আনহোলি স্মোক্স - Sudipto Nag
picture courtesy - Basudeb Mondal
এই কলকাতার গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। তার
মধ্যে রাধাকৃষ্ণবাবু একটা শাল চড়িয়ে এসেছেন।
সেই অনির্বাণ এর প্রথম গোয়েন্দাগিরি থেকে বুড়ো আমাদের সাথে জুটেছে। ইতিমধ্যে আমি
যাদবপুর এ ফিল্ম স্টাডিজ নিয়ে ২য় এম এ করছি, আর অনির্বাণ এইচ পি তে চাকরি করছে। বহুদিন হলো
অনির্বাণ রহস্য-টহস্য থেকে অনেক দুরে। এইচ পি র গবেষক হয়ে সফটওয়্যারের কি যে রহস্য
সমাধান করছে তা আমার বুঝে কাজ নেই। আমি ইন্ডিয়ান হরর সিনেমার ডিসারটেশন নিয়ে
ব্যস্ত। বুড়ো শালটাকে আরও ভালো ভাবে জড়িয়ে বলল- ‘কি গরম পড়েছে! উঃ!’ আমি মাথা
নাড়লাম-আপনাকে দেখে অবশ্য বোঝার উপায় নেই। রাধাকৃষ্ণবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন- দ্যাখো
ছোকরা ধর্মীয় মানুষদের একটু শাল-টাল ছাড়া মানায় না।আমি ল্যাপটপ বন্ধ করে মুচকি
হাসলাম-এটা হল কলিযুগ...এক্সপ্লয়টেশন,সেক্সপ্লয়টেশন...
বুড়ো আমার মুখ চেপে ধরলো- চুপ...একদম
চুপ। তোমাদের জন্যই দেশটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে।আজকে যদি বিবেকানন্দ থাকতেন...
-তাহলে গরমে শাল গায়ে দিতেন না।
আমি রাধাকৃষ্ণবাবুর লম্বা লেকচার শুরু
হওয়ার আগেই তাকে থামিয়ে দিলাম। আমি ভাবলাম বুড়ো বোধহয় খেপে যাবে, কিন্ত বুড়ো আজকাল
কেমন ঝিম মেরে গেছে। বুড়ো একটা বিচ্ছিরি হাঁই তুললো। এ্যাই জি টিভি টা একটু খোলোতো।
হানুমান এর সিরিয়াল টা শুরু হবে। আমি মনেমনে প্রমাদ গুনলাম। আজকাল অনির্বাণ অফিসে,
রহস্য ও কিছু নেই। বুড়ো খালি আমার ঘরে টাইম পাস করতে আসে। শুরু হয় রামায়াণ বা
মাহাভারত দিয়ে, শেষে শাশ-বহু তে এসে ঠেকে। আমার জে ইউ এর এইচ ও ডি বলেন বেশি
সিরিয়াল দেখলে বুদ্ধির সেল ড্যামেজ হয়ে যায়। তবে রাধাকৃষ্ণবাবুর মত লোকের ক্ষেত্রে
সেল ড্যামেজ এর চান্স খুবই
কম। যাই হোক আমি রিমোট নিয়ে ব্রাউজিং করছি হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেল। “২৫ বছরের যুবক
নিরুদ্দেশ”। নাম- প্রসেনজিৎ পাল৷ বাড়ি-
হওড়া ৭১১১০৯,আন্দুল রোড, দানেশসেখ লেন। আরে এ তো আমাদের কোয়ার্টারের প্রসেনজিৎ। বাবা বলেছিল বটে বেশ কিছুদিন ধরে প্রসেনজিৎ এর বাবার চায়ের দোকান বন্ধ। কিন্তু
ও নিখোঁজ এসব কিছুই জানতাম না। প্রসেনজিৎ কে হয়তো আমার মনেও থাকতনা। দীর্ঘদিন ওর
সাথে কথা নেই। কিন্তু ওর নাকের জন্য ওকে ভোলা সম্ভব নয়। নাকের ফুটোর ভেতর যেন
অজন্তা ইলোরার ভাস্কর্য। ওকে নিয়ে আমরা ছোটবেলায় ঠাট্টা করে গাইতাম – “এমন নাকটি
কোথাও খুঁজে পাবেনাকো তুমি...”
সে যাই হোক আমি কিছু বলার আগেই বুড়ো
চিৎকার করে উঠলো- আরে একে তো আমি চিনি!
-আপনি চেনেন?
-হ্যাঁ, আরে ঝর্ণা সিনেমাতে গেটকিপার
ছিল।
-তাই নাকি? ঝর্নাতে তো অ্যাডাল্ট ফিল্ম
দেখান হয়। কিন্তু আপনি কি করে জানলেন?
বুড়ো আঁতকে উঠে ঢোঁক গিল্ল- আমি মানে...
বুঝতেই তো পারছো অল্প বয়সে, হেঁ হেঁ ঐ যে বিবেকানন্দ বলেছেন না সব এক্সপিরিয়েন্স
করা উচিত। তাই...।
- ও তাই বুঝি! আর আমার রিসার্চ নিয়ে এতক্ষণ খুব নিন্দে করা হচ্ছিল। আপনি তো
আচ্ছা লোক!
- রাধাকৃষ্ণবাবু বেকায়দায় পরে কথা ঘোরালেন- সে যাই হোক। এতো ৪-৫ বছর আগের কথা,
ঝর্ণা তো এখন বন্ধ। এই প্রসেনজিৎ কে তুমি
কিভাবে চেনো?
আমি অনির্বাণ এর
নাম্বার টা ডায়াল করতে করতে বললাম- আমাদের পাড়ারই তো ছেলে। যাই হোক এতদিনে একটা
কেস পাওয়া গেল। যা যাচ্ছেতাই ব্যোমকেশ বানাচ্ছে আজকাল সবাই, এবার অনির্বাণ কে নিয়ে
একটা ফিল্ম বানাতে হবে। এই ঘটনাটা জমে গেলে বেশ হয়। আমি কথা শেষ করতে না করতেই
ওপাশ থেকে অনির্বাণ খিঁচিয়ে উঠল- ফোন করেছিস কেন?
-তোর তো আজ হলিডে, রাগ
করছিস কেন?
-আরে ভাই আমার টিম এর
ম্যাচ চলছে।
তোদের টিম? তুই আবার
খেলাধুলো শুরু করলি কবে?
-আরে ধুর ছাই! বলছি
ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড আর চেলসির ম্যাচ হচ্ছে! ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড আমার টিম।
রুনিকে যা লাগেনা!!
আমি চমকে উঠলাম- জীবনে
ফুটবল খেলিসনা আর ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড তোর
টিম??
-হ্যাঁ, হ্যাঁ...আর
কিছু বলার আছে?
-আছে। প্রসেনজিৎ
নিখোঁজ।
-এক মিনিট...গোওওওল,
রুনি কি পাস দিলো...জিও ভাই! ১-০...চলবে। হ্যাঁ তুই কি একটা বলছিলি?
-আমাদের পাড়ার প্রসেনজিৎ
কে পাওয়া যাচ্ছেনা।
-কে প্রসেনজিৎ?
-আরে সেই যে যাকে আমরা
অজন্তা ইলোরা বলে ক্ষ্যাপাতাম।
-শুয়োরের বাচ্চা!
-কে প্রসেনজিৎ?
-আরে না না,
হ্যাজার্ডটা। চেলসি ১-১ করে দিলো।
আমি মরিয়া হয়ে বললাম-
তুই কি ফুটবল ছেড়ে এবার একটু সোশ্যাল ওয়ার্ক এর কথা ভাববি?
অনির্বাণ বেশ কিছুক্ষণ
চুপ করে থেকে বলল- আমি সোশ্যাল ওয়ার্কার নই। বরঞ্চ বেশ অ্যাসোশ্যাল। তবে তোর মতো আর্ট লাভার দের কথা ভেবে এই রকম এক জন
দুষ্প্রাপ্য ভাস্কর্য সম্পন্ন মানুষকে হারিয়ে যেতে দিতে পারিনা। আর ওকে খুঁজে পেলে
ওর ওই ভাস্কর্য আরেকবার দেখার সুযোগ হবে।
আমি খেঁকিয়ে উঠলাম- অনেক
ইয়ার্কি হয়েছে। এটা জীবন মরণের ব্যাপার। তুই কি আসবি? না হলে আমিই...
এইবার অনির্বাণ প্রায়
আঁতকে উঠল- না না তোকে কিছু করতে হবেনা। আমি কাল সকালেই আসছি। তুই ততক্ষন বরঞ্চ
তোর কঠিন কঠিন দু্র্বোধ্য থিওরি বানা। বলেই অসভ্যে্র মতো লাইন টা কেটে দিল। এই
আজকালকার আইটি-র ছেলেদের নিয়ে আচ্ছা মুশকিল! দিনরাত বিশ্বের ফুটবল নিয়ে বাড়াবাড়ি
আর হিউম্যানিটিজের জিনিস নিয়ে হাসাহাসি।
রাধাকৃষ্ণবাবু আমার
ব্যা্জার মুখ দেখে প্রশ্ন করল- কি হল? আসবেনা?
-ফুটবল নিয়ে মেতে আছে।
-মোহনবাগান?
- ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড
বুড়ো এমন মুখভঙ্গি করল
যেন দেশ পরাধীন হয়ে গেছে।
(২)
আমরা প্রত্যেকে
অত্যন্ত গম্ভীর মুখ করে বসে আছি। রাজকুমারকাকু কাঁদতে কাঁদতে প্রসেনজিতের
নিরুদ্দেশ হবার গল্প বলছেন। অনির্বাণ ঘনঘন কফিতে চুমুক দিচ্ছে আর মাথা নাড়ছে। আমি
রাজকুমারকাকুকে দেখছি আর আরো ভাল করে
বুঝতে পারছি যে মাঝেমধ্যে সিরিয়াল এর ক্যারেকটাররা স্ক্রীন এর বাইরে বেরিয়ে
পড়ে।তবে সবচেয়ে গম্ভী্র রাধাকৃষ্ণবাবু। মাঝেমাঝেই উহু-আহা করে এমন সব শব্দ করছেন
যে রাজকুমারকাকু চমকেচমকে উঠছেন। দশ মিনিট এর কাহিনি প্রায় এক ঘণ্টায় শেষ হল।
অবশ্য আমাদের মনে হল তিন-চার ঘণ্টা কেটে গেছে।
রাজকুমারকাকু বেরোতেই
আমি অনির্বাণ এর দিকে তাকালাম। ওর মুখ খুবই করুণ হয়ে গেছে। হওয়াই স্বাভাবিক। আফটার
অল প্রসেনজিৎ আমাদের ছোটবেলার বন্ধু। আমি জিজ্ঞেস করলাম- কি রে? ভেঙ্গে পড়লি নাকি?
-কাইন্ড অফ।
-সেকি রহস্য তো তোকেই
সমাধান করতে হবে!সেন্টি হয়ে পড়লে চলবে?
অনির্বাণ চানাচুরের
কৌটো থেকে এক খাবলা চানাচুর মুখে পুরে দিয়ে বিরক্তভাবে বলল- দ্যাখ ভোমলা, তোর না
হয় বোরিং বোরিং জিনিস দেখা অভ্যাস আছে; কিন্তু এই লোকটার বিশাল ডেসক্রিপশন শুনে
আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। সেই বেল তার না মেল তার কার একটা সিনেমা চালিয়ে ছিলি-ঘোড়া
যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। একজন বসে আছে তো আছেই, সেরকমই বলছিল। শালা! দাঁত মাজা,
পায়খানা,জুতোবাঁধা কিছুই বাদ দিলোনা!
আমি টিভিটা অন করতে
করতে সায় দিলাম- তা সত্যি, বড্ড বেশি বকেছে।তাই বলে বেলা তার এর তুরিন হর্স-এর
নিন্দে করিসনা। ওটা তো মাস্টারপিস। বুড়ো আমাদের ধমক দিল- লোকটা একটা কত বড় সমস্যায়
আছে আর তোমরা ইয়ার্কি করছ?
তোমরা না খোঁজ, আমিই
যাব। আমি যে করে হোক খুঁজে
বের করব।
আমি বুড়োর কথায় কান না
দিয়ে চ্যানেল পাল্টালাম। তাপস পাল ডাক হরকরা। চিঠিপত্র ফেলে মাঠে নাচ করছে। এই রকম
অসামান্য একটা দৃশ্য দেখে আমার ব্রাউজিং থেমে গেল। অনির্বাণ আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়ল-
পাল্টা বলছি, ওফ!অসহ্য!
আমি প্রতিবাদ করলাম-
যথেষ্ট মীনিংফুল। একটু ব্যাড সিনেমা অ্যাপ্রিশিয়েট করতে শেখ। অনির্বাণ হাসলো- তুইও
শেষে বার্গম্যান থেকে তাপস পাল এ নেমে এসেছিস। কি দিনকাল পড়ল! বাই দা ওয়ে প্রসেনজিৎ
ডাকহরকরা হলে কিন্তু নাকের ভেতর দিয়েই চিঠি পোস্ট করত। আমি আর অনির্বাণ দুজনেই
জোরে হেসে উঠলাম। বুড়ো ছাতা বগলে দরজার কোনা থেকে বলল- তোমরা আজকালকার ছোকরারা
ইয়ার্কিই কর। আমি চললুম প্রসেনজিৎকে খুজতে।
অনির্বাণ দৌড়ে গিয়ে
তাকে টেনে নিয়ে এল- আরে চটছেন কেন জ্যেঠু! আমরাও তো চাই প্রসেনজিৎকে। তারপর
অনির্বাণ চোখ টিপলো আমার দিকে তাকিয়ে- এই এবার তাপস পাল বন্ধ কর। অভদ্র লোকেদের
কেস আমরা নিইনা
আমি সায় দিলাম- তবে
হ্যাঁ সৃজীত জড়িত নেই বলেই কিন্তু প্রসেনজিৎ এর কেস নেওয়া হচ্ছে।
বুড়ো আবার হাউমাউ করে
উঠতে যাচ্ছিল, হঠাৎ চুপ করে গিয়ে কী যেন ভাবতে ভাবতে আঙুল তুলে বলল- সৃজীত এর কথা
বলতে হেমলকের কথা মনে পড়লো। প্রসেনজিৎ সুইসাইড করেনিতো? না হলে এতদিন নিখোঁজ?
অনির্বাণ হাসতে হাসতে
বলল- আচ্ছা জ্যেঠু আপনার হঠাৎ সুইসাইড কেন মনে হল? কত কিছুই তো হতে পারে।
রাধাকৃষ্ণবাবু হাতের
লাঠিটা দুলিয়ে বললেন- ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। সুইসাইড না হলে আর কি হবে? এতদিন
নিখোঁজ!
বুড়ো আজকাল এত ভুলভাল
প্রবাদ বলে যে আমরা ওর ভুল প্রবাদ শুনে শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। অনির্বাণ হাসলো-
দেখুন জ্যেঠু, হতে পারে এটা ট্রাফিকিং এর কেস, হতে পারে প্রসেনজিৎকে গুম করা হয়েছে
বা মারা হয়েছে গোপনে বা...
-বা?
-হয়তো বা প্রসেনজিৎ
নিজের ইচ্ছায় নিখোঁজ। হতেও তো পারে ও কোন খারাপ কাজ করে লুকিয়ে আছে।
আমি আর বুড়ো একসাথে প্রতিবাদ
করে উঠলাম- ধ্যাৎ, ও তো গেঞ্জির কারখানায় কাজ করে। ওর বাবা তো বলে গেল।
অনির্বাণ মাথা নাড়লো-
রাইট, বাট ওর ঠিকঠাক অ্যড্রেস-ই তো ওর বাবা জানেনা। ওই জায়গাতে প্রায় কুড়ি পঁচিশটা
গেঞ্জির কারখানা আছে।তাছাড়া ওর মোবাইলও দীর্ঘদিন সুইচড অফ। এই ফোন বন্ধের
ব্যাপারটাও খুব সন্দেহজনক, তাই বুঝতেই পারছিস...
বুড়ো হাউমাউ করে উঠল-
কি বুঝবো? কিছুই তো আমার মাথায় ঢুকছেনা। অনির্বাণ সে কথায় কান না দিয়ে পাল্টা
প্রশ্ন করল বুড়োকে- আচ্ছা জ্যেঠু, ওই ঝর্না থিয়েটারে কি রকম লোকজন আসতো?
রাধাকৃষ্ণবাবু উত্তর
দেবার আগেই আমি বলে উঠলাম- গরিব লোকেরাই যায়। রিক্সাওয়ালা, শ্রমিক জাতীয় লোকেরা।
আমার রিসার্চ অনুযায়ী এসব হলে...
অনির্বাণ খিঁচিয়ে উঠল-
চুপ কর। তোর রিসার্চে আমার কাজ নেই। আমি কিছু স্পেসিফিক ইনফর্মেশন চাই আমার
ইনভেসটিগেশন এর জন্য।
বুড়ো মাথা চুলকোলো-
ওসব ছোটলোকদের সাথে আমি কথা বলতাম না। নিজের মতো দেখে বেরিয়ে আসতাম।
অনির্বাণ হাসি চাপলো-
সেটাই স্বাভাবিক। যাই হোক আমি জানতে চাই আপনি কি প্রসেনজিৎ এর সাথে ঐ হলের কোন
বাজে লোকের যোগাযোগ আছে এরকম কিছু জানেন?
বুড়ো বিরক্ত ভাবে বলল-
দ্যাখো, কে খারাপ আর কে ভালো আমি কি করে জানবো? আমি ধার্মিক মানুষ। ভগবান নিয়ে
থাকি। তবে হ্যাঁ, বি.গার্ডেনের মস্তান বাপি ওর সাথে আড্ডা দিতো। শুধু ঝর্ণা-র গেটে নয় ওদের আমি
একসাথে বাইকেও দেখেছি।
অনির্বাণ চেয়ার ছেড়ে
উঠে দাঁড়ালো- চলুন, এই লোকটার সাথে দেখা করা দরকার। ওই এলাকায় খোঁজ করলে পাব
নিশ্চয়ই! মাস্তানরা তো পাড়ায় বেশ ফেমাস।
বুড়ো ঢোঁক গিলল- ইয়ে,
তোমরা যাও না। আমার আবার কোমরে ব্যথা।
অনির্বাণ বুড়োর লাঠিটা
ঘোরাতে ঘোরাতে বলল- এই কোমরে ব্যাথা নিয়ে রোজ তিনতলায় উঠে ঠাকুরের নাম গান করেন,
হঠাৎ এখন কী হল?
-ওসব ঠাকুরের দয়া!
আলাদা তেজ চলে আসে বুঝলে?
অনির্বাণ লাঠিটা বুড়োর
দিকে পয়েন্ট করে বলল- সত্যি বলুন তো... যাচ্ছেন না কেন? এই ধর্মের কথা ছেড়ে কোন অধর্ম করেছেন কিনা
বলুন।
বুড়ো আমতা আমতা করে
বলল- সে অনেক গল্প! আসলে তোমরা তো জানো চিরকালই আমার রত্নের প্রতি লোভ। গয়নার
দোকানে কাজ করতাম, রত্ন চিনতাম। আমি বাপিকে মাঝেমধ্যে খোঁজ খবর দিতাম। এই ভাবে আমাদের কাজ চলত। কিন্তু একবার নিজে
লোভে পড়ে একটা হিরে চুরি করেছিলাম। বাপি বুঝতে পেরে গেছিল আমি ওকে ঠকিয়েছি। সেই
থেকেই ও আমার ওপর খেপে আছে। আমার তো ওকে দেখলেই বুক হিম হয়ে যায়।
অনির্বাণ আমার কাঁধে
একটা টোকা মেরে বলল- দেখছিস অবস্থা!
যাক এই পাইরেসি-র যুগে
তো আমরা ভদ্রলোকেরাও চুরি করে চলেছি। এই অপরাধও না হয় মাফই করা গেল।
বুড়ো লাঠি ঠুকে গর্বের
সঙ্গে বলল- যাই হোক, এখন কিন্তু আমি অন্য মানুষ।
শুধু ধর্ম নিয়েই থাকি।
আমি অনির্বাণ এর দিকে
তাকিয়ে চোখ টিপলাম- চোরের মায়ের বড় গলা।
বুড়ো রেগে মেগে লাঠি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল।
অনির্বাণ তাকে থামিয়ে হাত জোড় করল-স্যরি..স্যরি! আসলে ভোমলা তো লেখক, একটু বেশিই
সৎ। আর সৎ-এর চেয়েও বড়ো কথা হল লেখকদের কাজই হল মহান মহান কথা বলা। ওসব আপনি গায়ে
মাখবেননা জ্যেঠু।
বুড়ো রাগে কাঁপতে কাঁপতে
বলল- নাচতে না জানলে উঠোন ব্যাঁকা! এতো পুরো অপমান!! আমি বয়সে কত বড় হই!!
আরেকটা ভুল প্রবাদ।তবু
বেশি কথা বলে ফেলেছি তাই চুপ করেই থাকলাম।
অনির্বাণ বুড়োকে সান্ত্বনা দিলো- আরে
ছাড়ুন তো। আপনার ভগবান কৃষ্ণও তো মাখন চুরি করত। আমিও তো লোকের ফেসবুক হ্যাক করি, যদিও প্রয়োজনে কিন্তু সেটাও তো জিনিস চুরিই হল তাই না?
বুড়ো নোংরা রুমাল দিয়ে
মুখ মুছলো- ঠিক আছে। চল তবে যাওয়া যাক। কিন্তু বাপিকে একটু সামলে রেখো। আমার
ব্যাপারটা ফাঁস করে দিওনা। আমি জুতো বাঁধতে বাধতে বললাম- একবার প্রসেনজিৎ-র ফেসবুক
দেখলে হয়না?
-ও করে ওসব?
-করে তো। তবে দীর্ঘদিন মনে হয় অ্যাকাউন্ট খোলেনি।
-বেশ ওটা একবার চেক
করবো। এখন বাপির কাছে যাওয়া যাক।
(৩)
-এই যে শুনুন আমি
পসনজিৎ-কে চিনি ঠিকই, কিন্তু ওর সাথে আমার কোন যোগাযোগ নেই। আমার টাইম নষ্ট
করবেননা। বিকেলে আমি ফুটবল খেলতে যাই।
অনির্বাণ আমাকে ইঙ্গিত করতেই আমি ব্যাগ থেকে
ওল্ড মঙ্কের বোতলটা বের করলাম- আরে ছাড়ুন তো। দেখুন দাদা আমাদের পাড়ার ছেলে
হারিয়েছে, আপনার বন্ধু। এখন আপনিই একমাত্র ভরসা। আসুন বসে মাল-টাল খাই...আপনারও
মাথাটা ঠান্ডা হলে হয়তো আনেক ইম্পরট্যান্ট কথা মনে আসবে।
বাপি বোতলটা তুলে ঘুরিয়ে দেখে হাসলো- বাঃ! বেশ
ভালো জিনিস। ভেতরের ঘরে চলুন। আমি তো ভদ্দ ছেলে মা-বাপ দেখে নিলে পবলেম আছে।
বুড়ো ঢোঁক গিললো- ইয়ে বাপি তো খুব ভালো ছেলে।
বাপি মদ ঢালতে ঢালতে
চিৎকার করে উঠল- আপনি চুপ করুন। কত ধার্মিক আপনি জানা আছে। আজ এরা না থাকলে...
অনির্বাণ বাপির হাত
ধরে তাকে শান্ত করলো- আরে ছাড়ুননা, বোতলটা খুলুন তো।
বাপি বোতল খুলে
রান্নাঘর থেকে তিনটে গ্লাস আনলো।
বুড়ো হাত বাড়ালো-
আমার গ্লাস?
অনির্বাণ আর আমি
চমকে উঠলাম। আরেকটু হলে প্রায় হাত থেকে গ্লাস পরেই যাচ্ছিল আর কি। অনির্বাণ বিষম
সামলে উঠে বলল-আপনি ও খান নাকি?
বুড়ো জীবনে এই প্রথম
ধর্ম-টর্ম ছেড়ে নির্লজ্জ ভাবে বলল – আমারটা ‘র’ হবে।
শুরু হল মদ খাওয়ার
পর্ব। অনির্বাণ দেওয়ালে টিকটিকি দেখছে, পুরনো বাড়িতে রং করলে কেমন হবে সে বিষয়ে
কথা বলছে কিন্তু প্রসেনজিৎ-র কোন উচ্চবাচ্চা নেই। আমি যখন প্রায়ে হাল ছেড়ে দিয়েছি, হঠাৎ
অনির্বাণ বাপির কাছে সরে এসে বলল – দেখুন, আমি শুধু প্রসেনজিৎ-কে খুজতে চাই। আপনার
কোনো ক্রাইম নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। বাপি টক করে পেগ টা শেষ করে বলল –
পসনজিৎ এই বুড়োটার মতোই জোচ্চোর। ওকে দিয়ে গাঁজা সাপ্লাই করাতাম গঙ্গার ঘাটে।
শালা, রোজই আমার মাল মারত। শেষে ওকে ছাড়িয়ে দি। গাঁজা ছাড়ুন, ও শেষের দিকে যা
পাতার নেশা করত! মালটা হয়ত টপকেই গেছে।
অনির্বাণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো – শেষ কবে দেখেছেন?
-এই ছ’মাস আগে।
-ও তো পাঁচ মাস হল নিখোঁজ।তখন কী করছিল?
বাপি আরেকটা পেগ বানাতে বানতে বলল- ও এসেছিল পাতার খোঁজে। এসে আবার বলছিল এই
শেষবার। আর নাকি নেশাই করবেনা।
আমি আর থাকতে পারলাম না – আপনার কাছে আছে?
- প্রসেনজিৎ?
-না গাঁজা?
অনির্বাণ আমায় হাত ধরে চুপ করিয়ে দিল- তোর গল্প লিখতে ওসব লাগবেনা। এমনিতেই
কিছু কম গাঁজাখুরি লিখিসনা তুই । যাই হোক আপনি আমায় বলুন তখন প্রসেনজিৎ-কি কাজ
করতো?
বাপি চিৎকার করে উঠলো- মদ, গাঁজা, পাতা খেয়ে কেউ এসব ভদ্দ কথা বলে? ও তো ভাজ্জিন বলে খুব ফাস্টেটেড ছিলো। রোজ খালি
বলতো-সোনাগাছি...
বুড়ো বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে লাঠি তুলল- তোমরা আজকালকার ছোকরারা এই বুড়ো
মানুষটাকে শান্তিতে একটু মদও খেতে দেবেনা? একজন বয়স্ক লোকের সামনে এসব বলতে লজ্জা
করেনা?
বাপি মদের গ্লাস রেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো- থাক্ থাক্ আপনাকে আর গাজন
গায়িতে হবেনা। আপনার স্ত্রী ই তো পাড়ায় পাড়ায় রটায়, আপনি নাকি অল্প বয়সে...
আমি রাধাকৃষ্ণবাবুর লুপ্তপ্রায় সম্মান রক্ষার্থে বললাম-সে যাই হোক ওসব ছাড়ুন।
বিবেকানন্দ তো বলেইছেন- সব এক্সপিরিয়েন্স করা উচিত।
রাধাকৃষ্ণবাবুর বোধহয় ভালই নেশা হয়েছে। বুড়ো ফাঁকা গ্লাসে চুমুক দিয়ে টলতে
টলতে আঙুল তুলল- শ্রীকৃষ্ণও তো গোপীদের বস্ত্রহরণ করেছিল।
অনির্বাণ সে কথায় কান না দিয়ে হ্যান্ডশেক করে উঠে এলো। চৌকাঠ পেরুবার পর আমি
জিজ্ঞেস করলাম – কি রে কিছু সুত্র পেলি?
অনির্বাণ ফিসফিস করে বলল- আচ্ছা এটা প্রসেনজিৎ-র ব্যাপারে ইনভেস্টিগেসান হচ্ছে
না রাধাকৃষ্ণবাবুর? ওনার যা পাস্ট বেরুচ্ছে আমি তো ওনার ফিউচারের কথা ভেবেও ভয়
পাচ্ছি। বুড়ো কাছে এসে অনির্বাণ এর পিঠ চাপড়ে দিল- ছোকড়া, তুমি আছো বলেই সাহস করে
গেছিলাম। যাই হোক তোমাদের সাথে কাল কথা হবে। আজ মাথাটা খুব ঘুরছে।
আমি হাসলাম – পেটে বেশি পড়েছে বুঝি?
-পেটে নয়, বুকে...বুকে। রামকৃষ্ণ বলেছেন যত মত তত পথ। গুড নাইট।
আমি আর অনির্বাণ আমাদের দোতলার
ফ্ল্যাটে তালা খুলে ঢুকতে অনির্বাণ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আমি বুঝতে পারলাম
না ব্যাপারটা কী? তাই ওকে জিজ্ঞেস করলাম- কী ব্যাপার বলতো? তুই ওখান থেকে হঠাৎ
হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলি, তারপর প্রায় ঘোড়দৌড় লাগালি। কিছু সূত্র পেলি নাকি?
অনির্বাণ চেনাচুরের কৌটে যতখানি হাত ঢোকে ঢুকিয়ে দিয়ে টিভিটা ওন করতে করতে
বলল- তুই একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখেছিস?
বাপিদের বাড়িতে টিভিটাই খারাপ।
-তাতে কী? এটা কি কোন সূত্র?
-আরে ধুত আরেকটু হলে ম্যানঞ্চেস্টার ইউনাইটেড এর খেলাটাই মিস হতো! আচ্ছা এখন
আর কথা নয়। ১১ টা নাগাদ খেলা শেষ হলে প্রসেনজিৎ-র ফেসবুক চেক করব।
(৪)
অনির্বাণ হতাশ হয়ে বসে পড়লো। প্রসেনজিৎ এর ফেসবুক জুড়ে সলমন খানের ছবি। আর
কিছুই নেই। অনির্বাণ আমার দিকে অসহায় ভাবে তাকালো- কি ফিল্ম ক্রিটিক...এ ব্যাপারে
আপনার কি মত?
আমি কিছুক্ষণ ভেবে বললাম- প্রসেনজিৎ সলমন-র ফ্যান। ও নিজেও বডি বানাতো।
-ধ্যাৎ, সে না হয় হল। আচ্ছা এই কভার পিকটা কোন ফিল্মের?
আমি হেসে ফেললাম- দ্যাখ, সলমন এর ফ্যানরা সলমন এর যেকোন ভালো ছবি কভার পিক
বানায়। কোন ফিল্ম কি এসে যায়!
-প্লিজ জানলে বল,কোন ইনফরমেশানটা কাজে লাগে কে বলতে পারে।
আমি আরেকটু ভাল করে চিন্তা করে বললাম- মনে হচ্ছে ‘তেরে নাম’।
-সিওর?
-ইয়েস।
-কি নিয়ে ফিল্মটা?
-তুই ইয়ার্কি করছিস আমার সাথে? বলিসনা আবার এই গল্পের সাথে প্রসেনজিৎ-র গল্পের
কোন মিল আছে! তুই কবে থেকে এত ফিল্মি হলি?
অনির্বাণ বিরক্তভাবে বলল- প্লিজ বল। জানলে সুবিধে হতেও তো পারে।
-লাভ স্টোরি। এসব ছবির গল্প মনে থাকেনা ভাই।
-যথেষ্ট, থ্যাঙ্কস। চল ঘুমোনো যাক। কাল আবার কথা হবে। বাই দা ওয়ে আমি
ইন্সপেক্টার জয় রায় কে ফোন করেছিলাম- প্রসেনজিৎ এর নাম্বারটা নিজের নামে নয়। ওটা
একটা সোনাগাছির দালালের নামে?
-ওয়াট? হতেও তো পারে লোকটা ওর রিলেটিভ। সোনাগাছির সাথে প্রসেনজিৎ এর কোন
কানেকশন আছে নাকি?
-জানিনা। এদিকে এই লোকটার খোঁজ করব তাও উপায় নেই। লোকটা গত মাসে মারা গেছে।
-কে মেরেছে প্রসেনজিৎ?
-মে বি। মানে ও যদি গে হয়।
-গে?? কি সব বলছিস।
-আরে ভাই ঠিকই বলছি। লোকটার তো এইডস হয়েছিল। ওফ্ এতো ফালতু বকাস কেন বলত তুই?
কাল ওসব দেখা যাবে। এখন চুপচাপ ঘুমো নাহলে হ্যাং ওভার হবে।
আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই অনির্বাণ নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
আমি মশা তাড়াতে তাড়াতে রাধাকৃষ্ণবাবুর যোশিলা যাবানীর কথা ভাবতে ভাবতে প্রায়
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম হঠাৎ অনির্বাণ এর চিৎকারে ধড়মড় করে উঠে বসলাম।
- প্রসেনজিৎ! প্রসেনজিৎ!
-কোথায়
-ভাই, কি ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখলাম! প্রসেনজিৎ এর নাকের ভেতর ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ
হচ্ছে। আমরা সবাই নাকের খাঁজে টিকিট কেটে খেলা দেখছি। রুনি সবে গোলের সামনে এসে গেছে, প্রসেনজিৎ
হাঁচতেই নাকের ভেতর ভূ্মিকম্প। আমি,তুই, রাধাকৃষ্ণবাবু সবাই নাকের মারিয়ানা খাতের
গভিরে তলিয়ে যাচ্ছি সর্দির প্রবল স্রোতে। কী বিভৎস!
আমি সায় দিলাম- যা বলেছিস। এই কনসেপ্টটা দিয়ে কিন্তু দারুন একটা সুরিয়ালিস্ট
ফিল্ম হয়।
অনির্বাণ আঁতকে উঠলো- না,না, সেন্সর বোর্ডে আটকে দেবে অশ্লীল বলে।
-তাতে কী? আমরা নেটে রিলিজ করবো।
-তোর এই নোংরা ছবি বুড়োর মতো অ্যাভিড পর্ণ ওয়াচারও দেখবেনা। বাজে না বকে
চুপচাপ ঘুমো কাল কিছু একটা করতেই হবে।
বলেই অনির্বাণ গরমে কম্বলটা প্রাণপণে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। অনির্বাণ ও দেখি এ
ব্যাপারে বুড়োর চেয়ে কম জায়না।
সূর্য কখন উঠে গেছে। অনির্বাণ এখনো ঘুমিয়ে
যাচ্ছে। আমিও উঠবো উঠবো করছি আবার ঘুমিয়ে পড়ছি। তন্দ্রা মত এসেছিল বুড়োর কলিং বেল
র শব্দে লাফিয়ে উঠে দরজা খুললাম। বুড়ো একমুখ হেসে বলল- ওঠো হে অনির্বাণ। আমি
বুঝেছি প্রসেনজিৎ কোথায়।
অনির্বাণ ধড়মড় করে উঠে বসলো- কোথায়?
বুড়ো জানলার বাইরে আকাশের দিকে তাকালো- ভোলাবাবার প্রসাদ খেলে এই হয়।
-মানে?
-মানে আর কী? ওকে আর পাবেনা। কোন মঠে লুকিয়ে কিংবা কোন জঙ্গলে তপস্যা করছে কে
জানে।
অনির্বাণ আঁতকে উঠলো- সন্ন্যাসী হয়ে গেছে নাকি?
-তাই আমার মনে হচ্ছে। কালরাতে প্রসেনজিৎ এসেছিল আমার স্বপ্নে বিবেকানন্দর রূপ
ধরে।
প্রসেনজিৎ-র ঐ নাক শুদ্ধু বিবেকানন্দ কল্পনা করে আমি আর অনির্বাণ প্রায় খাবি
খেলাম।
বুড়ো চোখ মুছল- প্রসেনজিৎ বলল- আমি স্বামিজীর দর্শন পেয়েছি। আর গাঁজা, মদ,পাতা
খাইনা। মাঝেমাঝে শুধু বিড়ি টানি। মেয়েদের সম্মান নিয়েও আর খেলিনা। সব খারাপ কাজ ছেড়ে
দিয়েছি।
অনির্বাণ চমকে উঠলো- মেয়েদের নিয়ে খেলা?
বুড়ো আঁতকে উঠল- না মানে ইয়ে স্বপ্ন তো...তাই
মানে স্বপ্নে তো কতো কিছুই...
অনির্বাণ স্থির গলায় বলল- কিছু লুকোচ্ছেন আপনি।
বলুন নইলে থানা তে নিয়ে গিয়ে বলাতে বাধ্য হব।
-তুমি আমায় বিশ্বাস করোনা?
আমি তো সত্যের
পূজারী।
-আপনি মিথ্যে বলছেন বলিনি
কিন্তু। জাস্ট আমার সাথে অশ্বত্থামা হত ইতি গজ খেলার কথা ভেবে থাকলে ভুলে যান।
বুড়োর মাথা নিচু হয়ে গেল- আসলে তোমাদের কি ভাবে
বলি বলতো?
অনির্বাণ বুড়োর পিঠে হাত রাখলো- আপনি ওকে
সোনাগাছিতে দেখেছেন। তাই তো?
-তুমি কি করে জানলে?
-কি করে জানলাম সেটা
ইম্পরট্যান্ট নয়। এখন বাকিটা আপনিই বলবেন? না আমাকে এটা ও বলতে হবে
যে আপনি রেগুলার সোনাগাছি যান।
বুড়ো এখন রীতিমত ঘামছে।আমি তো পুরো হাঁ। কথা
হারিয়ে ফেলেছি।
অনির্বাণ একটু থেমে বলল- আগেরদিন মদ খেয়ে যখন
বেশি লাফালাফি করছিলেন আপানার বাঁ পকেট থেকে কোহিনূর জ্বেল্লা ঠিকরে বেরোচ্ছিল।
আপনার তো স্ত্রী মারা গেছে অনেক বছর হল। এরপরও ডিনাই করবেন?
বুড়ো চমকে উঠে পকেটে হাত দিল।
- ভয় নেই। কেউ নেয়নি। আপনার জিনিস আপনার কাছেই আছে। এখন কি
দয়া করে সব বলবেন?
-আমি সব বলছি। প্রসেনজিৎ
২-৩ মাস আগে সোনাগাছি তে ডিলার ছিলো। আমি এখন আর ওখানে তেমন যায়িনা। কিন্তু অনেক
দিনের অভ্যাস তো। আর কিছু পুরোন দেনাও শোধ করতে হয়। দু-তিন মাস আগে যখন শেষবার
গেছিলাম তখন প্রসেনজিৎকে দেখতে পাইনি। এসব কাজ করত বলেই ও বাড়িতে কন্ট্যাক্ট রাখতো
না। খুবই কম যেত।
অনির্বাণ দেওয়ালে একটা ঘুষি মারল- ড্যাম,
আর সব কিছু জেনেও
আপনি সাধু সাজার লোভে মিস লিড করছিলেন আমদের। আপনার মত হিপোক্রিটদের
জন্যই দেশটার
এই হাল। আপনার থেকে তো দুর্যোধনও ভাল। অন্তত ভণ্ড নয়।
বুড়ো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো- আমার লুকোবার কোন
ইচ্ছেই ছিলোনা। কিন্তু তোমাদের সামনে বলতে বাধছিলো।যাই হোক তোমরা যখন সব জেনেই গেছ
আমিও আর সংকোচ করছিনা।
অনির্বাণ আবার খেপে উঠতে যাচ্ছিল। আমি ওকে
থামালাম- অনেক হয়েছে ছাড়। উনি আমাদের চেয়ে অনেক বড় হন। ঝগড়া না করে বল এবার কি করব
আমরা এখন।
অনির্বাণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল- কি আর করব?
লেটস্ গো টু
সোনাগাছি।
বুড়ো বলল – বেশ আমি তবে চলি?
অনির্বাণ ঢোঁক গিলল- না মানে...আপনি চটছেন কেন?
আসলে ঐ সব জায়গায়
আমি আর ভোমলা...ইয়ে আসলে আপনার তো পরিচিত এলাকা তাই বলছিলাম আপনি গেলে খুব সুবিধে
হত।
বুড়ো বীরের মতো বলল – আমি তো মজা করছিলাম। ওসব
জায়গায় তোমাদের একা ছাড়ি আমি? পাগল নাকি?
চল যাওয়া যাক।
দুগ্গা দুগ্গা!
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সোনাগাছি রওনা হয়ে গেলাম। আমাদের ট্যাক্সি একটা
গলির সামনে থামতেই আমরা গলির পর তস্য গলি ঢুকতে লাগলাম। আমার আর অনির্বাণ এর ভয়
বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। অনির্বাণ আমায় বলল-ভাই, সঙ্গে বেশি পয়সা নিসনি তো?
এসব জায়গা
সুবিধের নয়।
-আরে না,না। আমি কি গাধা নাকি?
একটা নতুন গলি তে ঢুকতেই আমরা যেসব দৃশ্য দেখতে
লাগলাম। তা ফিল্মেই সচরাচর দেখে থাকি। অনাবৃত বিভিন্ন বয়সের মহিলা এবং অল্প বয়সী
মেয়েরা আমাদের আকারে ইঙ্গিতে ডাকছে। একজন মহিলা অনির্বাণ এর হাত ধরে টান তেই ও
প্রায় ডুকরে কেঁদে উঠলো। আই শখের গোয়েন্দাগিরিতে ওকে এরকম কিছু ফেস করতে হতে পারে
ও কখন ভাবেনি। রাধাকৃষ্ণবাবু আমদের করুন অবস্থা দেখে বললেন- তোমরা আমার হাত ধরে হাঁটো
কোন ভয় নেই। শেষে এক টিনের ঘরের সামনে মুখ বাড়াতে এক মহিলা বলল- এ্যই বুড়ো কাকে
চাই?
রাধাকৃষ্ণবাবুর তাকে সব খুলে বলার পর মহিলা
বলল- প্রসেনজিৎ বহুদিন কাজ ছেড়ে দিয়েছে। ওর মোবাইল সেটও সুইচ অফ অবস্থায় ফেলে
গেছে। অনির্বাণ জিজ্ঞেস করলো- সেকি? ও আর কোন খবর পাঠায়নি?
-না
-কেউ কিচ্ছু জানেননা।
-না,
এবার যাও তো
তোমরা। সকাল বেলায় বউনি হবে ভাবলাম। কোথায় কি!
অনির্বাণ একটা একশ টাকার নোট দিয়ে বলল- বিরক্ত
করার জন্য সরি।
মহিলা মাথায় নোটটা ঠেকিয়ে বলল- ভগবান তোমার
মঙ্গল করুক। ঘরের ভেতরে এসোনা। গরমে এসেছ
একটু বাতাবি লেবুর শরবত খেয়ে যাও।
আমি অনির্বাণ এর হাত ধরে টান মারলাম- না,না আমাদের তাড়া আছে।
বুড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলল- বাতাবি তো নয় যেন ডাঁসা
পেয়ারা।
অনির্বাণ তার দিকে কটমট করে তাকালো। আপনি কি
এবার একটু কেসটার কথা ভাববেন?
-স্যরি
অনির্বাণ চারিদিকে একে তাকে জিজ্ঞেস করতে লাগল।
আমি আর বুড়ো এদিকে নির্লজ্জের মত মেয়ে দেখতে ব্যাস্ত। লেখকদের তো খ্যাঁচ সব সময়ই
বেশি হয়। হঠাৎ অনির্বাণ একটা অল্পবয়সি ছিপছিপে মেয়ের সাথে কিসব বলতে বলতে একটা
অন্ধকার ঘরে ঢুকে গেলো। বুড়ো আর আমি দুজনেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। ছিঃ! ছিঃ!
ওর বাড়িতে জানতে পারলে কি বলবে?
ওর জন্য আজ আমার মাথাও হেঁট হয়ে গেল। বুড়ো
তাচ্ছিল্লভরে বলল- গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল। আমি বিরক্ত হোয়ে বললাম- কেন আবার ভুল
প্রবাদ বলছেন? গোঁফে তেল এর গল্পই নেই। গাছে তো কাঁঠাল পাড়তে উঠেই পড়লো।
একটু বাদে অনির্বাণ হাফাঁতে হাফাঁতে বেরিয়ে এল-আমি আর বুড়ো চেঁচিয়ে উঠলাম- লজ্জা
করেনা! এসব কি হচ্ছেটা কী?
অনির্বাণ দম নিয়ে বলল –ভাই ঐ বদ্ধ ঘরে দম বেরিয়ে
গেল।
বুড়ো বীরের মতো মাথা উঁচু করে বলল- দম রাখা অতি
সংযমের ব্যাপার। কেবল আমার মতো সাধকরাই এই বয়সেও...
অনির্বাণ বুড়োকে থামিয়ে বলল- শিগগির ট্যাক্সি
ধরুন। আন্দুল যেতে হবে।
-মানে?
-জট খুলেছে অবশেষে।কিন্তু
সব পড়ে বলব। আগে ট্যাক্সি।
(৫)
ট্যাক্সিতে বসে অনির্বাণ এক নিঃশ্বাসে বলে চলল-
ঐ ‘তেরে নাম’ থেকেই আমার সন্দেহের শুরু। যে সেক্স নিয়ে ফ্রাস্টেটেড সে
লাভ স্টোরি নিয়ে মাতবে কেন? ওসব প্রসেনজিৎ-র গুল।
আসলে প্রসেনজিৎ দারুন লাভার। এই যে মেয়েটার আমায় ডাকলো ওর বন্ধু পিঙ্কিকে
প্রসেনজিৎ খদ্দের এনে দিত। এই ভাবেই ধিরে ধিরে প্রেম হয় তারপর ওরা বিয়ে করে পালায়।
বেশ্যাকে বিয়ে করেছে বাড়িতে কি বলা যায়? তাই না বলেই বিয়ে করেছে।
আমরা ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে নতুন দম্পতির ঘরে কড়া নাড়তেই যে দরজা খুলল তাকে দেখে
আমরা ভিরমি খেলাম। রাজকুমারকাকু হাতজোড় করে বললেন- তোমরা যা জেনেছ কাউকে প্লিজ
পাড়ায় বলোনা। আমরা তাহলে আর মুখ দেখাতে পারবনা।
অনির্বাণ হেসে উঠলো- কি যে বলেন কাকু! আমরা তো
আপনাকে হেল্প করার জন্যই করছিলাম। তা এলামই যখন প্রসেনজিৎ-র নাক মানে মুখদর্শন করে
যাওয়া যাক। পাশের ঘরে যেতেই হিরো-হিরোইন কে পাওয়া গেল। অনির্বাণ আর কথা বলবে কি?
আধঘণ্টা নাক
দর্শন করেই কাটিয়ে দিল। তারপর বেরিয়ে এসে বলল-বউটাকে তো শালা নাকের মধ্যেই ঢুকিয়ে
রাখতে পারে। জিনিস বটে একটা!
আমি মাথা নাড়লাম- যা বলেছিস! কিন্তু রাজকুমারকাকু
কে এখানে দেখব ভাবিনি।
অনির্বাণ সায় দিল- সত্যি দিনকাল বড় খারাপ।
কোথায় ভেবেছিলাম খুন-জখমের কেস। এও সেই ঘুরে ফিরে হিন্দি সিনেমার ফর্মুলা।
আমি ঘাড় নাড়লাম- তাহলেই বল সিনেমাও অনেক সমায়
বাস্তবের মতো।
অনির্বাণ মাথা নাড়লো দুদিকে- কোনদিনও না।
সিনেমা তো অনেক প্রগ্রেসিভ মেসেজও দেয়রে। আমাদের যা অদ্ভুত যুগ বাপ নিজের নাম নাম
রাখতে নিজের ছেলেকে প্রায় নিখোঁজ করে দিচ্ছে।
বুড়ো মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে একটা বোতল বের করে
আমাদের উদ্দেশ্যে বলল-জানি আজ দিন অপবিত্র হবে তাই গঙ্গাজল সঙ্গে এনেছিলাম। ঐ
পাড়ায় গেছ আজ,একটু ছিটিয়ে নাও। মন পবিত্র হয় যাবে।
________
Comments
Post a Comment