মুক্তি | অলভ্য ঘোষ
|
আমার লিঙ্গের ডগাটা দেখে পাকিস্তানি সৈন্য পোঁদে লাথি মেরে ছেড়ে দিয়েছিল। এটা ইনফেকশনে এমন হয়ে গেছে ছোট বেলায়; তাই রক্ষা। আমার বোন হিন্দু না মুসলমান- এ বিচারে ধরা পরেনি। মেয়ে হবার খেসারত দিয়েছে ট্রেন থামানো একদল মুসল.. না; ধর্ষকদের হাতে। অঙ্গে আলতা সিঁদুর কিছুই ছিল না,
বোরকা ঢাকা তবুও। সবকিছু হরিয়েও বাংলাদেশের মুক্তির লড়াই লড়েছি আমি বন্দুক হাতে নিয়ে। শান্তি কমিটির ইমাম সাহেব ঘোষণা করলো ইন্ডিয়ার দালাল। ভিটেমাটির সওদা যারা করলো; তারা রয়ে গেল। আমি রাতের অন্ধকারে পালিয়ে এলাম ভারতে।
নোংরা নালা। কলকাতার সেই গু-মুত ভেসে যাওয়া নালার পাশের বস্তিতে; আমরা রিফিউজি নেড়ি কুত্তার দল। পিঠে তখনো লেগে রয়েছে কাঁটাতারের ঘা। বাসা নেই, চাকরি নেই, আত্মীয় বলতে শ্যামবাজারের দূরসম্পর্কের ফরিদপুরের মামা।
এক বিজয়া দশমীর রাতে মনে হয়েছিল প্রতিশোধ নিই। কার ওপর জানতাম না। এখনো জানি না। সোনাগাছির মেয়েদের লাইনে গিয়ে নাম জানতে চেয়েছি।
- শ্যামলী, কাজরী, বৈশাখী।
- সাবিনা, রোজিনা, ফাতেমা কেউ নেই?
এখানে তো সবারই নাম বদল হয়। অনেকটা আমার মত গান্ডুর দেশ বদলের মতো। এক দালাল ঠিক চট করে বুঝেছিল আমি বাঙ্গাল; বাংলাদেশি মাগী খুঁজছি।
–
আছে। নতুন এসেছে টাটকা। রখরা একটু বেশি লাগবে।
–
নাম কি?
–
বিলকিস বানু। চলবে?
– চলবে মানে! দৌড়বে।
মনের মধ্যে একটা ছুরি শান দিয়ে রেখেছি ওর জন্য। দরজা বন্ধ করে মেয়েটার একটার পর একটা কাপড় খুলে নিচ্ছিলাম যখন শিকারি হায়েনার মতো; তখনো আমি মেয়েটির মুখটা দেখতে পাইনি। ও দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে শুধু থরথর কাঁপছিল। আর ও যত কাঁদছিল আমার শিশ্নটা ততই মেশিন গানের মতো মুখ উঁচিয়ে নাচছিল আনন্দে। মুখের আগে বুকটা খুলে নখ বসাতে গিয়ে একটা জড়ুল দেখলাম। হঠাৎ থার্মোমিটারের পারদ গেল পরে। ছোটবেলায় বোনকে যখন পুকুরে সাঁতার শিখাতাম কতবার ঐ জড়ুল দেখেছি ওর ছাতিতে। জলাতঙ্ক রোগীর মতো ঘরের এক কোণে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় মেয়েটাকে বলেছিলাম
- কে তুই?
মুখের থেকে হাত সরিয়ে, জলে ঠাসা দুটো চোখে ও বলেছিল
– আমি চট্টগ্রামের ভাল ঘরের মাইয়া। পাকেচক্রে এইখানে আইয়া উঠছি।
নাম শুধোলে বলল
– দুর্গা। এরা আমায় বিলকিস বইলে ডাকে। আমি বাঁইচতে চাই।
– আমার বোনও এ কথা বলেছিল। বাঁচা-মরা কোন কিছুই তো আমাদের হাতে নেই।
– কার হাইতে আছে? ধম্ম? কোন ধম্ম এমন বিধান দেয়?
– যে ধর্মে মানুষ আর মানুষ থাকে না।
– ভগবান বলে কিছু নাই?
প্রচণ্ড হাসি পেয়েছিল আমার।
– ঐ শুয়োরের বাচ্চাটা এই পাড়ার কোন মেয়ের সায়ার তলায় ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। আসলি ভগবান তো ইয়াইয়া খান। এত বড় খান-কি পৃথিবীতে একটাই।
বিজয়ার বিসর্জনের ঢাক বাজছিল। একটার পর একটা ঠাকুর পরছিল বাবু ঘাটের গঙ্গায়। আমাদের ইছামতীর মতো নৌকা বিহার এখানে হয় না। প্রতিমা ডুবাতে গিয়ে কেউ যদি ডুবে যায় পাহারাদার নৌকো তুলে আনে। এখানে ডুবানো হয় নিষ্ঠুর ভাবে নেচেকুঁদে। দুর্গাকে শুধু একটা কাঠামো ভাবে। ভক্তি কম। কলকাতার সব খারাপ বলবো না। এর মত উদার সস্তা বাসস্থান ভূ-ভারতে কোথাও নেই। আমার গন্ধী কলোনির ঝুপড়িতে বিসর্জিত দুর্গা প্রতিষ্ঠিত হল। কালীঘাটে পনের টাকা খরচে বিয়ে।
মুক্তি কি হয়েছে আমাদের?
আমার মেয়ে এখন নবম শ্রেণীর ছাত্রী। বাংলাদেশের শান্তি কমিটির সংস্কৃতিতে নির্মিত রিফিউজি উন্নয়ন কমিটির দৌলতে দখলের জমিতে বানানো ঢালাই বাড়ির ছাদে একটা মোবাইল কানে বিদ্যা ছেড়ে বিদ্যা বালান হয়ে কার্তিক মাসের ছোঁকছোঁকে নেড়ি কুত্তাদের মত ছেলেদের পিঠ বুক খোলা জামা আর পাছা দেখানো জিন্স পরে মনোরঞ্জন করে। ফেসবুকে পাঁচ হাজার বন্ধু। বেঁকেচুরে ছবি পোস্ট করে, হুমড়ি খেয়ে একশোর উপর ছেলেদের লাইক পড়ে। বুড়োরাও কচি সেজে লাইক টিপে মজা পায়। ক্লাস সেভেনে বইয়ের ভেতর থেকে পাওয়া গিয়েছিল ব্লু-ফিল্মের
ডিভিডি। এই বয়সেই যৌনবিজ্ঞানের জ্ঞানে স্বয়ং বাৎস্যায়নকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। সে জানে গর্ভনিরোধের ওষুধ সাধারণত মাসিকের নির্দিষ্ট সময়ান্তে দীর্ঘ মেয়াদে মেয়েদের সেবন করতে হয়। পেট হবার তার কোন সম্ভাবনা নেই। রেপ হবারও নয়।
রেপ তো মতের বিরুদ্ধে হয়। আসলে এখানে ধরা পড়লে ধনঞ্জয়, না পরলে গুরু এনজয়।
আমার মেয়েকে কোন দিন আমাদের ইতিহাস বলা হয়নি। যেটুকু বলেছি সবটুকু ঢেকে পরিমার্জিত করে। ভয়ে না লজ্জায় কে জানে, কিছুই জানানো হয়নি। কোনো কোনো সময় ভেবেছি আমি তোমার বাবা- এটুকু বললেই যেন সব বলা হয়ে যায় কেমন করে তার পৃথিবীতে জন্ম হল। অনেক দুর্গম পথ অতিক্রম করে ইন্ডিয়াতে আসা; এ বললে কষ্টটা কি বোঝানো যায় না? তারপরেই মনে হয়েছে যে কোনদিন অমৃত খায়নি তার কাছে ওটা শুধু মিষ্টি রসগোল্লার মত। মিষ্টতা ছাড়াও অমৃতের একটা পবিত্র স্বাদ আছে যা পেলে মানুষ অমর হয়। যা আমরা কোনদিন পাবো না। তেমনি যন্ত্রণা উপবাসের মত মানুষকে সংযমী করে, হিসেবি করে, আবার বোধহয় কিছুটা স্বার্থপর। যাই করুক ঘা খাওয়া বিবেক হয় সদা জাগ্রত। দেশ হারানোর ঘা; জ্ঞাতি হারানোর ঘা। এই ঘা আমার মেয়ের নেই। সে যুদ্ধ বলতে জানে “বর্ডার” ফিল্ম। দেশভাগ বলতে “রিফিউজি”। আর প্রেম বলতে “কহনা প্যার হ্যাঁয়”। হিন্দি সিনেমাতে না খেতে পাওয়া নায়িকারও ডাগর ডাগর কমলালেবুর মত বুক আর তানপুরার মত পাছা। বাস্তবে না খেতে পেলে সব শুকিয়ে আমসি হয়ে যাবে। এরা বাস্তবটা জানে কম। বেঁচে থাকে স্টার, সোনিম্যাক্স দেখে। যেখানে ছবিতে সিরিয়ালে শুধু দেখান হয় পরকীয়া। একাত্তরের পাকিস্তানি সৈন্যদের মত চ্যানেল কর্তাদেরও শুধু লক্ষ্য মানুষের যৌনাঙ্গ। চলছে দেদার সুড়সুড়ি। অতি সংস্কৃতিবানেরা নীল ছবি বানাচ্ছে। রিয়েলিটি তুলে ধরতে ব্যাকগ্রাউন্ডে রবীন্দ্রসংগীত। কোন কিছুই বলছে না আমার মেয়েকে তার মায়ের অতীত জীবনের কথা; তার পিসির অপর লুণ্ঠনের কথা; তার বাবাকে রাষ্ট্রের নগ্ন করে পরীক্ষা করার কথা। আমিও কিছুই বলিনি তাকে। মুক্তিযুদ্ধ নাকি এবার পশ্চিমবঙ্গের পাঠ্যপুস্তকে থাকবে। থাকলে কী আমার মেয়ে ঠিকঠাক তার ইতিহাসটা জানবে? নাকি ক্ষতগুলো ঢেকে মজে থাকবে রাখি সাওয়ান্তের “স্বয়ংবরে”। টিভি-রোগে ভোগা ভালোবাসায় গাইবে হান্ডেট পার্সেন্ট লাভ। এখানেও ধর্ম আর রাষ্ট্র শক্তির ফণা সেকুলারিজমের আড়ালে মেঘনাদের মতো সুযোগ খোঁজে। জেনারেল কাস্টে আশি শতাংশ নম্বরেও যখন সরকার মুখ ঘোরায়, কারো কারো কম পেলেও চলে। বিভাজন চলছে, চলবে। অণু থেকে পরমাণু হলেও আমাদের ছাওয়ায় এটম বোমার সম্ভাবনা। আত্মা থেকে পণ্যে মনুষ্যত্বের সোপানগুলো ভেঙ্গে চুরে তছনছ করে দিলে বেঁচে থাকবে ডিজিটাল নেশাগ্রস্ত একটা জানোয়ার। যার হাত পা মাথা থাকবে শুধু থাকবে না। মস্তিষ্কে মুক্তির স্বপ্ন।
কয়েকটা বোতামের চাপে হোটফাদার তাকে দিয়ে দাসোচিত সব কিছু করিয়ে নেবে অনায়াসে।
আমার কান্না পাচ্ছে। কত দিন বাঁচবো এভাবে? ইনটেনসিভ ভেন্টিলেশনে বেঁচে থেকে কি লাভ! এত কথা বললেও কিছুই আমার মেয়ের কানে পৌঁছাচ্ছে না। কিছুই আমার বলা হল না। হাত-পা মাথা সব কেমন যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। প্যারালাইসিস হবার আগে আর একবার শুধু আমি বলতে চাই।
“আমি মুক্তি চাই। আমাকে.. মৃত্যু.. দাও..”।
|
|
শাবাশ।দুরন্ত বললেও কম।
ReplyDelete