শহরের প্রেত - বি ভা স রা য় চৌ ধু রী





Weekly-Editionভাস্কর চক্রবর্তী
কবি ভাস্কর চক্রবর্তীকে প্রথম দেখি তাঁর বাড়ীর বিখ্যাত সেই ছাদের ঘরে। প্রতিভাস প্রকাশন সংস্থার কর্ণধার বীজেশ সাহা আমাকে নিয়ে গেছিলেন। বীজেশ দার বাড়ী আমি এসেছিলাম কাজে। তখন আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে। ছন্নছাড়া জীবন। এলোমেলো হয়ে গেছে সবকিছু বিষপিঁপড়ের কামড়ে। পড়াশুনার দফারফা হয়ে গেল। বাড়িতে প্রবল অশান্তি। কেবল নাটক-করা, কবিতা লেখা, কয়েকজন বন্ধুই ভরসা। সীমান্তশহর বনগাঁর যে পাড়ায় আমি থাকতাম, সেখানে একটা ছোট ছাত্রাবাস ছিল। আমরা আশ্রম বলতাম। সেই আশ্রমেই তখন আমার দিনরাতের আস্তানা। বেড়া-টালির ঘর, অন্ধকারে ঘাপটি মেরে থাকে সবসময়। স্বপ্ন ছিল, স্বপ্নের উজ্জ্বলতা ছিল না। উদ্বাস্তু বাড়ির পরের প্রজন্ম আমি। বাবা-মা’র আধা-খ্যাচড়া সংসার নিয়ে অশান্তিতে দিনরাত চিৎকার করছে। আমি ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি অজানা ভবিষ্যতে। আত্ম-ধ্বংস ভাল লাগত খুব সেসময়। জীবনানন্দ, বিনয়, শক্তি প্রিয় কবি ছিলেনই। তুষার রায় হঠান এহেন জীবন জুড়ে। শ্মশানে গিয়ে অন্যের চিতার দিকে তাকিয়ে তুষারে ‘বিদায় বন্ধুগণ’ উচ্চারণ করতে কী রহস্যময় ভাল লাগত। তুষার রায়ের হাত ধরেই এসে গেলেন ভাস্কর চক্রবর্তী। বিষণ্ণ জীবনের আবহে আত্মীয় হয়ে গেলেন ভাস্কর। “শীতকাল কবে আসবে, সুপর্ণা?”। আমিও তখন লোকালয়ে ঘুরে বেড়াতাম একা-বকা, আর ভাবতাম আমার কান্না কাউকে বুঝতে দেব না, চোখে জল এলে টুপিটা নামিয়ে পথ হাঁটব ভাস্কর চক্রবর্তীর মতোই। এক নশ্বর সন্ধ্যায় আমারও মনে হয়েছিল-

“আমি যে কী করবো নিজেকে নিয়ে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
সুদূর কোনো গ্রামে গিয়ে লুকিয়ে পড়ব?
কান্নাকাটি করবো কোনো মেয়ের কাছে গিয়ে?
জীবনটা নিয়ে, সত্যি, একটা ছেলেখেলা করেছি-
পুরানো প্রেমিকার শোকে আপাতত একটা সিগারেট ধরানো যাক...”
( বিশাল এই মহাদেশের ছায়ায় )

যাই হোক, ভাস্কর চক্রবর্তীকে দেখলাম। তিনি একটা খাটে বসে আছেন। ছোট্ট ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অনেকেই। বীজেশদা আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। উনি একবার আলতো দেখে নিয়ে আবার আড্ডাতেই ডুবে গেলেন। তাচ্ছিল্য করে একটা কথা আমার সম্পর্কে বলেছিলেন, আমি ভয় পেয়েছিলাম, কিছু মনে করিনি। ভাস্কর চক্রবর্তীর প্রতি তখন আমার দুর্বলতা অসীম। উনি যোগ্য লোক, যা মনে হয়েছে বলেছেন। তো আমি চুপ করে অনেকক্ষণ বসে থাকলাম তাঁর ঘরে। একের পর এক সিগারেট উড়ছে। অন্যমনস্কতা মাঝে মাঝেই ছুঁয়ে যাচ্ছে তাঁর মুখ। সেদিন মুগ্ধ ধুকুপুকু নিয়ে কী ভাবছিলাম আজ আর মনে নেই। বরং তাঁর কথা লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে ভাস্করের এই কবিতাটা এই অংশে তুলে দিই এক্ষুণি। কবি ও কবিতার দেখা হোক।

 “রাত্রিবেলা চিত্রের আকাশ আজ কিছু কথা বলতে চাইছে।
 বাংলা কবিতার মতো নির্জনতা ছুঁয়ে
 এখন দাঁড়িয়ে আছি- জানালায়- এখন চোখের জল নেই।
 আমার চোখের জল নিজেই দালাল হয়ে বিক্রি করেছি।
 মা তুমি কেন যে এই
 অসহায়তার ডিম ফেলে রেখে গ্যাছো এই ঘরে
 শুধু নিকোটিন আর নিকোটিনে পুড়ে যাচ্ছি- তবু এই
 বিষের রাজত্ব থেকে, দাঁত আর
 নখের আড়াল থেকে - দু-লাইন লিখছি এই - শুধু মনে পড়ছে তোমাকে”।
 (মা-র জন্যে আরেকটি)

বিষাদ ছাড়া কিছুই লেখেননি কবি ভাস্কর চক্রবর্তী। একবার তাঁর সম্পর্কে আমার মনে হয়েছিল ‘চিরবিষণ্ণ মেঘ’। পরবর্তীকালে বাংলা কবিতার নানা নাচাগানায় ভিড়ে যেতে যেতে আমার বড় শ্রদ্ধা হয়েছে ‘বিষাদ’-এর ওপর। মনে হয়েছে, দুঃখী কবিতাই প্রকৃত কবিতা। বিষাদই কবিতার প্রকৃত স্বভাব। আর-সব তর্ক, আর-সব কবিতা মতামত বাদ দিয়ে একথা বলাই জায়, বিষণ্ণতা কাউকে প্রতারণা করে না... সে নাছোড় লেগে থাকে ভালবাসাপ্রবণ মানুষের গায়ে। ওই যে ভাস্কর লিখেছেন ‘বাংলা কবিতার মতো নির্জনতা’- ওখানেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আজীবনের কবিতা-বিশ্বাস। হাজার বছরের শ্যাওলা ঘিরে ধরে তাঁকে, আর তিনি এই শহরে নিঃসঙ্গ ভুতুড়ে জীবন কাটান। বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার ধ্বংসস্তূপে শান্তভাবে বসে থাকেন। এই যে একলা সরে-থাকা, পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো, এই বিচ্ছিন্নতা কেন? কেন স্বপ্ন থেকে দূরে-দূরে থাকা, যাতে অস্পষ্ট লাগে? ভাস্কর নিঃসন্দেহে নাগরিক কবি, কিন্তু নগর-সভ্যতায় তিনি নিজেকে প্রান্তিক করে রেখেছিলেন। প্রান্তে স্বেচ্ছা-নির্বাসিত হয়েছিলেন বলেই অনেক বেশি দেখতে পেয়েছেন তিনি। বিষয় তাঁকে গ্রাস করেনি, তিনি সৎ প্রতিক্রিয়া দিয়ে গিয়েছেন অবিরাম। প্রচলিত-র সঙ্গে সংযুক্ত না হতে-পারার কারণেই কষ্ট পেয়েছেন তিনি, ডানা ছেঁড়ার শব্দ পেয়েছেন। এক অর্থে এই কষ্ট পাওয়াটাই তাঁর প্রতিবাদ। অনেকেই ভাস্করের বহু জনপ্রিয় পংক্তি উচ্চারণ করে প্রমাণ করেন কবির সপ্রতিভতার কথা। আমার আরও একটা কথা মনে হয়, ভাস্করের কবিতায় এক ধরণের আলস্য ছড়ানো আছে, যা সংক্রমণ ছড়ায়।

 “এইখানে, মূর্খ এক, তার
 অসুখী জীবন নিয়ে খেলা করেছিলো।

 ছাদে, তার রঙিন পাজামা পড়ে আছে-
 ঘরে-বাথরুমে, তার
 পড়ে আছে হাত ও পায়ের কসরত-

 এইখানে, এখানে-সেখানে- রক্ত, আর
 মোজা, আর
 শুধুই জলের দাগ

 থেমে আছে কবেকার ছিন্নভিন্ন হাসি।”
 (এক মূর্খের সম্মানে)

অবিস্মরণীয় এক প্রেমের কবিতায় “একটা কাঠবেড়ালী আমার জন্যে একটা বাদাম নিয়ে ছুটে আসছে”- সেখানেও এক আলতো অপেক্ষা লক্ষণীয়। কোনও তৎপরতা নেই। বাংলা প্রেমের কবিতার সংকলন হাতে তুলে নিলে পাঠক-মাত্রই বুঝতে পারবেন কত রকম কায়দায় কত রকম তৎপরতা ছড়িয়ে আছে। আমার মনে হয়, যে-সমস্ত কবি কবিতায় আচ্ছন্ন জীবন কাটান, তাঁদের কবিতায় মিশে থাকে প্রবল কোনও নেশা। এই ধরনের কবিদের সংখ্যা কম। কবিতা-প্রচারক কবির সংখ্যাই চারপাশে বেশি, যাঁদের শব্দগুলো তাঁদের নিজস্বই হয় না কখনও। ভাস্কর চক্রবর্তী সেই দিক থেকে কবিতায় আচ্ছন্ন মানুষ বলেই ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধু-বান্ধব ব্যতীত একলাই থেকে গিয়েছেন।
একটি কবিতায় লিখেছিলেন, “আমি নিজেই ফিসফিসিয়ে বলছিলাম নিজেকে আর ঘুমিয়ে পড়ছিলাম।” এতেই পরিষ্কার হয় তাঁর একা-একা শব্দখেলার বিষয়টা। সংখ্যাগরিষ্ঠের সমাজের সঙ্গে কিছুটা একমত হলেও এত নিঃসঙ্গ তিনি হতেন না। নিজের নিয়তি নিজেই তিনি নির্মাণ করেছেন স্বভাববশত। দেখেছেন, যুঝেছেন, ক্লান্ত হয়েছেন, নিস্তার পেতে প্রকট বিদ্রোহের বদলে শীতঘুমের রাস্তা বেছে নিয়েছেন। ওই যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘রক্তকরবী’ নাটকে ‘রাজার উচ্ছিষ্টে’-র কথা। যেখানে শহর আছে, সেখানেই অলিতে-গলিতে পড়ে আছে ‘রাজার উচ্ছিষ্ট’। সন্ধেবেলায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে একলা বিষণ্ণ মানুষ যে ‘রাজার উচ্ছিষ্ট’-র কাছে যায়, মিছিল-অভ্যস্ত আমাদের কাছে তার তাৎপর্য চিন্তা করে দেখলে কিন্তু অত্যন্ত গভীর। কবি ভাস্কর চক্রবর্তী উচ্চাকাঙ্ক্ষী নাগরিক জীবনের বিপ্রতীপে ম্লান আলোর সেই কবিতাই উপস্থিত করেছেন,

“ভিখিরি আর বখে-যাওয়া ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বেশ একটা পিরিতি জমেছে আমার
আমাদের রাস্তাগুলো ওদের চেনাই-
দেখাই শহরের দেয়াল-জানাই, কতদূর যেতে পারি আমরা-
শহর যখন ঘুমিয়ে পড়ে, আমি বলতে থাকি, ভাসমান রহস্যময় রাত্রির কথা
আরো বলি: আমার কোনো টাকা-পয়সা নেই...”
(ঢেউ)

বিষাদগ্রস্ত এই ধারাবিবরণী কাব্যগ্রন্থের পাতা থেকে উঠে এসে পাঠকের মধ্যে চারিয়ে যায়। যেন এর শেষ নেই কোনও। মৃত্যুর আগে কবি লিখে গিয়েছেন প্রকৃত সত্য-

“আমার মাথাটা ছিল প্রজাপতি
হাজার আলোকবর্ষ উড়ে এসে
শহরের প্রেত আমি শহরে জন্মিয়ে
শহরেই পচে মরে গেছি।”
(এপিটাফ)

শহর একটা মৃত গ্রাম। ভাস্কর ছিলেন সেই শহরের প্রেত। মনখারাপের অন্ধকারে নিয়ত যার বাস।
||

Comments

  1. ভাস্কর চক্রবর্তী আমার বোধের এক সর্বনাম । তাঁর উপর বিভাসের এই হৃদবিন্যাসটি আমি সঞ্চয়ে রাখলাম ।

    ReplyDelete

Post a Comment