চির-জীবিত ভাস্কর চক্রবর্তী - বি না য় ক ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়




Weekly-Editionভাস্কর চক্রবর্তী
(কথোপকথনঃ মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়, অর্ণভ। অনুলিখনঃ মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়)

ভাস্কর দা বাংলা কবিতায় একটা নতুন দিক এনেছিলেন। তাঁর কবিতা জীবনের দুঃখ, কষ্টকে তুলে আনার কবিতা। এখানে নিজের সঙ্গে নিজের কোন ভণ্ডামি নেই। আমরা অনেক সময় দেখি অনেক কবি কবিতায় হয় তো অনেক কথা বলছেন, ‘মানবিকতা’ ‘বিশ্ব মানবিকতা’, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত স্তরে আমরা এর কিছুই পাই না। সেখানে লোভ, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা- এগুলোরই আধিক্য। তাঁদের সামনে গেলে ভয় লাগতে থাকে মনে হয় দূর থেকেই দেখি। কিন্তু ভাস্কর’দার সব থেকে বড় যে ব্যাপার ছিল তিনি কবি হিসেবে যেমন ছিলেন, তিনি মানুষ হিসেবেও তেমনি বড় মাপের ছিলেন। মানুষ হিসেবে তিনি বিষণ্ণ, নির্জন, আবার আঁকড়ে ধরতে চাইতেন ভালোবেসে। তেমনি তাঁর কবিতাতেও আমরা তাঁকে সেই ভাবেই পাই। ভাস্কর’দার একটা কবিতার লাইন মনে পড়ছে,- পঁচিশ বছর আগেকার মুখ যেন জাপানি অক্ষর... বিছানায় শুয়ে মনে পড়ে একদিন প্রেমিক ছিলাম। সত্যিই তো পঁচিশ বছরে আমাদের মুখে কত পরিবর্তন আসে। কুড়ি বছর আগের আমার মুখ দেখলে মনে হয় – এটা কী আমার মুখ! বা ‘ডাক্তারখানায় গিয়ে যারা ডাক্তারেরও আগে বসে থাকে আমি তাদেরই একজন’ একটা কথার মধ্যে দিয়ে একটা ক্লাস বা একটা শ্রেণী যেন উঠে আসছে। এটা শুধু ভাস্কর’দার ক্ষেত্রেই আমি বলব না, ষাটের দশকের বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, সুব্রত চক্রবর্তী, তুষার চৌধুরি প্রত্যেকের কবিতাতেই দেখা যায়। তবে ভাস্কর’দা অবশ্যই পথিকৃৎ। ভাস্কর’দা বরাহনগরের একটা বাড়িতে থেকেও যেভাবে সারা শহরটার মেজাজটাকে ধরতে পেরেছিলেন, কারণ ভাস্কর’দা বুঝতে পেরেছিলেন- অভিমুখটা গ্রাম থেকে শহরের দিকে হবে, শহর থেকে গ্রামের দিকে নয়।
ভাস্কর’দার কবিতা একরকম না, অনেক রকম।

‘...
এক ডজন মোমবাতি কিনে এনে
নতুন জীবন শুরু করে দেবো আগামী সপ্তাহে-
নৌকোভর্তি আশাবাদ নিয়ে যাব পশ্চিমে বেড়াতে -
বিদঘুটে শুয়োর এক চেঁচায় পাশের জেলা থেকে
কখন চা খাব আমি কখন খাব না
কখন বৌয়ের সঙ্গে শোব আমি কখন শোব না
ইটের থ্যাত্‌লানো ঘাস
কোন্‌ দেশী নিষ্ঠুরতা তুমি!
মুক্ত কবিতার জন্য বসে আছি
স্বপ্ন বিস্তারের জন্য বসে আছি
কি ভাবো আমাকে তুমি? কলের পুতুল?
বাঘের নখের মধ্যে বসে আমি তিন খাতা চার খাতা
কবিতা লিখি নি?’
(প্রতিবহন | বই - তুমি আমার ঘুম | রচনা ১৯৯২-৯৭ | প্রকাশ ১৯৯৮)

 এই ভাস্কর’দা বিদ্রোহে ফেটে পড়া ভাস্কর দা। এই ভাস্কর’দা কিন্তু একলা ঘরে নির্জন মানুষ ভাস্কর’দা নয়, ‘দু’টো দীর্ঘশ্বাসের মাঝে মৃত্যু, আমি তোমাকে দেখছি” ভাস্কর’দা নয়। ভাস্কর’দার মধ্যেও কতগুলো ফেজ আছে। অনেকে যেমন ভাস্কর’দাকে ভাবে পেসিমিস্টিক কবি বা বিষাদের কবি। কিন্তু আমার মতে ভাস্কর’দার কবিতা পজেটিভ কবিতা। এমনকি আত্মহত্যার মতো একটা স্টেপও পজেটিভ স্টেপ। কারণ, মানুষ আত্মহত্যা করে বাঁচতে না পেরে, বাঁচতে চেয়ে সে আত্মহত্যা করে। ভাস্কর’দার কবিতা সেই অন্তর্লিন বিষাদটাকে অস্বীকার করে নয়, কোনো কল্পিত আরোপিত আশাবাদ, মহাজাগতিক ব্যাপার স্যাপার নিয়ে নয়। ভাস্কর’দার কবিতার মধ্যে পাই হাইড্রেন শহরের নোংরা গলি-নালা, চিলেকোঠা, ছাদ, সিগারেট। ‘আমাদের স্বর্গ নেই স্যারিডন আছে’ (চৌ-রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমরা চারজন | বই – শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা | রচনা ১৯৬৫-৭১ | প্রকাশ ১৯৭১)এতো ভাস্কর’দার বিখ্যাত, আইকন হয়ে যাওয়া পংক্তি। ‘...স্বর্গ নেই স্যারিডন আছে’ কোন নেগেটিভ পংক্তি নয়, বরং স্যারিডন যে আমাদের মাথা ব্যাথাটা সাড়িয়ে আমাদের বেঁচে থাকাটাকেই স্বর্গীয় করে তোলে – হয়তো এই কথাটাই ভাস্কর’দা বলতে চেয়েছেন। তাই ভাস্কর’দা কে শুধু বিষাদের কবি বলেই মনে করি না, বিষাদটাকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কবি বলেই মনে করি।
ভাস্কর’দার কবিতায় যে বাঁকগুলো এসেছে তা কালের নিয়মে এসেছে। ভাস্কর’দা র কবিতা পড়ে আমার একটা কথাই মনে হয়, ভাস্কর’দা পৃথিবীর মধ্যে ব্যক্তিকে নয়, ব্যক্তির মধ্যে পৃথিবীকে দেখাতে চেয়েছেন। ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’ থেকে ‘জিরাফের ভাষা’ তাঁর কবিতায় বরাবর ব্যক্তিকেই চ্যাম্পিয়ন করে গেছেন ভাস্কর’দা। ‘চলে যেতে হয় বলে চলে যাচ্ছি, নাহলে তো, আরেকটু থাকতাম।’ (৪৮ নং কবিতা | বই জিরাফের ভাষা | রচনা ১৯৯৭-২০০৪ | প্রকাশ ২০০৫)কেন থাকতাম? না আমার ভালোবাসাটার জন্য থাকতাম। এই কথাটা যখন ভাস্কর’দা বলছেন সেখানেও কিন্তু ব্যক্তিকেই চ্যাম্পিয়ন করে দিলেন। বা ‘শয়নযান’-এর মতো গদ্যেও আমরা কিন্তু পাই সব বিরোধিতার মধ্যে, সব প্রতিকূলতার মধ্যে একজন মানুষ উঠে দাঁড়াচ্ছে। মানুষের বাইরের অস্তিত্বটা নয়, সে হয়তো একটা ময়লা পাঞ্জাবি পরে চারমিনার খাচ্ছে; কিন্তু এই চেহারাটা তার বাহ্যিক। এটা দেখে হয় তো রাস্তার কুড়িটা লোক তাকে চিনে যাবে। কিন্তু সেই সময় তার ভিতরে যে মহাজাগতিক বিস্ফোরণ ঘটছে তার খবর রাখে কেবল খাতা আর কলম।

ভাস্কর’দা আমাকে খুব স্নেহ করতেন। যখনই দেখা হতো ওনার বাড়িতে আসতে বলতেন। কিন্তু একমাত্র ভৌগোলিক দূরত্বের কারণেই ভাস্কর’দার বাড়ি মাত্র একবারই গিয়েছিলাম। বইমেলা, বাংলা একাদেমিতে বেশ কবার দেখা হয়েছে। ওনার দুটো বই আমাকে সই করে দিয়েছিলেন। ভাস্কর’দার সাথে যে কবারই দেখা হয়েছে উনি আমাকে কবিতা লিখতে উৎসাহ দিয়েছেন। উনি তরুণদের খুব উৎসাহ দিতেন। তরুণ কবিদের কবিতা খুব খুঁটিয়ে পড়তেন। আমার সাথে দেখা হলে, কোন্‌ ছোট পত্রিকায় কবে কোন্‌ লেখা লিখেছি সেটা মনে করে বলতেন। ভাস্কর’দা তরুণদের সাথে মিশতে খুব ভালোবাসতেন। সবসময় তাঁর মনের মধ্যে সেই তারুণ্য ব্যাপারটা ছিল। কিন্তু অকালে চলে গেলেন ভাস্কর’দা। এতো তাড়াতাড়ি ভাস্কর দার চলে যাওয়ার কথা ছিল না। তবু বলব ভাস্কর চক্রবর্তীরা তো যান না, পুনরাবিস্কৃত হন।

ভাস্কর চক্রবর্তীর ‘কী রকম আছো মানুষেরা’ (রচনা ১৯৯৭-২০০৪ | প্রকাশ ২০০৫) কাব্যগ্রন্থের ‘এপিটাফ’ কবিতায়

‘...
এখানে ছিলাম আমি
আমার মাথাটা ছিল প্রজাপতি
হাজার আলোকবর্ষ উড়ে এসে
শহরের প্রেত আমি শহরে জন্মিয়ে
শহরেই পচে মরে গেছি।’

এখানে ‘শহরের প্রেত আমি শহরে জন্মিয়ে/ শহরেই পচে মরে গেছি।’ এই কবিতাটার মধ্যেই কিন্তু একটা লাইন ঘুরে আসছে ‘আমার মাথাটা ছিল প্রজাপতি’। ভাস্কর’দাই প্রথম এই বিভাজনটা তুলে ধরেন। যে জীবনের মধ্যে দিয়ে যেতে আমরা বাধ্য হচ্ছি সেটা কিন্তু আমার মানস জীবন নয়, আমার স্বপ্ন জীবন নয়। সেই জীবনটা একদম আলাদা। যে মানুষটা বাজারে গিয়ে ফুলকপি দর করছে, সে হয়তো কবি। কিন্তু সেই মুহূর্তে সে অন্য লোক। এই যে অবস্থানটা, এই অবস্থানকে জয় করে আমার মাথার যে উত্থান, আমার অবস্থানের উত্থানটা তো আমার হাতে নয়। সেটা আমাকে রাজনৈতিক দল করতে দেবে না, পুঁজিবাদ করতে দেবে না। কিন্তু আমার মাথার উত্থানটা তো আমার নিজের হাতে। দিনকে দিন এম টিভি ফ্যাশান শপিং মল ইত্যাদি ইত্যাদি দিয়ে আমার এই মাথাটাকে কিনে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। আমাকে বোঝানোর চেষ্টা চলছে ‘তুই আমার কোকাকোলা’ একটা প্রেমের গান। আমাকে একটা জিনিস গিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একটা কালচার আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যেটা আমার নয়। ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা আমার জীবনটাকে গিলে ফেলার বিরুদ্ধে, আমার স্বপ্নটাকে গিলে ফেলার বিরুদ্ধে একটা শান্ত প্রতিরোধের কবিতা। ভাস্কর’দার একটা কবিতা মনে পড়ছে

‘কালো কালির ওপর
লাল কালির মর্মান্তিক কাটাকুটি।
ব্যাপার কিছুই নয়।
ব্যাপারটা সত্যি তেমন কিছুই নয়
যদি-না মনে পড়ে
কালো একটা ছেলে
রক্তাক্ত  
ধানক্ষেতে শেষ ঘুমে ঘুমিয়ে আছে।’
(কাটাকুটি | বই কীরকম আছো মানুষেরা | রচনা ১৯৯৭ – ২০০৪ | প্রকাশ ২০০৫)

এখানে ভাস্কর’দা একটা কালো কালিকে লাল কালি দিয়ে কাটার বিষয়কে বিশ্ব-মানবিকতায় উত্তীর্ণ করে দিচ্ছেন। সেখানেও কিন্তু তার হিরো একটি কালো ছেলে, যে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে।

ভাস্কর’দার কবিতাকে কি এ্যাণ্টি-পোয়েট্রি বলব? না! বরং ভাস্কর’দা এ্যাণ্টি-লাইফকে কবিতায় রূপান্তর করেছেন। কারণ, আমরা যে জীবনটা যাপন করতে বাধ্য হচ্ছি, সেটা ঠিক জীবন নয়। জীবনের থেকে নিচুস্তরের একটা কিছু। কিন্তু আমরা সেই জীবনটা কে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি। আমাদের জীবনের সেই বিষটাকে নিংড়ে ভাস্কর’দার কবিতা যেন এক ওষধি গাছ। যে গাছ বছরের পর বছর আমাদের ফুল দেবে, ফল দেবে, ছায়া দেবে।

ভাস্কর’দা তাঁর সময়ের থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। সমকালে একজন কবির খ্যাতি, কবিকে নিয়ে আলোচনাটা কবির ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে তার বই কত ছাপা হচ্ছে, তাঁর জনপ্রিয়তা কতটা, তাঁর বই কত বিক্রি হচ্ছে, তাঁকে কে পছন্দ করছেন কে অপছন্দ করছেন ইত্যাদি বিষয়ের ওপর। কিন্তু সেটা তো কবির একটা খুব তাৎক্ষণিক বিচার। এই আজকে যে তোমরা ভাস্কর চক্রবর্তীকে নিয়ে সংখ্যা করছো বা ভাবছো, ভাস্কর চক্রবর্তী তো এসে তোমাদের বলেন নি। তোমরা মন থেকে করছো। তোমরা ভাস্কর চক্রবর্তীর ওপর না করে এমন কোনো কবির ওপর করতে পারতে যিনি জীবিত। কিন্তু এমন অনেক কবি আছেন, যাঁরা বেঁচে থেকেও তাঁদের কবিতা থেকে আমাদের নতুন করে আর কিছু পাওয়ার নেই। কিন্তু ভাস্কর চক্রবর্তী আজকে শারীরিক ভাবে না থেকেও কবি হিসেবে জ্যান্ত। ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা সময়ের থেকে এগোনো বলেই আমরা আজকে সেই কবিতাকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করছি। এই কণ্ঠস্বরটা তো খুব অলৌকিক একটা ব্যাপার। এবং আমি সত্যি কথাই বলব যে জায়গাটার থেকে ব্যক্তিকে একটা চ্যাম্পিয়ন করা বা একটি ব্যক্তির কথা তুলে ধরা এবং তার বিষণ্ণতাটাকে একটা স্মারক করে তোলা, এটা বাংলায় ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতাতেই পাওয়া যায়। সেই কবিতার লাইনটা মনে পড়ছে যে

‘একটি মেয়েকে ঘিরে চার-পাঁচজন বসে আছে
দূরের টেবিলে।’
(দূরের টেবিল | বই – রাস্তায় আবার | রচনা-১৯৭১-৮০ | প্রকাশ- ১৯৮৩)
বা
‘আর কোন ইচ্ছে নেই, শুধু ওই
মেয়েটির সঙ্গে যেন
আমাদের
তরুণ কবির বিয়ে হয়।’
(এসো, সুসংবাদ এসো | বই এসো, সুসংবাদ এসো | রচনা ১৯৭২-৭৮ | প্রকাশ ১৯৮১)

এখানে কিন্তু কবি ব্যক্তির পিছনে চলে যাচ্ছেন। ব্যক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, মানে কিন্তু এই নয় যে সেই ব্যক্তি কবি নিজে হবেন। কারণ কবি জানেন ছেড়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়েও একটা পাওয়া আছে।
পঞ্চাশের দশকে আমরা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় যেটা পেয়েছি, একটা মানুষের কথা; একটা মানুষ কথা বলছে, একটা মানুষ প্রতিবাদ করছে। এই বিষয়টা পরবর্তী সময়ে ভাস্কর দার কবিতায় একটা অন্য মাত্রা নিয়েছে। এমন তো নয় যে ভাস্কর চক্রবর্তী জল হাওয়ার বাইরে মানুষ হয়েছেন, তাঁর কবিতায় তাঁর পূর্বসূরিদের প্রভাব বলব না আত্তীকরণ বলব, আসতেই পারে। এটাই তো কবিতার ধর্ম। যে একজন কবি চার পা এগিয়ে তাঁর ব্যাটনটা আরেকজনের হাতে তুলে দেন, পরের কবি আবার সেটা নিয়ে কিছু দূর এগিয়ে যান। ভাস্কর চক্রবর্তী বাংলা কবিতাকে অনেকটা এগিয়ে দিয়ে গেছেন। আমাদের কাজটাকে অনেকটা কঠিন করে দিয়ে গেছেন। বিশেষত যাঁরা ভাস্কর চক্রবর্তী পড়ে ইম্প্রেসড তাঁদের ক্ষেত্রে এটা খুবই কাজ করে। তাঁদের মনে হতে পারে, আমি কিছু না লিখলে কী কিছু ক্ষতি হতো! আমি কী এই কবিতার থেকে অন্য কিছু লিখছি। সে হয়তো লেখা বন্ধ করে দেবে তা নয়। কিন্তু ভাস্কর চক্রবর্তী এই প্রশ্নটা অনেক কবির মধ্যেই তুলবেন।

আমি ভাস্কর’দার ধারার কবি নই। যেরকম আমি নিজে লিখছি শুধু সেরকম কবিতাই আমার ভালো লাগে এরকম তো নয়। ভাস্কর চক্রবর্তীর ধারাটা একটা অন্য ধারা। তার দ্বারা আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। কিন্তু আমি নিজের মতো লেখার চেষ্টা করেছি। যাঁরা আমাদের সামনে প্রভাবিত করার একটা প্রচণ্ড সম্ভাবনা নিয়ে আসেন, তরুণ কবিকে হয়তো কোনো একটা জায়গায় তাঁদের অস্বীকারও করতে হবে, না হলে সে নিজের লেখা লিখতে পারবে না। তারাপদ রায়ের একটা লাইন আছে -জীবনানন্দ দাস একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়ান আমায় কবিতা লিখতে দিন। সেই জায়গাটাতে ভাস্কর চক্রবর্তী একটা বিরাট মাইলস্টোন তো বটেই। ভাস্কর চক্রবর্তীকে রক্তে নিয়ে নিতে হবে। ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা যেন একটা বিরাট গাছ, যে গাছটাকে আগের দিন দেখিনি আজকে হঠাৎ বিশাল আকার নিল। ওনার কবিতায় ছন্দের কোন বিরাট কারুকার্য নেই, কোন বিরাট টেকনিকাল ব্যাপার নেই, তবুও ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা শেষ অবধি বুকে বিঁধে যায়। এটাই কবিতা। আমরা তাজমহল দেখে মুগ্ধ হলাম, বললাম ‘বাহ্‌ কী সুন্দর!’ কিন্তু তাজমহলের সামনে জীবন কাটানো যায় না। জীবন কাটানোর জন্য সেই নিজের ঘরটাতেই ফিরে আসতে হয়। ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা সেই ঘরের দিক থেকে দেখলে তার কোনো ঝাঁ চকচকে ব্যাপার নেই, কিন্তু সেই ঘরের মধ্যে যে আন্তরিকতা, যে প্রাণোচ্ছলতা- সেটাই এক বিরল জিনিস। সেই জিনিসটাই ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতাকে স্বতন্ত্র করে রাখে, আরো দীর্ঘদিন স্বতন্ত্র করে রাখবে। একটা কবিতা কখন কবিতা হয়ে ওঠে? আমি গোদা ভাষায় বলছি, না যখন মনে হয় এই কবিতাটি আমার মনের কথা বলছে। তেমনি ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা পড়তে পড়তেও আজকের জেনারেশানের মনে হচ্ছে, এই মানুষটি আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে কি করে আমার মনের কথা জানলো! এটা যাঁর সম্পর্কে মনে হবে সেই কবি থাকবেন। এটা যাঁর সম্পর্কে মনে হবে না সেই কবি থাকবেন না।

আমার কাছে ভাস্কর’দার কবিতা যেন একটা ছেলে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে উড়তে শুরু করল।
‘তুমি তো দেখেছো
মৃত্যু, দেখেছো অনেক শীতরাত
কী আছে বা প্রাণ ছাড়া?
বলোঃ ভালোবাসা, বলোঃ জীবন আলোসমান,
হাতে হাত রাখা।’
(প্রাণ | বই- তুমি আমার ঘুম | রচনা ১৯৯২-৯৭ | প্রকাশ ১৯৯৮)

এখানে কবিতাটি হাঁটতে হাঁটতে বিষাদ পেড়োতে পেড়োতে হঠাৎ করে ‘বলোঃ ভালোবাসা, বলোঃ জীবন আলোসমান’, এখানে এসে কবিতাটি উড়ান পেল। একটা এরোপ্লেন যে উড়বে সবাই জানে, কিন্তু একটা রিক্সা যদি উড়তে শুরু করে তখন যেরকম লাগে-সেরকম অভিজ্ঞতা হয়।

কোনো কোনো কবির ক্ষেত্রে দেখা যায় তিনি যে ধরণের কবিতা লেখেন তাঁর বাইরে তিনি যেতে পারেন না, তাঁর থেকে অন্য ধরণের কবিতা তিনি পছন্দ করেন না। ভাস্কর চক্রবর্তী এর ব্যতিক্রম ছিলেন। তাঁর ঘরানার বাইরে যাঁরা লিখছেন, তাঁদের কবিতাও তিনি মন দিয়ে পড়তেন। তাঁদের কবিতারও তিনি পাঠক ছিলেন।

ভাস্কর’দার মুগ্ধ পাঠক হয়ে আমার তাঁর সমালোচনার তো কোন জায়গা নেই, সেই ধৃষ্টতাও আমার নেই। তবে ভাস্কর’দা যে রেঞ্জের কবি তিনি নিজেকে আরো ভাঙতে পারতেন, আরো লিখতে পারতেন। আরও যেটা ভীষণ ভাবে মিস্‌ করি সেটা ভাস্কর’দার গদ্য। ‘শয়নযান’ পড়ে এতো মুগ্ধ হয়েছি! ভাস্কর’দা কেন আরো গদ্য লিখলেন না। ভাস্কর’দার সাথে যখন দেখা হয়েছে তখন বলেওছি সেই কথা।
ভাস্কর’দা এখন নেই। কিন্তু তাঁর কবিতা রয়ে গেছে। পুনরাবিষ্কৃত হচ্ছে। তোমরা ভাস্কর’দাকে নিয়ে সংখ্যা করছো। তোমাদের মধ্যে দিয়েই ভাস্কর’দা বেঁচে থাকবেন।

Comments