সভ্যতার সংকটঃ দ্বিতীয় পর্ব | অনির্বাণ ভট্টাচার্য





ইন্দিরা-প্রমথ ছবি পোস্টাইছে – রবীন্দ্রনাথ দেখিয়াও দেখিলেন না, আজকাল ইন্দিরা আর আগের মতো নাই, ইনবক্সে কিছু লিখিলেও উত্তর নাই। বা, হয়ত মান রাখিবার জন্য সংক্ষেপে – ‘বাহ, ভালো লিখেছ রবিকা, আরও লেখো’। রবীন্দ্রনাথ এ চত্বরে খুব বেশীদিন আসেন নাই, তবে আসিয়াই ধরিয়া পারিয়াছেন অনেক কিছুই। যেমন এখানে  তোষামোদ বা ‘আমাকেও পরিবর্তে করিবে’ এসবের আরেক নাম লাইক, এখানে কিছু তোতাপাখিবুলি আর্কাইভ করিয়া রাখিতে হয়, কেহ দুর্বোধ্য কোনও লেখা দিলে বা কোনও অ্যাঙ্গেলেই সুশ্রী লাগিতেছে না এমন কোনও মুখভঙ্গি পোস্টাইলে সেই আর্কাইভ থেকে আহা কি সুন্দর গোত্রের কিছু একটা বাহির করিতে হয়। তারপর ঝুলি হইতে বাহির হয় মার্জার, আর কবির দক্ষিন হস্তের দিকে লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, কেননা রানু বলিয়া গেছে ইহার নাম মাউস। সম্বিত ফিরিল চ্যাটবক্সে চোখ পড়ে, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জরুরী তলব – ‘কাল সভায় আসছ নাকি?’ সভা? কবি ভাবিতে বসিলেন। এককালে এই মানুষটিকেই সভায় প্রেসিডেন্ট করার জন্য বারংবার হাজিরা দিতে হইয়াছিল কবিকে, তবু, বিদ্যাসাগর রাজি হন নাই। ‘আমরা বুড়োরা সভায় যাইয়া নাকি সব ভণ্ডুল করিয়া দিই। তোমরাই থাকো, তাজা রক্ত’সেই মানুষটিরই কিনা...মনে পড়িল। তবে এ সভা যে সে সভা নয়, এখানে বিদ্যুৎ থাকিবে, তাই মোমবাতি লাগিবে না। ধর্মীয় ষাঁড়েদের থেকে বাঁচিবার জন্য লড়াই। ‘কে কে যাচ্ছে’? ঈশ্বরচন্দ্রের চটজলদি উত্তর – ‘ডাক্তার মহেন্দ্রলাল, ব্রম্ভবান্ধব, নিবেদিতা, আজাদি চাই আজাদি চাই বলিয়া কান ঝালাপালা কড়া কিছু চ্যাংড়া ছোঁড়া আর যদি শরীর কুলায়, তাহলে শ্রীবিলাসের সাথে তোমার জ্যাঠামশাই’। টুক করিয়া কানেকশন চলিয়া যাইল। তাঁহাকে বাঁচাইয়া দিল। সভায় যাইবার বিষয়ে কবির কিঞ্চিত একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করে। অন্তর হইতে আর সাড়া পান না। আর তাছাড়া তিনি কী করিবেন, যাহারা মারিবে, তাহারা মারিবেই। পরমুহূর্তেই আবার সবুজ আলো। তবে বিদ্যাসাগর অফলাইন। দেয়াল বরাবর কবি নীচে নামিলেন। কেটি সেলফি দিয়াছে। কবিকে ধরিয়া লাইক সংখ্যা তেত্রিশ কোটি এক। ইদানীং এ চত্বরে সবাই অল্পবিস্তর কায়দা করিয়া কথাবার্তায় পারদর্শী, তাই অমিত রায়ের আলাদা করিয়া কোনও বাজারদর নাই। সে একটি একলা অ্যাকাউন্ট খুলিয়া মনমরা হইয়া বসিয়া থাকে। জীবনানন্দ দাশগুপ্ত বলিয়া একটি ছেলে ল্যান্সডাউন রোডে ঘর ভাড়া করিয়া থাকে। কষ্টে। প্রতিদিন একটি অন্ধকার গৃহের ছবি আপলোড করে, কেউ দেখে না, তবে কবির বেশ লাগে। তিনি শুধু লাইক না, রিয়্যাক্ট করিয়া একটি তম্বুলপত্রের ছবি সাঁটিয়া দেনসে প্রত্যুত্তরে তাঁহাকে ‘ধন্যবাদ কবিবরেষু’ বলিয়া অপদস্থ করে। শেষ ছবিটি দিয়াছিল গেল বার পূজার সময়ে, দেশপ্রিয় পার্কের। তারপর আর কিছু সংবাদ নাই বহুদিন। আশঙ্কা হয়। কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে। ভিড় বাড়িতেছে। কখন কাহার কী হয়। পার্কের ঈশ্বরই ভিড় সামলাইতে না পারিয়া মুখ ঢাকিলেন, তাহলে সে তো কবিমাত্র, কোন ছাড়। কবির বয়স হইতেছে, এত চিন্তা লইতে পারেননা। আচমকা এক নারীর ছবি চোখে পড়িল। এরকম কত যে মানুষের অচেনা আশ্রয়স্থল হইয়া পড়িতেছে তাঁহার সময়রেখা, তাহার ইয়ত্তা নাই। প্রায়ই ‘কী কবিবর কেমন আছেন?’ তিনি সৌজন্যবশত হয়তো লিখিলেন ‘ভালো’, অমনি ‘কাল দেখিলাম, হাসিলাম, আপনি তো ভাই কথা বলিলেন না, হাসিলেনও না?’ কবি বাহিরে তাকান। জোড়াসাঁকোর বয়স বাড়িতেছে। তাহার ভেনেশিয়ান গবাক্ষের স্মৃতিতে প্রতিদিন উড়িতে আসা একটিমাত্র শালিখ, দ্বিজেন-লোকেনের মতো রাতারাতি পাল্টে যাওয়া কলিকাতার রঙ, কিম্বা প্রতিদিন ছাদে বেড়াইতে গেলে তাঁহার দিকেই লক্ষ্য করিয়া নিম্নচাপলোভী বায়স - তাহাদের কেহও হয়ত তাঁহার দিকে তাকিয়া হাসিয়াছিল, কবি তাহাদের ভাষা বুঝিতে পারেন নাই। জগদীশকে তলব করিতে হইবে সে যদি জানে। বহুদিন গঙ্গাবক্ষের কাছে ফলতায় জগদীশের মনোরম গৃহে যাওয়া হয় নাই। জগদীশ এই চত্বরে ছিল এতদিন, প্রতিরক্ষা হইতে বিজ্ঞান শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রের অনুদান কম কেন বলিয়া ক্যাম্পেনিং করিত, ঈশ্বর-দেবতার ছবি শেয়ার হইবার বিপুল সুনামিতে গত সপ্তাহে হাবুডুবু খাইয়া সে পলাইছে। যাহাই হউক, কথার পিঠে কথা চলিয়া আসে, সেই মহিলা তাঁহার বান্ধব তালিকাতেই আছে, কবি জানিতেন না। ক্রিস্টালক্লিয়ায় ছবি। কবিকে ম্যাক্সিমাইজ করিতে হয় না। বেলজিয়ান আরশির সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছে। এলোকেশী। কবি দেয়াল হইতে রজনীগন্ধার সুবাস পান। দালানে বৃষ্টির গন্ধ পান। তড়িঘড়ি নামাইয়া আসেন। ফটিক গেম খেলিয়া কত স্কোর করিয়াছে, তাহার বিবরণ দিয়াছে। উপরন্তু এতেও ক্ষান্ত হয়নাই। তাঁহাকেও রিকুয়েস্ট পাঠাইয়াছে। ওঃ, এ ছেলেটি দেখিতেছি আবার বেয়াদবি শুরু করিয়াছে, ছুটি ছুটি করিয়া মাথা খারাপ করিত, এখন ক্যান্ডি ক্রাশ করিতেছেবলেন্দ্র ব্রম্ভবিদ্যালয় নিয়া ঘ্যানঘ্যান করিত, এখন গেল হপ্তায় ঠাকুরবাড়ির ওপর কী এক ছবি মুক্তি পাহিয়াছে, তাহার রিভিউ পড়িতেছে। সরলাও দেখিয়াছে, দেওঘর হইতে স্কাইপে আসিয়াছিল, কবি টেলিপ্যাথিতে টের পাহিয়াছেন, তাহার পর হইতে জ্ঞানদানন্দিনী কবির সহিত আর কথা বলিতেছেন না। উপরন্তু যাহা তিনি দুচক্ষে দেখিতে পারিতেন না সেই মেগাসিরিয়াল, উচ্চ শব্দ সহকারে দেখিতেছেন। কবি বুঝিতে পারেননা, ইহারা একই কাহিনী পুনরাবৃত্ত করে কেন? খুঁটিনাটি দেখিলে বোঝা যায়, ইহারা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী, পরনিন্দা ও রূপসজ্জায় নিমজ্জ রাখিতে পছন্দ করে, তাঁহার চোখের বালিতে একটি কুচক্রী পাহিয়া তাহাকেই গপ্পের নায়িকা বানাইয়াছে একটি মেয়ে ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে বসিয়া অস্ফুটে হাসিতেছে, আঃ এখানে তাঁহার গান ঢুকাইবার কী কারণ হইল। কবি চলিয়া আসেন। দেয়াল খোলা ছিল। দেখেন নাই, কখন গড়পাড় নিবাসী সুকুমার আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে এই চত্বরে। গড়পাড়েই ছেলেটির ঠাকুরদার প্রেসটি কবি একদিন দেখিয়া আসিয়াছেন। চমৎকার ভাবনা। তো, সেই সুকুমার মেসেজে একপাল রাখি পাঠাইয়া দিয়াছে। ওমা, রাখি কিসের। কবি আবার বিস্মৃতি হইতে মুক্তি পাইলেন। কার্জনের খবরাখবর নাই। শুনিয়া যাইতেছে থেরেসা বলিয়া কেহ একজন মসনদে বসিতেছেন। সরলা পোস্টাইয়াছিল ‘ফিলিং লিবার‍্যাল’। কবি বুঝিতে পারেন নাই। সরলা উত্তরে একটি হাস্যমুখ দিয়া লিখিয়াছিল - নারী শক্তির জয়। তবে কবির আবার রাস্তায় নামিয়া রাখি বাঁধিবার সময় আসিয়াছে। ধর্মঘট লইয়া একদল বলিতেছে পথে নামো, অন্যদল নামিলেই মুখ ভারকবি তবু সিরিয়াল মানিয়া লইতে পারেন, বাংলা ভাগ পারেন না। সুকুমার দীর্ঘদিন ধরিয়া রোগভোগ করিতেছে, কবির এহেন প্রস্তাব শুনিয়া একটি নতুন করিয়া চাঙ্গা হইয়া উঠিতেছে। এতো রাখি, কবি ভাবেন, কোথায় যে রাখি...। আড়চোখে নজরে পড়িল, প্রভাত কতক্ষণ হইতে আসিয়া বসিয়াছে, তাঁহাকে বলে নাই। মুখ জোড়া ঘর্ম। কলেজ স্ট্রীটের জ্যামে আটকাইয়া। তাহার শুকনো মুখ। রবীন্দ্র জীবনী তাহাকে নতুন করিয়া লিখিতে হইবে। তাড়াহুড়োয়, আর প্রকাশকের চাপে তড়িঘড়ি শেষ করিয়া দিয়ছিলেন। কী জ্বালা। রথী ইলিনয় হইতে আমেরিকার ট্রাক্টরের আপলোড করিয়াছেআজ প্রতিমার জন্মদিন। রথী তাই বোধহয় খুশীতে আছে। নোটিফিকেশনে আসিয়াছিল। কবি শুভেচ্ছা জানালেন। দেখিলেন তাহারও আগে শতাধিক। কেহ গোলাপ। কেহ কেক। সেরেস্তার কিছু লোক কবিকে এখনও জমিদার বলিয়া মনে করে। তাহারি একজন, গত মাসে দেখিলেন তাঁহাকে ত্যাগ করিয়াছে। কবি খুশী হইলেন, অচেনা অজানা মোসায়েবদের হইতে প্রায়শই ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট আসে। কবি ভদ্রতায় না করিতে পারেননা, তবে, তোষামোদি থেকে তিনি শতহস্ত দূরেই থাকিতে চান। তাই ইদানীং শান্তিনিকেতনও যান না। ভাবিলেন, বাঁচা গেছে। ও মা, পরদিন হইতে দেখেন, শিলাইদহের পুরনোর বদলে নতুন এবং নতুনের বদলে নতুনতর কুঠি, পদ্মার জলে নতুন ইলিশ, কন্যার বিবাহ সব খবরেই দেখিতেছি কবির নোটিফিকেশন বাক্স ভরিয়া গেছে। কবি ডিলিট করিতে করিতে ঘুমাইয়া পড়িতেছেন। পরে অবশ্য রানু বলিয়া গিয়াছিল ইহা ত্যাগ নহে, ট্যাগ। অতিমাত্রায় আদরের ভালো নাম। মহর্ষি বলিয়াছেন, তাঁহাকেও একটি অ্যাকাউন্ট খুলিয়া দিতে হইবে। কবি রাজি হননি। বয়স হইয়াছে। এসব লইতে পারিবেন না। তিনি বরং কাশী কিম্বা হিমালয় ঘুরিয়া আসুন। এখানে প্রিন্সেপ ঘাট হইয়াছে। তাঁহার স্থান সঙ্কুচিত। শুধু তিনতলার ওই কক্ষটি লোকে দেখিতে পায়না। যেখানে......সুভাষ ইনবক্সে লিখিয়াছে, সে তাসের দেশটি ফিরিয়া দিতে চায়। কবি বিস্মিত হলেন। কেন? তিনি কি কোনোভাবে আহত করেছেন এই প্রাণোচ্ছল ছেলেটিকে? স্কাইপে সুভাষের মুখ ম্রিয়মান দেখাইল। সে হাসিল। কিন্তু হাসিতে প্রান নাতাসের দেশ বলিতে কবির নাট্যগ্রন্থটি বলে নাই সে। চারিদিকে চারটি উদাসীন শাখা প্রশাখা লইয়া যে জাড়ুল বৃক্ষটি টব হইতে বাহির হইয়া থাকে বাচ্চাদের তেরঙ্গা প্যাস্টেলে কালার্ড হইতে হইতে, সুভাষ সেই বৃক্ষের কথা বলিতেছে। অবন খাসা আঁকিয়াছিল। মহাত্মাজী মুজফফরনগর, ত্রিলোকপুরী, সাহারানপুর ঘুরিয়া ঘুরিয়া অ্যাওয়ারনেস চালাইতেছেন, কবিকে ক্যাপশন লিখিতে বলিয়াছেন। গ্রুপ খুলিয়াছেন। তাঁহাকে না বলিয়াই ঢুকাইয়া লইয়াছেন। এল্মহারস, পিয়ারসনরাও অকুস্থলে চলিয়া গিয়াছে, বেলুড় হইতে দত্ত বাড়ির ছেলেটা এই ভাঙা শরীর লইয়াও ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প খুলিয়াছে। এমনকি দেশে ফিরে যাওয়ার ডিসিশন স্থগিত করিয়া শেষমেশ বাগবাজারে নিজের বোসপাড়া লেনের গৃহ হইতেই রাত্রিদিন এক করিয়া প্ল্যাকার্ড লিখিতেছে নিবেদিতা। কবি শেয়ার করিলেন। তিনি দ্রুত টাইপ করিতে পারেন না। ধীরে ধীরে, পাশের পাকুড় গাছটায় পাতা নড়া গুণিতে গুণিতে, ক্যাপশন লিখিলেন – ‘সভ্যতার সংকটঃ দ্বিতীয় পর্ব’। 


Comments