শুদ্ধ স্বর - সুজিত সাহা



Weekly-Editionযাপন

‘রাজা একটা কিট আনবি?’
‘কদিন হল?’
‘আজ সাত দিন’
‘হুম’ ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রাজা, বাসের টাইম হয়ে যাচ্ছে। ইমন বেরোবে আরো আধঘণ্টা পরে। দুজনের স্কুল দুদিকে। দুজনেরই সাবজেক্ট অঙ্ক। ইমনের স্কুল শহরের মধ্যে, রাজাকে বাসে করে যেতে হয়, শহর ছাড়িয়ে একটা গ্রামের স্কুলে। ইমনের নির্দিষ্ট রিকশ আছে,প্রতিদিন ওতেই যাতায়াত। রাজা ডেইলি প্যাসেঞ্জার, পুরো ভাড়া দেয় না তাই প্রায় দাঁড়িয়েই যেতে হয়। কাছাকাছি নেমে যাবে এমন কোন সিটে বসা প্যাসেঞ্জারের সামনে দাঁড়ালে কোন কোন দিন বসার সুযোগও পেয়ে যায় শেষ মিনিট কুড়ি। আজও তাই হল, একটা বসার জায়গা পেয়ে গেল বেশ আগেই। ভিড় বাসের মধ্যে থেকে চম্পকদা বলে উঠল, ‘রাজা আজ সকালে কার মুখ দেখে উঠেছ?’ চম্পকদা রাজার স্কুলের বাংলার টিচার। রাজা বসতে বসতে বলল, ‘চম্পকদা আমি তো একই মুখ রোজ দেখি।’ ‘ফল তো কিছু দেখি না,’ রসিকতা করে চম্পক। চাপা গলায় ধমক দেয় সবিতা দি, ইতিহাসের টিচার, ‘কি হচ্ছে চম্পক!’ চুপ করে থাকে রাজা, জানলা দিয়ে চাষের কাজ দেখে। মনে পড়ে যায় বাড়ি মানে বাসা থেকে বেরোবার সময় ইমনের কথাটা। তার মানে আবার একটা ভয়ঙ্কর অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া। চম্পকদার কথা গায়ে মাখে না কিন্তু কোথায় যেন খচ করে ওঠে। এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি তো ইমনকেও হতে হয়। কেমন করে সামলায় ইমন নিজেকে সে সময়? রাজা ভাবে, ইমনের মত মেয়ের পক্ষে এই চিন মিউজিক সামলান কেমন কঠিন। স্কুলের সামনে বাস দাঁড়ায়। নেমে পড়ে রাজা।
সুবলদা একটু দেখে চালাবেন, ঝাঁকুনি যেন না লাগে। সাবধানে রিকশতে উঠে বসতে বসতে ইমন বলে ওর প্রতিদিনের বাহক সুবলকে। সুবল মাঝ বয়সি, কোন কথা বলে না, কিন্তু অন্যদিনের থেকে সতর্ক হয়ে বাম্পার, খানা, খন্দ দেখে স্কুলে পৌঁছে দেয় ইমনকে। আজ নামার সময় সুবল বলে, ‘সাবধানে নামবেন দিদি।’ ইমন মিষ্টি হেসে ঠিক সময়ে বিকেলবেলা আসতে বলে স্কুলে ঢুকে যায়। টিচার্স রুম হয়ে প্রেয়ার শেষ করে ক্লাস ফাইভের খাতাটা নিয়ে বেরোতে গিয়ে আবার বসে পড়ে ইমন। সুচিত্রাদির ক্লাস নেই বলে বসেছিল, অন্যরা সবাই যে যার মত ক্লাসে চলে গেলেও ইমনকে বসে থাকতে দেখে বলে, ‘কি রে ক্লাসে যাবি না?’ ‘যাচ্ছি, মাথাটা কেমন ঘুরে গেল,’ উত্তর দেয় ইমন। সুচিত্রাদি উঠে আসে, ‘কি হয়েছে? কোন খবর আছে নাকি?’ ‘ধুর, এমনি, যাই ক্লাসে’ ইমন উঠতে যায়। সুচিত্রাদি বসিয়ে দেয়। খাতাটা তুলে নিয়ে নিজে চলে যায়। যাওয়ার সময় বলে যায় ‘চুপ করে বসে থাক।’ অস্বস্তি বোধ করে ইমন, এমনিতেই এই ক্লাসটা ও মিস করতে চায় না। ফাইভের ক্লাসটিচার হওয়াটা ওর নিজের ইচ্ছেতে। বাচ্চাগুলোকে ভীষণ ভালবাসে ও। ওদের গায়ে পড়া ভাবটাকে ও উপভোগ করে। ইমনের মনে হয় স্কুলে ওরা নবজাতকের মত, এখনই তো ওদের নেড়েচেড়ে, আদরে, যত্নে বড় করে তোলার সময়। কিন্তু আজ স্কুলে এসেও ক্লাসটাতে না যেতে পেরে, ওদের কাছে যেতে না পেরে কষ্ট বোধ করে ইমন। মনের ভেতর আর একটা ভয় খচখচ করতে থাকে। একটু পরে ঘণ্টা পড়লেই সব টিচাররা ফিরে এসে যখন……..। সে বড় অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হবে। নানা প্রশ্ন, ফিসফাস, কৌতূহল, উপদেশ। বড়দির কানে পৌঁছে দেওয়ারও লোক আছে। তিনি আবার ডেকে পাঠাবেন। তারপর......যদি...। না ও হতে পারে। এরকম সিম্পটম গত দু বছরে আরো কয়েকবার হয়েছে। সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে ইমন। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে মেসেজ পাঠায় রাজাকে। ‘মাথাটা ঘুরে গেল, ক্লাসে যেতে পারলাম না, বসে আছি।’ মেসেজটা সেন্ড করেই মনে হয়। না পাঠালেই হত।
একটা প্রভিশনাল সহ পরপর চারটে ক্লাস নিয়ে, টিফিন করতে বসে রাজা। সাধারণত এই সময়ে ইমনের সঙ্গে দু-চারটে মেসেজ বিনিময় হয়। মোবাইল খুলতেই ইমনের মেসেজটা দেখতে পেল। আবার গম্ভীর হয়ে উঠল রাজা। একই সিম্পটম। এবার বাড়ির বাইরে। চিন্তিত হল, স্কুলে এরকম হওয়া মানে, কি কি হতে পারে ভেবে। ‘এখন কেমন আছিস?’ মেসেজের উত্তর এল সঙ্গে সঙ্গে, ‘ঠিক আছি, ক্লাস করছি, টিফিন খেয়েছিস?’ রাজা আর কোন উত্তর দিল না। চম্পকদা এসে পাশে বসল তার মুড়ি চানাচুরের ঠোঙা নিয়ে। মুড়ি খেতে খেতে গল্প জুড়ল। ‘মুড়ি খা।’ রাজা মাথা নেড়ে না জানায়। বুঝতে পারে চম্পকদা খেজুর করছে। টিফিন করা শেষ করে উঠতে যেতেই চম্পকদা ওর কাঁধে হাত রাখে। ‘সকালে বাসের কথাটার জন্য কিছু মনে করিস না ভাই, সবিতাদি খুব বকাবকি করেছে আমায়। আমি ঠিক….।’ ‘আরে ছাড়ো তো সবিতাদির কথা,’ একটা দেঁতো হাসি দিয়ে উঠে পড়ে রাজা। অর্ণব ঠিকই বলে, সংখ্যালঘুর উপর দু রকমের খোঁচা দেওয়া যায়। একটা আক্রমণ আর একটা সহানুভূতি। রাজা ভাবে, অধিকাংশ বিবাহিত নারী পুরুষের মতো তারা এখনো সন্তান ভূমিষ্ঠ করতে পারেনি, সেই হিসাবে সংখ্যালঘু।চম্পকদা তাই নিয়ে দুবার দুরকম খোঁচা দিল। কাল হয়ত আবার বলবে, কিছু মনে করিসনি তো? কতবার এরকম বলবে চম্পকদা ? যতক্ষণ পর্যন্ত রাজা বিরক্ত হয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে? অর্ণব থাকলে হয়ত বাসের মধ্যেই বলত,তাতে তোমার কি হে? ও বলে এদের লাই দিবি না রাজা। রাজা পারে না, অর্ণবের মতো আক্রমণাত্মক হতে পারে না। অর্ণব বরাবরই ডাকাবুকো, একই দিনে দুজনে হস্টেলে ঢুকেছিল একই ঘরে। তিন বছর ওরা রুমমেট ছিল। রাজা মাস্টার্স করতে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত। সবসময়ই অর্ণব রাজাকে আগলে আগলে রেখেছে, সে ক্যাম্পাসেই হোক বা হস্টেলে। পর পর দু বার চার মাসের মাথায় ইমনের মিসক্যারেজ হয়ে যাওয়ার পর ইমন আর ক্যারি করেনি। শেষ বারের পর প্রায় এক বছর ইমন কেমন হয়ে গিয়েছিল, কোথাও যেত না। বন্ধুদের থেকে দূরে থাকত, কারো সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত রাখত না। সে এক ভয়ঙ্কর সময় গেছে। তখন আবার অর্ণব হাত রাখল রাজার পিঠে। দুই জনে আলাদা আলাদা জেলা থেকে এই জেলাতে এসেছিল জীবিকার কারণে। পুরনো বন্ধুত্ব আবার জমে গেল। ইতিমধ্যে অর্ণব একটা ফুটফুটে পুত্রের পিতা হয়েছে। সেই সময় ইমন থাকত একটা লেডিস হস্টেলে। আর রাজা ওর জেলা থেকে রোজ প্রায় একশো কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে স্কুল করত। একদিন হঠাৎ করে অর্ণব রাজাকে প্রায় জোর করে তুলে আনল বাসস্ট্যান্ড থেকে পাকড়াও করে ওর বাসাতে। তার পরের তিন চার ঘণ্টা প্রায় সিনেমার মতো ঘটনাবহুল করে তুলল অর্ণব।
‘আজ থেকে তোরা এইখানে থাকবি। চল ইমনকে নিয়ে আসি।’ যে বাড়িতে অর্ণব ভাড়া থাকে, তার একটা অংশ, ঠিক ওর পাশের অংশটা দেখিয়ে বলেছিল অর্ণব।
‘মানে , কি বলছিস?’ অবাক রাজা প্রশ্ন করেছিল।
‘এটাই বলছি, এভাবে জীবন চলে না হে, এখানে থাকবি, আমরা আছি, আমার ছেলেটা আছে, ইমন ঠিক হয়ে যাবে।সবচেয়ে বড় কথা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হবে। চল, চল ইমনকে নিয়ে আসি’
সে রাতে ইমন কান্নার নদী নামিয়েছিল রাজার বুকে। তার পর আদরে আদরে ক্লান্ত হয়ে খুব ঘুমিয়েছিল ওরা। পরদিন স্কুলে যায়নি কেউ। সারাদিন ধরে গুছিয়ে নেওয়া, সাজিয়ে তোলা, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া, আর অর্ণবের ছেলের সঙ্গে ইমনের জমাটি খেলা। ‘অর্ণব, বাড়িওয়ালাকে বলেছিস তো সব? লুকোসনি তো কিছু?’ রাজা জিজ্ঞাসা করে। ‘বলেছি তো তোর নাম রাজা আর তোর বৌ ইমন।’ ‘এইটুকু শুধু?’
‘আমার যে টুকু প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে, বলেছি।’
‘তারপর যখন জানতে পারবে...’
‘থাম তো, আমি আছি না। ওদের আমাকে ছাড়া চলবে না।’
‘কেন, তুই কে?’ রাজা জানে অর্ণব নিশ্চয় কোন ছক কষে রেখেছে।
‘আরে থাকে তো দুই বুড়ো বুড়ি, মাঝে মাঝেই ওদের হার্ট অ্যাটাক হয়, তখন তো আমাকেই দেখতে হয়।’
‘মানে! মাঝে মাঝে হার্ট অ্যাটাক !’
‘আরে, দুই ছেলে থাকে বাইরে। বুড়ো বুড়ি নিজেরা ঝগড়া করছে সবসময়। একে অন্যকে ভয় পাওয়ানোর জন্য হার্ট অ্যাটাক করায় একজন, তখন অন্যজন এসে আমাকে ডাকে। তবে রাতে হয় না হার্ট অ্যাটাক, কারণ রাত দশটার মধ্যে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ওরা শুয়ে পড়ে। আর আমি না থাকলেও অ্যাটাক হয় না। তুই ছাড়, ওটা আমার চিন্তা।’
প্রথম মাসের ভাড়ার টাকা নিজের হাতে দিয়ে এসে অর্ণব একটা রশিদ এনে দিয়েছিল রাজার হাতে। রাজা দেখল তাতে লেখা রয়েছে, ভাড়াটিয়া – রাজা আলম।
আজ পুজোর শেষ দিন। অর্ণবরা চলে গেছে বাবা মায়ের সঙ্গে পুজো কাটাতে। ওর ছেলেটাকে খুব মিস করছে ইমন। সে যে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই ইমনের কাছে থেকেছে । তিন মাস হয়ে গেল, তার মধ্যে দু মাস স্কুলে জাওয়া বন্ধ রেখেছে ইমন। ডাক্তারবাবু বলে দিয়েছেন একদম বিছানাতে বিশ্রাম। কোন ঝুঁকিই নিতে চান না তিনি। প্রথমে বলেছিলেন একদম পুরো সময়টা নার্সিংহোমে রাখবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্কুল ছুটি নিয়ে বাড়িতেই বিশ্রামে থাকার সিদ্ধান্ত হয়। কখনো ইমনের মা বা কখনো রাজার মা এসে থেকেছেন। আপাতত রাজার স্কুল ছুটি হওয়াতে তারা কেউ নেই। সারাদিন রাজা বাড়িতে থাকে, ইমনের দেখাশোনা করে। কত পুরনো কথা, সেই প্রেমে পড়ার কথা। ক্লাসের অন্য বন্ধুদের কথা, এইসব। মাস্টার্স করতে গিয়ে দুজনের আলাপ, ইমন কলকাতার মেয়ে। রাজা মুর্শিদাবাদের ছেলে, কল্যাণী থেকে গ্র্যাজুয়েট। আজকে ওরা খুনসুটি করছে কে আগে এগিয়ে এসেছিল, কে প্রপোজ করেছিল এই নিয়ে। রাজা সবসময় খেয়াল রেখে চলেছে, কিছুতেই যেন আগের বারের মিসক্যারেজের সময় গুলো নিয়ে ইমন না ভাবে। ডাক্তারবাবু রাজাকে সতর্ক করে দিয়েছেন এ ব্যাপারে। ‘দেখুন, দু বছর চিকিৎসার পর কনসিভ করানো গেছে। এটা আমার কাছে একটা চ্যাঁলেঞ্জিং কেস। আপনারা তো বটেই, আমিও নিজেকে উদ্বেগ রাখতে করতে পারছি না। চেষ্টা করতে হবে পেসেনট এর মধ্যে যেন কোন উদ্বেগ না থাকে।‘ ‘আবার কি সেরকম হতে পারে?’ শুকনো গলাতে রাজা প্রশ্ন করেছিল ডাক্তারবাবুকে।’ ‘শুধুমাত্র উদ্বেগ, যাকে টেনশন বলি আমরা তাতেও মিসক্যারেজ হয়ে যায়। সেখানে আপনার স্ত্রীর কেসটা তো আরো জটিল। আগের দুবার চার মাসের বেলাতে ঘটনাগুলো ঘটেছিল। সুতরাং এই সময়টা খুব সাবধানে কাটাতে হবে। বলছি না যে তারপর বিপদমুক্ত, কিন্ত ওটা একটা হার্ডল তো বটেই। দেখা যাক হার্ডলগুলো টপকে ফিনিসিং লাইনে পৌঁছন যায় কিনা। অর্থাৎ ডাক্তারবাবু নিশ্চিত নন। দুশ্চিন্তা রাজার মস্তিষ্কের কোষ বেয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, কুঁকড়ে যায় রাজা। ইমনের সঙ্গে যে উচ্ছল সময় কাটাতে চায়, সেটা অভিনয়ের মতো হয়ে যায়। ধরা পড়ে যায়। ‘রাজা এত টেনশন করিস না, এবার আর ওরকম হবে না।’ ইমন বলে। গান শোনে, ডাক্তারবাবুর কথা মতো হালকা মেজাজের বই পড়ে। অর্ণবরা যাওয়ার আগে পুজোর গিফট হিসাবে একটা মোটা উপন্যাস সমগ্র দিয়ে গেছে, সেটা পড়তে পড়তে ইমন ঘুমিয়ে পড়ে।
উদভ্রান্তের মতো ঘুরছে রাজা। মুখে জ্বলন্ত সিগারেট, পকেটে আরো দু প্যাকেট। সকলে কি দেখছে ওকে? ওর সামনে সামনে চলেছে সিরাজ খান। লুঙ্গিটাকে তুলে হাঁটুর কাছে বাঁধা, গায়ে একটা স্যাণ্ডো গেঞ্জি, তার আসল রং কি ছিল বোঝা যাচ্ছে না, এখন তার উপর ফোঁটা ফোঁটা শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ, কিছু সদ্য শুকোনো রক্তের দাগও আছে। একই অবস্থা লুঙ্গিটার। একটা ভুঁড়ি নিয়ে থপ থপ করে হাঁটছে সিরাজ, রাজা তাকে অনুসরণ করছে। রাজা ভাবছিল, সিরাজ যখন চপার চালিয়ে মাংস কাটে তখন কি ও সন্ত্রাসবাদীর মতো নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে? ওর ওই চপার চালানোর চেহারাটা কি মাংস খাওয়া মানুষের কাছে কোন বিশেষ আকারে থাকে? রাজার কেমন সিরাজকে নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ বলে মনে হয়। রাস্তার মানুষ কি রাজাকে দেখছে সিরাজের সঙ্গে যেতে? তারা কি রাজাকেও নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ ভাবছে? ‘ইনি হচ্ছেন রাজা আলম, মাস্টার মশাই এই হল খোদাবক্স ভাই।’ খোদাবক্স নামাজি মানুষ, প্রায় সকল সময়েই মসজিদে থাকে, সে রাজাকে নিয়ে যায় মসজিদের পিছন দিকে একটা গলির মধ্যে। সেটা একটা মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চল, প্রায় বস্তির মতো। এলাকার মসজিদটাই কেবল সাফসুতরো, বাকিটা ঘিঞ্জি, নোংরা। এবং মানুষগুলো সব এলাকার মতো মানানসই, কেবল রাজার চেহারা, পোশাক সব কিছুই বেমানান। রাজা লক্ষ্য করে, উৎসুক চোখ অনুসরণ করছে তাকে। ‘এই বিপদের সময় মুসলমানের পাশে মুসলমান না দাঁড়ালে খোদার খিদমতগার হওয়া যায় না। এই দেখেন এই ঘর, ঐখানে গোসল ঘর।’ তার ভাড়া দেওয়ার ঘর ও ব্যবস্থা দেখিয়ে খোদাবক্স বলে। ছিটকে বেরিয়ে আসে রাজা, পিছন পিছন সিরাজ। ‘এখানে থাকা আপনার পক্ষে কঠিন, একজন বললেন খুব বিপদে পড়েছেন, তাই আপনাকে এনেছিলাম। দ্রুত সিগারেট ধরিয়ে সিরাজের কাছ থেকে নিঃশব্দে বিদায় নেয় রাজা। এক ভয়ঙ্কর গ্লানি রক্তস্রোতের মতো সারা শরীরে বয়ে চলেছে। রাজা বুঝতে পারছে এই মুহূর্তে স্বাভাবিকের থেকে অনেক দ্রুত তার পালস রেট। মাথার ভেতরটা দপদপ করছে। সেগুলো যেন এক একটা হাতুড়ির বাড়ির মতো মনে হচ্ছে রাজার। কেন, কেন, কেন এই অপমান তাকে পেতে হবে? হ্যাঁ ওই বাসস্থান দেখতে যেতে হওয়া অপমান ছাড়া কি? সিরাজ! না সিরাজ চেনে না মুর্শিদাবাদের বনেদি আলম পরিবারকে, সিরাজ জানে না রাজা যাদবপুরের অঙ্কের মাস্টার্স করা, সিরাজ চেনে না এই শহরের বড় স্কুলের অঙ্কের দিদিমণিকে, জানে না ইমনের শরীরে বইছে ভারত বিখ্যাত সঙ্গীত ঘরানা। সিরাজের কাছে রাজা শুধু একজন মুসলমান। খোদার বান্দা, খোদাবক্সের কাছে। আর এই পরিচয়ের জন্য আজ রাজাকে বন্ধু, সহকর্মী, দালালের কাছে গিয়ে বলতে হচ্ছে আমাকে একটা বাসস্থান খুঁজে দাও। ইমন একা রয়েছে, এমনিতেই গত দু সপ্তাহে রাজার কাণ্ডকারখানা ইমনকে উদ্বেগে রেখেছে। আজ তো বলেও আসেনি বাড়ি থেকে বেরোবার সময়। দু-এক বার ফোনে রাজা বলেছে, এক্ষুনি ফিরছি। কি করবে রাজা ভাবছে, বাড়ি ফিরে যাবে? অর্ণবকে ফোন করে সব জানাবে? হঠাৎ একটা ইউরিনালের গায়ে হাতে লেখা পোস্টার দেখে, ‘বাড়ি ভাড়ার জন্য যোগাযোগ করুন, দালাল নহে।’ সঙ্গে ফোন নম্বর। রাজা ফোন বের করে নম্বর খুঁচিয়ে কল করে দেই নম্বরে। হাতে সময় নেই, দু একদিনের মধ্যে অর্ণব এসে পড়বে, তার আগেই যা করার করে ফেলতে হবে। অর্ণবের সহানুভূতির ছাতার তোলা থেকে বেরোতেই হবে রাজাকে।
সে সন্ধ্যাটা ছিল বিজয়ার দু এক দিন পর। হঠাৎ সন্ধ্যাবেলা বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক ডেকে পাঠালেন রাজাকে। উপরটা আবার শুনশান হয়ে গেছে। ওদের ছেলেটা সপরিবার পুজো কাটিয়ে ফিরে গেছে। বিজয়ার দিন সন্ধ্যাবেলা এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে রাজা এসে প্রণাম করে গিয়েছিল। সেদিনও অনেকের উপস্থিতিতে কোলাহল মুখর ছিল বাড়িটা, আজ আবার নিঃসঙ্গ নৈঃশব্দ্য। শোবার ঘরে রাজাকে নিয়ে বসলেন বৃদ্ধ। সামনের টেলিভিশনে তখন আলোচনা চলছে, “সন্ত্রাসবাদের হাতে বাংলা” রাজা ইদানিং খবর প্রায় দেখেই না। কিন্তু এদিকে ওদিকে আলোচনা হতে শুনেছে কোথায় যেন বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে। লোকজনের মধ্যে একটা চাপা আতঙ্ক এবং একরকমের ক্রোধ চেপে বসছে। ‘কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ করা উচিৎ। এরা তো সব লোপাট করে দিচ্ছে, ’ বাড়িওয়ালা রাজার দিকে না তাকিয়ে বলে; ‘আসলে আমরা ঠিক এই রকমটা ভাবতেই পারি না, কত মানুষের ত্যাগে যে স্বাধীনতা পেলাম তারপর এসব মানা যায় না।’ রাজা মাথা নাড়ে, অনুচ্চ উচ্চারণে সম্মতি জানায়। এর বেশি রাজার কিছু বলার থাকে না। কোন সরকারের কি দায়িত্ব রাজা তা জানে না, আগ্রহীও না। তবে এইরকম সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের ঘটনাতে ও কেমন গুটিয়ে যায়। সেকি সন্ত্রাসবাদের ভয়ে নাকি সন্ত্রাসবাদের বৃহত্তর প্রেক্ষাপট নিয়ে? রাজা বুঝে পায় না। আর এই মুহূর্তে ইমন, আর তার ধারণ করা প্রাণটুকু ছাড়া কিছুই মাথায় ঢোকাতে চায় না। রাজা উসখুস করে, ইমনকে ওষুধ খাওয়ানোর সময় হয়ে যাচ্ছে। ‘তোমাকে যা বলার জন্য ডেকেছি,’ বলে বাড়িওয়ালা যা বলতে লাগলেন তার মূল কথা হল – দুই উচ্চপদাধিকারী ছেলেদের কথা মতো রাজাকে বাড়িটা ছাড়তে হবে। এবং সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তিনি মনে করছেন দু সপ্তাহ সময়ের মধ্যে রাজা এটা করবে। এর বেশি সময় তিনি দিতে পারবেন না। প্রায় টলতে টলতে উঠে পড়ে রাজা, বৃদ্ধা মহিলা এসে ম্লান মুখে ইমনের কথা জিজ্ঞাসা করেন। রাজা অস্পষ্ট উচ্চারণে কি বলেছিল বোঝা যায়নি। ওই উচ্চপদস্থ ছেলেদের একজন যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ার, রাজা ভাবে। অর্ণবকে এর মধ্যে না জড়ানোর অনুরোধ করেছে ভদ্রলোক, ওর ফেরার আগেই ব্যবস্থা করতে বলেছেন। ওরা অর্ণবকে ভয় পায়না, বিশেষ স্নেহ করে। অর্ণবকে ওরা ছাড়তে চায় না, কিন্তু রাজাকে ছাড়তে হবে। এই প্রথম রাজার মনে হয় অর্ণব হিন্দু, বাড়িওয়ালার হিন্দু ভাড়াটে। কিন্তু ও কি করবে? জানাবে না অর্ণবকে? জানলে অর্ণব ছুটে আসবে, এবং কিছুতেই ওদের বাড়ি ছাড়তে দেবে না, বাধা দেবে, আটকাবে। কিন্তু কতদিন, কতবার এইরকম ভাবে অর্ণব ওকে আগলাবে? ছাতা ধরবে মাথায়? হস্টেলের সেই ভারত পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের দিন থেকে যা শুরু হয়েছিল। সকলে মিলে খেলা দেখতে দেখতে একটা ধর্মীয় টিটকিরি ছুটে এসেছিল রাজাকে উদ্দেশ্য করে, যাতে দেশের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্ন জড়িত ছিল। কেঁদেছিল রাজা সেদিন, এবং প্রথম বুঝেছিল সে শুধু ভারতীয় নয়, সে একজন সংখ্যালঘু, মুসলমান ভারতীয়। ‘কেঁদো না হে, শোনো, ঘরে এসে অর্ণব বলেছিল, সারা পৃথিবীতে যে যেখানে সংখ্যালঘু, সবারই তোমার মতোই অবস্থা। সে ইয়োরোপের ইহুদী, বাংলাদেশের বা পাকিস্তানের হিন্দু, অথবা ইরানের কুর্দ, গাজার মুসলমান, করাচীর সুন্নি, এরকম অজস্র উদাহরণ শুধু ধর্মের ভিত্তিতেই দেওয়া যায়। আর তা ছাড়া আরো অনেক রকমের সংখ্যালঘু হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের বিরুদ্ধে যাওয়া মানেই তুমি সংখ্যালঘু। এটা জেনে রাখ রাজা, যে কোন সংখ্যাগরিষ্ঠতা হিংস্রতার জন্ম দেয়। এই হিংস্রতা গায়ে মাখা মানে ফাঁদে পা দেওয়া, মনে রাখিস। মনে রেখেছে রাজা, কখনো আর এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি, পাত্তা দেয়নি, উপেক্ষা করেছে। বরং একটা সংখ্যালঘু স্কলারশিপের সুযোগ ও যখন পেয়েছিল, তখন ওর বাবা একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, যদি সবার মধ্যে থেকে মেধার জন্য তুমি এটা পেতে তবে আমি গর্বিত হতাম। কিন্তু বিশেষ কোন কারনে তোমাকে এই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, তোমাকে আলাদা করা হচ্ছে অন্যদের থেকে। যে কোন রকম সংখ্যালঘুত্বের সুযোগ না নেওয়াই ভাল। এই সুযোগ দিয়ে তোমার পরিচিতি সত্তাকে তৈরি করে দেওয়া হবে অন্যদের কাছে। আর এতে বঞ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের হিংসার কারণ হয়ে উঠবে তুমি। রাজা নেয়নি সে স্কলারশিপ। কিন্তু বাবার ওই দর্শনকে সম্মান করে এসেছে এতদিন, কখনো নিজেকে আলাদা ভাবেনি। তাই দু বছর প্রেম চালানোর পর অদিতি যেদিন বলেছিল, ‘রাজা এই ভয়ঙ্কর চাপ আমি নিতে পারব না, তুই ভুলে যা আমাকে।’ সেদিন আবার রাজার মনে হয়েছিল ও শুধু রাজা নয়, রাজা আলম। ডাইনোসর নেই, সিন্ধু সভ্যতা নেই, রাজা বাদশারা নেই, যীশু নেই, নবী নেই, বাসিয়ানের বুদ্ধ নেই, বাবরি মসজিদ নেই তবুও সবকিছু চলছে। কাঁধে হাত রেখে অর্ণব বলেছিল, ‘জীবনে অনেকটা পথ হাঁটতে হয় রাজা, অদিতি চ্যাটার্জি একটা হোঁচটের মতো, এমন হোঁচট আরো আসবে। ভুলে যা।’ রাজা ভুলে গেছে অদিতিকে, কিন্তু একটা খোঁচা কখনো কখনো চাগার দিয়ে ওঠে, পাত্তা দেয় না রাজা।
‘কোথায় যাচ্ছিস আবার?’ উদ্বিগ্ন ইমন প্রশ্ন করে। ‘এখুনি আসছি।’ বেরিয়ে যায় রাজা। দুপুর গড়িয়ে যখন বাড়ি ফিরেছিল, তখন বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছিল রাজাকে। কিন্তু এখুনি একটা ফোন রিসিভ করার পরই কেমন বদলে গেল আবার, লক্ষ্য করেছে ইমন। গত কয়েকদিন রাজার কি হয়েছে বুঝতে পারছে না ইমন, অপরিচিত রাজাকে নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। ‘রাজার কি হয়েছে বুঝতে পারছি না, অস্বাভাবিক লাগছে, আমার ভয় করছে। মেসেজ পাঠায় অর্ণবকে।
‘কাল সকালে তাহলে আপনার পরিচিতির প্রমান, ফোটোকপি দেবেন, ও সঙ্গে অরিজিনাল গুলো আনবেন, আমি দেখে নেব।’
‘আনব সব।’
‘ভাড়া ওই দশহাজার করেই লাগবে। আসলে টাকার প্রয়োজন বলেই ভাড়া দেওয়া, না হলে...’
‘ঠিক আছে দশহাজারই দেব।’
‘অ্যাডভান্সটা সকালেই দেবেন। ওটা তাড়াতাড়ি দরকার, সেজন্যই ঐ হাতে লেখা পোস্টার সকালে দিয়েছিলাম।’
‘দিয়ে দেব, আপনি ভাববেন না।’
‘ও, যেটা বলছিলাম, হিন্দু বাড়িতে কোন অবৈধ খাদ্যবস্তু যেন না আনা হয়।’
‘না, না, ও নিয়ে আপনি ভাববেন না।’
‘আর ঐ নামাজ টামাজ....’
‘না, না, একদম না।’
আপনি ঈশ্বরকে ডাকতেই পারেন, তবে শব্দ না হলেই হল। খোদাও আপনার মতোই , শব্দ পছন্দ করেন না । তাহলে কাল সকালে......
‘হ্যাঁ আটটার সময় এসে আমি ওগুলো সব দিয়ে যাবো, আপনি দয়া করে একটু পরিষ্কার করিয়ে দেবেন কাউকে দিয়ে। টাকা আমি দিয়ে দেব।’
‘ঢুকবেন কবে?’
‘কাল বিকেলেই চেষ্টা করছি...’
‘ঠিক আছে আসুন, ও আপনার ফোন নাম্বারটা একটু লিখে দিয়ে যান।’
ফোন নম্বর লিখে দিয়ে ভদ্রলোককে একটা প্রণাম ঠুকে বিদায় নিয়েছিল রাজা। স্বস্তির শ্বাস নিয়ে দুপুর গড়িয়ে বাড়িতে ঢুকে প্রস্তুতি নিচ্ছিল রাজা। এবার ইমনকে সবকিছু বলবে। গত কয়েকদিনের যে ঘটনা প্রবাহ ব্যাতিব্যস্ত করে রেখেছিল তা বলবে, বুঝতে পারছে রাজা, ইমন খুব উদ্বেগে আছে ওকে নিয়ে। একটা সুসময়, ঘনিষ্ঠ সময় খুঁজছিল রাজা। এমন সময় বেজে ওঠে রাজার মোবাইল, পর্দাতে দুপুরের ঐ বাড়িওয়ালার নাম। ঘরের বাইরে বেরিয়ে ফোনটা ধরে রাজা। লোকটা বোধহয় বাড়তি কিছু চাইবে, আশঙ্কা করে রাজা। সবকিছুতেই রাজি হবে রাজা।
‘রাজা আলম বলছেন?’
‘হ্যাঁ, বলুন কাকাবাবু’
‘না, মানে একটা সমস্যা….’ থেমে যান ভদ্রলোক।
‘বলুন, আমি শুনছি।’
‘এন.আই.এ যেরকম খানাতল্লাশি শুরু করেছে…।’ আশঙ্কিত হয় রাজা। ‘...করাই তো উচিৎ, একেবারে গোড়ার চাঁইগুলোকে ধরতে না পারলে…শুনেছেন নিশ্চয়ই, এন.আই.এ আজ কোথা থেকে যেন প্রচুর বোমা আর বিস্ফোরণের মশলা উদ্ধার করেছে।’
‘না, আমি খবর দেখিনি।’ রাজা উত্তর দেয়। ওর বুকের ভেতর ঢিবঢিব করতে থাকে এক আশঙ্কা।
‘সেটাই কথা, আপনাকে কথা দিয়েছি কিন্তু…।’ রাজা বিস্ফোরণের অপেক্ষা করে, ঘন ঘন নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া ও প্রান্তে আর কিছু যায় না। ‘আপনি অন্য কোথাও দেখুন। আমাকে...মানে আমার এখানে সম্ভব নয়।’
ফোন কেটে দেয় রাজা। রাজা, রাজা আলম, তুমি শুধু মুসলমান নও, তুমি জিহাদি মুসলমানও হতে পারো, হয়ত এন.আই.এ তোমাকেই খুঁজছে ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে পড়ে রাজা ইমনকে উপেক্ষা করে।
কয়েকবার ফোন করেছে অর্ণব, রাজা ধরেনি, কেটে দিয়েছে। পরশু ওদের ফেরার কথা, তার আগে, হ্যাঁ, তার আগেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে, পরিকল্পনা করে ফেলেছে রাজা। খোদাবক্সের পাড়াতে যায়। ফরাজি স্টোর্স থেকে একটা ফেজ টুপি কেনে, সেটা মাথাতে পড়ে। দোকানের আয়নাতে একবার দেখে নিজেকে। সুপুরুষ রাজা, কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি, ফেজ টুপি রাজা চিনতে পারে না নিজেকে। এ এক নতুন রাজা। গলি থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যার কোলাহল মুখর সদর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে। কেউ কি দেখছে ওকে, বুঝতে পারছে ওকে? নিজেই পথচারীদের দিকে লক্ষ্য করে, অনেকে অবাক হয় ওর চাহনিতে। রাজা দেখে তাদের মুখে ভয়ের ছায়া। ওষুধের দোকানে যায়। পরিচিত দোকান, নিচু স্বরে কথা বলে দোকানির সঙ্গে। ওষুধ নেয় ইমনের জন্য। দোকানি ওকে দেখছে, রাজা খুশি হয়। দোকানির মুখে আতঙ্কের ছাপ ওর নজর এড়ায় না। বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করে। চমকে যায় বৃদ্ধ রাজাকে দ্যাখে।
‘আমি রাজা আলম, আপনাকে কথা দিয়ে যাচ্ছি, অর্ণব আসার আগেই আপনার বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। চিন্তা করবেন না..... ।’ বাড়িওয়ালা ভড়কে যায়। বিস্ফোরিত চোখে রাজাকে দেখতে দেখতে কেমন মিইয়ে যায়। রাজা ঘরে ঢোকে। ইমন চমকে ওঠে, খানিকক্ষণ থিতু হয়ে প্রায় হাসিতে ফেটে পড়ে। ‘সালাম রাজা মিয়া।’ বলে হাসতেই থাকে, ‘এবার কি দাড়িটাও রাখবি?’ তাহলে আমি কিন্তু নেই। রাজাও হাসে। দুজনে রাতের খাবার খেয়ে নেয়। ইমন হঠাৎ রাজার চুলে বিলি কাটতে কাটতে প্রশ্ন করে, ‘কি হয়েছে রে রাজা? আমার কাছে লুকোস না।’ এড়িয়ে গিয়ে রাজা বলে ‘বিবিজান, রাত হো গিয়া, দাবা লিজিয়ে।’ এক এক করে ওষুধ দেয় রাজা, ইমন সেগুলো খায় রোজকার মতো। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে। মোবাইলের সুইচ বন্ধ করে জেগে থাকে রাজা।
অর্ণব রাজাকে ফোনে ধরতে না পেরে উদ্বিগ্ন হয়। তারপর আর দেরি করে না, সকাল হতেই বেরিয়ে আসে একদিন আগেই। স্তুম্ভিত অর্ণব প্রশ্ন করে, ‘কি করে হল? কখন হল?’ ‘মাঝরাতের পর অসম্ভব পেটে ব্যথা, কি করব তখন? বাড়িওয়ালাকে ডাকলাম, তিনিও কিছু সাহায্য করতে পারলেন না। তার পর শুরু হল ব্লিডিং, ভোরবেলা একটা রিক্স জোগাড় করে নারসিংহোমে আনলাম।’ নির্বিকার রাজা উত্তর দিল। ‘ডাক্তারবাবুকে বা নারসিংহোমে ফোন করলি না কেন?’ ‘অত রাতে ডাক্তারবাবু কি ফোন ধরতেন? আর নারসিংহোমের নম্বরটা খুঁজে পেলাম না।’ অর্ণব কিছু বলতে গিয়ে দেখল ডাক্তারবাবু নেমে আসছেন। রাজাকে ডাকলেন, অর্ণবও এগিয়ে গেল। ‘আপনি ফোন করলেন না কেন আমাকে? আপনাকে তো বলাই ছিল। দেরি হয়ে গেছে, আই অ্যাম শকড। কি করে হল বুঝতে পারছি না।’ অর্ণব জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছে?’ ‘শি ইজ ইন ক্রিটিকাল, আই অ্যাম নট শিওর অ্যাবাউট হার লাইফ।’ ‘বেবিটা?’ অর্ণব আবার প্রশ্ন করে। ‘বেবি! সে তো এ পর্যন্ত পৌঁছতেই পারেনি। বোধহয় বাড়িতেই অ্যাবোর্ট হয়ে গেছে।’ শিরশির করে ওঠে অর্ণবের শরীর। মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে ‘মাই গড।’ রাজার হাসি পায়, অর্ণব ভগবানকে ডাকছে। ও তো জানে, ইমনকে যখন রিকশতে তুলছিল, প্রায় অচৈতন্য, রক্তে ভেজা ইমনের নাইটির ভিতর থেকে এক খণ্ড দলা পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। পাড়ার কুকুরগুলো সেটা নিশ্চয়ই পরিষ্কার করে ফেলেছে। ‘আমি আরো কয়েকজন ডাক্তারবাবুকে ডেকেছি, সাহায্য করার জন্য। দেখা যাক কি হয় শেষ পর্যন্ত। আপনারা কাছাকাছি থাকবেন। ডাক্তারবাবু আবার উপরে চলে গেলেন।
এই ফেজ টুপি পরা, নির্বিকার রাজাকে দ্যাখে অবাক হচ্ছে অর্ণব। হয়তো মানুষ বিপদে শেষ আশ্রয় খোঁজে, রাজা তাই টুপি মাথায় দিয়ে ঈশ্বরকে স্মরন করছে। কিন্তু তবুও অপরিচিত মনে হচ্ছে রাজাকে। রাজা কি বুঝতে পারছে না ডাক্তারবাবুর কথা? ভয়ে রীতিমত ভেঙ্গে পড়ছে অর্ণব অথচ রাজা বেশ স্টেডি রয়েছে। অর্ণব ঘন ঘন সিগারেট ধরাচ্ছে, রাজা জানিয়েছে সে গতকাল সন্ধ্যা থেকে ধূমপান ছেড়ে দিয়েছে। এই সব কিছুর মধ্যে অর্ণব অস্বাভাবিকতার আঁচ পাচ্ছে। ওরা এসে সামনের চায়ের দোকানে বসেছে, কেউ কথা বলছে না। হঠাৎ রাজা বলে উঠল, ‘ভালই হল, আর একটা সংখ্যালঘু বৃদ্ধি পেল না।’ অর্ণব রাজার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল কেমন ভাবলেশহীন। রাজা সামনে পড়ে থাকা খবরের কাগজটার দিকে তাকাল, হেড লাইনে চোখ আটকে গেল, হন্যে হয়ে সন্ত্রাসবাদী খুঁজছে এন.আই.এ। একটা চোরা হাসি খেলে গেল রাজার মুখে। অর্ণবের চোখে তা ধরা পড়ল।
‘কি হয়েছে তোর বল তো?’ অর্ণব প্রশ্ন করল।
‘এন.আই.এসন্ত্রাসবাদী খুঁজছে।’ হেসে উঠল রাজা।
‘তাতে তোর কি?’
‘পাচ্ছে না, ওরা ধরতে পারছে না, ওরা পারবেও না।’
‘এটা হেঁয়ালির সময় নয় রাজা। তুই বুঝতে পারছিস না, ইমন ইজ ইন ডেঞ্জার.’
‘এন.আই.এ আমাকে ধরতে পারবে না।’
‘কি বলছিস, মানে কি?’ চিৎকার করে ওঠে অর্ণব।
‘গতকাল রাতে ওকে গর্ভপাতের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছি আমি।’ ভেঙ্গে পড়ে রাজা অর্ণবের কাছে।

Comments