জীবাশ্ম | অয়ন ঘোষ (২)
“শুক্রবার রাতে কি?” “অফিস থেকে ফিরছি। একটু রাত হয়েছিল। রনি বিশ্বাস কর, মোবাইলে স্পষ্ট দেখলাম আমার বন্ধুর মেসেজ। বললো রাতে ক্যাব পাচ্ছে না, আমি যদি একটু বাড়ি ড্রপ করে দি। ওর অফিস ফেরার পথেই পড়ে। ওকে পিক আপ করলাম। জিজ্ঞেস করলাম বাড়ি কোথায়। বললো পার্ক স্ট্রীটের কাছে। পার্ক স্ট্রীটে ওকে নামিয়ে লক্ষ্য করলাম যেখানে গাড়িটা দাঁড় করিয়েছি জায়গাটা কাদা-কাদা। তাতে আমার জুতোর দাগ, গাড়ির চাকার দাগ। বাট নো সাইনস্ অফ আ সেকেন্ড পার্সন। তারপর তাকিয়ে দেখি আমি গোরস্থানে!” “তারপর?” “বাড়ি ফিরে এলাম। এসে ঘুমিয়েছি। সকালে উঠে খেয়াল করলাম যে আমার বন্ধু, ওর নাম সন্দীপ, ও গত পাঁচ বছর ধরে ইউ কে-তে আছে।” সোম থামে। চোখ বন্ধ করে। “তার মানে সেদিন রাতে?--” “ইট ওয়াজ অ্যান ইলিউশন! আই অ্যাম হ্যালুসিনেটিং!” “কিন্তু তুমি সত্যি গেছিলে পার্ক স্ট্রীট গোরস্থানে?” “আমার গাড়ির ওডোমিটার তো তাই বলছে। আর মোবাইলে সন্দীপের থেকে কোনো মেসেজ নেই। সোহিনী বাড়িতে তুমুল অশান্তি করছে।” -- গোলাবাড়ি থানার ওসি প্রমাদ গুনলেন। সকাল সকাল এ কি বিপদ! পাগলটাকে প্রথম দেখে কয়েকজন সবজি বিক্রেতা। ব্রিজের পশ্চিম দিকের পিলারগুলোর একটাতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছিল, কিন্তু কি বলছে কেউ বুঝতে পারেনি। তারাই প্রথম থানায় খবর দেয়। ফায়ার ব্রিগেড আসে, কয়েকজন দমকলকর্মী ব্রিজে ওঠার চেষ্টা করে উপযুক্ত সরঞ্জামের অভাবে পনেরো মিনিটের মধ্যেই হাল ছেড়ে দেয়। এরপর হেডকোয়ার্টারে খবর দিয়ে নতুন মই আনানো হয়। তাতে কাজের সুবিধা হলেও এখনো ঠিক জুত করে উঠতে পারেনি। আর পাগলটাও বলিহারি--কিরকম পাঁই পাঁই করে এদিক ওদিক ছুটে যাচ্ছে। নীচে উৎকন্ঠিত জনতা, ঠায় আকাশপানে চেয়ে আছে। পাগল-পুলিশ দু পক্ষকেই সমান ভাবে চিৎকার করে উৎসাহিত করে চলেছে। টান টান উত্তেজনা। এই ভিড়ের মধ্যে পকেটমার থাকলে তাদের নির্ঘাত পোয়াবারো। ওসি গোপাল চন্দ ভট্ট রুমাল বের করে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মোছেন। ট্রাফিক কন্ট্রোল রুম থেকেও একের পর এক দুঃসংবাদই এসে চলেছে--বড়বাজার, ব্র্যাবোর্ন রোড, এম জি রোড, গোলাবাড়ি, হাওড়া ময়দান। এর মধ্যে আবার আজ কেন্দ্রীয় হোম মিনিস্টারের ভিজিট, এই পথেই যাবেন। পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে তাতে আজ পিঠের ছাল-চামড়া বজায় থাকলে হয়। মনে মনে ছোট্ট করে একটা মানত করে ফেললেন কালীভক্ত গোপাল চন্দ। আজ হাড়ে-হাড়ে শিক্ষা হল--এর চেয়ে বাপু কৃষক আত্মহত্যা বা শিক্ষাগৃহে পুলিশি লাঠিচার্জ অথবা নিদেনপক্ষে ছাত্র সংঘর্ষ ও মোমবাতি মিছিল সামাল দেওয়া অনেক কম ঝক্কির বিষয়। -- ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ে চলে এক টানা; নিম্নচাপের বিষণ্ণ একঘেঁয়েমির মধ্যে অ্যান্টার্ক্টিকের ভুখন্ড আর কলকাতা শহরের মধ্যে স্বাভাবিকতাটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠতে থাকে সোমের কাছে। উদ্দীপিত পেংগুইনের মতই চারিদিকে ছুটছে অসংখ্য মানুষ। তাদের মধ্যে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে থাকা সোম। উদাহরণটা হয়তো ভুল হলো, সোমের মনে হয়। জীবজগতে পেংগুইন হলো একগামী প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম, প্রাকৃতিক দিকে থেকে দেখলে কিছুটা ব্যাতিক্রমিই। মানুষ বোধহয় অনেকটা প্ল্যাটিপাসের মত, যাদের প্রজনন করার একমাত্র পদ্ধতি হলো সমকামী গণধর্ষণ। ফ্ল্যাশব্যাক হয়। বারবার মাথার ভিতর একটাই দৃশ্য ঘুরপাক খেতে থাকে। সোমের গাড়ির চাকার তলায় চলে যাচ্ছে কুকুরটা। ককিয়ে উঠে একটা আর্তনাদ করে থেমে গেলো। সব শেষ। বোঝার আগেই একটা নিষ্পাপ প্রাণীহত্যা ঘটে গেলো। করলো সোম। প্রচন্ড রাগ হয়, তার সাথে দুঃখ। এ কি পরিণতি হয়েছে তার! দুদিন ধরেই মাথায় ঘুরছিল সেই কবেকার স্কুলের একটা ঘটনা। ছেলেটার নাম ছিল সৈকত, বেশ গাঁট্টাগোট্টা বুলি টাইপের মুর্তিমান শয়তান। সোমের সাথে কি নিয়ে যেন ঝামেলা হয়। সোম মার খেয়েছিল চুপ করে পড়ে পড়ে। সবার সামনে সেই অপমান শিশুমন মেনে নিতে পারেনি। কাল রাতে অফিস থেকে ফেরার পথে অন্যমনস্কভাবে হঠাতই সৈকতকে নিশ্চিন্তভাবে রাস্তার উপর ঘুমোতে দেখে সোম। অ্যাক্সিলারেটরে পা দিয়ে সোম গাড়িটা সোজা চালিয়ে দেয় কুকুরটার উপর। সম্বিত ফিরে পাওয়ার আগেই সব শেষ। সোম কুকুর ভালোবাসে, তার নিজের বাড়িতেও একটা ল্যাব্রেডর আছে। কিন্তু আজ একটা প্রাণীকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে সে। কাল যদি অন্য কাউকে--আর ভাবতে পারে না, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠে। এরপর আর দুনিয়ায় বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই তার। আই হ্যাভ বিকাম আ মনস্টার! সোমের চোখে জল আসে। আজ নিজেকে বড় একা লাগছে। শহরে এতগুলো মানুষের মধ্যে একদম একা। পচে গলে একটা জীবাশ্মে পরিণত হয়েছে। একেবারে ব্যর্থ একটা জীবন। “কি দিয়েছি বল আমরা?” রনিকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল সোম। “কিই বা দিতে পেরেছি? কিই বা দিতে পারি?” কিচ্ছু না। ধনদৌলত ঐশর্য থেকেও আমরা গরীব। আছে শুধু প্রাণটা। “এক সময় সব ছিল। গান ছিল, কবিতা ছিল। শুধু পয়সা ছিল না। এখন দশটা গিটার ঘরে পড়ে পড়ে ধুলো খাচ্ছে, কিন্তু গান আর নেই। কোথাও মুক্তি নেই। একদিন সব ছেড়ে, সব দান-ধ্যান করে অন্য কোথাও চলে যাবো, আবার গরীব হবো।” “বাবু, এ বাবু!” ঘুরে তাকায় সোম। একটা সাধুবাবা। হাত বাড়িয়ে ভিক্ষে চাইছে। লোকটা বিশাল লম্বা। কপালে দু চোখের ঠিক মাঝখানে একটা দগদগে ঘা, তাতে মাছি বসছে। ঘা-টা বিভৎস দেখতে। চমকে ওঠে সোম--কিন্তু কি তীব্র তার চোখের দৃষ্টি। “কুছ দে দে বাবু।” সোম পকেট হাতড়ে মানিব্যাগ বের করে। খুচরো নেই। শিট্! পাশে চায়ের দোকান। “ভাই, একটা চা।” “আরে দাদা! পাঁচশোর নোট!” “নেই ভাই। কি করবো? একটু দেখো না।” দোকানি গজরাতে গজরাতে চা আর ভাঙানি দেয়। সোম চা-টা আর কয়েকটা খুচরো নোট সাধুবাবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে হাঁটতে থাকে। পুরোটাই প্ল্যান করা আছে সোমের। আজ নিজেকে শেষ করবে সে। পৃথিবীতে আর একটা প্রাণের ক্ষতি করার আগেই নিজের হ্রদযন্ত্রটা থামিয়ে দেবে। এখান থেকে এখন সে সোজা চলে যাবে কলকাতার সব থেকে দামি কোনো পাঁচতারা হোটেলে; সেখানে চেক ইন করে বিলাসবহুল সুইটে নিজেকে বন্ধ করে ফোনটা গুঁড়ো গুঁড়ো করে ভেঙে ফেলবে যাতে ওর মধ্যে থেকে আর কোনো ডেটা উদ্ধার করা সম্ভব না হয়। তারপর অনেকটা মদ খাবে, যতক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়াতে পারছে। সারাটা দিন ভীষণ ভাবে প্রাণ খুলে বাঁচবে। জোরে গান চালিয়ে দিয়ে উলঙ্গ হয়ে নাচবে, পর্ন দেখবে, অশ্লীল ভাষায় চিৎকার করতে করতে অবসাদ অবধি স্বমেহন করবে। এরপর আধা-বেহুঁশ অবস্থায়...এ ভার্টিকাল ইনসিশন অ্যালং দ্য রেডিয়াল আর্টারি--পড়াশোনা করা আছে সব। সমস্ত কিছু ঠিকঠাক ভাবে করতে পারলে বিশ মিনিটের মধ্যে চির-ঘুম। লাইফ ইনশিওরেন্স করা আছে সোমের। সোহিনীর কোনো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। আঃ! কতদুর এলো? আশেপাশে চোখ পিট পিট করে তাকায় সোম। সেই পার্ক স্ট্রীট। মাথার ভিতরে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে; আওয়াজগুলো বাড়ছে, থামতে চাইছে না। মদ চাই সোমের। সোহিনী ভাবে তার কন্ডিশনটা অ্যালকোহলিজিমের কারণে। নাথিং কুড বি ফার্দার ফ্রম দ্য ট্রুথ। সোম আর ভাবতে পারে না। ওই তো সামনে ওলিপাব। ক্ষিপ্রগতিতে পা চালায়। -- সোহিনীকে এত ভেঙে পড়তে কখনো দেখেনি রনি। চোখের নীচে কালি পড়ে গেছে। মুখটা শুকনো। “কোথায় যেতে পারে জানিস? কোনো বন্ধু?” “না। তুমি কিছু আন্দাজ করতে পারো?” “আমি যাকে যাকে জানি সবাইকে ফোন করেছি। কোত্থাও নেই।” বলে আবার কাঁদতে থাকে সোহিনী। রনি ভেবে পায় না কিছু। এতটা ঠুঁটো এর আগে লাগেনি কোনোদিন। মানুষটা গেলো কোথায়? এত বড় শহরে কোথায়ই বা খুঁজবে তাকে? সোফায় বসে ফোঁপাতে ফোঁপাতে সোহিনী বলে, “পুলিশকে খবর দিবি একটা? ওর এক কলিগ গাড়িটা দেখেছে অফিসে। চাকায় নাকি রক্তের দাগ ছিল। ওরা আসতে চেয়েছিল। আমিই বারণ করলাম।” “ভালো করেছো,” বলে রনি ঘড়ি দেখে। ক্রমশ সময় চলে যাচ্ছে। ভেবে কোনো উপায় বের করা যাচ্ছে না। অগত্যা টেলিফোনটার দিকে এগোয়। -- আর যেন তর সয় না সোমের। পেটে পানিয় ঢালার অপেক্ষায় বুকটা ওঠানামা করতে থাকে। প্যালপিটেশন। এমটাই হওয়ার কথা ঠিক অন্তিম মুহুর্তে, যখন সারা শরীর বেঁচে উঠতে চায়, কিন্তু মন সংশিত থাকে। দা বডিজ্ ওভাররাইড রিক্যাকশান টু স্টে অ্যালাইভ। মদে মনোনিবেশ করে সোম। চারিদিকে সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। মস্তিষ্কের প্রতিটা কোষ যেন চিৎকার করে উঠছে। চোখ বন্ধ করে বিয়ারে চুমুক দেয়। এক যে ছিল রাজা... একটা ভারী মার্জিত পুরুষকন্ঠ পাশের টেবিল থেকে হঠাৎই গেয়ে ওঠে। সোম তাকায়। এক বিদেশী ভদ্রলোক। মাথায় টুপি। পরনে কুর্তা আর জিন্স। নিখুঁত বাংলায় গাইছে। উচ্চারণে সামান্য টান আছে বটে, কিন্তু ভালো করে না শুনলে বোঝা যায় না। উদাত্তকন্ঠে গাইছে। সবাই ঘুরে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার সাথে গলা মেলাচ্ছে। একজন দুজন করে সবাই ঐকতানে গেয়ে ওঠে। যার ভান্ডারে রাশি রাশি সোনাদানা ঠাসাঠাসি তারও হয়... অজান্তে সোমও গাইতে থাকে। কলেজে থাকতেই সোমের গানবাজনার শখ ছিল। গান লিখতো। কবিতাও। এখন আর কিছু হয় না। দুঃখ যাবে কি? দুঃখ যাবে কি? বিরসবদনে রাজা ভাবে কি? ছোটবেলায় সোমের খুব প্রিয় গান ছিল এটা। বাবা-কাকা খেলাচ্ছলে গাইতেন। সেই গানটাই--বাঙালীর আলতরাপ রবীন্দ্রসঙ্গীত না, পশ্চিমি সুরে বাংলা কথার অতি-পুনঃ-উত্তরাধুনিক গাথাও না, অত্যন্ত সহজ-সরল--আজ, এখানে, এই অবস্থায়, তাও এক বিদেশী সাহেবের গলায় শোনা সোমের কল্পনাতীত ছিল! গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে সোমের। একবার ত্যাজিয়ে সোনার গদি রাজা মাঠে নেমে যদি হাওয়া খায় তবে রাজা শান্তি পায়, শান্তি পায়। গানটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিন চারবার করে গাইতে থাকে লোকটা। সাথে সাথে মন্ত্রমুগ্ধের মত শ্রোতারাও। দুঃখ কিসে যায়? দুঃখ কিসে যায়? প্রাসাদেতে বন্দি রওয়া বড় দায়, বড় দায়। গানের শেষে হাততালি দিয়ে ওঠে সকলে; ভদ্রলোক টুপিটা খুলে অভিবাদন গ্রহণ করলেন, তারপর হাতজোড় করে একটা নমস্কারও করলেন, কিন্তু মনে হলো যেন হাততালিটা কোনো সাধুবাদ বা তারিফের না, সবাই নিজেকে নিজেই অভিনন্দন জানালো, উন্মাদ নগর চরিতে কয়েক মুহুর্ত উজ্জীবিত হয়ে ওঠার আনন্দে। চাকরি জীবনের শুরুতে দেশ-বিদেশের বেশ কিছু শহর ঘুরেছিল সোম, কিন্তু এই অভিজ্ঞতা কলকাতা ছাড়া দুনিয়ার আর কোথাও হতে পারে বলে জানা নেই তার। সোম টের পায় তার খিদে পেয়েছে। কাল রাত থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। বিয়ারটা শেষ করে খাবারের অর্ডার দেয় অভি। -- তিন ঘন্টার আপ্রাণ প্রচেষ্টা ও দমকলবাহিনীর প্রশংসনীয় বাহাদুরির পর পাগলটাকে ব্রিজ থেকে নামানো সম্ভব হয়। এই ইঁদুরশিকার দেখার জন্য পালে পালে মানুষ জড় হয়েছিল যেমন ইডেনে খেলার সময় হয়, বা ময়দানে মিছিলে। চোখের সামনে লাইভ বিনোদন দেখতে প্রচুর সংখ্যক কলকাতাবাসী সমস্ত কাজ ফেলে আজ জমায়েত হয়েছিল হাওড়া ব্রিজে। শহরে নিম্নচাপ ঘনিভুত হয়েছিল। কলকাতার আরেক প্রান্তে একই উচ্চতার হাইরাইজের সাড়ে চোদ্দশো স্কোয়ার ফীটের ফ্ল্যাটে সোম আড়াই মাস আগে এমনই এক দিনে ব্লেড দিয়ে বুকে-হাতে আঁচড় কেটে খোলা বারান্দায় বৃষ্টিতে ভিজছিল, আর সাদা পাঞ্জাবীতে ব্লটিং পেপারের মত আঁকাবাঁকা শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে পড়েছিল রক্তের দাগ। “কি করছো! কি করছো!” বলে সোহিনী পাগলের মত সোমের শরীরটাকে আঁকড়ে ধরে অসহায় ভাবে ফুঁপিয়েছিল। সোম এক মনে তাকিয়ে ছিল বৃষ্টির দিকে। মেঘলা ছাইরঙা আকাশের বুকে হাইরাইজ আর বিলবোর্ডের এবড়োখেবড়ো স্কাইলাইনটা যেন কাগজ কেটে সাঁটিয়ে দেওয়ার মতই কৃত্রিম দেখাচ্ছিল। সোম দুপুরেই বাড়ি ফিরেছিল সেদিন। দরজাটা খোলাই ছিল তাই কলিং বেল বাজাতে হয়নি। সোহিনী ভুত দেখার মত ছুটে এসেছিল, সোমকে জাপটে ধরে বুকে মাথা দিয়ে ডুকরে ডুকরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল। তার প্রিয় ল্যাব্ররডরটাও দৌড়ে এসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে দিয়েছিল। পাথরের মত দাঁড়িয়েছিল সোম। পিছনে একা দাঁড়িয়ে রনি স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলেছিল, চোখেমুখে চিন্তার ক্লান্ত দাগ। কারো মুখে কোনো ভাষা ছিল না। ব্রিজের চুড়োয় পাগলা খাঁদু নীচে এত মানুষের তামাশা দেখে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছিল আর নিজেকে রাজা বলে মনে করছিল। সিনেমা হলের সব থেকে দামী সিটে বসে বই দেখার মত। পুলিশ আর ফায়ার ব্রিগেডের পরিশ্রান্ত পেটমোটা বাহিনীর সাথে ধরাধরি খেলতে খেলতে এক টাওয়ার থেকে আরেক টাওয়ারে ছুটে যাচ্ছিল বারবার। হাওয়ায় উস্কোখুসকো চুলগুলো উড়ছিল, বৃষ্টির ছিটে লাগছিল গায়ে। হেব্বি আমেজ আসছিল। কখনো ট্রাফিক পুলিশের ঢঙে হাত নাড়িয়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছিল, কখনো বা মন্ত্রীদের বক্তৃতা দেওয়ার ভঙ্গিমায় সটান খাড়া হয়ে দাঁড়াচ্ছিল, যদিও কি বলবে মাথায় আসছিল না। খালি ফিক ফিক করে হেসে ফেলছিল। এত হাঙ্গাম, এত হট্টগোল। কি দারুণ মজা! মফিজুলের বাপ এখন চাইলে এই উঁচু থেকে গোটা দুনিয়াটাকে উঠবোস করাতে পারে। মাটির উপর পিঁপড়ের মত লোক আর গাড়ির ভিড়, সবাইকেই এক লাগে--ধনি-গরীবে তফাত থাকে না। ঝুঁকে পড়ে দেখতে যাওয়ায় দমকল আর পুলিশবাহিনী যেন মহা ত্রাসে “রে রে” করে ওঠে। আজ গোটা শহর তার বশে। যাকে যা বলবে তাই করবে। অফিসের বড় বাবু আজ চা খেতে গিয়ে সাড়া গায়ে উল্টে নাকানিচোবানি খাবে। স্যুট বুট পড়া অফিসার গাড়ি থেকে নেমে কলার খোসায় পা পিছলে পড়বে। সাদা জামা কেরানির গায়ে আজ কাদা ছিঁটিয়ে দেবে সজোরে পাশ কাটিয়ে যাওয়া অটোরিকশা। হাঃ হাঃ হাঃ! সবাই কিরকম বোকার মত ছুটছে। কিন্তু যাবে কোথায়, আজ মফিজুলের বাপ সব ভন্ডুল করে দেবে। গোটা কলকাতা শহর থেমে যাবে। সি এম বক্তৃতা দিতে গিয়ে তোতলাবে। পুলিশের চোর ধরতে পন্ডশ্রম হবে। ঠিক সেই সময় কলকাতা থেকে সাত হাজার মাইল দূরে এক উভ্রান্ত পুরুষ পেংগুইন দলের বিপরীতে ছুটতে শুরু করবে সুদুর পর্বতশ্রেণীর দিকে, তুষার মহাদেশের বুকে কোনো অনাবিল মুক্তির আহবানে। কলেজপড়ুয়া যুবক এফ এমে ফোন করে প্রেয়সীর জন্য গান উৎসর্গ করতে চাইবে; আর জে তাকে প্রশ্ন করবে, “তুমি কিভাবে বিখ্যাত হতে চাও?” ছেলেটা বলবে, “হাওড়া ব্রিজের মাথায় চড়ে।” সবাই হেসে উঠবে। পেংগুইনটা ভুখন্ডের অন্তর্দেশে খাবারের অভাবে এক সময় নিস্তেজ হয়ে মারা পড়বে। ভৌগলিক নিয়মে ভুগর্ভে জীবাশ্মে পরিণত হবে; আজ থেকে অনেক অনেক বছর পরে বৃষ্টি ভেজা শহরে সোমের কোনো বংশধর পেট্রল পাম্পে গাড়ি থামিয়ে জ্বালানি ভরাতে আসবে বলে। |
Comments
Post a Comment