পত্রলেখার ডiary : ভোর হলো। দোর? | সৌম্যজিৎ চক্রবর্তী


Diary
Soumyajit
         ভোর হলো। দোর? 



সন্দীপন সমাজপতিগায়ের রঙ বাঙালীর মতো। চোখগুলো গরুর মতো। হাতদুটো ক্রিমিনালের মতো। মাথাটা করিমগঞ্জ নিম্ন-বুনিয়াদী ইস্কুলের বাইরে বসে থাকা ফুচকাওলার মতো। সুকুমার রায় সন্দীপনকে পেলে নিশ্চয় কিছু লিখতেন। কতবার ভেবেছি সন্দীপনকে নিয়ে লিখব। লেখা আসতে চায় না। একটা অযথা মানুষকে নিয়ে কি লিখব? যাই লিখি না কেন, সে তো অযথাই হবে। ফুটবল খেলতে গিয়ে গোলপোস্টের এক কোণায় সন্দীপন দাঁড়িয়ে আছে গত ঊনচল্লিশ বচ্ছর। খেলা শেষ হলে সে শুধু ফুটবলটাকে বুকে ধরে হাউহাউ করে কাঁদে। গায়ে লেগে থাকা ঘাসগুলোকে জলের আরামে ডুবিয়ে রাখে। সন্দীপন সমাজপতি।

সন্দীপন সমাজপতি। সাইকেল চোরকে যখন বাঁধা হল ল্যাম্পপোস্টে, সে পুকুরের জলে একটার পর একটা ঢিল ছুঁড়তে লাগল। শব্দতরঙ্গের মতো ঢিলগুলো ছড়িয়ে পড়ল আমাদের আস্তিন গোটানো মর্দ-বাজীতে। আধমরা চোরকে অচলায়তন পড়ে শোনায় সে রাতভোর, সন্দীপন সমাজপতি।

সন্দীপন সমাজপতি। ইলেকশনের আগের সন্ধ্যেয় কানাই বলে গেলো বাড়ি বাড়ি- আগামীকাল কষ্ট করে ভোট দিতে যাওয়ার দরকার নেই। যা গরম বাড়ছে কলকাতায়। ফালতু তিন-চারটে সানস্ট্রোকের খবর। হেডলাইন তো আর হবে না। ঐ পাঁচ নম্বর পাতার কোণার দিকে এক চামচে। তাতে খুশি হবেন না মন্ত্রী। তাই। ইলেকশনের আগের রাতে পার্টির খান চারেক পতাকায় অ্যাসিড ঢেলে দেয় সে মুখুজ্জ্যেদের দোতলা বারান্দা থেকে চুপি চুপি সে দৃশ্য দ্যাখে দোয়েল। ওই লোকটার নাম কি বাপি? বাপি বলে- ওর থেকে দূরে থাকবি। বেশি তাকাবি না ওর দিকে। ও সন্দীপন সমাজপতি।

সন্দীপন সমাজপতি। জুট মিল থেকে ওকে ছাঁটাই করা হয়েছে। তাও বছর দু’য়েক হলো। শুধু ওই নয়, সঙ্গে আরও বিয়াল্লিশ জন আছে। একদিন ভোরে ও জেনে গেলো তুমি নেই। আমি নেই? এই যে এতোদিন ধরে এতোকিছু করে গেলাম। আমার ভাগ্নেটা গরম পাটের গন্ধ ভালোবাসে স্যার। আমিও বাসি। ওটা ছাড়া যে আর কিছুই বুঝি না। গরম ভাতের গন্ধ আর নাকে সইবে না যে! এসব কি বলছেন! আমি নেই? আমি সন্দীপন সমাজপতি।

সন্দীপন সমাজপতি। সন্দীপন সমাজপতি। সন্দীপন সমাজপতি..
‘হাজির’ বলতেই হবে? আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না? আমি নেই এই সমাজে? আপনাদের চশমা গুলোয় বড্ড গুয়ের গন্ধ। অ্যাহ্‌। ধুয়ে আসুন, যান। আর কিসের বিচার করবেন হ্যাঁ? জোর করেই বলবেন আমি ম্যানেজারের মাথা ফাটিয়েছিতাই তো? তার জন্য এতো আয়োজন? এই পাখা ঘোরাচ্ছেন, বাতি জ্বালিয়েছেন- পয়সা কে দেয়? পয়সা? কি হলো? কথা ফোটে না যে মুখে আর! আমি শ্রমিক। না? শ্রমিকের সাথে ঝগড়া করতে রুচিতে বাধে। হ্যাঁ? শ্রমিক। শ্রমিক। শ্রমিক। আমি মজদুর। হ্যাঁ হ্যাঁ মজদুর। দিন আমায় জেলে। জেলের বারোটা বাজিয়ে দেবো, দেখে নেবেন। আমাকে চেনেন না তো। আমি সন্দীপন সমাজপতি।

সন্দীপন সমাজপতি। একটা পাগল হাওয়া হাতছানি দেয়। নতুন বারুদের গন্ধে ভরে ওঠে কোর্টরুম চত্বর। কেউ ঘাঁটায় না। শুধু কোথা থেকে কিভাবে তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় পাগলের সার্টিফিকেট। হলদে চিলেকোঠায় সেই সার্টিফিকেট পুড়িয়ে ফেলে সে। রেডিওতে শেষবারের মতো বিশেষ বিশেষ খবর পড়েন গম্ভীর মিত্র। কালবৈশাখী হতে পারে, এমন আশঙ্কার কথা আগেই জানিয়েছিল কলকাতা আবহাওয়া দপ্তর। এখনো পর্যন্ত এর প্রকোপে শহরে তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের নাম অমুক কোলে, তমুক সরকার আর সন্দীপন সমাজপতি।

সন্দীপন সমাজপতি। সুকুমার রায় সন্দীপনকে পেলে নিশ্চয় কিছু লিখতেন। কতবার ভেবেছি সন্দীপনকে নিয়ে লিখব। লেখা আসতে চায় না। একটা অযথা মানুষকে নিয়ে কি লিখব? 



“ক্রীতদাসটি অনেক কষ্টে হাবুডুবু খেয়ে, একটা দ্বীপের চড়ায় এসে ঠেকল। সেখানে ডাঙ্গায় উঠে সে চারিদিকে চেয়ে দেখল, তার জাহাজের চিহ্নমাত্র নাই, তার সঙ্গের লোকজন কেউ নাই যখন সন্ধ্যা হয়ে এল, তখন সে উঠে দ্বীপের ভিতর দিকে যেতে লাগল মাঝখানে চমৎকার শহর। শহরের ফটক দিয়ে মশাল হাতে মেলাই লোক বার হচ্ছে। তাকে দেখতে পেয়েই সেই লোকেরা চীৎকার করে বলল, “মহারাজের শুভাগমন হোক। মহারাজ দীর্ঘজীবী হউন। [এক বছরের রাজা, সুকুমার রায়] | |

Comments