দিল্লি হচ্ছে তার রাজধানী, যেখান থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হয়..
| |
ঠিক হয়েছে, দেশ ছেড়ে পালাতে গিয়ে জলে ডুবে মরেছে। সংখ্যাটা হাজারে হাজারে, লক্ষ লক্ষ ও হতে পারে কিন্তু ঐ অ-দেশপ্রেমিকদের এই মৃত্যুতে কোনও বেদনার কারণ নেই। দেশে থেকেই হয় জঙ্গীদের মানববোমা হয়ে ফেটে পড়তে পারত অথবা আসাদের পক্ষে থেকে জঙ্গীদের গুলি খেয়ে মারা যেত বা রাশিয়া বা ন্যাটোর বিমান হানাতে। তবে তো বুঝতাম যে দেশপ্রেমের ছিটেফোঁটা ওদের মধ্যে আছে। তা না, বাঁচার জন্য দেশ ছেড়ে পালাতে গিয়ে ডুবে মরল। তাই সমুদ্রতটে পরে থাকা আয়লানের দেহ দেখে চোখ ছলছল করার মত নেকু নেকু হওয়ার কোনও মানে নেই। চোখের জল যদি ফেলতেই হয় তবে বুক-ফাটা কান্না কেঁদে টিভির পর্দা ধুয়ে দেব হনুমন্থাপ্পার জন্য। প্রকৃতি যাকে মনুষ্যবাসের জন্য নিষিদ্ধ করেছে সেই স্থানে দেশের জন্য অপঘাতে প্রাণ দিল। একেই বলে দেশপ্রেম, যারা আগেই মরে গিয়েছিল তারা ঠিক অতটা দেশপ্রেমিক নয় হনুমন্থাপ্পার মতো। হনুমন্থাপ্পা মরতে মরতে বেঁচে ছিল বেশ কয়েকটা দিন। ততদিন, যতদিন না প্রধানমন্ত্রী দ্রুত আরোগ্যের জন্য টুইট করার সুযোগ পান। রাজধানীর হাসপাতালে হনুমন্থাপ্পার মৃত্যু তাই দেশপ্রেমের চূড়ান্ত উপাখ্যান হয়ে রইল। আয়লানদের তাহলে দেশদ্রোহী বলতেই পারা যায়।
ঐ দেখুন এতটা এসে গেছি, বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ উচ্চারণ করা হয়নি, আমি দেশপ্রেমিক। আগামী দিনে আমাদেরকে আধারের মতো একটা কার্ড দেওয়া হবে যাতে দেশদ্রোহী চিনতে সুবিধে হয়। মহান দেশপ্রেমিক হিটলার সাহেব যেমন ব্যবস্থা করেছিলেন ইহুদিদের জন্য, সেই রকম আর কি। সে যা হোক, আমি যে দেশপ্রেমিক সেটা বোঝাবার দায় তো আমাকেই নিতে হবে। কাজটা সহজ নয়, প্রেম প্রকাশ করা যদি সহজ হতো তাহলে কত প্রেম যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে আটকা পড়ত...! সত্যি বলছি দেশ কে আমি আমার প্রেমিকার মতো ভালোবাসি। কেন বলছি; দেশ ছেড়ে থাকতে পারিনা একদম, প্রবাসে সবসময় দেশের কথা মনে হয়, বুকের মধ্যে আগলে রাখতে ইচ্ছে করে, ছুঁয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় দেশের মাটি, চুমু খাই বারবার। খেলাতে হারলে কষ্ট জিতলে আনন্দ হয়। দেশের ক্ষতির কথা শুনলে মন কাঁদে। এই সবগুলোই প্রেমিকা সম্পর্কেও হয়। দেশমাতৃকা...? হ্যাঁ সেও বটে ...তবে আমার হয়েছে কি... প্রেম-প্রেমিকা–দেশপ্রেম ...এটাতে সাবলীল বোধ হয়। আসলে আমি দেশপ্রেমিক, এটা বোঝাতে পেরেছি নিশ্চয়। ব্যাস ঝামেলা খতম। এখন আমি দেশকে চুষে খেয়ে ফেললেও আমি দেশপ্রেমিকই থাকব। ধীরুভাই-এর সন্তান আর আমার বাবার সন্তানের মধ্যে একটাই মিল, ওরা সবাই দেশপ্রেমিক।
চুপিচুপি একটা কথা আপনাদের বলে নিই, আমার প্রেমিকার সঙ্গে প্রেমের অনেক আগে থেকে দেশের সঙ্গে প্রেম। কবে থেকে তা আমিও ঠিক বলতে পারব না। শুনেছি বা জেনেছি অথবা আমাকে জানানো হয়েছে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা এক খন্ড অঞ্চল নাকি আমার দেশ। দিল্লি হচ্ছে তার রাজধানী, যেখান থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হয়। ধুর বাবা রাজধানী থেকে ত দেশ চালনা করা হয় বলে জানি। তবে কি দেশ আর রাষ্ট্র এক? তালগোল পাকানো ব্যাপার থাক এখন, বরং যে কথা বলছিলাম, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা আমার দেশ, যার অতি সামান্য অংশ আমি চিনি। কাশ্মীর দেখলাম না সারা জীবনে, কন্যাকুমারিকাও না। এমন কি লালকেল্লাটা সত্যিই লাল কিনা তাও জানি না, অথচ সেই কবে থেকে আমাকে বোঝানো হয়েছে যে ওগুলো সব আমার দেশ। এমনকি সিয়াচেন বলে একটা জায়গা, যেখানে পৌঁছনো আমার পক্ষে দুঃসাধ্য শুধু নয়- নিষিদ্ধও বটে, তাও আমার দেশ। এই যে না দেখা না চেনা সত্ত্বেও শুধু মানচিত্রে যার একমাত্র অস্তিত্ব আমার কাছে, তাকে আমি দেশ বলে জানি, তাকে ভালোবাসি। তার প্রেমে আমি এমন মজে আছি যে সে “সারে জাঁহা সে আচ্ছা” বলে বিশ্বাস করি। তার কেউ নিন্দেমন্দ করলে হিংস্র হয়ে আক্রমণ করতে পারি। দেশপ্রেমের সব থেকে বড় গুন হল দেশের জন্য হিংস্র হয়ে শত্রুকে আক্রমণ করা। কিন্তু শত্রু কে? নিশ্চয় দেশকে যে আক্রমণ করছে সে বা তারা। সবসময় যে আমার দেশ আক্রান্ত হতে হবে তার মানে নেই, আমার দেশ আক্রমণও করতে পারে। তখন ঐ আক্রান্তও আমার শত্রু। এ হল দেশপ্রেমের নীতি কথা, রাষ্ট্র এই নৈতিকতা শিক্ষা আমার মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেয় দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলবার সময়। হ্যাঁ, রাষ্ট্রই আমাকে দেশপ্রেমিক বানায়, আমার ভিতরে এক সীমাবদ্ধ কাল্পনিক প্রেমের জগৎ সৃষ্টি করে। আমি আর সাইবেরিয়ার পাখি হতে পারি না, আমার আকাশ সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। আমি সেই সীমাবদ্ধতা নিয়ে কখনও উদ্বেল হই কখনও ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠি। আমার এই দেশপ্রেমের আবেগ রাষ্ট্র ব্যবহার করে তার প্রয়োজনমত। কিন্তু কেন দেশপ্রেমের মত এমন একটা নিরাকার আবেগ রাষ্ট্রের কাজে লাগে? এইবার সেই ফেলে আসা দেশ ও রাষ্ট্রর কথাতে আসা গেল। দেশ মানে এক খণ্ড ভূমি এটা বোঝা গেছে। প্রকৃতি তাকে দিয়েছে জল, বায়ু, অরণ্য-সহ নানাবিধ সম্পদ। যা দিয়ে মানুষ জীবনধারণ করবে। আর সে কারণেই মানুষ দেশের কথা ভাবে, এক মাত্র মানুষের কাছেই দেশ নামক কোনও কনসেপ্ট আছে। মানুষ ছাড়া আর কেউ দেশ নিয়ে বিন্দুমাত্র উৎসাহী নয় কারণ মানুষ কে দেশের ঐ সম্পদের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয়। ঐ সম্পদের ভাগ বাঁটোয়ারা কি ভাবে হয়? কিছু মানুষের চাহিদা প্রয়োজনের অতিরিক্ত, তারা সংখ্যায় গুটিকতক কিন্তু চাহিদা সীমাহীন। আর এর ফলে বেশিরভাগ মানুষের; সংখ্যায় যারা অগুন্তি, তাদের প্রয়োজনটুকু তে পড়ে ছাঁটাই। এবং সে ছাঁটাই এত বেশি যে ফল “ভুখমারি”। তখনি এক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, কেউ কেউ চেয়ে বসে “ভুখমারি সে আজাদি”। কিন্তু সংখ্যায় গুটিকতক যারা তারা ত আর ছাড়বার পাত্র না, সম্পদের সম্পুর্ণ অংশের উপর তাদের দখলদারি চায়। তাই তাদের এই দখলদারি চালু রাখতে একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যবস্থা দরকার হয়, যে ব্যবস্থা সম্পদের অসম বণ্টনকে রক্ষা করবে আর আজাদি মাঙ্গনেবালে কো শাসন করবে। রাষ্ট্র হল সেই ব্যবস্থা। রাষ্ট্রই দেশ শাসন করে, আইন বানায়, পেয়াদা পোষে, দেশ চেনায়, আমাকে দেশপ্রেমিক বানায় আর আমাকে দেশের শত্রুদের ঘৃণা করতে শেখায়। তাই আমি রাষ্ট্রের প্রয়োজন হলে আমার দেশপ্রেমের আবেগে ভেসে যাই। সিয়াচেনে বরফ চাপার কথা শুনলে আমার চোখ ফেটে ধারা নামে। আমার মনে এক বারও প্রশ্ন আসেনা যে কেন গড়ে প্রতি বছর ২৮ জন করে সেনাকর্মী ওখানে এমন ভাবে মরে। শুধু ভাবতে ইচ্ছে করে কতখানি দেশপ্রেম থাকলে কেবল খেয়ে পরে বাঁচবার তাগিদে ঐ মৃত্যু উপত্যকাতে যাওয়া যায়। যারা এই ভাবে প্রাণ দিচ্ছে তারা তো দেশেরই মানুষ। আসলে দেশ মানে দেশের মানুষ। দেশের ভালো মানে তো দেশের মানুষের ভালো। মানুষের ভালো কি করে হয়? ঐ খেয়ে পড়ে বাঁচলেই মানুষের ভালো। তার জন্য কেউ কারখানাতে, কেউ অফিসে, কেউ কয়লার খনিতে আবার কেউ চা বাগানে কাজ করে। সেখানেও মরে মানুষ যেমন মরছে এখন চা বাগানে অনাহারে। কেউ কেউ তখন চেয়ে বসে “ভুখমারি সে আজাদি”। আমার মনে হয় সে দেশদ্রোহী। রাষ্ট্র আমাকে শিখিয়েছে যে কোন আজাদির দাবি হচ্ছে দেশ-বিরোধী তাই তা দেশদ্রোহিতা। দেশপ্রেম-কে চাগিয়ে তুলতে গোটাকয় দেশদ্রোহী লাগে এ কথা রাষ্ট্র জানে। দেশপ্রেমিকের কাছে দেশদ্রোহী হল স্টিমুল্যাণ্ট। কিন্তু কাকে দেশদ্রোহী বলে, কাদের কে? রাষ্ট্র যাকে চিনিয়ে দেয়। তারা কারা, কোন দেশের? তারা স্বদেশের, রাষ্ট্র তাদেরকেও আমার মতই দেশপ্রেমিক বানাতে চেয়েছিল। তারা মানবতাবাদী দেশপ্রেমিক, তারা দেশ বলতে মানুষ বোঝে। তারা আজাদি বলতে মুক্তি বোঝে, অসাম্য থেকে, অনাহার থেকে, চিন্তার সীমাবদ্ধতা থেকে। আর অসাম্য, অনাহার এবং চিন্তার সীমাবদ্ধতা যেহেতু রাষ্ট্রেই তৈরী করা ব্যবস্থা তাই তারা রাষ্ট্রের কাছে হয়ে ওঠে বিপজ্জনক শত্রু। রাষ্ট্রের তখন প্রয়োজন হয় আমাদের মতো দেশপ্রেমিকদের থেকে ওদের বিচ্ছিন্ন করা, আমাদের কাছেও ওদের কে শত্রু বলে চিনিয়ে দেওয়া। তাই ঐ মুক্তচিন্তার দেশপ্রেমিকদের গলাতে রাষ্ট্র ঝুলিয়ে দেয় দেশদ্রোহিতার মেডেল আর আমরা হাতের কাছেই পেয়ে যাই আমাদের দেশপ্রেম জাত ঘৃণাতে বিদ্ধ করার শত্রুকে। আমার মাথাতে প্রশ্ন করার বোধ আর কাজ করে না, আমার দেশপ্রেমিক নৈতিকতা তখনই আমাকে দিয়ে ঘোষনা করায় “দেশের খেয়ে দেশের পরে, দেশদ্রোহিতার ফাঁসি চাই”। ঠিক সেই মুহূর্তে রাষ্ট্র স্বস্তি বোধ করে, দেশপ্রেমিক ও দেশদ্রোহী সৃষ্টির আনন্দে আরও মানুষকে মৃত্যু উপত্যকাতে ঠেলে দেয়, সিয়াচেন বা চা বাগানে। ধীরুভাই-এর সন্তান-রা তখন দেশ চুষে ONGC’র পুল থেকে গ্যাস তুলে নেয় আর আমার বাবার সন্তানদের কাছে রাষ্ট্র SMS পাঠায় “গ্যাসের ভর্তুকি ছাড়ো, দেশপ্রেমিক হও”। আমার সন্দেহ হতে থাকে আমিও কী তবে দেশদ্রোহী? আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমার অন্তস্থলের খননে, খুঁড়তে খুঁড়তে আমি আবিষ্কার করি আমার মধ্যেও এক দ্রোহ জন্ম নিয়েছে।
আমি চিৎকার করে উঠছি, আয়লান বাপ আমার আরও অনেক দিন বেঁচে থাক, আমার পিঠ দেব তোকে, পার করে দেব মহাসমুদ্দুর।
বেঁচে থাকো ভাই হনুমন্থাপ্পা যতক্ষন পারো উত্তাপ নাও আমার শরীর থেকে। আমার শরীরে দেশপ্রেমিকের উত্তাপ ক্রমশ আগুনে বদলে যাচ্ছে, তুমি নাও, বাঁচো, আরও কিছু দিন বাঁচো। মৃত্যুর জন্য এ তোমার অসময়। গড় ২৮ জনের একজন হওয়ার জন্য তোমাকে যারা পাঠিয়েছে তারা তোমাকে উত্তাপ দেয়নি কেন? চলো চেয়ে নি বাঁচার জন্য উত্তাপ।
সারা জীবন চা পাতা তুলতে তুলতে রক্তাক্ত করেছ যে আঙুলগুলো তাতে আজ গরম ভাতের ছেঁকা লাগে না মা? ভাত কই তোমার থালাতে? কতদিন আর ফাঁকা থালা ও শুন্য পাকস্থলী নিয়ে অন্তিমের জন্য অপেক্ষা করবে? এসো হাত ধরো, যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট আছে তাই নিয়ে উঠে দাঁড়াও। আমি তোমার দেশপ্রেমিক সন্তান মা, তোমার জন্য ভাতের বন্দোবস্ত করতে না পারলে আমার দেশপ্রেম বৃথাই যাবে মা।
আমি তাই আকাশের দিকে তাকিয়ে, শরীর পিছনে বেঁকিয়ে অননুকরণীয় ভঙ্গিতে চিৎকার করি “ভুখমারি সে আজাদি”। চিন্তার আজাদি। শোনবার আজাদি। উড়বার আজাদি।
আমি আবার সাইবেরিয়ার পাখি হয়ে যাই, আমার আর সীমানা থাকে না। জানি আমাকে ক্রুশবিদ্ধ করার আয়োজন হয়ে গেছে। ক্রুশবিদ্ধ হতে হতে আমি বলে যেতে চাই- “আমার দ্রোহ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, প্রেম দেশের সঙ্গে। আমিও আদতে তোমাদের মতই দেশপ্রেমিক।”
| |
Comments
Post a Comment