমতি প্রয়োজন, ভেবে।

তবু, পাইনি কি! ঠাম্মার ফর্সা হাত যতবারই ধান-দূর্বা ছুঁইয়েছে মাথায়, আর আমি কপাল ঠেকিয়েছি পায়ে বিশ্বাস করি, সে-প্রণাম দেশের উদ্দেশ্যেও আঁকা হয়েছিল। কাঁটাতার আমায় কাঁদিয়েছে একদিন। একদিন সেই কাঁটাতারের পাশ দিয়েই আমি প্রবেশ করব পূর্ববঙ্গে। বর্শিকুড়ায় যাব। যাব চিঠির সেই মালকিনের কাছেও। আমার বাঙালভাষার যা-কিছু অপূর্ণতা, তার কোলে ঢেলে দিয়ে বলব শেখাও! ঠাম্মার যোগ্য উত্তরসূরী তুমি। আমাকে মানুষ করবে না?

খামের ভেতর আমিও তখন আলো
পাঠিয়ে দেখব
, অক্ষর ফুটিফুটি
তোমার সীমানা আমার সীমানা মিলে
বাংলাভাগের ইতিহাস ভুলে যাব


আমরা দুজন, একবার চিঠি পেলে
দেখে নিও
, উপমহাদেশ পাল্টাব!

ততদিন বরং এটুকুই থাক। চাওয়া অথচ না-পারার এই টানাপোড়েন আর কীই বা দিতে পারে, অপেক্ষা ছাড়া?




Comments