অশরীরী - অবিন সেন
|অশরীরী
অবিন সেন
এক এক জন মানুষের দুঃখ এক এক রকমের হয়। জামরুল গাছের ছায়ার
নীলিমায় দাঁড়িয়ে নিজেকে খুব দুঃখী আর একা লাগছিল। পুরানো বাড়ির দেওয়ালে
আগাছা আর শ্যাওলার উপর দুপুরের রোদে একাকী এক কাঠবিড়ালি কিছুটা ঝিমিয়ে নিচ্ছে। দূরে কোথাও একটা পাখি
ডেকে উঠল। কি পাখি,
আমি তার নাম জানিনা। কিন্তু প্রতিদিন দুপুর বেলা এমনি করে পাখিটি আমাকে ডাকে। আমি প্রাচীরের গা ঘেঁসে
বন বাদাড় আগাছা পেরিয়ে পুকুরের পাশে চলে আসি। পুকুরের ঘাট থেকে ওপারে
মঞ্চি বাগদির চালাঘর দেখা যায়। চালার সামনে বাখারির বেড়া। কিছু কাঠ কুটো সামনে
জড়ো করা। তবু, এপারের ঘাট থেকে মঞ্চির চালাঘরের দাওয়া পরিষ্কার দেখা যায়। দেখা যায় দাওয়ায় বসে
মঞ্চি তার আড়াই বছরের ছেলেকে স্তন পান করাচ্ছে। তার আর একটা বুক খোলা। মঞ্চির সে দিকে খেয়াল
নেই। কিংবা আছে ! বাচ্চাটি এক হাত দিয়ে সেই স্তন নিয়ে খেলা করছে। পুকুরের ধারে এক মরা
গুল্মের উপর একটি মাছরাঙা বসেছিল। আমি মুখ দিয়ে হুস করে একটা বখাটে শব্দ করলাম। মাছরাঙাটি উড়ে গেল। হয়ত মঞ্চিকে সচকিত
করাই আমার “হুস” নামক শব্দের বাচালতা ছিল। কিন্তু মঞ্চির সে দিকে
কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
পুকুরের পাড় থেকে ফিরে, আমি বাগানে চলে আসি। ভুতের মতো অপরিষ্কার
গাছ ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে গাছগুলো গুনে দেখার আমার সাধ হয়! এবং রোজ রোজ আমি
আশ্চর্য হয়ে যাই। দেখি ভোজবাজির মতো দু-একটা গাছ কোথাও যেন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। একি আমার ভ্রম? এই কথা ভাবতে
ভাবতে আমি শুনতে পাই পুকুর ঘাটে এসে সুরমা বাসন মেজে নিচ্ছে। বাসনে বাসনে ঠোক্কর
লাগার শব্দে আমি সচকিত হয়ে আবার পুকুরের ঘাটে
ফিরে যাই।
সুরমা বাসন মাজছে আর বাতাসের সঙ্গে কথা বলছে। সে সারাদিন এমন হাওয়ার
সঙ্গে কথা বলে। সে একবার কথা বলছে, তখন তার বাসন মাজার হাত থেমে যাচ্ছে। তার পর সে উৎকর্ণ হয়ে
হাওয়ার থেকে উত্তরের অপেক্ষা করছে। তখন তার ক্রুদ্ধ হাত ঘস ঘস করে বাসন ঘষছে। আবার হাত থামিয়ে সে
প্রত্যুত্তর করছে। এভাবে অনবরত এক অলীক কথোপকথন চলতে থাকে।
আমি ঘাটে এসে বসি। বসে বসে সুরমার মূকাভিনয় দেখি যেন। এই ভাবে দীর্ঘ সময়
অতিবাহিত হয়ে যায়। সুরমার বাসন মাজা চলতে থাকা। দুপুরের রোদ মাঝ আকাশ
পেরিয়ে পশ্চিমের তাল তমালের সারির পিছনে ঢলে পড়ে। মঞ্চি ছেলেকে দুধ খাইয়ে, একটা চাটাই
পেতে বারান্দায় শুইয়ে দেয়। তার পাশে সেও কিছুক্ষণ গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে। মঞ্চি বিধবা। সে সধবাও ছিল না বোধহয়
কোনোদিন। আমরা তার বর কে কোনোদিন দেখিনি। সে কপালে সিঁদুর দিত, শাঁখা পলা
পরত। সে বলত তার বর কোথাও বিদেশ বিভূঁইয়ে কাজে গেছে। তবে তার বর আর কোনোদিন
ফেরেনি। একদিন শাঁখা পলা ভেঙে সিঁদুর মুছে মঞ্চি নিজেই বিধবা হল। তার পরে মঞ্চির ঘরে
কত লোক এল গেল। মঞ্চির ছেলে হল। ছেলেটি বেশ। সুন্দর ফুট ফুটে। মঞ্চি আমাদের ঘর গেরস্থালীর অনেক কাজ করে দেয়। পুকুরের ওপারে আমাদের
জমিতেই মঞ্চির ঘর। কতবার ইচ্ছা হয়েছে তাকে বলি
মঞ্চি তোর ছেলেকে আমাদের দিবি?
মঞ্চি হয়ত রাজি হবে না।
কিন্তু নীলিমা নিমরাজি হয়েছে বার বার।
কার না কার ছেলে, ঠিক ঠিকানা নেই! ওসব আমাদের ঘরে মানাবে না।
তবু, মাঝে মাঝে মঞ্চির ছেলের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে আমি তাকিয়ে থাকি। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ির
বারান্দায় ছেলেটিকে বসিয়ে রেখে মঞ্চি কাজ করে। ছেলেটি টল-মলে পায়ে
সারা বারান্দায় দৌড়ে বেড়ায়। চিৎকার করে । হাসে।
আমি চমকে চমকে উঠি। নীলিমা চমকে চমকে ওঠে। বলে
যাও তো একটু বকে দিয়ে এসো।
কথাটা বলে নীলিমা যেন আমাকেই ধমক দেয়। আমার হাত থেকে চুরুটের
ছাই ঝরে পড়ে যায়। আমি ঘর থেকে দৌড়ে বারান্দায় চলে আসি। বাচ্চাটি আমাকে দেখে
আরও হেসে ওঠে। খিল খিল করে সেই হাসি বারান্দার দেওয়ালে, জানালায়, কপাটে ধাক্কা
খেয়ে যেন প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। হাসির আঘাত লেগে জানালার ভারি পর্দা যেন আরো জোরে দুলে ওঠে।
আমি বিস্মিত হয়ে সেই সব দেখি। আমারও হাসি পায়। আমি নীলিমার কথা ভুলে যাই।
ইচ্ছা হয়,
মঞ্চিকে বলি
কি রে,
ছেলেটিকে আমায় দিবি?
নীলিমার কথা ভেবে আমি থমকে যাই। থমকে দাঁড়িয়ে থাকি।
বহু বছর ধরে সুরমাকে আমি একই চেহারায় দেখেছি। শীর্ণ, কঙ্কালসার
হাত, পা। মাথার অর্ধেক চুল পাকা। অথচ কতই বা বয়স হবে
তার ! আমার থেকে বছর দুয়েকের ছোট। আমার এক দূর সম্পর্কের বোন সে। স্বামী পরিত্যক্তা
হয়ে ভাসতে ভাসতে সে আমাদের বাড়ি এসে জুটেছিল। তখন বাবা বেঁচে। আমাদের বাড়ির ফাই ফরমাস
খাটতে খাটতে সে যেন আমদের বাড়ির ঝি হয়ে গিয়েছে। তার প্রতি আমাদের অবহেলার
শেষ নেই। এ কথা তাকে একবার বলতে গিয়ে দিখেছি, তার দু চোখ
জলে ভরে আসে। কৃতজ্ঞতার দাম চোকাতে চোকাতে সে যেন দিনে দিনে এই বাড়ির অজস্র
ভুতের মতো এক ভুতে পরিণত হয়ে গিয়েছে। এই বাড়ির ইট কাঠ পাথর আর দুঃসময়ের ভিতর চাপা পড়ে গিয়েছে। সে যখন হেঁটে চলে বেড়ায়
তখন তার পায়ের কোনো শব্দ আমি শুনতে পাই না। বৈদেহীর মতো,
বাতাসের মতো তার চলাচল। সারাদিন সে অশরীরীদের
সঙ্গে কথা বলে বেড়ায়। সে ভাবে তার চারপাশে যারা আছে তারা সবাই মৃত। কারও কোনো নশ্বর শরীর
নেই।
এই যে আমি যেমন এই মুহূর্তে তার সামনে বসে আছি। তার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ
নেই। আমি যে বসে বসে তার নির্বাক চলচিত্ত দেখছি সে দিকে যেন তার কোনো
খেয়াল নেই। সে নিজের মনে কথা বলতে বলতে বাসন মাজা শেষ করে উঠে চলে গেল।
ততক্ষণে সূর্যের আলো আরো পশ্চিমে ঢলে পড়ে নিস্তেজ ও ম্যাড়ম্যাড়ে
হয়ে গিয়েছে। চতুর্দিকের গাছের ছায়ায় পুকুরের জল কালো আর ঘোলাটে। আমি সেই ঘোলা জলে পা
ডুবিয়ে বসে আছি। চারপাশ যেন ভীষণ থম থমে। সেই নীরবতা ফুঁড়ে মাঝে
মাঝে দু একটা পাখি ডেকে উঠছে।
এবার আমাকে উঠতে হবে। হয়ত নীলিমা ঘুম ভেঙে বিছানায় অসহায়ের মতো পড়ে আছে। তাকে ধরে ধরে পিঠের
পিছনে বালিশ দিয়ে, বিছানার একপাশে বসিয়ে দিতে হবে। তার ওষুধ খাবার সময়
হয়ে গিয়েছে। তাকে ওষুধ খাইয়ে দিতে হবে। সে নিজে আজকাল কোনো
কাজই করতে পারে না। কিন্তু আমার দুই পা পুকুরের কালো কুৎসিত জলের মধ্যে যেন প্রোথিত
হয়ে গিয়েছে। আমি কিছুতেই জল থেকে সেই পা তুলতে পারছি না। আমি যেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত
এক গাছ হয়ে গিয়েছি। চারপাশের গাছগুলো যেন ঘাড় নুইয়ে আমাকে দেখছে আর ভীষণ মজা পেয়ে
গিয়েছে এমন ভঙ্গিমায় হেসে উঠছে। তাদের সেই হাসির চিৎকার যেন আমার কানের পর্দা ফাটিয়ে আমাকে অস্থির
করে দিচ্ছে। আমি জানি,
পৃথিবীর আর কেউ সে হাসি হয়ত শুনতে পাচ্ছে না কিন্তু আমার ইচ্ছা
করছিল সেই হাসির ধিক্কারে আমি উঠে পালিয়ে যাব। কিন্তু আমায় এক দল
অশরীরী যেন ঘাড় ধরে আমাকে নিশ্চল সেখানে বসিয়ে রেখেছে।
কিন্তু এই যাত্রায় মঞ্চি আমাকে বাঁচিয়ে দিল। সে হয়ত আমাদের ঘাটে
গা ধুতে এসেছিল। তার সরু টর্চের আলো আমার গায়ে পড়তে সে চমকে উঠেছিল। সে সামলে নিল নিজেকে। এমন অন্ধকারে মানুষ
দেখা, তার অভ্যাস আছে। সে আমাকে দেখে চিনতে পেরে বলল
ছোড়দা তুমি এখনো এখানে বসে আছো?
সে যেন অবাক হয়ে গিয়েছে!
আমি তার কথার উত্তর না দিয়ে বললাম
তোর কাজ কম্ম হয়ে গেছে? তোর বউদি উঠেছে দেখলি?
সেও আমার কথার উত্তর দিল না
বলল
আমি তো জানতাম তুমি বৌদির ঘরে আছো। আমি যেন বৌদির ঘরে
তোমার গলার আওয়াজ পেলুম। বৌদির গলার আওয়াজ! বৌদি তবে কার সঙ্গে কথা বলছিল?
আমিও অবাক হয়ে গেলাম। নীলিমা কার সঙ্গে কথা বলছিল? তবে কি আমাদের বাড়ির কোনো এক অশরীরী এসেছিল
?
আমার বুকের মধ্যে এক ত্বরা ধাক্কা মারছিল। ইচ্ছা করছিল আমি এখুনি
দৌড়ে নীলিমার কাছে চলে যাই। আমি এবার জল থেকে আমার পা সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। অনুভব করলাম গাছগুলো
সব এবার নিশ্চুপ। বললাম
মঞ্চি তোর একা একা অন্ধকারে গা ধুতে ভয় করবে না ? আমি দাঁড়াব
?
সে যেন অন্ধকারে মুখ ঢেকে হাসল।
সে যেন আমার শয়তানি টের পেয়ে গিয়েছে। আর সেটা টের পেয়ে সে
দারুণ আমোদ পেয়েছে। মুখে বলল
তুমি যাও ছোড়দা। অন্ধকারে আমার ভয় করে না।
কিন্তু আমি শুনলাম। সে বলল
তুমি,
থাকলেই বরং বেশী ভয় !
আমি আর দাঁড়ালাম না। আমাদের বাড়িটা তিন পুরুষের পুরানো। এক কালে দেউটিতে দারোয়ান
থাকত। পূজা পার্বণে নহবত বসত। শেষবার নহবত বসেছিল
আমাদের বিয়ের সময়। তা প্রায় বিশ বছর হয়ে গেল। তার পরে শুধু মৃত্যু
মিছিল দেখেছে এই বাড়ি। যারা মানুষ ছিল তারা সবাই এখন ছবি।
সারা বাড়ি অন্ধকার । নীচের তলার একদিকের বারান্দায় একটা আলো জ্বলছে। নিচের তলাতেই আমরা
থাকি। দো-তলা,
তে-তলা চাবি-বন্ধ পড়ে আছে। দু বছর আগে যে দুর্ঘটনা
ঘটে গেল নীলিমার সঙ্গে তার পরে আমি আর একতলা ছেড়ে উপর তলায় পা বাড়াইনি।
নীলিমার ঘরে আলো জ্বলেনি। নীলিমা কি অন্ধকারেই
কথা বলছিল ? অবাক লাগল! আলো জ্বালতে দেখলাম সে এখনো ঘুমিয়ে আছে। আমি বিছানায় তার পাশে
গিয়ে বসলাম। তাকে জাগিয়ে তুলতে আমার ইচ্ছা করছিল না। তা ছাড়া আমাদের দু
জনেরই জেগে ওঠবার কোনো ত্বরা নেই। না। কথাটা ভুল বললাম। নীলিমার জেগে ওঠবার কোনো ত্বরা নেই আর আমার ঘুমিয়ে পড়বার।
প্রায় দু বছর আমার ঘুম হয়নি। আমি জানি না এতদিন
না ঘুমিয়ে একজন মানুষ কি ভাবে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু আমার চোখে ঘুম
আসে না। কিংবা হতে পারে আমি ঘুমিয়ে পড়ি, অথচ আমি
জানতে পারি না। ঘুম আর জাগরণের মাঝের সীমানাটা হয়ত মুছে গিয়েছে আমার কাছে।
আমি জানি আমাদের এই বাড়িটা এক মৃত্যু বাড়িতে পরিণত হয়ে গিয়েছে। এই যে আমরা তিনজন বেঁচে
আছি। আদতে আমরা কি বেঁচে আছি ? আমার ভীষণ সন্দেহ জাগে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের
এই বাড়িতে আমাদের সঙ্গে আরো অনেকে বসবাস করে। তারা আমাদের সঙ্গে
হাসছে, খেলছে,
কথা বলছে। এই যেমন আমি যখন ছিলাম না তখন নিশ্চয়ই কেউ এসে নীলিমার সঙ্গে
গল্প করে গেছে। তাকে ওষুধ খাইয়ে, বিছানা পরিপাটি করে দিয়ে, ঘরের আলো
নিভিয়ে দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে গেছে। তা না হলে কি ভাবে নীলিমা এখনো ঘুমিয়ে আছে! বিকেলের পরেই তো
তার ঘুম ভেঙে যায়। সে তো চলৎশক্তিহীন। সে নিজের কোনো কাজই নিজে করতে পারে না। তার সব কাজই আমাকে
করে দিতে হয়ে। অথচ আমি মাঝে মাঝে বুঝতে পারি আমি ছাড়াও অন্য কেউ তার কাজ করে
দিয়ে গিয়েছে। আমি ছাড়াও আরো কেউ তাকে মায়া মমতায় ভরিয়ে রেখেছে। কিন্তু সে কে আমি জানি
না।
আমার ইচ্ছা হল ধাক্কা মেরে নীলিমাকে জাগিয়ে দিই । জাগিয়ে দিয়ে জেনে নিই
কে তাকে এমন করে মায়ায় আদরে ভরিয়ে রেখেছে।
আমি বাইরে বেরিয়ে চিৎকার করে ডাকলাম
সুরমা,
সুরমা।
কিন্তু সুরমা কোনো সাড়া দিল না।
আমি দৌড়ে রান্না ঘরের কাছে গেলাম। দরজার বাইরে থেকে শুনতে
পেলাম সে কারো সঙ্গে কথা বলছে।
কথা বলছে আর হাসছে সুরমা। ঘরে ঢুকে দেখলাম সে
একা। গ্যাসে ভাত চড়িয়ে দিয়ে বসে সে যেন আমোদে কারো সঙ্গে গল্প করছে।
কি এক ক্লান্তি-বোধ যেন আমাকে পেয়ে বসেছে। নীলিমার ঘরে গিয়ে আমি
আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। শুনেছি অশরীরীর ছায়া আয়নায় পড়ে না। আমি দেখলাম আমার প্রতিবিম্ব
আয়নায়। সে কি আমারই প্রতিবিম্ব? আমার নিজের প্রতিবিম্ব যেন নিজের কাছেই অচেনা
হয়ে গিয়েছে।
সহসা নীলিমা পিছন থেকে ডেকে উঠল। বলল
কি অত নিজেকে দেখছ পাগলের মতো?
তোমার ঘরে কে এসেছিল?
কে আবার আসবে?
মঞ্চি বলছিল তুমি কার সঙ্গে কথা বলছিলে !
তুমি মঞ্চির ঘরে গিয়েছিলে ?
আমি কি তার ঘরে যাই ?
নীলিমা শব্দ না করে হাসল । আমি আয়নার ভিতর দিয়ে
দেখতে পেলাম ।
আমরা যেন শুধু পরস্পরকে প্রশ্ন করে চলি। আজ-কাল আমাদের কথা
শুধু এমনি প্রশ্নে প্রশ্নে চলতে থাকে। নীলিমা বলল
আমি পঙ্গু হয়ে গিয়ে তোমার খুব সুবিধে হয়েছে না !
কি সুবিধে ?
যার তার ঘরে যেতে পারছ ? যার তার সঙ্গে শুতে পারছ !
আমি এই বাড়ি বাগান ছেড়ে কতকাল কোথাও যাইনি তা জানো?
যাওয়ার তো দরকার নেই! আমি পঙ্গু হয়ে পড়ে আছি ! নষ্ট মেয়েমানুষ
তো ঘরেই আসতে পারে তোমার?
আমি এর কোনো উত্তর দিতে পারি না !
সে আবার বলে
শুধু এই জন্যেই কি তুমি আমাকে পঙ্গু করে দিলে ? আমাকে মারতে
চেয়ে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছিলে ?
আমি আয়ানার সামনে থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে তার বিছানার সামনে গিয়ে
দাঁড়াই। নিজেকে আমার ভীষণ হিংস্র আর নিষ্ঠুর লাগছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম
আমার মুখটা এখন ভীষণ কুৎসিত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু নীলিমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কোনো ভয় পায়নি। তার মুখ আশ্চর্য মালিন্যহীন। সে বলল
তুমি নিজেই তো জানো, তুমি কাউকে কোনোদিন সন্তান দিতে পারবে না। তবে কেন সমস্ত রাগ
তোমার আমার উপর? আমি তো জানি একটি শিশুর কলতান ফিরে এলে এই বাড়ি থেকে সমস্ত অশরীরী
দূরে চলে যাবে। এই মৃত বাড়িতে একটা প্রাণের স্পর্শের প্রয়োজন।
আমি যেন তার কথা ভালো করে শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমার মাথার ভিতর যেন
বিস্ফোরণ ঘটে যাচ্ছিল। আমি কি ভীষণ সঙ্গোপনে আমার এই চরম অক্ষমতার কথা নিজের ভিতর গচ্ছিত
রেখেছিলাম। নীলিমা যেন সেই কথা আজ বাজারের মধ্যে চিৎকার করে বলে দিয়েছে
বলে মনে হয়। আমার ভিতরের শ্বাপদ চিৎকার করে বলে
হারামজাদি,
তুই আমার উপর গোয়েন্দাগিরি করেছিস ?
আমি যেন ভীষণ ত্বরায় আমার হাতের চার পাশে এক মারণ অস্ত্র খুঁজছিলাম। কিন্তু কিছু যেন খুঁজে
উঠতে পারছিলাম না
নীলিমার মুখে যেন কোনো ভয়ের ছাপ নেই আজ। সে যেন সমস্ত বন্ধন
মুক্ত হয়ে পাখির মতো হয়ে গিয়েছে। শান্ত ভাবে সে বলল
যদি জানতাম মঞ্চির ছেলে তোমার সন্তান, তা হলে আমি
বাধা দিতাম না। কিন্তু কার না কার ছেলে, আমি তাকে মানতে পারব না। জানি না এই বাড়িতে
কোনো অশরীরী আছে কি না। যদি কেউ থাকে সে তুমি।
|
Comments
Post a Comment