‘নতুন জীবন শুরু করে দেব’ - য শো ধ রা রা য় চৌ ধু রী





Weekly-Editionভাস্কর চক্রবর্তী
১.
কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার আলাপ ছিল না। কিন্তু আমার একটি প্রেমের অভিজ্ঞতায় তিনি এইভাবে জড়িয়ে ছিলেন: ক্রমশ-গড়ে-ওঠা ঘনিষ্ঠতার প্রায়-শুরুর মুহূর্তে একবার সেই ছেলেটিকে আমি জিজ্ঞাসা করি, কবিতা পড়েন?– হ্যাঁ।– প্রিয় কবি কারা, মানে, ইয়ে, কাদের কবিতা পড়েন?- ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা ভাল লাগে। ওই যে, ‘ভাষা-প্রেমিকের কাছে বসে আছি/ এখন বিকেল যায়, আস্তে, চলে যায়।’

কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার আলাপ ছিল না। নানা কবি-সম্মেলনে দেখেছি দীর্ঘদেহী ওই মানুষটিকে। মিতবাক ও দীর্ঘদেহী। আচ্ছা, তাহলে সেই দীর্ঘতাই কি জিরাফ? ‘আমি আর এসবের মধ্যে নেই বাপু। জিরাফ অদ্ভুত প্রাণী আমি তার ভাষা কিছু শিখতে পেরেছি।’
ভাস্কর চলে যাওয়ার পর অনেকেই নানা জায়গায় নানা কিছু লিখেছেন, যাঁরা তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁকে কাছে থেকে দেখেছেন। তাঁর কবিতাকে কাছে থেকে দেখেছেন। এ-সবের পর আমার মনে হয়েছিল, আমার আর কিছুই যোগ করার থাকতে পারে না। অথচ ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’ আবার এখন পড়তে গিয়ে, আমি অনুভব করি, আছে কিছু যোগ করার, যেটা ভাস্কর কত ভাল মানুষ ছিলেন বা কত দুঃখী কবি ছিলেন, এ-সব প্রসঙ্গেই নয়। কেবলমাত্র তাঁর লিখিত কয়েকটি শব্দ, লাইন, শরীর, কবিতা নিয়ে।

২.
‘তোমারই শিংয়ের কাছে গুঁড়ি মেরে বসে থাকি-/কখন যে চাঁদ/ ওঠে, কখন যে মেঘ/ ঢেকে দিয়ে চলে যায় তোমাকে আমাকে’।
 ভাস্কর চক্রবর্তী যখন লিখছিলেন তখন, যখন তিনি লিখতে শুরু করেছেন শুধু, তখন, চারপাশে যে-সব বাঘা-বাঘা কবিদের তুমুল লেখালেখি-তার অদৃশ্য চাপ সহ্য করতে হয়েনি কি তাঁকে? তাঁকে নিতে হয়নি এই সমস্ত ধরনের নতুন ও জনপ্রিয় স্টাইলের বাইরে গিয়ে নিজের জন্য এক সম্পূর্ণ ভিন্ন স্টাইল তৈরি করে নেওয়ার পরিশ্রম? তাঁকে সযত্নে অস্বীকার করতে হয়নি কি, যাবতীয় তৎকালীন কবিতার শব্দবহুলতা, গমগমে প্রাচুর্য? এবং এ-সবের ভিতর দিয়ে সূক্ষ্ম সুতোর মতো করে পথ তৈরি করতে হয়নি? ভাস্কর নির্ঘাত সাংঘাতিক সাহসী আর বেপরোয়া এক মানুষ ছিলেন, তাই, বিকল্পহীন এক স্ট্র্যাটেজিতে তিনি দুর্দান্তভাবে নিজের জন্য তৈরি করে নিলেন নিজস্ব এক সেন্স। তৈরি করলেন এমন-একটা রাস্তা, যেখানে মানুষের সমাগম খুব কম হবে, অথচ গাছে-গাছে, বাড়িঘরে পাথরের সমাধিফলকে আড়াল-করা সেই রাস্তাকে খুঁজে-খুঁজে ঠিকই, পড়ে নেবে কোনও পাঠক। কেউ-কেউ চমকেও যাবে, কেউ-কেউ সবিস্ময়ে আলোচনাও করবে। অদ্ভুত, বেখাপ্পা, অতুলনীয় সেই পথ, তাকে নিয়ে কেউ-কেউ মাতামাতিও করবে। পার্ক স্ট্রিটে চিকেন রোল খেয়ে তারপর খুরিতে চা খেতে-খেতে কেউ-কেউ আসন্ন প্রেমিকাকে বলবে, পড়েননি, ‘মনে পড়ে আলিঙ্গন-/ মনে পড়ে শান্ত হাসিমুখ?/ রক্তে বিষ মিশে আছে, প্রিয়তমা/ এখন জীবন যায়, আস্তে, চলে যায়?’
আসলে ভাস্কর, তাঁর সময়ের, একজন, হয়তো একমাত্র নন, আরবান কবি। ঠিক-ঠিক আরবান বলতে যেটা বোঝায়। ‘আমরা অফিস থেকে ফিরে এসে/ মোজা খুলতে খুলতে হঠাৎ নিশ্বাস ফেলি-আমরা রাস্তায়/ হঠাৎ চুলকে নিই হাত’(হেমন্ত)- এ-রকম উল্লেখ যিনি অনায়াসে, পলকে-পলকে, লাইনে-লাইনে করবেন, তিনি কী আদ্যন্ত শহুরে, কী ভীষণভাবে কলকাতার। ‘আমরা পুরনো হোটেলে যাই, শুধুমাত্র, হেমন্তকালের জন্যে/ আমরা ভালোবাসি সিগারেট-আমাদের, চারপাশে হেমন্তকাল’। এই শহরের কোনও গলিঘুঁজিই ভাস্করের কবিতায় অনাবিষ্কৃত থাকে না আর। আর কলকাতা শহরের এই টীকাটিপ্পনীকারকে ক্রমাগতই তাই আবিষ্কার করে চলতে হয়, খুঁড়ে চলতে হয় সেই ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’র স্টাইলেই - সামান্যতম কলকাতা নির্ণয়ের এক গসাগু- ‘ভিখিরি আর বখে-যাওয়া ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বেশ একটা পিরিত জমেছে আমার।/ আমাদের রাস্তাগুলো আমি ওদের চেনাই-/ দেখাই শহরের দেয়াল-জানাই, কতদূর যেতে পারি আমরা-/ শহর যখন ঘুমিয়ে পড়ে, আমি বলতে থাকি, ভাসমান রহস্যময় রাত্রির কথা/ আরও বলি : আমার কোনও টাকা পয়সা নেই।’ ভাস্করের কবিতায় ‘গরিব’ বা গরিব-বোধক শব্দনিচয় বারবার আসে-যেমন এসেছে আগের উল্লেখের কবিতাটিতে। আর আসে ‘দুঃখী’। কিন্তু এই ‘গরিব-দুঃখী’ আমাদের বাঙালীমার্কা প্যানপ্যানে ‘গরিব-দুঃখী’ নয়, নয় গ্রাম্য। যে-রকম গরিব-দুঃখী দেখলে দেবতারা টুপটাপ বর দিয়ে যাবেন। এই গরিব এই দুঃখী একগাল দাড়ি ও পোড়া-সিগারেট-সহ এক শহুরে একাকী যুবকের ইমেজ। নিরুচ্চার, চাপা এবং উদ্বেগ-উত্তেজনাহীন একধরনের আন্ডারস্টেটেড গরিবিয়ানা ও দুঃখবোধ এটি। ভাস্করই যে-ব্র্যান্ডের উদ্ভাবক ও প্রচারক। ভাস্কর চক্রবর্তী আসলে একজন গুরু-অফ-আন্ডারস্টেটমেন্ট। মিনিম্যালিস্ট ঘরানায়, দৈনন্দিনতার গুঁড়ো-গুঁড়ো দিয়ে, ক্ষুদ্রতম কথা ও শীর্ণতম চিন্তা, মুখচোরাতম অস্তিত্ব ও আরশোলার মতো শুঁড়নাড়া সূক্ষ্ম দুঃখকষ্ট দিয়ে রচনা করেন যিনি একটি আপাত-নাটক। যা শেষ হয় এক ফুৎকারময় অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্সে, এবং বেদনার এক নতুন সংজ্ঞায়। শুধু বেদনা কেন, পুরো জীবনকে, গোটা অস্তিত্বকে, যিনি বানিয়ে ফেলেন একটি চিত্রনাট্য, যেখানে পাত্র-পাত্রীদের ভূমিকা ততটাই তাৎপর্যহীন, যতটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশ ও আবহের রং, স্পর্শ, মেটিরিয়াল প্রগাঢ়তা।

‘ইয়ার্কি নয় ডিয়ার-রাত দুপুরে মানুষের জানলায় উঁকি মেরে
দেখেছি আমি
খোলা শরীরের ওপর, খেলা করছে, খোলা শরীর
হলুদ বিছানা, ভেসে চলেছে স্বর্গের দিকে’
[ভিখারি, শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা ]

প্রেম ও যৌনতা নিয়ে একজন কবি ঠিক কতটা নিরুচ্চার ও নিস্তব্ধের কাছাকাছি হতে পারেন। কতটা তুচ্ছতার পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন প্রেমকে, যেমন ভয়কেও? ‘দেখো ডাকটিকিট, পনেরো পয়সার বাঘ’ অথবা ‘আঃ আমি সুন্দরভাবে মরে যেতে পারি আজ/ ছেঁড়া কপিপাতার ওপর আজ ভেসে থাকুক আমার নিরুত্তাপ মুণ্ডু’, আসলে তীব্র প্রেম আর চণ্ড রাগ, কোনওটাই বরদাস্ত করতে পারতেন না এই কবি, যেমন কবিদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও সাফল্যকামনাকে – ‘এখন ন’টা বাজে, দশটা বাজে, এগারোটা হল রাত।/ সফলতার দশ-পয়সার চাবি-কাঠি নিয়ে নাচুক এখন শনিবারের কবিরা।’ এরপরেই আসছে মরে যাওয়ার কথা, আর আলপিনের চিন্তা। ‘আলপিন’ ভাস্করের প্রিয় এক বিষয়। বারবার আসে। যদি বলি, একটি মেয়ে এবং একটি আলপিন দুই-ই ভাস্করের সমান পছন্দের-খুব কি বাড়িয়ে বলা হবে কিছু? ‘রীনা সপ্তাহে দু’বার গীতবিতানে যায়, চুলে কেয়োকার্পিন মাখে’ অথবা ‘আশেপাশে আছে, কিছু কিছু প্ল্যাসটিকের মানুষ। প্ল্যাসটিকের বৌ নিয়ে অনবরতই তারা ঢুকে পড়ছে সিনেমায়’ থেকে আমার তো তাই মন হয়।বরং ‘রান্নাঘর’ ভাস্করের কাছে অনেক বেশি শরীরী ও অস্তিত্বময়, বাস্তব-কিছু। অথবা বাথরুম। ‘আমাদের পুরোনো জুতো/ পড়ে থাকবে আমাদের স্তব্ধ বাথরুমে’, ‘দেখো একা একা আমি রান্নাঘরে নেমে আসছি কীরকম’, ‘শুধু ফাঁকা ঘরে, চুপচাপ বেজে চলেছে রেডিও।’ অথবা ‘আমি টেবিল থেকে শুধুই মানুষের ফেলে-যাওয়া দেশলাই জড়ো করেছি/ গঙ্গার মাটি দিয়ে সারিয়েছি উনুন।’ কিংবা ‘জেনো, আমি/ একডজন মোমবাতি কিনে এনে/ নতুন জীবন শুরু করে দেব আগামী সপ্তাহে-’ জিনিসপত্রের এই পৃথিবীতে তাহলে মানুষ বা মানুষের সম্পর্ক ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় আর। অথবা পালটে নিচ্ছেন, বদলে নিচ্ছেন কবি, তাঁর বিষয় - তাই মানুষের বদলে সম্পর্ক গড়ে উঠছে জিনিসদের সঙ্গেই। কারণ, মানুষরাও, শেষ পর্যন্ত, জিনিসের মতো, বা জিনিসদের কাছে সমর্পিত। ‘এইখানে, মূর্খ এক, তার/ অসুখী জীবন নিয়ে খেলা করেছিল/ ছাদে, তার রঙিন পাজামা পড়ে আছে-/ ঘরে-বাথরুমে, তার/পড়ে আছে হাত ও পায়ের কসরত-’ আসলে, ভাস্করের একটা কবিতা পড়লে আর-একটি পড়তেই হবে। আলাদা- আলাদা করে প্রতিটি কবিতার মানে কেউ বুঝতে পারবে না। বরং মালার মতো পরপর, বা ছড়িয়ে ছিটিয়েও যদি পড়া যায় তাঁর সমস্ত কবিতা, আগের পরের ‘শীতকাল কবে’ থেকে ‘এসো সুসংবাদ, এসো’ বা ‘আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে’ থেকে ‘জিরাফের ভাষা’-একজনই কবিকে তাঁর বস্তুময় বিশ্বে গরিব ও দুঃখীর মতো, শহরের এক দীর্ঘশ্বাসের মতো, বসে থাকতে দেখব আমরা।
‘এইসব পারদের এইসব বারুদের ছোটোখাটো দিনে/কীরকম আছো মানুষেরা?/আছো কি আমারই মতো? কুকুরের হলুদ বমির মতো একা?’
অসুখ, মৃত্যু, আর কষ্ট প্রথম জীবনের কবিতা থেকে শুরু করে জীবনের শেষদিনের কবিতা পর্যন্ত এমন নিরাসক্ত সমানতায় বিছিয়ে রেখেছিলেন ভাস্কর, যে, একটি-কোনও পর্ব থেকে তাঁকে আলাদা করে খুঁটে তুলে নেওয়া কঠিন। শেষদিনের ফুসফুসের কষ্ট, ক্যানসার তাঁকে উত্তেজিত করেনি কখনও- কেননা আজীবন তিনি বয়ে গেছেন একাধিক মৃত্যু ও অসুখের মধ্য দিয়ে। গেছেন ডাক্তারবাবু আর ট্যাবলেটের মধ্যে দিয়ে, যে-সব তাঁর হৃদয়ের জিনিসের মতো। ‘পলিথিনের প্যাকেটে এখন ভেসে আছে একটা ফুসফুস।’ ভাস্করের এই দৃশ্যগুলো আসে এক সমান্তর পুনরাবৃত্তির মতো। এই কয়েকদিনের মধ্যে ভাস্করের অনেক কবিতা পড়ে ফেললাম আমি। আর তারপরেই, দেখলাম, চোখ বুজলে মাথার ভিতর চলে আসছে একটার-পর-একটা দৃশ্য, ফিল্মের দৃশ্যের মতো-গলি ও রাস্তা, দেওয়াল, ল্যাম্পপোস্ট, গাড়ি, বারান্দা, ছাদ, আর এইসব ছুঁয়ে-ছুঁয়ে হেঁটে, দৌড়ে-যাওয়া এক ছায়া-ছায়া পুরুষ। নীলচে, হলদেটে ম্লান এই দৃশ্যের মধ্যে এরপর মিলে যেতে থাকে আমার নিজের বাস্তবতা-রাস্তায় পাস করে যায় হর্ন-দিতে-থাকা একটা গাড়ি, ঘ্যাঁস করে থামে, সকালটাকে আশ্চর্য স্তব্ধ মনে হয়, শান্ত আর স্তব্ধ। আর আমার মাথার ভিতর থেকে শুধুই পশম তুলে শুধুই পশম তুলে এনে ডাঁই করে রাখি তারপর।

---

(লেখাটি পূর্বে রক্তমাংস পত্রিকায় প্রকাশিত)

Comments