হারাতে হারাতে একা -- কিস্তি ২৮ ( দ্বিতীয় খন্ডে )



টিস্কো কারখানার বাউন্ডারি, ক্যান্টিন আর গেটগুলো ঘুরে চিনে নিলাম আগে, আর তাছাড়া সেবারেই প্রথম আসা GOI Trainee-দের কারখানার পুকুরপারে আড্ডা মারার স্থায়ী বাঁধানো গাছতলা তো আছেই। প্রথম দিকে কারখানা চেনাবার প্রোগ্রামে আমি আমার বাবার ডিপার্টমেন্টেও গিয়েছিলাম। বাবা ব্লুমিং মিলে চাকরি করতো। লোহার সিড়ি দিয়ে উঠে তেতলার হাইটে একটা কাঁচের ঘরে বসতো, হাতের সামনে হ্যান্ডেলওয়ালা ড্রাইভিং বক্স কয়েকটা, ঠিক ট্রামের ড্রাইভারের সামনে যেমন থাকে, আর নিচে রোলার-এর উপর দিয়ে গরম লাল লোহার ইনগট ছুটে যাচ্ছে, প্রেস-এর চাপে রোগা হচ্ছে, কাটারে কাটা পড়ছে, পালটে দেয়া হচ্ছে, ছুটে গিয়ে পাশে জমা হচ্ছে, জলের বৃষ্টি দিয়ে ঠান্ডা করা হচ্ছে, একের পর এক জমা হচ্ছে সেখানে। এই সব কান্ড কারখানা সেই কাঁচের এসি ঘরে বসে বাবা ওই কয়েকটা ড্রাইভারের নিখুঁত চালনায় সম্পন্ন করছে, চোখে চশমা, মনযোগ নিবদ্ধ লাল লোহার ওপর। লোহার এই পট পরিবর্তনকে বলা হচ্ছে ফুল ফোটা, ব্লুমিং, রসিকতাটা বাবা বুঝতো কিনা সন্দেহ ছিল আমার। মাঝে মাঝে চায়ের বিরতি হতো। তখন আমিও সেই চেয়ারে বসে ড্রাইভারের হ্যান্ডেল ঘোরাতাম। অবশ্য তখন মিল বন্ধ থাকতো, গরম ইনগট থাকতো না। মেকানিকাল, ইলেক্ট্রিকাল, মেটালার্জিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং একসাথে প্রয়োগ করা দেখে সবে কারখানা বুঝতে শিখছি। ১৯৬৭ শরৎকাল তখন। ওই ব্লুমিং, মানে ফোটা, বাবার বাগান করা, ফুলগাছের পরিচর্যা, ফুল ফোটানোর চমৎকারে উদ্ভাসিত হওয়া, পুরস্কার পাওয়ার আনন্দ – সব আমার মনে পড়ে গেল। নতুন ভাবে তাকিয়ে দেখলাম পুরো ব্যাপারটা, নিজের হাতে গরম লোহার রূপ বদলে দেবার উত্তেজনা ... বাবা হয়তো তার নিজের পরিবার সংসার আত্মীয়দের প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন পরিশ্রম করে সার্থকতার স্বপ্ন দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। সেই অলীক আনন্দ ছাড়া বছরের পর বছর এই ককপিটে ( কাঁচের চেম্বারে ) বসে গরম লোহার কান ধরে থাকতে কে চাইবে ? টাটার এই কারখানাতেও বাবা ছিল একজন শ্রমিক। শ্রমিকের অহঙ্কার আমি বুঝতে পারলাম। এই বোঝাপড়া আমার ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের সঙ্গী হয়ে থাকল। এতদিনে প্রথমবার আমি আমার বাবাকে অস্ফুট ধন্যবাদ দিলাম গোপনে। 
    এভাবে বিশাল টিস্কো কারখানার সাথে আমার পরিচয় শুরু হল। আমার ভবিষ্যতের কর্মকান্ড সম্পর্কে সামান্য ধারণা। কলেজে পড়ার সময় পশ্চিমবঙ্গের নানা কারখানা, অফিস, টেকনিকাল মার্কেটিং, ইত্যাদি ঘুরিয়ে দেখানো হয়েছিল আমাদের। কিছুতেই ভুলতে দেওয়া হতো না আমরা ইঞ্জিনীয়ার হয়ে কি কি ছিঁড়বো ( হি হি হি ), তা দিয়ে কি গড়বো। এই জন্যই তো পড়াশোনা বাদে বাকি সময়টা পালিয়ে বেড়াতাম বনে বাদাড়ে, চা বাগানে, নদীতে, পাহাড়ে, দু’চাকায় ডুয়ার্সময়। জামশেদপুরের তো প্রতি ইঞ্চি আমার নখদর্পণে। চারপাশটা। কারখানার পরে বাকি দিনটা চান খাওয়া বাদে পাড়ার ক্লাবে কাটতো প্রথমে। ক্যারম, তাস, জুয়া, দাবা, জিম, ব্যায়াম -- লোহা নিয়ে, রিং, প্যারালেলবার, যোগাসন, প্রেমের ছোঁয়ার গল্প, আউটডোর খেলাধূলা ... কীসে যে শান্তি সেটাই জানতাম না। বাড়িতে যতক্ষণ, বই নিয়ে। সময় কেটে গেল। পুজোয় অব্দি ছুটি নেই। মাত্র তো ট্রেনি। আর কী যে অশান্তি -- সেই সেকেন্ডারি স্কুল থেকে, মানে ১৯৫৫ থেকে এই পর্যন্ত কোন মেয়েকে স্কুলে কলেজে কর্মক্ষেত্রে পেলাম না। মেয়েরা ভিন্ন গ্রহের জীব যেন। মানে, বাড়ির পাড়ার পরিবারের ক্লাবের ছোট মেয়েরা না, --- যাদের দেখে মনে রঙ লাগত, তারা, রঙ মুছে চলে যেত হাসতে হাসতে। নির্দয়, মনে হতো। ফলে ক্লাবে।
    এর মধ্যে একটা কেস হল কারখানায়। রোটেশনে আমাদের কাজ পড়ল ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টে। কারখানার ভিতরে সব শপে মালগাড়ি যাতায়াতের রেললাইন লক্ষ্য করেছিলাম। টাটানগর রেলস্টেশন দিয়ে মাল লেনদেন-এর ব্যবস্থা ছিল। ইঞ্জিন আর রেক, মেন্টেনেন্স শপ। লোকবল। আমরা রিপোর্ট করলাম ফোরম্যান মিঃ চক্রবর্তীকে। তিনি আমাদের পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে ডিউটি অ্যালট করলেন। আমার ডিউটি হল টাও ট্রেনে বসে আপ ট্রলি কারগুলোর নং নোট করা একটা খাতায়, আবার ডাউন ট্রলি কার-এর নং নোট করা। সামনে একটা ইঞ্জিন আর পেছনে একটা ছোট সিট কার। মাঝখানে দশটা ট্রলি কার। আপ ট্রেনে ব্লাস্ট ফার্নেসের স্ল্যাগ কালেক্ট ক’রে তা নিয়ে উঁচু একটা প্রাকারের ওপরে গিয়ে একটা একটা করে ট্রলি কার উল্টে দিতে হবে। কার-এর স্ল্যাগ নিচের জলরেখায় গড়িয়ে পড়বে। সবগুলো ট্রলি কার খালি হলে ডাউন ট্রেন শপে ফিরে যাবে জল দিয়ে ঠান্ডা করার জন্য। খাতায় এসব নোট করে রাখতে হবে। এবার মজা হল, ব্লাস্ট ফার্নেস থেকে গরম স্ল্যাগ নিয়ে প্রাকার টপ থেকে নিচে ঢেলে দেবার সময় আগুনের ফুলকি বেরোয়, লাল হয়ে যায় চারপাশ। মনে পড়ল জামশেদপুরে টাটা কারখানা থেকে মাঝে মাঝে, বিশেষত সন্ধ্যার পরে, যে লাল আভা ফুটে ওঠে আকাশে, রাঙিয়ে দেয়, যা আমরা অনেক দূর, এমন কি ঘাটশিলা থেকেও দেখতে পাই, হঠাৎ আকাশের রাঙিয়ে যাওয়া সুন্দর, তা এই ট্রলি কার উল্টে দেওয়াতেই হয়, সেই ব্যাপারটা আবিষ্কার করে পুলকিত হলাম। আমি অন্যদের সাথে রুটিন বদলে এই রুটটাই চেয়ে নিতাম। আমাকে এই রুটে লেগে থাকতে দেখে মিঃ চক্রবর্তী ঘনিষ্ঠ হলেন। আমার পড়াশুনা, ঘরবাড়ি, বাবার কাজ-এর খোঁজ খবর নিলেন। এমনকি আমার দেশের বাড়ি, জামশেদপুরে আমার আত্মীয়রা কি করে, মানে হাঁড়ির হাল। আমি এগ্রিকোতে থাকি, আর যে স্কুলে পড়েছি শুনে বললেন --- আমার পোলাও হেই স্কুলে পড়সে, হ্যায়ও ইঞ্জিনীয়ার, কমল চক্রবর্তী। চিন নি ?
    আমি তো তৎক্ষণাৎ চিনতে পারলাম, আমাদের স্কুলের সেই জুনিয়ার ছেলেটা, সুন্দর দেখতে, ভাল পোশাক পরে মাঞ্জা দিয়ে বিকেল বেলায় এগ্রিকোতে আমাদের পাড়ায় রোডবাজি করে মেয়েদের হিড়িক দিতো যে ছেলেটা, যাকে পেটাবার প্ল্যান করার খবর রটিয়ে ভাগিয়েছিলাম পাড়া থেকে। ইনি তার বাবা ? এখন আমার কোন রাগ নেই কমলের ওপর কারণ আমিও বড় হয়ে গেছি। কমলের বাবাকে একটা প্রণাম করলাম হাঁটু ছুঁয়ে। মনে হাসি চেপে বললাম --- আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ভাল ছেলে আপনার। আমাদের স্কুলে পড়তো। কি করে এখন ? ( মনে মনে বললাম – শালা হারামী ইভ টিজার। ) আপ্লুত চক্রবর্তী সাহেব মাসখানেকের জন্য আমার আকাশ আভানো ট্রেনযাত্রা মঞ্জুর করে দিলেন। আমি কৃতজ্ঞ হলাম।
    আগে ছোটবেলা থেকে দেখতাম দলমা পাহাড়ে কারা যেন আগুনের মালা ফেলে গেছে। এই রোজ। কে যে বানায় ওই সুন্দর মালা, কি করে সাজায় --- ভাবতাম। পরে জেনেছি, স্বচক্ষে দেখেছি, বনরক্ষীরা ঝরা পাতা সরু লাইনে সাজিয়ে, গাছ থেকে একটু দূরত্বে, সন্ধ্যেবেলা আগুন লাগাতো দাবানল ছড়িয়ে পড়া থেকে বন বাঁচাতে। কিন্তু দূর থেকে তা দারুণ লাগতো। সেরকমই আমার চিরকালের প্রশ্ন জামশেদপুরে সন্ধ্যার আকাশে লোহিত কণারা ভেসে ওঠে কিভাবে --- এবার জানা হল, আর আমিও তাতে অংশ নিলাম ভেবে পুলক হল। বন্ধু সুভাষকে জানালাম ঘটনাটা। সে বলল --- কত নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিস, এবারে সে সব থেকে গল্প বার কর। কলম তুলে নে হাতে। মেজরাব খুলে রাখ। ব্যাপারটা হল --- হঠাৎ আমার শখ হল গিটার বাজানো শিখতে হবে। ওই সময়ে বিটলস্‌দের দেখে শুনে। গিটার কিনে সপ্তাহে দুদিন মাস্টারের কাছে আর বাকি দিনগুলোয় কখনো ক্লাবের সময় মেরে বাড়িতে বসে পিড়িং পিড়িং। হাওয়াইয়ান দিয়ে শুরু। রবীন্দ্র সঙ্গীতে হাতেখড়ি। সুভাষ বলল --- এই রেটে আগামী জন্মে তুই ওস্তাদ হবি। তার চেয়ে আবার গল্প লেখা শুরু কর। তুই লিখতি। হাতে আছে। মাথায় আছে গল্প। এত পড়েছিস, দেখেছিস। কাম অন ইয়ার, গল্পকার বারীন ঘোষালের উদয় হোক আবার। আমার মনে পড়ল যোগা ব্যায়াম শিক্ষকের রোল। ডুয়ার্সে ঘুরে বেড়ানো। গল্প লেখা। গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশনের লাইব্রেরিতে বই পড়া। উর্দু শায়েরি লেখা অভ্যাস করা। ড্রইং শিট কেটে ছোট ক্যানভাস বানিয়ে ছবি আঁকা, শুধু পেন্সিল স্কেচ। এবার গিটার। কতদিন আর। গিটারের জন্য নতুন ধূলোরা অপেক্ষায়। হয়তো গল্পেরাও। পুরনো পোথাপুঁথি ঝেড়ে বার করতে হবে দেখছি। 
    ইতিমধ্যে বাবা একটা মোপেড কিনেছে কারখানায়, বাজারে যাতায়াতের জন্য। সাইকেলটা অতঃপর আমার দখলে। সেটাতেই টিস্কো আর জামশেদপুর। কখনো বা মোপেডে হাত মক্সো। বোন এম এ পড়ছে রাঁচিতে। ভাই চলল ম্যাঙ্গালোরে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে। বাড়িতে মা বাবা আর আমি। অঢেল সময়। গিটার আর পুরনো লেখা গল্পগুলো নেড়েচেড়ে দেখি। সুভাষের সাথে পাড়ার দোকানে চা খাই। ওর বাবা যাত্রা করতেন। বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল। আড্ডা। সুভাষের সাথেই একবার সাকচীর একটা ক্লাবের সোস্যাল-এর জন্য আর্টিস্ট বুক করতে কলকাতা গিয়ে কসবায় সলিল চৌধুরীর বাড়িতে। তিনি ছিলেন না। তার স্ত্রী সবিতা চৌধুরীকে বুক করতে গিয়েছিলাম। সবিতা সন্তানসম্ভবা ছিলেন, অসম্মত হলেন, একটা ফোন করে আমাদের পাঠালেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি, শ্যামবাজারে। দ্বিজেনবাবু আদর করে আমাদের বসালেন বৈঠকখানায়। বাপরে ! কী বৈঠকখানা ! প্রথম দেখলাম এমন। বিশাল ঘরের মেঝে গালিচায় মোড়া সাদা চাদর পাতা। দুটো হারমোনিয়াম, গোটা পাঁচেক তবলা-ডুগি, পাখোয়াজ, তানপুরা, সেতার ... কী নেই ! এখানে বসেই তিনি রেওয়াজ করেন বোধহয়। দ্বিজেনবাবুর সাথে কথা পাকা করে আমরা ফিরে এলাম। সেবার অনুষ্ঠান ভালোয় ভালোয় উৎরে গেল। বাকি রইলো জয়তী।
      আগেকার সেই কিশোরীটি নেই আর, পরিপূর্ণ যুবতী এখন। বিয়ের বয়স। বি এ পাশ করে বাড়িতে বসা। ওর বাবা, দুই দাদা নজরে রেখে চলেছে। ভাগ্যিস তারা সবাই আমার ক্লাবের কর্মকর্তা। ফলে যাওয়া আসা দেখা, কথা বলার অসুবিধা ছিল না। কিন্তু বাইরে নৈব নৈব চ। ধুর। কিছুক্ষণের দেখা, সবার চোখের আড়ালে জড়াজড়ি, চুমু অব্দি ঠিক আছে, আর কোন বাড়াবাড়ি সম্ভব না। আমার কপালই এই। জলপাইগুড়িতে সুমনার কেসেও এক। ঠিক করলাম – আর না। এবারে হয় পুরি কাহানি, নেহি তো বিতি জওয়ানী।
    দেখতে দেখতে পুজো পেরিয়ে শীত এসে পড়ল। পুরনো লেখাজোখাগুলো ধূলো ঝেড়ে নিয়ে বসলাম একদিন। দুদিন চোখ বুলিয়ে গিয়ার আপ করে নিয়ে একদিন সত্যি সত্যি খাতা কলম নিয়ে বসে গেলাম। দিন দুয়েকের মধ্যে একটা ছোট গল্প নামিয়ে কারখানা শেষে বিকেল বেলায় সুভাষের বাড়ি চলে গেলাম শোনাতে। ওর বাবার কোয়ার্টার। সামনের বারান্দায় বসে গল্পটা শোনালাম ওকে। সামনের বাগানে একটা পেয়ারা গাছ ছিল। কিন্তু শীতে নো ফল। থাকলে নির্ঘাৎ ফল ছিল কপালে। ও বলল – চল চা খেয়ে আসি, গল্প নিয়ে গল্প হবে খন। মাসীমা, ওর মা তখনই দুকাপ চা নিয়ে এলেন---
     --- কোথায় যাবে বাবা, এই তো চা। বসো। ভাল আছো ? আসো না আজকাল। বাণীর বিয়ে তো। এসে কাজ করতে হবে কিন্তু।
    --- নিশ্চয়ই মাসীমা। কিরে সুভাষ, বোনের বিয়ে বলিসনি তো। কোথায় বিয়ে ......... আবোল তাবোল .........
    --- শালা, তুইও হিজরায় ? মাসীমা চলে গেলে সুভাষ বলল। গল্পটা ভাল্লাগলো। কিন্তু তুই এতসব জানলি কি করে বে ?
    --- কি করি ? আমার বন্ধু হিজরা কোম্পানিতে চাকরি করবে, তার ভাল মন্দের কথা জানতে হবে না ? আসলে সুভাষ চাকরি করতো টাটানগর ফাউন্ড্রি নামে একটা ছোট কারখানায় যেখানে টেম্পোরারি শ্রমিক হিসাবে হিজরাদের রাখা হতো। তাই কোম্পানিটাকেও হিজরা কোম্পানি বলা হতো। সুভাষ কম্পটোমিটার নামে একটা ক্যালকুলেটিং মেশিনে কাজ করত টেবিল চেয়ারে বসে। ছোটবেলা থেকেই হিজরাদের দেখতাম পাড়ায় পাড়ায় নেচে গেয়ে উপার্জন করতে। তাদের নাকি নাগরিক অধিকার আর ডিউটিও নেই। আইন তাদের ছোঁয় না। সেই হিজরারা সুভাষকে চারপাশে ঘিরে রেখেছে, গল্প হিসাবে এই প্লটটা তো চমৎকার। সুভাষ কোম্পানির হিসাব কিতাব রাখতো ওই মেশিনে। তখন যে কম্পুটার ছিল কারখানায়, তা আমি দেখেছি টিস্কোতে, যেখানে আমি ট্রেনিং নিচ্ছিলাম। এক একটা ৩০ X ২০ ফুট সাইজের বিশাল সাইজের ঘরে ছিল এক একটা কম্পুটার মেশিন. একটা মেশিন চালাতে পাঁচজন মানুষ লাগতো। ছোট কারখানায় একটা কম্পটোমিটার মেশিনেই কাজ সারা হতো। সুভাষ নিবিষ্ট মনে চেয়ারে বসে মেশিন চালিয়ে হিসেব কষছে আর হিজরারা তাকে ঘিরে হাততালি দিয়ে নাচগান করে চলেছে। সিনটা দারুণ। আমি একটা গল্প লিখে ফেলেছিলাম ঘটনাটা ভেবে।
    এভাবেই মাঝে মাঝে আমার গল্প আর সুভাষের কবিতা চলতো। সুভাষ গলা কাঁপিয়ে ঊচ্চস্বরে কবিতা মুখস্ত বলতো। পড়তে হতো না। বাবা যাত্রা করতেন তো, সেই সূত্রে সুভাষের উত্তেজিত পাঠ। প্রেম, সামাজিক বঞ্চনার প্রতিবাদ, মানুষের ব্যবহারে হাসির খোরাক, এই সব ছিল সুভাষের কবিতার বিষয়। আমি তো কবিতা লিখতাম না, কবিতার বইও পড়তাম না। সুভাষের সেই দীপ্ত কবিতা পাঠকেই ভাল লাগত। ছোটবেলায় কিছুদিন আমার হিরো ছিলেন সেই রাজপুত্রের মতো চেহারার স্বরচিত কবিতার কবি সত্যেন্দ্র দে। তারপর ভুলে গেছি। এখন পর্যন্ত অনেক বাংলা ইংরাজি বই পড়লেও কবিতা কখনো না। জানি না কেন কবিতা আমাকে টানতো না। সুভাষই একদিন, গ্রীষ্মকালে শুধু ল্যাঙ্গোট পরে ক্লাবে বেঞ্চ প্রেস করছি, ঘামে কুলকুল, এসে বলল,
    --- বারীন, খবর আছে। দুজন কবি আসবে তোর সাথে দেখা করতে, কিন্তু, এই ড্রেস পরেই দেখা করতে হবে। ঠিক হ্যায় ?
    --- ল্যাঙ্গোটটাও ছেড়ে গেলে হয় না ? আমি বললাম ঠাট্টা করে।
    --- তাহলে তো ভালোই হয়। কবিতা সারা গায়ে স্পর্শ করা দরকার, বাচ্চাদের গায়ে তেল মাখার মতো। কিন্তু পারবি বাইরে ?
    --- কিন্তু আমি তো কবিতা লিখি না পড়ি না, আমাকে কেন ? গপ্পো ঝাড়ছিস ? আমি বললাম অবিশ্বাসে।
    --- নারে। সেতো তুই কবিদের সাথে মিশিশ না বলে। আড্ডায় বসলে তোর ভেতর থেকেও কবি বেরিয়ে আসবে। তুই জানিসই না তোর ভেতরেও একজন কবি আছে।
    সুভাষের আপ্তজ্ঞানে আমি মুগ্ধ। জামশেদপুরে তাহলে সুভাষ ছাড়াও কবি আছে ? দেখাই যাক। ওদিকে আমার ট্রেনিং পিরিয়ড শেষ হবে জুলাইয়ে। দিন এগিয়ে আসছে। অনেকগুলো আড্ডা ছিল আমার। পাড়ার আড্ডা, ক্লাবের আড্ডা, ট্রেনিদের আড্ডা, এবার কবিদের আড্ডাও হতে যাচ্ছে। আমি একটু হাওয়া বদল করে আসি। পাড়ার বন্ধুদের সাথে ঠিক হল ১৫ দিনের ঝটিকা সফর সারবো জুনে। যাবো কাশ্মীর। ট্রেনের টিকিট কেটে সেই মতো রওনা হলাম পয়লা জুন। তখন টিকিট পাবার ঝামেলা ছিল না। আমরা গিয়ে পাঠানকোটে নেমে বাসে শ্রীনগর গেলাম। পথে রাত কাটিয়ে দিনে পৌঁছে হাউস বোটে উঠলাম। শিকারা করে ডাল লেক ঘুরে বেড়ালাম একটা গোটা দিন, মোগল গার্ডেন দেখতে দেখতে। শিকারায় প্রথমে তো আঁকড়ে ধরে বসেছিলাম, বোটটা যাতে উল্টে না যায়। ক্রমশ সহজ হয়ে গেল জলযাত্রা। দারুণ ফুর্তি করলাম। সেই অভিজ্ঞতার তুলনা নেই। হাউসবোটে থাকা শোয়া খাওয়া এমনকি পটি করা, দুলতে দুলতে। ওঃ ! সিগারেট সেই চারমিনার। মদে তেমন আসক্তি ছিল না তখন। আমরা চারজন ছিলাম। তারপর শ্রীনগর বাজার, শোনমার্গ, গুলমার্গ, পহেলগাওঁ, হজরত বাল মসজিদ, আরো কি সব দেখলাম। ফেরার পথে পাঠানকোট, অমৃতসর, দিল্লী, আগ্রা, হরিদ্বার, ঋষিকেশ, পাটনা, প্রায় দুনিয়া ঘুরে বাড়ি ফিরে ঘুমোলাম টানা একদিন। শ্রীনগর থেকে মায়ের জন্য একটা শাল কিনেছিলাম। মা খুশি হল।
    মনে আছে, ২০শে জুন, ক্লাবে ব্যায়াম করছি, সুভাষ হাজির। --- বারীন আয়। কবিরা এসেছে। আমি গা মুছে জামা প্যান্ট পরে বেরিয়ে এলাম। দেখি কালভার্টে দুজন বসে আছে। সুভাষ পরিচয় করিয়ে দিলো --- এই হল বারীন ঘোষাল, গল্পকার, আর এ কমল চক্রবর্তী আর ও অরুণ আইন। দুজনেই কবিতা লেখে। আমার চোখ কমলে নিবদ্ধ। কী সুন্দর নিষ্পাপ মুখ ! একে পেটাবার প্ল্যান করেছিলাম ! সেই যে বলেনা, মানুষের গা থেকে বেরনো তরঙ্গে অন্য মানুষের ওপর আকর্ষণ বিকর্ষণ হয়, আমার তাই হল। কমলকে ভাল লেগে গেল চোখাচোখি হওয়া মাত্র। কমলেরও আমাকে। টের পেলাম তৎক্ষণাৎ। অরুণ বয়সে ছোট। কমলের পাড়ার বন্ধু। বললাম
    --- তোমার বাবার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে কারখানায়। বেশ ভাল লেগেছে।
    --- হাসিমুখ ভাল লেগেছে। এবারে ধীরে ধীরে মেজাজ দেখে পিঠটান দিও না। আমার স্কুলেই ছ’বছর যাবৎ আমার এক বছর নিচে পড়তো তাই ঘনিষ্ঠতা ছিল না। এখন জানলাম স্কুল পাশ করে বিষ্ণুপুর পলিটেকনিকে ডিপ্লোমা করতে গিয়ে মারপিট-থানা-পুলিশ-জেল-কাঠগড়া শেষে বিতাড়িত কমল রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা করেছে। বিশাল অভিজ্ঞতা তাহলে। ক্রমশ জানতে হবে, দাঁড়া। আমরা তখন ঠিক করলাম প্রতি রবিবার বিকেলে এক জায়গায় বসে গল্প কবিতা পড়াশোনা আর আলোচনা করবো। প্রথম আড্ডাস্থল হল সুভাষের বাড়ি। মনে আছে, ২০শে জুন এই কথার পরে ২৩শে জুন আমরা প্রথম বসলাম আড্ডায়। আমার সুভাষকে নিয়ে লেখা হিজরার গল্পটা জমে গেল। কমল, অরুণ, সুভাষ কবিতা পড়ল। কমলের কবিতা আমার ভাল লেগে গেল। আমি তখন কবিতার কিছুই বুঝি না, পড়ি না, ওই যে ভাল লাগল শুনতে, আমার আগ্রহ বাড়ল। অপেক্ষা করতে থাকলাম ৩০শে জুনের আড্ডার, দ্বিতীয় পাঠক্রমের জন্য। শুরু হয়ে গেল আমাদের সাহিত্য সফর। সুভাষের বাড়ির সামনের হাতায় যে পেয়ারা গাছটা ছিল তাতে ফল হয়েছে। আমরা কয়েকটা এনে খেলাম। ফলটার নাম দিলাম ‘কবিফল’। কমল বলল
    --- আজকের আড্ডা একদিন ইতিহাস সৃষ্টি করবে। চল সবাই একপাত্র করে খেয়ে দাগ মেরে দিই জীবনে। আমরা পৌঁছে গেলাম কাছাকাছি একটা চুল্লুর ঠেকে। চারজনে এক গ্লাস করে গুড়কি ( গুড় দিয়ে চোলাই ) মেরে হাত মিলিয়ে যে যার বাড়ি ফিরলাম।
(ক্রমশ )

Comments