প্রসঙ্গঃ কবি ভাস্কর চক্রবর্তী : কবির স্ত্রী বাসবী চক্রবর্তী ও মেয়ে সোনাঝুরির সাথে কথোপকথন




Weekly-Editionভাস্কর চক্রবর্তী


(দলছুটের হয়ে সাক্ষাৎকারে নিয়েছেনঃ ভাস্করজ্যোতি দাশ, সুমনা ঘাঁটী ও অংশুমান। অনুলিখন: অংশুমান।)

অংশুমানঃ ভাস্কর বাবুকে নিয়ে আপনার প্রবন্ধটা পড়লাম উর্বী প্রকাশন-এর ‘নির্বাচিত ভাস্কর চক্রবর্তী’ বইটাতে। খুব মর্মস্পর্শী।

বাসবীঃ ওটা আসলে নন্দনে একটা ক্রোড়পত্রে বেড়িয়েছিল। এই বইটা করার সময় আবার এই লেখাটা দিলাম। যদিও আরো একটু সম্পাদনার কাজ বাকী ছিল। বইটা বেরোনোর সময় এত ব্যক্তিগত স্তরে অনুরোধ পেয়েছিলাম; সব লেখা নেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালনের সময় শঙ্খ বাবুর ওই বই রিলিজ করার কথা ছিল কিন্তু অসুস্থতার কারণে তিনি করতে পারেননি। খুব চাপের মধ্যে দিয়ে সম্পাদনা করেছি ওই বই, তবু খারাপ হয়নি। বিশেষ করে ডায়রি অংশটা খুব মূল্যবান বইটার মধ্যে। ওনার অপ্রকাশিত কবিতা সব ওখানে দিয়েছি। অরূপ রতন বসুর লেখা, মনীন্দ্র গুপ্তের লেখা আর অমিতেশ মাইতি এনাদের লেখাগুলো অনেক কষ্টে জোগাড় করা হয়েছিল। এগুলো খুব দামী।

অংশুমানঃ আপনি তো ওনাকে অনেকদিন ধরে অনেক কাছ থেকে দেখেছেন। উনি কেমন মানুষ ছিলেন, জীবন যাপন, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের কিছু বলুন।

বাসবীঃ এগুলো আমি লিখেছি আগেও। প্রচণ্ড এলোমেলো স্বভাবের ছিল। আর নিজের বক্তব্যে খুব অনড় থাকত। সংসারের চালনার জন্য পুরোপুরি আমার উপরে নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু নিজের কিছু জিনিষ খুঁজে না পেলে খুব রেগে যেত, যেমন পেন, লেখার কাগজ, সিগারেটের প্যাকেট বা কোনো বই এগুলো নড়াচড়া হলে চলতো না। এলোমেলো হলেও, ওঁর পড়ার ঘরে কোথায় অনুবাদ কবিতা, কোথায় প্রবন্ধের বই, কোথায় কবিতার বই, কোথায় পত্রিকা এগুলো মাথায় থাকত। সবসময় পড়াশোনা নিয়েই থাকত। স্কুলে প্রায় যেতেই চাইতো না। আমি ঠেলেঠুলে পাঠাতাম। আর পাড়ার চায়ের দোকানটাকে তো ওঁরা বরানগরের কফিহাউস বানিয়ে ফেলেছিল। কে না আসত! আর সারাক্ষণ ওখানেই বসে আড্ডা দিত। তোমাদের ভাস্কর দাই ওই চায়ের দোকানটাকে বিখ্যাত করে দিয়ে গেছে।

ভাস্করজ্যোতিঃ আপনার সাথে ওনার প্রথম আলাপ কবে কিভাবে হয়?

বাসবীঃ জয়(গোস্বামী) আর আমি খুব বন্ধু ছিলাম আর এক পাড়ায় থাকতাম ছোটবেলায়। তো যখন প্রমা থেকে ওর ‘রাস্তায় আবার’ বইটা বেরোয়, ১৯৮৩ সালে, তখন জয় একদিন আমায় বলে এই বইটার কথা। আমি যেহেতু ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতার ফ্যান ছিলাম, বইটা বইমেলাতে কিনবো ভেবেছিলাম। কিন্তু বিভিন্ন কারণে বইমেলাতে কেনা হয়ে ওঠেনি। বইমেলা শেষ হওয়ার পর দে বুক স্টোরে আমি বইটা কিনতে যাই। তখন এই ফেব্রুয়ারি মাস। আমি গিয়ে বইটা চাওয়াতে বলেছিল যে প্রমা থেকে বইটা পাঠায় নি এখনো। তখন আমার সাথে আমার এক ছোটবেলার বন্ধু দেবব্রত ঘোষালের দেখা হয়। আমরা কফিহাউসে কফি খাচ্ছিলাম তো কথায় কথায় ভাস্কর চক্রবর্তীর বই খোঁজার কথাটা জানতে পেরে আমায় বলে যে ও ভাস্কর দা কে চেনে। একই পাড়ায় থাকে, মাঝে মাঝে আড্ডাও মারতে যায় ভাস্কর দার বাড়ী। দেবু আমাকে ওনার স্কুলে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে আমি বলি যে আলাপ নেই যখন এমনি এমনি ওভাবে যাবো না। তারপরে উনিই হঠাৎ ওখানে আসেন, প্রথমে না দেখেই আমাকে দেবুর বান্ধবী তপতী ভেবে বসেন। তখন দেবু আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় আর বলে যে আমি ওনার কবিতার ভক্ত ও রানাঘাট থেকে ওর বই কিনতে এসেছি। দে বুকস্টোরে বইটা দেয়নি শুনে ও আমাকে একপ্রকার জোর করেই সঙ্গে নিয়ে যায় ওই দোকানে। তখন ভেতর থেকে সিল খুলে আমাকে বইটা বের করে দেয় ওরা। ও আমাকে বইটা দেয়নি, আমি কিনেছিলাম। তারপর কথা প্রসঙ্গে জয় ও আমার বাবার কথা বলি। আমার বাবা গোবিন্দ চক্রবর্তী চল্লিশের দশকের একজন কবি ছিলেন। এইটা শুনে ও বলে যে, আমাদের বাড়ীতে নাকি জয়ের সাথে একবার গেছিল কিন্তু তখন হয়তো আমি বাড়ীতে ছিলাম না। আমি বেথুন কলেজে পড়তাম, হস্টেলে থাকতাম। সেদিন এভাবেই কথা শেষ হয়। এটাই ছিল আমাদের প্রথমবার আলাপ। তারপর সেই বছরেই বিয়ে হয় আমাদের।

ভাস্করজ্যোতিঃ গোবিন্দ বাবুই কি ওই ব্যক্তি, যাঁর কাছ থেকে দশক হিসেবে কবিদের শ্রেণীবিভাগ শিখেছিলেন বলে বলে থাকেন জয় গোস্বামী?

বাসবীঃ হতে পারে, কারণ জয় খুব ছোটবেলা থেকেই আমাদের বাড়ী আসতো। অন্যদেরও নিয়ে আসতো। আমার বাবা খুব অল্প বয়সে মারা যান।

ভাস্করজ্যোতিঃ ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা প্রথম কোথায়, কিভাবে পড়েন আপনি?

বাসবীঃ প্রথম কিভাবে কোথায় পড়ি সেটা ঠিক বলতে পারবোনা। তবে আমি জয়ের বাড়ীতে গিয়ে সাধারণত কবিতা পড়তাম কারণ ওর বাড়ীতে অনেক সমসাময়িক ও সব ধরণের সাহিত্য পত্রিকা আসতো। এইরকম একদিন কোনো পত্রিকায় ওনার লেখা পড়ার পর আমার মনে হয় যে খুব ভাল লেখা ওনার। তখন জয় আমাকে ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’ বইটা পড়তে দেয়। তারপর আমি ‘এসো সুসংবাদ এসো’ বইটা কিনি। সুবোধ সরকার-এর কৃষ্ণনগর থেকে যে পত্রিকাটা বেরোতো সেখানে, আমার বন্ধু অনুপ-এর ‘ভূমিকা’ পত্রিকায়, কৃত্তিবাসে ইত্যাদি নানা জায়গায় ওঁর কবিতা পড়েছি।

ভাস্করজ্যোতিঃ বাংলা কবিদের বিবাহ-প্রস্তাব নিয়ে যে মিথ খুব প্রচলিত তা হল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের তাঁর প্রেমিকাকে মনুমেন্ট-এর মাথায় রীতিমত হুমকির মত করে প্রস্তাব দেওয়া। আর তারপরেই আমার মনে হয় ভাস্কর চক্রবর্তীর ওই ভাবে আপনাকে একটা অদ্ভুতভাবে বলা যে বাড়ীতে বোলো পাত্রের গোঁফ নেই। এটা শুনে আপনার প্রথম কি প্রতিক্রিয়া হয়?

বাসবীঃ এটা যখন হয় তখন আসলে আমি বিয়ে নিয়ে ভাবার মত পরিস্থিতিতে ছিলাম না। বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারের অবস্থা একটু কঠিন ছিল। তখন একদিন উনি আমাকে বলেন, ‘আমাকে বিয়ে করবেন?’ আমি বলি ওনাকে যে না আমি আসলে এখন এগুলো নিয়ে ভাবছি না। তখন আমরা একে অপরকে আপনি বলেই সম্বোধন করতাম। তো আবার আমায় বলেন যে, ‘তাহলে ভাবুন না।’ আমি তো তখন বলি যে না এখন মাকে বিয়ে নিয়ে বলা হয়তো সম্ভব হবে না। তখন উনি বলেন যে, ‘মা কে বলবেন, আমি একটা স্কুলে পড়াই, কলকাতায় একটা বাড়ী আছে আর আমার গোঁফ নেই।’ এটা শুনে আমি অবাক হয়ে যাই আর হাঁ করে তাকিয়ে থাকি।

ভাস্করজ্যোতিঃ তো শেষ পর্যন্ত আপনি বাড়ীতে গিয়ে বলেছিলেন?

বাসবীঃ না আমি বলতে সাহস পাইনি। আমার ছোট ভাইকে গিয়ে বলি প্রথম। আসলে মা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন বাবার মারা যাওয়ার পর তাই আমার পক্ষে বলা সম্ভব ছিলনা। মা একটু প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে রাজী হয়ে গেছিলেন। আসলে অনেকটা বয়সের তফাৎ ছিল প্রায় ১২ বছরের মতো, আর সেটাই ছিল মায়ের একটু আপত্তির কারণ।

ভাস্করজ্যোতিঃ ‘বোধশব্দ’-তে ভাস্কর চক্রবর্তীর ইন্টারভিউয়ে একটা জায়গায় বলছেন যে একটা প্রেমিকা ওনাকে এসে প্রস্তাবনা দেওয়ায় উনি উত্তরে বলছেন যে, ‘আমার তো আর চাকরী করা হবেনা।’ সেটা শুনে সেই প্রেমিকা বলেছিলেন যে, ‘আগে বিয়ে হোক তারপর দেখা যাবে।’

বাসবীঃ হ্যাঁ একজন মহিলা তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন ও নিজেই উপার্জন করে সংসার চালাবেন বলে দাবী করেছিলেন তিনি। ওটা একটা একতরফা প্রেম ছিল মেয়েটির পক্ষ থেকে। একদিন সকালে এই বাড়ীতে এসেছিলেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, তিনি নিজেই। উনি ডিভোর্সি ছিলেন, সঙ্গীহীনতায় ভুগছিলেন। খুব বড়লোক বাড়ীর মেয়ে ছিলেন ও ভাস্করকে খুব পছন্দ করতেন। এটাও ৮৩ সালেরই ঘটনা, তখন আমার সাথে সদ্য আলাপ হয়েছিল। আমি পরে এই কথাগুলো শুনি।

ভাস্করজ্যোতিঃ তো এইরকম জীবিকা ও জীবনধারণ ব্যাপারে উদাসীন একজনের সাথে বিয়ে করার রিস্কটা আপনি নিয়েছিলেন?

বাসবীঃ আসল কথা বলতে কি, তখন মনেই হয়নি এটা কোন রিস্ক বলে। তখন বয়সও অল্প ছিল আমার। আর যেহেতু ওঁর কবিতার খুব ফ্যান ছিলাম আর ওঁকেও খুব ভাল লেগেছিল তাই সব মিলিয়ে কিছু তেমন মনে হয়নি আমার। আর আমার নিজের ওপরে একটু বিশ্বাস ছিল, যেহেতু রেজাল্ট ভাল ছিল তাই খুব শীঘ্র একটা চাকরী আমি নিজেই পেয়ে যেতাম, এটাই ভেবে আরো কিছু মনে হয়নি।

ভাস্করজ্যোতিঃ আপনি তো দেখেই নিশ্চয় এটা বুঝেছিলেন যে উনি গৃহস্থ হিসেবে খুব একটা সেরকম ধরণের মানুষ নন। তাও এগিয়েছিলেন এই সম্পর্কের দিকে? পরের দিকেই বা ওনার সাথে গৃহস্থ জীবনে থেকে আপনার কি অভিজ্ঞতা হয়?

বাসবীঃ আমি প্রথমে যতটা ভেবেছিলাম, বিয়ের পরে দেখলাম যে আরোই খারাপ অবস্থা। একদমই সংসারী মানুষ ছিলই না ও। আমার বাবাও যেহেতু কবি ছিলেন তাই ছোটবেলা থেকেই দেখেছি একটা পরিবেশ যেখানে অনেক বেলা অবধি আড্ডা হত, চা খাওয়া চলতো আর ছড়ানো-ছেটানো ঘর, ছড়ানো সিগারেট ইত্যাদি। এগুলোতে মা খুব রেগে যেতেন। বাবাও এসবের মধ্যে অনেক কাজ ভুলে যেতেন। তবে তোমাদের ভাস্কর দা আরোই এলোমেলো ছিল। এরকম মানুষের সাথে সংসার করা খুবই কঠিন ব্যাপার। ভাস্করও প্রায় কাজ ভুলে যেত ভাল আড্ডা পেলে। তখন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়রা আসতো ফুটুর চায়ের দোকানে, সেখানেই সারাক্ষণ সময় কাটতো। সংসারের দায়িত্ব পালন করতে একদমই পারতোনা। তখন হয়তো এগুলো নিয়ে খুব রাগ হত, কিন্তু হয়তো খুব ভাল গৃহী হলে ও আজ এত বড় কবি হতে পারত না। তবে একটা ঘটনা আমার খুব দুঃখজনক লাগে আজও ভেবে, যে ছোট বোন কে খুব ভালবাসত ও, তার দুরারোগ্য অসুখের সময়, মারা যাওয়ার আগের দিন এভাবেই হাসপাতালে তাকে দেখতে গিয়ে উঠতে পারেনি। সেদিন ওঁর আনন্দবাজার পত্রিকায় একটা লেখা দিতে যাওয়ার কথা ছিল, সেখানেই গেছিল। আমি বলেছিলাম ওঁর বোনকে দেখতে যাওয়ার কথা। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রভৃতি আরো মানুষদের সাথে কাজে, আড্ডায় জড়িয়ে গিয়ে অনেক রাতে বাড়ী ফেরে। সেদিন রাতে আমি ওঁকে তিরস্কার করি। পরের দিন সকাল আটটায় আমার ছোট ননদ মারা যায়। এই ঘটনা নিয়ে ওঁর মনেও খুব কষ্ট ছিল সারাজীবন।

ভাস্করজ্যোতিঃ কবিপত্নীদের একটা ব্যাপার খুব হয় সাধারণত যে, তাঁরা কবিদের সাথে জীবন কাটানোর পর সন্তুষ্ট হন না। এটা সারা বিশ্বেরই ঘটনা বলা যেতে পারে। বা কবির সাথে সাংসারিক জীবন ভাল কেটেছে এটা খুব রেয়ার। আর বাংলা কবিদের ক্ষেত্রে জীবনানন্দের স্ত্রীর কথা সর্বোপরি উল্লেখযোগ্য। জীবনানন্দ মারা যাওয়ার পর তাঁর স্ত্রী বলেন যে, ‘বাংলা কবিতাকে তো উনি অনেক কিছু দিয়ে গেলেন কিন্তু আমাকে কি দিয়ে গেলেন!’ আমার প্রশ্ন এটাই যে, আপনার কি কখনও মনে হয়েছে যে একজন কবিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত আপনার ভুল হয়েছে?

বাসবীঃ না। আমার এটা কখনও মনে হয়নি। আমার আত্মীয়রাও অনেকে বলেছিল আমায় এই ব্যাপারে, কিন্তু আমার কোনদিন এরকম মনে হয়নি। আমি হয়তো এরকম মানুষের সাথেই ভাল থাকতে পারতাম একমাত্র। আমার অন্যান্য বিয়ের সম্পর্কও আসতো। কিন্তু খুব পার্থিব মানসিকতার মানুষের সাথে আমি নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারতাম না।
ভাস্করজ্যোতিঃ তো এর একমাত্র কারণ কি আপনার ওইরকম একটা পরিবেশের মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠা?

বাসবীঃ হ্যাঁ। আসলে আমার বেড়ে ওঠা বাবার সাথেই। খুব ছোটবেলা থেকে দেখতাম এইসব মানুষদের। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। হয়তো কবিতা বা সাহিত্যের খুব বেশিটা বুঝতাম না। কিন্তু ওইরকম পরিবেশ, ওইরকম মানুষ আমার খুবই ভাল লাগতো। বড় হওয়ার পর আমিও ওঁদের সাথে আলোচনায়, আড্ডায় অংশগ্রহণও করেছি। খুব ভাল লাগত সাহিত্য গান সব নিয়ে আলোচনা। কিন্তু আবার সংসারের আরো দিক থাকে, দায়িত্বের ব্যাপার থাকে। আমি হয়ত ওঁকে বুঝতে পারতাম কিন্তু অন্য লোকজনরা তো এগুলো নিয়ে বলতো। যেমন আমার ছোট ননদকে না দেখতে যাওয়ার ঘটনাটায় অনেকে অনেককিছু বলেছিলেন। খুব ভুল বোঝাবুঝিও হয়েছিল। আবার এরকমও হয়েছে যে আমার মেয়ে হওয়ার আগের একবার আমাকের ডাক্তার-এর কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ভুলেই গিয়েছিল। এগুলো তো স্ত্রীর প্রতি বড় দায়িত্ব। আমি ওঁর জন্য অপেক্ষা করে করে নিজেই চলে গেছিলাম একা ডাক্তারের কাছে। অনেক পরে ওঁর মনে পড়েছিল যে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল ও আমি রাস্তায় অপেক্ষা করবো। ওই অ্যাপয়েন্টমেন্টটা মিস করলে আবার ডাক্তারবাবু কে পেতে অনেক দেরী হত। তো আমি নিজেই ট্যাক্সি ধরে চলে গেছিলাম। পরে ফিরে এসে আমাকে ক্ষমা চেয়েছিল এই বলে যে রণজিৎ দাশ এসেছিল তাই অনেক বেশি আড্ডার মাঝে ভুলেই গেছিলাম যে তুমি দাঁড়িয়ে আছো। দায়িত্ব ব্যাপারটার ভীষণ রকম অভাব ছিল ওঁর মধ্যে। খুব দরকারি জিনিষের সময় এরকম হলে খুব কষ্ট হত আমার। শেষমেশ মনে হত, ও তো ওইরকমই আর কতই বা বলবো। কিন্তু ওঁর ক্ষেত্রে কোন ছোটখাটো কাজ আমি ভুলে গেলেই প্রচণ্ড রেগে যেত। একবার সুবোধ সরকার এর সাথে একটা ট্রান্সলেশন ওয়ার্কশপ এ গিয়ে একই ঘরে ওঁরা ছিল। তখন সুবোধ সরকার দুদিন থাকার পর আমায় বলেছিল, বাসবী তুমি ভাস্করের সাথে এতদিন ধরে সংসার করছো কী করে! ও আমার ঘরে থাকতো ঠিকই কিন্তু রোজ আড্ডা মেরে রাত করে ফিরতো আর লাইট জ্বালিয়ে কাজ করতে শুরু করে দিত। ও যেখানে থাকতো নিজের মত থাকতো, কারোর সুবিধে অসুবিধে খুব একটা দেখতো না।

ভাস্করজ্যোতিঃ আপনার তো জয় গোস্বামীর সাথে ভাল বন্ধুত্ব ছিল। তার মানে কবিতা নিয়েও আপনার নিজস্ব ভাবনা চিন্তা ছিল। ভাস্কর বাবুর সাথে কি আপনার সেভাবে কবিতা কেন্দ্রিক বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল? আপনারা কি কবিতা নিয়ে আলোচনা করতেন?

বাসবীঃ হ্যাঁ, আমরা আলোচনা করতাম। একদম শেষের দিকটাই হয়তো অতটা আর ছিল না। যখন থেকে ওর লাঙস্‌ এর সমস্যাটা ধরা পড়ে তখন ও খুব চুপচাপ থাকতো। আর আমাদের মধ্যে প্রধান ঝগড়ার বিষয় ছিল ওঁর ওই প্রচণ্ড পরিমাণে সিগারেট খাওয়া। আমি বলতাম কিন্তু ও শুনতো না। তখন আমাকে একটু ভুল বুঝেছিল এই নিষেধ করার জন্য। কিন্তু মৃত্যু শয্যায় শুয়ে আমায় বলেছিল যে আমার কথা ওঁর শোনা উচিৎ ছিল।

ভাস্করজ্যোতিঃ ক্যান্সার ধরা পড়ার পর উনি কতদিন বেঁচে ছিলেন?

বাসবীঃ এপ্রিল মাসে ধরা পড়ে তারপর জুলাইতে মারা যান। অর্থাৎ চার মাস।

ভাস্করজ্যোতিঃ এই কদিন বেঁচে ছিলেন তা সত্ত্বেও ওনার কবিতায় মৃত্যুর কথা অনেকদিন আগের থেকেই পাই। যেমন উনি এই ধরণের কথা লিখছেন যে, এত দিন বেঁচে আছি এটাই অনেক ইত্যাদি। এটা কী করে?

বাসবীঃ ওঁর কবিতায় তো মৃত্যু চেতনা ছিলোই। আর মৃত্যু নিয়ে অদ্ভুত অবসেশনে ভুগতো। মাঝে মাঝে ঘুমোতে যাওয়ার সময়ও এরকম বলতো যে, কাল যদি আর না ঘুম ভাঙে। সামান্য জ্বর হলেই ও মনে মনে ভয় পেত যে হয়তো আর বাঁচবে না। খুব ছোটবেলা থেকেই ওঁর এটা ছিল। হার্ট অ্যাটাক আর ক্যান্সারে খুব ভয় ছিল। ও খুব সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিল। কিন্তু ক্যান্সারের আগেও ওঁর ফুসফুসে অন্য সমস্যা ধরা পড়ে ছিল। তখনও এক পকেটে ইনহেলার আর অন্য পকেটে লাইটার সিগারেট নিয়ে ঘুরতো। দিনে তিন প্যাকেট সিগারেট খেত।

ভাস্করজ্যোতিঃ ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতাকে ডকুমেন্ট হিসেবে ধরলে কিন্তু এটা বোঝার উপায় নেই যে উনি এত পরে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন।

বাসবীঃ ওই বাবরী মসজিদ কাণ্ডের সময় ওঁর প্রথম ওই ফুসফুসের সমস্যাটা ধরা পড়ে। খুবই সিগারেট খাওয়ার ফল। যদিও প্রথমের এই সমস্যাটা নন-স্মোকার দেরও হয় বলে জেনেছিলাম ডাক্তারের থেকে।

ভাস্করজ্যোতিঃ আপনি এত কবিতার জগতে ছোটবেলা থেকে থেকেছেন। আপনি কবিতা লেখেন নি?

বাসবীঃ ছোটবেলায় যেমন সবাই চেষ্টা করে আমিও করেছিলাম। সিরিয়াসলি আর চেষ্টা করিনি।

ভাস্করজ্যোতিঃ ভাস্কর বাবু আপনাকে কবিতা লিখতে বলতেন না?

বাসবীঃ না। বরং ও পছন্দ করতো না আমি যদি কবিতা লিখার কথা বলতাম। আমি অন্য লেখা লিখলে, যেমন গদ্য ইত্যাদির ক্ষেত্রে কিছু বলতো না। ও আমাকে কোনোদিন লেখার ব্যাপারে ইন্সপায়ার করেনি।

ভাস্করজ্যোতিঃ আপনার কবিতামত ও তাঁর কবিতামত এর পার্থক্য ছিল? মানে ওনার কোনো লেখা আপনার পছন্দ হলো না বা অন্য কবিতা নিয়ে পছন্দ বিষয়ে তর্ক হল এরকম হত? তাহলে সেরকম একটা ঘটনা বলুন।

বাসবীঃ হ্যাঁ আমার দ্বিমত থাকতো মাঝে মাঝে। সব কবিতা কি আর ভাল লাগা সম্ভব? ভাল না লাগলে বলতাম। আর ওঁর কাছে যেসব তরুণ কবিরা আসতো তারা ভীষণ রকম ভাস্করপন্থী ছিল। ভাস্কর ভালো বললে তারাও ভালো বলতো। এটা আমি খুব একটা মানতাম না। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে ওঁরা ভালো বলতো না। কিন্তু আমার ভালো লাগতো আমি বলতাম। যারা আসতো খুব নাক উঁচু ছিল। তাদের মধ্যে সুমন্তও একজন। আবার আমার গায়ত্রী গুপ্তর কবিতা ভাল লাগতো না, কিন্তু ওদের খুব ভাল লাগতো তার লেখা। এইরকম বিষয়ে অনেক ঝগড়া হত। ওঁরা বলতো, হয় ভাল না হয় খারাপ এর বাইরে কিছু হয়না। কিন্তু আমি এরকম করে ভাবতাম না।

অংশুমানঃ উনি কবিতা লেখার পর আপনাকে পড়াতেন?

বাসবীঃ না কখনোই না। কাউকেই লেখা পড়াতেন না উনি। বাড়ীতে এত ছেলেমেয়েরা আসতো তারা তাদের কবিতা পড়াতো ওঁকে কিন্তু ও কখনো ওঁর কবিতা পড়াতো না।



সুমনাঃ উনি কেন এরকম করতেন বলে আপনার মনে হয়?

বাসবীঃ ও এইসব বিষয়ে একটু সংকুচিত থাকতো। হয়ত ভাবতো যে ভাল হয়নি বোধহয়। কিন্তু শঙ্খ ঘোষ কে পড়াতো স্ক্রিপ্ট করার পর। এটাও আমার শোনা কথা যদিও। ‘জিরাফের ভাষা’ আর ‘কীরকম আছো মানুষেরা’ এই দুটোর ক্ষেত্রে আমি জানি যে শঙ্খ বাবুকে দেখিয়েছিল। হয়ত তখন শরীর খারাপের জন্য মন দুর্বল হয়ে গেছিল।

ভাস্করজ্যোতিঃ জিরাফের ভাষা-এর শেষ কবিতাটা কি ওনার ক্যান্সার ধরা পড়ার আগেই লেখা হয়ে গেছিল? ওনার শেষ কবিতার শেষ লাইনটা হল, ‘চলে যেতে হচ্ছে বলে চলে যাচ্ছি, নাহলে তো আর একটু থাকতাম।’ কবি সুজিত সরকার বলেছেন প্রত্যেক বড় কবিই বুঝতে পারেন যে তাঁর মৃত্যু এসে গেছে। তো শেষ লাইনটা কি আপনার কোইন্সিডেন্স মনে হয়?

বাসবীঃ জিরাফের ভাষা বইটার কবিতাগুলো অনেকদিন ধরে লেখা। শেষ কবিতাটা অনেক পরের। তখন হয়তো ক্যান্সার ধরা পড়েনি কিন্তু ও খুব অসুস্থই ছিল। এপ্রিলে একদিন গলা চোক্‌ড্‌ হয়ে যায়। আমরা অর্কিড নার্সিং হোমে নিয়ে যাই। ডা. পার্থসারথি ভট্টাচার্য কে দেখাই। প্রথম বাইওপ্সি রিপোর্ট অনুযায়ী ক্যান্সার ধরা পড়েনি। বিনাইন টিউমার বলে রিপোর্ট আসে। জ্বর আসতো। ওজন কমে যাচ্ছিল। তখন আবার টেস্ট করে ধরা পড়ে। এখানে প্রাথমিক চিকিৎসা করার পর মুম্বাই নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে সময় আর আমরা পাইনি।

অংশুমানঃ উনি তো ব্রাহ্মণ ছিলেন, তো ধর্ম, ঈশ্বর এগুলো সম্পর্কে ওনার মতধারণা কি ছিল?

বাসবীঃ পুরোপুরি নাস্তিক ছিল ও। ব্রাহ্মণ ছিল, ছোটবেলায় পৈতেও হয় কিন্তু সেটা ও খুলে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু ওঁর বাবা ছিল সংস্কৃতের পণ্ডিত। খুব নামকরা পণ্ডিত, ন’টা উপাধি ছিল ওনার। উনি পুজো করতেন। সংস্কৃত টোলেও পড়াতেন। কিন্তু ভাস্কর ভয়ঙ্কর নাস্তিক ছিল। জ্যোতিষী, ঈশ্বর কিছু মানতো না। এমনকি হোমিওপ্যাথিতেও ওঁর বিশ্বাস ছিলনা। বললে উৎপল বাবুর কবিতার ওই লাইনটা শোনাতো, ‘তোমার চোখ হোমিওপ্যাথির মত করুণা নির্ভর।’
ভাস্করজ্যোতিঃ বাংলা কবিতার কবিদের মধ্যে আপনার প্রিয়তম কবি কে? আর প্রিয় কবিদের সারিতে ভাস্কর চক্রবর্তীর অবস্থানই বা কোথায়?

বাসবীঃ প্রিয়তম কবির নাম আমি ওভাবে বলতে পারবোনা। তবে ভাস্কর চক্রবর্তী সম্পর্কে আমি বলতে পারি যে উনি আমার কাছে অন্যতম সেরা বাংলা কবিদের মধ্যে একজন।

ভাস্করজ্যোতিঃ উনি এত বড় একজন কবি এটা জেনে ওনার সাথে থাকতে আপনার কেমন লাগতো? কি অনুভূতি হতো?

বাসবীঃ হয়তো সেইসময় সেরকম ভাবে কিছু মনে হতনা। কিন্তু সবাই যখন নাম করতো, ভালো বলতো তখন খুব ভালো লাগতো আমার। একটা দুঃখ ছিল যে ও সেরকম কোনো পুরস্কারও পায়নি। জনপ্রিয়তাটাকে হয়তো এগুলো দিয়েই মেপে থাকি আমরা। কিন্তু ও কখনো নিজের প্রচার করতো না। বরং চাপা স্বভাবের ছিল খুবই। আমি বিয়ের পরে জোর করে অনেক কবিতার আসরে নিয়ে যেতাম। সেটাও সে পরের দিকে প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল। আর মেয়ে হওয়ার পর আমিও তেমনভাবে ওকে এগুলোতে সঙ্গ দিতে পারিনি। তার আগে খুব ওঁর সাথে থেকেছি। প্রথম দিকে তো অনেকে বলতো ভাস্কর বউ নিয়ে ঘুরছে এটা কেমন যেন লাগছে। এটা বলেছিলেন, প্রমার সুরজিৎ বাবু আর রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় এঁরা। নবনীতা দেব সেন বলেছিলেন, বিয়ে হয়েছে বাসবী চলে এসেছে এখন তো আর তোমার কবিতায় দুঃখ থাকবেনা ভাস্কর। এটাও কী কখনও হয়? বিয়ে করে কি আর জীবনে সমস্ত অনুভূতি পাল্টে যায়? একজন কি আর একজনের জীবনের সমস্ত বিষণ্ণতা সমস্ত একাকীত্ব মুছে দিতে পারে বা সব জায়গা ঘিরে থাকতে পারে? ভাস্করই লিখেছিল, ‘বিবাহ কি আর এমন ঘটনা?’

ভাস্করজ্যোতিঃ ভাস্কর চক্রবর্তী আমার একদম প্রথম পড়া কবিদের মধ্যে একজন। ওনার কবিতা পড়ে আমার মনে হয়েছিল যে আমি তাঁকে বহুদিন চিনি। কবিতার মধ্যে দিয়ে একটা আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল ওনার সাথে আমার। তখন আমি জানতামও না যে ওনার বয়স কত বা এমনকি উনি এতটা বিখ্যাত কবি সেটাও জানতাম না। কিন্তু তখন ওনার লেখালিখি আমার উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। সেই সময়ে তথ্যকেন্দ্র পত্রিকায় আমি একটা ছোট বিজ্ঞাপন পাই, তাতে লেখা ছিল যে কবি ভাস্কর চক্রবর্তী খুব অসুস্থ ও চিকিৎসার খরচ পরিবার থেকে যথাযথভাবে চালানো যাচ্ছেনা এই ব্যাপারে সাহায্য করুন। আর তাতে শঙ্খ ঘোষের ফোন নাম্বার দেওয়া ছিল ও তাঁর বাড়িতেই পৌঁছে দেওয়ার কথা লেখা ছিল। আমি তখন টিউশন পড়তে যাওয়ার টাকা মেরে জমিয়ে বই কিনতাম। সেই সূত্রে তখন আমার কাছে পাঁচশো টাকা জমেছিল। এই বিজ্ঞাপন দেখে আমি শঙ্খ ঘোষ কে ফোন করি(ভয়ে ভয়ে)। তখন উনি বললেন খবরটা ঠিকই কিন্তু আমরা তো তথ্যকেন্দ্র পত্রিকার নামই জানিনা। বললেন আমাকে সরাসরি বাড়ীতে টাকা পৌঁছে দিতে। আমি সেই টাকাটা পাঠাই ও পরে আমার কাছে সেই টাকা ফিরে আসে। আর রিসিভিং ডেটটা দেখে আমি জানতে পারি যে ওনার মৃত্যুর একদিন পরে ওই টাকা এই বাড়ীতে পৌঁছেছিল। তখন আমার মনে হয়েছিল, আমার জিরো জিরো সেভেনের পায়ে আমার ফুল পৌঁছলো না। তো এই বিজ্ঞাপন ও শঙ্খ বাবুর কথাগুলো আমি জানতে চাইছিলাম একটু।

বাসবীঃ আমরাও ঠিক জানতাম না এই বিজ্ঞাপনের রহস্য। ওটা কে যে কীভাবে দিয়েছিল জানিনা। ওই পত্রিকার নামও আমরা জানতাম না সত্যিই। তুমি ছাড়াও আমাকে অনেকে এই বিজ্ঞাপনের কথাটা বলেছিল। ক্যান্সারের চিকিৎসায় খুব খরচা। তখন আমি চাকরী করতাম ঠিকই কিন্তু আমি সঠিক স্কেলে মাইনে পেতাম না। তাই অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের খুব ভাল ছিলনা। ওর স্কুল থেকে পঁচিশ হাজার টাকা মত তোলা হয়। কিন্তু ওই বিজ্ঞাপন আমরা দিইনি। তবে কালীকৃষ্ণ দা, ভাষাবন্ধনের নবারুণ বাবু, শঙ্খ ঘোষ অনেকেই হেল্প করেছিলেন ওঁর চিকিৎসায়। তারপর আমরা মুখ্যমন্ত্রী তহবিলে আবেদন করি সাহায্যের জন্য। আমরা সেই টাকা যখন পাই, তার দুদিন আগেই ও চলে গেছে। তখন সেই টাকাও আমরা ফেরত দিয়ে দিই। হয়তো তোমার পাঠানো টাকা ওভাবেই আমরা ফেরত পাঠিয়েছিলাম তখন। কারণ ওগুলো আর তো কোনোভাবেই কাজে লাগতো না। যার জন্য সে টাকা, সে মানুষই তখন আর আমাদের মধ্যে নেই।

ভাস্করজ্যোতিঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে ভাস্কর চক্রবর্তী ধ্যানধারণা কি ছিল?

বাসবীঃ রবীন্দ্রনাথের গানের অসম্ভব ভক্ত ছিল। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তেমন বেশি কথা বলতে আমি শুনিনি ওকে। কোনো ঘটনা পরিপ্রেক্ষিতে কখনো কখনো বলতে শুনেছি রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন। রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের খুব ভক্ত ছিল এটা জানি।


ভাস্করজ্যোতিঃ আর জীবনানন্দ দাশ?

বাসবীঃ ও প্রচণ্ড ভক্ত ছিল জীবনানন্দের।

ভাস্করজ্যোতিঃ জীবনানন্দ পরবর্তী কাদের কবিতা ওনার ভাল লাগত?

বাসবীঃ শঙ্খ ঘোষ এর কবিতা পছন্দ করত। প্রণবেন্দু দাশ, উৎপল কুমার বসুর লেখা খুব ভাল লাগত ওঁর। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম দিকের লেখাও ও পছন্দের ছিল।

ভাস্করজ্যোতিঃ জীবনানন্দ পরবর্তী কবিদের উপর যেমন তাঁর প্রভাব ছিল ঠিক তেমনি কি ওনার কবিতায় জীবনানন্দের প্রভাব ছিল? বা উনি কোনোদিন এরকম ধরণের কিছু বলেছেন?

বাসবীঃ ও কোনোদিন সেরকম কিছু বলেনি। আর আমারও মনে হয়নি সেরকম কিছু।

ভাস্করজ্যোতিঃ আমি দু-একটা জায়গার কথা বলতে পারি যেখানে আমার মনে হয়েছে সেই জায়গা গুলোতে জীবনানন্দের প্রভাব আছে, যেমন, ‘বাস থেকে নেমে মনে হল বিদেশেই আছি, তবু কে ওই মেয়েটি? আমাদের ঘরের মেয়ের মত মনে হয়।’ এখানে ডিকশনটা দেখে আমার মনে হয়েছে জীবনানন্দ দ্বারা ক্ষীণ প্রভাবিত। আমি বলছি ওনার জীবন বা কবিতা চর্চার ক্ষেত্রে কি জীবনানন্দের প্রভাব ছিল?

বাসবীঃ জীবনানন্দ কে খুব বড় কবি বলে শ্রদ্ধা করত। তাই হয়তো কোনো না কোনো ভাবে ভেতরের সম্পর্ক ছিলই। ওঁর কথা বার্তায় জীবনানন্দ, শঙ্খ ঘোষ এঁদের কবিতার লাইন উঠে আসতোই। আর ওঁর খুব প্রিয় বই ছিল বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো চাকা’।

ভাস্করজ্যোতিঃ আমরা দেখি যে ভাস্কর চক্রবর্তীর প্রথম বই থেকেই ভাষা ও আঙ্গিকের দিক থেকে সম্পূর্ণ নতুন একটা দিক।

বাসবীঃ হ্যাঁ এটা হয়তো খুব বড় কবির লক্ষণ। একজন কবি ২১-২২ বছর বয়সে কবিতা লিখছে আর তার কাব্যভাষাতেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে মৌলিকত্ব। আর জীবনের শেষ কবিতা পর্যন্ত লেখার মান নিচে নামেনি। ওর যদি কোনো কবিতাকে ঠিকঠাক না মনে হত তাহলে ওঁর একটা বাতিল কবিতার ফাইল ছিল সেখানে রেখে দিত। ওই বাতিল কবিতাগুলোকে আমি ‘নির্বাচিত ভাস্কর’-এ দিয়েছি।

ভাস্করজ্যোতিঃ আপনার কখনো মনে হয়নি যে ‘ ভাস্কর চক্রবর্তীর বাতিল কবিতা’ নামে একটা বই বের হোক? তাতে আমাদের মত তরুণ কবিদের অনেক লাভ হত। আমরা শিখতে পারতাম কিভাবে বিচার করতে হয় ভালো কবিতা।

বাসবীঃ না আমার মনে হয়নি। কারণ ও বেঁচে থাকলে এটা কখনো চাইতো না। আর আমি তো বললাম ও খুব খুঁতখুঁতে স্বভাবের ছিল। তাই আমার এরকম কিছু মনে হয়নি করার কথা। তবু মনে অনেক দ্বিধা রেখে আমি ডায়রি থেকে কিছু অপ্রকাশিত লেখা ‘নির্বাচিত ভাস্কর’-এ দিয়েছি। ও যদি দেখতো যে এইসব কবিতা আমি ছাপছি তাহলে আমার উপর যে কী রাগ করতো সে কেবল আমিই বুঝছি। আনন্দবাজারে লেখার পর রণজিৎ আমাকে ফোন করে বলেছিল যে, উনি বেঁচে থাকলে এই লেখা পরে উনি আমায় তিরস্কারই করতেন। প্রচণ্ড পারফেকশনিস্ট ছিল ও। একবার দেশ-এর পূজা সংখ্যায় একটা কবিতা দিয়ে এসেছিল। পরে ওঁর মনে পড়ে যে একটা লাইনে কমা দেয়নি। এটা নিয়ে সারারাত আমাকে বলেছিল, যে ওইখানে কমা না দিলে আমার পাঠকের প্রতি অবিচার করা হবে। আমাকে সুনীলদার কাছে যেতে হয় পরের দিন। সুনীল দা ফাইল নামিয়ে ওঁর কবিতাটা বের করেন ও দেখেন যে কমাটা ওখানে ছিলই। আমার খুব লজ্জা পেয়েছিল। আসলে ও কমাটা দিয়েছিল তারপর ভুলে গেছিল যে ওটা দিয়েছে কিনা। তাই ওঁর কাজ করতে গেলে আমারও মনে হয় একটু ভাল ভাবে ওঁর কথা মাথায় রেখে করি। শ্রেষ্ঠ কবিতার ক্ষেত্রেও আমি এরকম খুব ভয়ে ভয়ে কবিতা সিলেক্ট করেছিলাম। পরে যদিও সবাই বলেছিল ভাল হয়েছে।

ভাস্করজ্যোতিঃ আমরা দেখি ওনার কবিতায় মেয়ে সোনাঝুরির কথা বারবার এসেছে। মেয়েকে নিয়ে চিন্তার কথা এসেছে। আর এমনভাবে লিখেছেন যে সব বাবাই ওই কথাগুলোকে নিজের সাথে রিলেট করতে পারে। এখানে ওনার একটা বিরাট সাফল্য। তো ভাস্কর চক্রবর্তীর সাথে মেয়ের সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলুন।

বাসবীঃ মেয়েকে খুব ভালবাসত ও। কিন্তু মেয়ে তখন খুব ছোট যখন ও মারা যায়। মেয়ের মধ্যেও তখন সেভাবে উপলব্ধি আসেনি ওঁর চলে যাওয়া নিয়ে। তখন ও সবে ক্লাস সিক্সে উঠেছে। এখন মেয়ে বড় হচ্ছে এখন খুব অনুভব করে বাবার অনুপস্থিতি। বাবার কবিতা পড়ে। ওর মধ্যেও বাবার মত একটা চাপা, গোপন ব্যাপার আছে। বাবার মত দুঃখপ্রকাশও কম করে। মাঝে মাঝে বাবার কবিতা পড়ে। ভাস্কর খুব ভালবাসতো ওকে। একটা কথা এই যে, ভাস্কর মেয়েকে খুব সময় দিত। মেয়েকে অদ্ভুত একটা নামে ডাকতো, হুতাতাতা। একবার সোনাঝুরির এক বছর বয়সের সময় মাথায় ইট পড়ে গিয়ে খুব বিপজ্জনক ভাবে আহত হয়। সেদিন দেখেছিলাম মেয়েকে নিয়ে ভাস্করের চরম উদ্বেগ। আর সেদিনই প্রথম ওঁকে কাঁদতেও দেখি।

ভাস্করজ্যোতিঃ ওনার কবিতায় বাজারের প্রসঙ্গ উঠে আসে। এক জায়গায় লিখছেন, একদিন বাজারের থলে হাতে বাজার করবে আমাদের ছোট্ট সোনাঝুরি। এখান থেকে কি মনে হয় যে, উনি যেমন বাজার করতেন না বটে কিন্তু মনে মনে খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন এটা ভেবে যে আপনাকে বাজার করতে হয় বা একদিন সোনাঝুরি কে করতে হবে?

বাসবীঃ হ্যাঁ, ওঁর মধ্যে একটা অপরাধ বোধ তো কাজ করতই যে ও সংসারের কাজ করেনা আমি করি। পারতোনা কিন্তু অপরাধ বোধ ছিল। আর এই সব ব্যাপারে অন্যের উপর নির্ভরশীলতা ছিল।

ভাস্করজ্যোতিঃ অনেক কিছুর উল্লেখই দেখছি ভাস্কর বাবুর কবিতায়, কোথাও কি আপনার কথাও লেখা আছে?

বাসবীঃ না আমাকে নিয়ে তেমন কোন লেখা নেই ওর। আমার উল্লেখ প্রায় নেই বললেই চলে। যদিও প্রেমের কবিতা অনেক লিখেছে। প্রথম দিকের কবিতায় কিছু কিছু লাইনে উল্লেখ ছিল। সেটা হয়তো আমার পক্ষেই অনেক ক্ষেত্রে বোঝা সম্ভব যে ওখানে আমার কথাই লেখা আছে। এক জায়গায় লিখেছে, ‘মেয়েটি নাটকের টিকিট কেটে আনলো’, এখানে আমি জানি যে আমার কথা। কারণ আমরা নাটক দেখতে যেতাম খুব, আর আমিই অনেকবার দুজনের জন্য টিকিট কেটে এনেছি। সিনেমা দেখতে গেলে টিকিট আমিই কাটতাম। সিনেমা দেখতে গিয়েও অনেকবার লেট করে পৌঁছোতো। অন্যদের সাথেও ও দেখতে যেত নাটক। এক-একবার আমায় না বলেও চলে যেত শ্যামল নামের ওঁর এক বন্ধুর সাথে।

ভাস্করজ্যোতিঃ ওনার নিজের কবিতা সম্পর্কে উনি নিজে কি বলতেন?
বাসবীঃ তেমন কিছু না শুধু বলতো, যা লিখতে চেয়েছি তার কিছু লিখতে পারিনি। আর একটা কথা বলতো যে, আমি যেসব কবিতা লিখেছি সেসব তরুণদের হতাশার দিকে ঠেলে দিতে পারে হয়তো।

ভাস্করজ্যোতিঃ এটা একটা ব্যাপার যে গেথের ‘সরোউ অব ইয়ং আরথার’ পড়ে অনেক তরুণ আত্মহত্যা করেছিলেন। কিন্তু ভাস্কর বাবুর এইরকম চিন্তা অমূলক কারণ আমি নিজেই ক্রাইসিসের সময়ে ওনার লেখা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে থাকি।

বাসবীঃ সে তো আমিও একজনের কথা জানতাম যে সুইসাইড নোটে লিখে গেছিল যে সে শীর্ষেন্দুর ঘুণপোকা নাকি সাতান্ন বার পড়েছিল। যদিও তার ব্যক্তিগত জীবনও খুব দুঃখের ছিল। কিন্তু ভাস্করের ক্ষেত্রে আমি বলবো যে ওঁর লেখায় আপাত হতাশা থাকলেও তার ভেতরে শুধুই আশার কথা। রণজিৎ দাশ ও আনন্দবাজারে সেটাই লিখেছেন যে ভাস্করকে বিষণ্ণতার কবি বলে ভাবা ঠিক না উনি উত্তরণের কথাই লিখেছেন বারবার। অনেকেই ভাস্করকে বলেছে যে, ও তাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা।

ভাস্করজ্যোতিঃ উনি বেঁচে থাকতে কি বুঝেছিলেন যে উনি পরবর্তী প্রজন্মের উপর, তাদের লেখার উপর এতটা প্রভাব ফেলবেন? এমন একদিন আসবে যেদিন প্রত্যেকের প্রিয় কবির নামের ক্ষেত্রে একটা কমন নাম হয়ে উঠবেন?

বাসবীঃ হ্যাঁ, ও এটা বুঝেছিল। পরবর্তী প্রজন্ম তো বটেই, এমনকি ওঁর সমসাময়িক অনেকের লেখায় ও ওঁর প্রভাব থাকতো এটাও ও বুঝতো। অনেকেই সেই সময় স্বীকার করেছেন ও বলেছেন ভাস্করকে যে, লেখায় ওঁর প্রভাব এড়ানো মুশকিল হয়ে উঠে তাদের।

ভাস্করজ্যোতিঃ ওনার পরবর্তী কবিদের মধ্যে কার লেখা পছন্দ হতো?

বাসবীঃ বিশেষত, ওঁর থেকে তরুণ যারা তাদের সাথেই ওঁর মেলামেশা বেশি ছিল। ওঁর পরবর্তীদের মধ্যে জয়ের লেখা খুব ভালোবাসত ও। জয়ের লেখা নিয়েও ও আনন্দবাজারে সমালোচনা লিখেছিল। আর সেখানে জয় যে পরবর্তীকালে খুব বড় জায়গায় পৌঁছবে সেটাও ও বলেছিল যেটা সত্যিই হল। মৃদুল দাশগুপ্ত, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, মল্লিকা সেনগুপ্ত, সুবোধ সরকার, রণজিৎ দাশ এদের পছন্দ করতো। তরুণদের কবিতা খুব পড়তো।
ভাস্করজ্যোতিঃ উনি কি কোনো ‘ইজ্‌ম্‌’ এ বিশ্বাস করতেন? মানে লেখার ক্ষেত্রে পোস্টমর্ডানিজম ফলো করছেন কিনা ইত্যাদি বিষয় কি মাথায় রাখতেন?

বাসবীঃ না এইসব ভেবে ও লিখতো না। অনেক ইন্টারভিউয়ে জিজ্ঞাসাও করা হত ওঁকে এই কথাটা। ও বলতো, কেউ হয়তো ওঁর কবিতায় কোনো ‘ইজ্‌ম্‌’ খুঁজে পেতে পারে কিন্তু ও এসব ভেবে কবিতা লেখে না। শয়নযান-এ জায়গার কবিতা নিয়ে কিছু ও লিখেছে। আমার নিজেরও মনে হয় আগে থেকে ওইভাবে ফ্রেম করে নিয়ে লেখা সম্ভবও নয় হয়তো।

ভাস্করজ্যোতিঃ কবি নন এমন বন্ধুদের সাথে ওনার কেমন সম্পর্ক ছিল?

বাসবীঃ এমনি তেমন বন্ধু খুব বেশি ছিলনা। কিছু বন্ধু ছিল পাড়ার, যাদের সাথে তাস খেলতো, দাবা খেলতো। আর সেইসব বন্ধুরা ওঁকে খুব ভালোবাসত। ও খুব ভাল দাবা খেলতো। আমি তো ওঁকে কোনদিন অন্তত হারতে দেখিনি। অতিরিক্ত আড্ডা আর তাস খেলার জন্য আমার অবশ্য সেইসব বন্ধুদের খুব একটা ভাল লাগতো না।

ভাস্করজ্যোতিঃ উনি জীবনে কোনদিন কোনো পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন?

বাসবীঃ না। সুমন্তরা ‘নীল অপেরা’ বলে যে পত্রিকাটা করত সেটার দায়িত্ব দিতে চেয়েছিল একবার। তাতে কিছু কবিতা সিলেক্ট করেছিল তরুণ কবিদের। তারপর আর কিছু করেনি। বাকীটা ওরাই করেছিল।


কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর মেয়ের কথা আমরা ওনার কবিতায় পেয়েছি সোনাঝুরি নাম দিয়ে। আর বাসবী দেবীর থেকে আমরা জানতে পারলাম যে ভাস্কর বাবু একটি অদ্ভুত ও সুন্দর নামে ওকে ডাকতেন সেটা হল, হুতাতাতা। মিষ্টি সোনাঝুরির আসল নাম হল প্রৈতী চক্রবর্তী। এই নামটা শঙ্খ ঘোষের দেওয়া। সোনাঝুরি এখন ক্লাস টুয়েলভ-এ পড়ে। ওকে কিছু প্রশ্ন করা হল।

ভাস্করজ্যোতিঃ তুমি কবিতা পড়া ও লেখা শুরু করেছো?

সোনাঝুরিঃ এই প্রশ্নটার সামনে আমাকে অনেক আগে থেকেই পড়তে হয়েছে। আমি ছোটবেলা থেকেই চেষ্টা করেছিলাম কবিতা পড়ার। তবু আগে বুঝতাম না তাই আগ্রহ তৈরি হয়নি। এখন একটু একটু করে পড়তে শুরু করেছি। বেশ কয়েকদিন থেকে আমার কবিতার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বাবার কবিতা গুলো পড়ি।

ভাস্করজ্যোতিঃ তুমি ভাস্কর বাবুর সংগ্রহগুলো দিয়েই কবিতা পড়া শুরু করলে?

সোনাঝুরিঃ হ্যাঁ, ওগুলো নিয়েই বসি মাঝে মাঝে।

ভাস্করজ্যোতিঃ তুমি আর কার লেখা পড়েছো?  

সোনাঝুরিঃ আমি তো সবে শুরু করেছি। আমি বাবার কবিতাই সব থেকে বেশি পড়েছি। তা ছাড়া শঙ্খ ঘোষের ও জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়েছি।

ভাস্করজ্যোতিঃ তাহলে তোমার প্রথম পড়া কবি হলেন তোমার বাবা। তুমি ওনার সেইসব কবিতাগুলো পড়েছো যেখানে তোমার কথা লেখা আছে?

সোনাঝুরিঃ হ্যাঁ, অনেক ছোটবেলা থেকেই পড়ছি। এখনো পড়ি।

ভাস্করজ্যোতিঃ যখন মা বা বাবা কবি হন আর কবিতায় সন্তানের কথা থাকে তখন সেই লেখা অনেকদিন পরে সন্তান যখন পড়ে ও দেখে তার কথা লেখা আছে আর যিনি লিখেছেন তিনি অর্থাৎ মা কবিটি বা বাবা কবিটি মৃতা বা মৃত, তখন অনুভূতিটা কেমন হয়? সেই কবিতাগুলো লেখাগুলো পড়ার সময়ের কথা বলছি। তখন তো একটা ব্যক্তিগত সংলাপ থাকে। আবার সেটা শুধু ওই লেখাটুকুকে ঘিরেই হয় কারণ সেই কবির কাছে তো আর পৌঁছনোর উপায় থাকেনা। তোমার অনুভূতিটা যদি একটু শেয়ার করো।

সোনাঝুরিঃ যখন ছোট ছিলাম আমার খুব গর্ব হত যে বাবা আমাকে নিয়ে কবিতা লিখেছে। তখন কবিতা তো অতটা বুঝতাম না। আর এটা বন্ধুদের কাছেও বলতাম। কিন্তু এখন যখনই পড়ি একটা গভীর সংযোগ তৈরি হয় বাবার সাথে। আর আমি বাবার ঘরেই থাকি চব্বিশ ঘণ্টা। তাই আমার এখন সবসময়ই মনে হয় এই ঘরে বাবা আছে। আমি সারাক্ষণ অনুভব করি তাঁর উপস্থিতি। আর এখন বাবার সাথে সংযোগের জন্য আমাকে আলাদা করে বাবার কবিতা পড়তে হয়না, এমনিই আমি বাবাকে আমার সাথে সর্বদা পাই, অনুভব করি। তবে অবশ্যই কবিতা পড়ার সময় আরো দৃঢ় হয় সেই অনুভূতি।
 

Comments