না লেখার চিঠি | দূর্বা সরকার

|
‘Thrill of a bloom’ by Fahid Chowdhury |
|
ভাই সুমি,
আজ শেষ হলো পরীক্ষা, এই একটু আগে ফিরলাম, ক্লান্ত কিন্তু বেশ নির্ভার লাগছে, তাই তোমায় লেখা না পাঠানোর অজুহাত লিখতে বসলাম। কিছু লিখতে পারিনি, পরীক্ষার জন্য না, ‘নগ্নতা’ সম্পর্কে কিছু তেমন অবেগ নেই বলেই বোধহয়। তবে ভেবেছি খুব। তোমাকে লেখা না দিতে পারা টা কষ্ট দেয়। কিই বা লিখি; একমাত্র তুমিই বরাবর লেখা চেয়ে নাও, তোমাকে লেখা দিতে না পারলে ব্যর্থ লাগে নিজেকে।
ভাবছিলাম, নগ্নতা সম্পর্কে আমি খুব কমই পড়েছি, বাংলা বা ইংরেজি দুই ভাষাতেই, পেইন্টিং কি ফোটো তেমন বুঝিনা, আর সিনেমাও কমই দেখেছি। সুতরাং, এই বিষয়ে আমার পরোক্ষ অভিজ্ঞতা প্রায় তলানিতে।
কিন্তু শরীর নিয়ে আমি নিজে বরাবর খুব সংকুচিত। ছোটোবেলায় মা আমায় ছেলেদের মতোই গেঞ্জি-প্যান্ট পরাতো। একবার বাবার এক বন্ধু আমায় জিজ্ঞেস করেছিলো, আমি ছেলে না মেয়ে; আমি বলেছিলাম, “প্যান্ট খুলে দেখে নাও! তখন আমি ততটাই ছোটো যে কারো সামনেই ন্যাংটো হতে বাঁধতো না। বাবা-মা কিন্তু খুব অপ্রস্তুত হয়েছিলো। সেইজন্য এখনও এই গল্প লোকজনের সাথে করে আমাকে অপ্রস্তুত করতে চেষ্টা করে।
যে বছর ক্লাস ফাইভে উঠলাম, সেবার পুজোর ছুটিতে মামাবাড়ি গেছিলাম। লক্ষ্মীপুজোর দিন সকালে দেখি টুম্পাদি স্নান সেরে আলপনা দিচ্ছে, খালি গায়ে। সেদিন প্রথম  তীব্র হিংসে টের পেলুম। টুম্পাদি ক্লাস সেভেনে পড়ে, আমার চেয়ে প্রায় তিন বছরের বড়ো, অথচ সে কেমন খালি গায়ে ঘুরে বেড়াতে পারছে, আর আমি... উঠোনে তাকিয়ে দেখলাম রাকেশদা হাফপ্যান্ট পরে সাইকেল নিয়ে চক্কর দিচ্ছে। তখনই খেয়াল হলো যে আমার সব ছেলে বন্ধুরাও তো সারাদিন হাফপ্যান্টেই থাকে, মেয়ে বন্ধুরাও তো বেশিরভাগ, শুধু আমিই সারাক্ষণ জামা গায়ে, কবে থেকে এমন শুরু করেছি তাও খেয়াল নেই! নয় বছরেই আমি বড়ো হয়ে গেলাম?
বাবা-মা বাড়ি না থাকলে আমিই লোকজন আপ্যায়ন করতাম। তেমনই একদিন প্রকাশ কাকু এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বুকে হাত দিয়েছিলো। সেই থেকে অভিজ্ঞতার শুরু। তারপর ভীড় ট্রেনের অচেনা পুরুষ, বন্ধু থেকে সদ্য প্রেমিক হওয়া ছেলেটা, পিসতুতো জামাইবাবু, ছুটিতে অঙ্ক শেখাতে আসা পাড়াতুতো দাদা- সবাই শুধু শরীর চায়। প্রশ্নটাও তখনই জাগলো, ছেলেরা শুধু মেয়েদের শরীর চায় কি? এইজন্যই কি মেয়েরা শরীর ঢেকেঢুকে রাখে, যাতে ছেলেরা আকৃষ্ট না হয়? নাকি ঢেকে রাখার জন্য আরো বেশি আকর্ষণ জাগিয়ে তোলা হয়ে পরে?   
ছেলেদের অর্ধনগ্নতা দেখে দেখে সবাই অভ্যস্ত, তাতে কিছু যায় আসে না। মেয়েদেরও এই ছুট মিললে কি হয়? কিন্তু ছুট মেলেনা। অভ্যাসের দাস হয়ে কাটাই। জানো, মেসের ছোট্ট ঘরে আমরা চারজন তো শুধু মেয়েই ছিলাম, তাও একে অন্যের সামনে কাপড় বদলাতে অস্বস্তি হতো। একদিন বাথরুম ফাঁকা না পেয়ে রুমেই জামা পাল্টানোর সময় বললাম, “আমি চেঞ্জ করছি, এদিকে তাকাসনে।” পিংকি বললো, “আমরা সবাই মেয়ে, দেখলেই বা কি? সেইদিন প্রথম খেয়াল হলো, অভ্যাস কতটা অন্ধ।
আমাদের বাড়ির বাথরুমটা যখন ভেঙেচুরে বড়সড় করা হলো, তখন তাতে আয়না লাগানো হলো মায়ের ইচ্ছায়। তখনও আমি পুকুরে স্নান করতাম, পাড়ার সব বন্ধুদের সাথে হুটোপুটি করে। একদিন নতুন বাথরুমে স্নান করতে গিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখেই ভয় পেয়ে গেলাম। এত বড়ো হয়েছি তাও ছেলেপুলে দের সাথে দাপিয়ে চান করি?? সেই থেকে পুকুরে যাওয়ার ইতি।
মনে পরে, প্রথম বন্ধু কাম প্রেমিকের ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল ফোটো তুলতে একদিনের জন্য ধার নিয়ে দেখেছিলাম তাতে রয়েছে নীল সিনেমা। পরদিন জিজ্ঞেস করতে সে বলেছিলো, ভুল করে তার বন্ধু ব্লু-টুথে দিয়ে ফেলেছে। অথচ সে সত্যি বললে আমরা হয়তো সহজ হতে পারতাম, ওইসব নগ্নতার দৃশ্যগুলো মনে পরে, পরে আর গা গুলোতো না। পরদিন সন্ধ্যায় পড়াতে গিয়ে আমার চারজন ছাত্রছাত্রীর দিকে তাকাতে ভয় হচ্ছিলো, যেন তাকালেই মনে মনে আমি তাদের নগ্ন শরীর কল্পনা করে ফেলবো!
জামাকাপড়ের আবডালে শরীর ঢেকে রেখে ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ পড়ে নগ্নতা-কে সহনীয় মনে হতে শুরু করলো। ‘বিবর’, ‘দেখি নাই ফিরে’ তে সাহিত্য-শিল্পের সাথে নগ্নতার সহজ মেলামেশা ভালো লেগেছিলো। এইরকমই টুকটাক জানি- বুঝি নগ্নতার শৈল্পিক প্রকাশ। যে মেয়েদের চুড়িদারের ওড়নায় বুকের খাঁজ, শাড়ির আঁচলে কোমর, কি বোরখা-হিজাবে পায়ের নখ থেকে চুলের ডগাতক ঢেকে রাখতে হয় তাদের কাছে নগ্নতা কিছুটা দীর্ঘশ্বাসের মতো বিষয়। নিজের ইচ্ছেমতো জামাকাপড় পরার আগে যাদের অনুমতি নিতে হয়, বাইরে বেরিয়ে কোনওরকম হেনস্থা হলে আগে যাদের পোশাকের দিকে সমাজ আঙুল তোলে তাদের কাছে নগ্নতা ঠিক কেমন জিনিস আমি নিজেও ভালো বুঝিনে। ইংরেজি সিনেমা দেখে খুব মনেটনে হয়, আমাদের এখানেও যদি নারী-পুরুষের নগ্নতার সমান অধিকার থাকতো তাহলে বেশ হতো। কিন্তু সিনেমা তো সিনেমাই। জীবন যা তা। জীবনে ‘সাতকাহন’ হয়, ‘দূর্গেশনন্দিনী’ হয় না।
বাড়িতে একটা পুরোনো কালিদাস রচনাসমগ্র আছে, আমায় সেটা লুকিয়ে পড়তে হয়েছিলো মায়ের বইয়ের তাক থেকে চুরি করে এনে। ওই লাল মলাটের বইটা কেন পড়া বারণ তা পড়ে তবে বুঝেছিলাম। প্রাচীন ভারতে এত ঢাকাঢাকির বাড়াবাড়ি ছিলো না বলেই কি কবির লেখায় সেই স্বাচ্ছন্দ্য টের পেয়েছিলাম? তাই ভালোও লেগেছিলো। এখনকার গল্প হলে কি ‘ঋতুসংহার’-টা পর্ণোগ্রাফি বলতো লোকে?
এইসব ভেবে ভেবেই দেখলাম নগ্নতা নিয়ে আমি কিছুই লিখে ফেলার মতো অবস্থানে নেই। বন্ধুর সাথে ছবিতে বুকের খাঁজ দেখা যাচ্ছে বলে যে আমি সংকোচ বোধ করি, পুরুষের নগ্নতার স্বাচ্ছন্দ্যে যার রাগ হয় অসময়ে, জাপানি কবিতায় নগ্নতার সহজ প্রকাশ পড়ে যে আমার হিংসে হয়, অথচ যে আমি গল্প-কবিতা-সিনেমায় প্রেমিক-প্রেমিকার শারীরিক নৈকট্য আগ্রহী হয়ে পেতে চাই, সেই ভন্ড-সংকীর্ণ-অক্ষম আমার লেখার কিছু নেই নগ্নতার আলোছায়া বিষয়ে।
নিজের অক্ষমতা, নিজের নগ্নতাও সহজ না। আচ্ছা সুমি, যা সহজাত অবস্থা সেটাই এত কঠিন বিষয় কেন করে নিয়েছি আমরা? তোমাদের পত্রিকা পড়ে উত্তর পাওয়ার আশায় রইলাম।
টাটা
ঘাসফুস
|

Comments

  1. বাহ।বেশ সুন্দর লাগলো দৃষ্টিকোণ

    ReplyDelete
  2. সময়ের শিল্পীত যন্ত্রণাদগ্ধ কথার ছেঁড়া ছাই দিয়ে বানানো চিঠি। মূলত মানুষকে প্রযত্ন করে লেখা।

    ReplyDelete

Post a Comment