কাজী মেহেদী হাসান
নীরু
নীরুকে দেখি না বহুকাল
নীরু আমার স্ত্রীর নাম
ঈশ্বরের শপথ আমি তাকে
ভালোবাসতাম।
চোখদুটো আশ্চর্য্য রকমের
শীতল
লাশটা পড়েছিল দেয়াল ঘেষে
হলদে বেসিন, সবুজ শিশি!
নীরুকে দেখি না বহুকাল
নীরু কি মহৎ ছিল?
ঈশ্বরের শপথ আমি তাকে ভালোবাসতাম।
এতটা বীভৎসভাবে কাউকে
মরতে দেখিনি
প্রশ্নবোধক চোখ নিয়ে
উল্টে ছিলো আমার লাশ!
নীরু কাঁদছে —
তোমাকে দেখি না বহুকাল!
সন্ধ্যার ভূগোল
দুটো খড়ের জামা আর ব্যালকনিতে খসে
পড়া নক্ষত্র নিয়ে
জীবিত পাখিদের সংসার। কোকিলের শ্বাসনালী দেখে একটা হারমোনিকার শখ হয়েছিল সেবার। তুমি বরং দুটো অর্কিড লাগাতে পারতে? বিছানায় অনভ্যস্ত শুয়ে বলেছিল সায়ন্তিকা ঘোষাল। বলেছিল— ওদের দেখে রেখো, অমন সুরেলা জীবন। সেই থেকে চোখদুটো দেয়ালে টানিয়ে রেখেছি। তুমি ছেড়ে যাবার পর আরও দুটো বছর। নজরে রেখেছি হলদেটে অর্কিড; পাখিদের হাড়ের কঙ্কাল; হারমোনিকায় বিস্তর ধুলো— সায়ন্তিকা, কখনও তো বলোনি- তুমি মৃত্যু ভালোবাসো?
আমার
বাবার কোন গল্প নেই
ছেলে
বড় চাকুরীজীবী হলে বাবার গল্প হয়ে ওঠে
আর
যদি হয় কোন বিদেশফেরত ভদ্রলোক
তবে
চায়ের কাপে নেমে আসে শীতকাল
তিনি
উড়ুক্কু বিমানের কথা বলেন—
ছেলের
চোখে বলতে থাকেন বিলাতের বিত্ত-বৈভব
পরিষ্কার
রাস্তাঘাট আর খানিক নিচু গলায় সেখানকার সংস্কৃতির কথা
আমার
বাবার কোন গল্প নেই!
তিনি
হিসেবী বেতনের একজন ভুলে যাওয়া সরকারী কর্মকর্তা
তিনি
সংশয়ে থাকেন আগামীকালের বাজারে কাঁচামরিচের দর নিয়ে
পাড়ার
চায়ের দোকানে বয়সী পা দুটোকে সাজিয়ে রাখেন ধীরে
রঙ
চা খেলে দুটো বাড়তি পয়সা নষ্ট হবে কি না
এই
ভেবে উঠে আসেন।
ছেলে
কবি হলে বাবাদের কোন গল্প থাকে না
কালে
ভাদ্রে কোন পত্রিকায় ছেলেকে দেখে আনন্দিত হন
চাপা
স্বরে স্ত্রীকে বলেন— 'দেখেছো আমাদের ছেলে'
পরক্ষণেই
নিকট আত্নীয়ের ছেলের পদোন্নতির মিষ্টি খেতে হয়
তারা
বাহারি গল্প করেন।
ঢাকায়
বাড়ি, দু'হাত ভর্তি টাকা আর মার্সিডিজ
এলো বলে
আমার
বাবা চুপচাপ শোনেন
তাকে
শুনতে হয়
তিনি
সমাজের প্রথাগত মানদন্ডকে ভয় পান
কবি
নন একজন দুর্নীতিগ্রস্থ চাকুরে ওজনে অনেক ভারি।
আমার
বাবা প্রচন্ড ধর্মানুরাগী
ছোটবেলা
থেকেই তিনবেলা আহারের মতো পাঁচবার প্রার্থনা করা শিখিয়েছেন
তবু
টেলিভিশনে লেখক হত্যার খবর দেখলে আঁতকে ওঠেন
স্ত্রীকে
তাগাদা দ্যান
ছেলে
নিরাপদে আছে শুনলে দু'রাকাত নফল নামাজ পড়েন।
প্রতিদিনের
মতো বাজারের ব্যাগ হাতে বের হন
ছোটখাটো
জটলার ভেতর দাঁড়িয়ে বড় মাছ কেনার গল্প শোনেন
মফিজ
সাহেবের ছেলের পাঠানো দামি পাঞ্জাবীর রঙ দেখে দিতে হয়
তারা
গল্প করতে থাকেন
সকাল
থেকে রাত—
ছেলে
বড় হলে বাবাদের এই নিয়ে কথা বলতে হয়
আমার
বাবার কোন গল্প নেই।
ছেলে
কবি হলে বাবাদের সংশয়ে থাকতে হয়
এই
বুঝি কারও তীর্যক কথা হজম করতে হবে
ছেলে
কবি হলে বাবাদের দুঃখ বহন করতে হয়
বিএসসি
পাশ ছেলেকে টাকা পাঠাতে হয়
বিশ্বাস
করুন, আমারও লজ্জা করে
ভীষণ
লজ্জা হয়—
বলতে
ইচ্ছে করে— "বাবা দেখো, একদিন
আমরাও..."
আমার
বাবার একদিন আসে না
চুলের
মতো বাবারও বয়স বাড়ে
বেড়ে
যায় পাঞ্জাবীতে দাগের সংখ্যা।
বাবা
নামাজ শেষে জিকির করেন
জিকির
শেষে নামাজ পড়েন
মানুষের
কাছে গিয়ে শুনে আসেন সব সফলতার গল্প
হয়তো
বাবাও চান
ছেলের
দেয়া চাদর ঝুলিয়ে অন্যদের তর্কে ঢুকে পড়তে
অতিথি
এলে বিশুদ্ধ জায়নামাজটা দ্যাখাতে
বাবা
পারেন না।
ছেলে
বাড়ি এলে ফ্রিজে রাখা মুরগিটা রান্না হলো কি না খেয়াল রাখেন
সাবধানে
পত্রিকায় পাওয়া চাকুরির বিজ্ঞাপনটা ছেলের বিছানার পাশে রেখে দ্যান
বাজারে
গেলে লোকেরা ঘিরে ধরে
ছেলের
গল্প শুনতে
কোন
ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবী নিয়ে এলো তার গল্প শুনতে
ক'বান্ডিল টাকা এনেছিল তার গল্প শুনতে
একসময়
আড্ডা জমিয়ে রাখা বাবা কোন গল্প বলতে পারেন না
ছেলে
মাথা নিচু করে হাতখরচ নিয়ে চলে যায়
বাবার
একদিন আসে না
আমার
অতি কথুকে বাবা ‘নীরবতা’ আবৃত্তি করে পড়েন
ছেলে
যাদের কবি
তাদের
কোন গল্প থাকে না।
|
|| সূচীপত্র
|
|
Comments
Post a Comment