ইন্টারভিউ - অনুপম মুখোপাধ্যায় পর্ব-২





| |                    ইন্টারভিউ - অনুপম মুখোপাধ্যায় পর্ব-১ 



আগের পর্বে প্রকাশিত সাক্ষাতকারে নির্মাল্য সেনগুপ্তর মতামত দেখে কি মনে হচ্ছে?

নির্মাল্য সেনগুপ্তর মতামত  গুলি লিখলাম এখানেঃ

'মাফ করবেন অনুপমবাবু। আপনার সাথে আমার ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা নেই। আপনার লেখাপত্তর আমি পড়েছি। প্রচণ্ড নার্সিসিস্ট হওয়া সত্ত্বেও আমি জানি আমার সাহিত্য বা কবিতা বোঝার কিছুটা হলেও চোখ আছে। আপনার কবিতা রুপম ইসলামের ফসিলস্তুতো গানের মতন। নির্দিষ্ট এক সংখ্যক শ্রোতা/পাঠক আছে তাঁর। রুপমের টার্গেট ইলেভেন থেকে থার্ড ইয়ারের বাচ্চারা-কারণ সে জানে এই বয়সে প্রেমঘটিত ছ্যাঁকা লেগেই থাকে। এই গান গুলো খুব খাবে। আর আপনার টার্গেট সেই মামা-মামনিদের যারা না বুঝলেই ভাবে 'আহা বেশ লিখেছে তো। আপনি একা নন। সেই বিষ্ণু দে'র আমল থেকে বহু লোক এমন লিখে যাচ্ছে। তবে এই বিষয়ে আপনার অয়াচিভমেন্ট ঋষি সৌরকের থেকে বেশি তা মানতেই হবে।


আপনাকে লোকে মনে রাখবে। আপনার পাঠকরা যখন বুঝবে, এই লেখাগুলোর মানে আপনি ছাড়া বিধাতাও বোঝেনি। যখন তারা প্রকৃত সাহিত্যের স্বাদ উপলব্ধী করতে শিখবে, আপনি হবেন ভিলেইন- যারা চোখে ধুলো দিয়ে সময় নষ্ট ছাড়া আর কিচ্ছু করেনা।'

পরীক্ষামূলক সাহিত্যঃ পরীক্ষা করা বলতে কী বোঝায়? লেখার ধরণ বদলে বদলে দেখা? লেখার বিষয় বদলে দেখা? আঙ্গিক বদলে দেখা? হ্যাঁ একজন মানুষের জীবনে সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা অথবা তা পাবলিশ করার প্রয়োজনীয়তা বিভিন্ন হতেই পারে। সাধারণত মানুষ কেন কবিতা- গদ্য লেখে? ফেসবুক-অর্কুট-লিটল ম্যাগ ফেয়ার- সাহিত্য ব্লগ - কবি বন্ধুগণ ইত্যাদি সমীক্ষা করে আমি একটা স্ট্যাটিস্টিকে পৌঁছেছি।


ক) ফ্রি তে সেক্স। হ্যাঁ, ৮০% মানুষ আজকাল লিখছে (শুধু তরুণরা নয়-আশি বছরের বুড়ো কবিও আছে) ফোকটে সয্যা সঙ্গী পাওয়ার জন্য। এই আশি শতাংশের নিরানব্বই শতাংশ মানুষই পুরুষ। কেউ কেউ সফল হচ্ছে, কেউ কেউ হচ্ছেনা। তবে এ মোটেই খারাপ কিছু নয়। নিষিদ্ধ পল্লীতে গিয়ে রোগ নিয়ে ফিরে আসার থেকে সাহিত্যচর্চা করা ঢের ভাল। ধর্ষণ করার থেকেও ঢের ভাল। কিছুটা এক্সারসাইজ হয়, লিটল ম্যাগ বিক্রিবাটা হয় আবার ট্র্যাজিক এন্ড ও হতে পারে।


খ) অনুপমবাবুই বলে দিয়েছেন, অন্যকিছুতে ঠিক জুত (বানানটা বোধহয় ভুল লিখলাম, যাগ্‌গে) করে উঠতে পারছেনা বলে।


গ) দেখতে বাজে। কিছু তো চাই সিভি-তে লেখার জন্য। (বেশ কিছু মহিলাগণ এই দোষে দূষিত)


ঘ) অবসরপ্রাপ্ত এবং গৃহবধু। আজকালকার সিরিয়ালগুলো জাস্ট নেওয়া যায়না। দুপুরের ঘুমটাও আসছেনা গত দু বছর ধরে-মরণ! অতএব- চালাও পানসি বেলঘরিয়া না কোথায় যেন- ওয়াটএভার...


ঙ) সত্যিকারের সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা। ছোটবেলা থেকে অগাধ বইপাঠ, নিজের লেখার ইচ্ছে, সাহিত্যের অবনমণের জন্য দুঃখিত। এদের মধ্যে কিছু স্পিসিস দুর্দান্ত লেখে- কিছু ইচ্ছে থাকলেও ছড়িয়ে ফ্যালে।


কিন্তু কথা হচ্ছে এই পাঁচ ধরণের পাঁচ লাখ লোকের একটা নিজস্বতা থাকবেই। তাঁদের যখন যেমন লেখা পাবে তেমন লিখবে। প্রেম পেলে প্রেমের কবিতা, প্রতিবাদ পেলে প্রতিবাদ, সেক্স পেলে চুটকি, ঘুম পেলে গান। গল্পতে তো আবার রহস্য-রোমাঞ্চও যোগ করতে পারে। কবিতায় সেটা ঠিক হয়না (নীলু ট্রাই করেছে)। পরীক্ষা মানে কী? আজকাল শুনি মেইন স্ট্রীম লেখা, এক্সপেরীমেন্টাল লেখা- কই বিখ্যাত লেখক/কবি তাঁরা তো এসব করেনি? এসব করতে দেখি ফেসবুকে দু'শ লাইকওয়ালা আর লিটল ম্যাগের

কিছু ঘোড়া রোগওয়ালা কবি/লেখকদের। যেমন ইচ্ছে হবে তেমন লিখব। পাঠকের ভাল লাগলে লাগবে, না লাগলে লাগবেনা। পরীক্ষা জীবনে থাক প্রচুর। লেখায় উপলব্ধি/অনুভূতি/বোধ থাক। তাতেই হবে।


কবিতা লেখার জন্য অসামাজিকতা দরকার! এমন বাণী মমতা দিদি অবধি ছাড়েনি। অসামাজিকতা বলতে কী বোঝেন? আমি তো ধর্ষণ করা, চুরি ডাকাতি, অশ্লীলতা, অভব্যতা বুঝি। এসব না করেই বহু লোক হেব্বি কবিতা লিখেছে।


আর কবিতার সংজ্ঞা হয়না। মাত্রা-ছন্দ ইত্যাদি হতে পারে অবিশ্যি। তবে এটা আমার ব্যক্তিগত মত। এ নিয়ে আমারও সংশয় আছে কিছু এক্সপার্টদের যুক্তি শুনে।


আর পদ্য মানে জাপানী তেল? মানে সুকুমার রায় আপনার কাছে ভায়াগ্রা? যতটুকু বুঝেছি আপনি যাকি লিখুন না কেন সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা একটু হলেও আপনার আছে। তাই এই কথা মানায়না আপনার কলমে।


বুকে হাত রেখে বলুন তো, আপনার লেখায় অ্যাভারেজের থেকে কুড়িটা লাইক বেশি পড়লে মনে মনে 'ইসসালা' বলে আরেকবার লেখাটা পড়ে দ্যাখেননা? পাঠক ছাড়া কবি/লেখক এইসব টার্মই জন্মাতনা। লোকে শুধু ডায়রী লিখত। উত্তরাধুনিক গোষ্ঠীদের কবি-লেখকদের মধ্যে একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি তাদের বক্তব্যই হল কবিতা বা গল্প বুঝতে গেলে মাথা খাটাতে হবে। why why why?????? মাথা খাটাতে গেলে বিগ ব্যাং, সিঙ্গুলারিটি, প্রোবাবলিটি ডিস্ট্রিবিউশন, নিদেনপক্ষে দাদাগিরি দেখব। কবিতা গল্প কেন পড়ব? কবিতা এমন হবে যে পড়তে পড়তেই ধারণাটা আমার মধ্যে জন্মাবে। তার জন্য অবশ্য প্রথম কবিতা শক্তি চাটুজ্জের 'অবনী বাড়ি আছ' পড়লে হবেনা। কিন্তু কবিতা বোঝার জন্য অন্য রাস্তা আছে অবশ্যই। টেস্ট ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে হয়। জীবনের সাথে সাথে উপলব্ধী করার মানসিকতা বাড়ে।

গল্পে এসব কিছুই লাগেনা অবশ্যি। কোনতা বড়দের গল্প আর কোনতা ছোটদের সেটা বাবা মা'ই সাহায্য করে তৈরী করতে। এগুলো খুব সাধারণ বিষয়। দশ বছরে কাকাবাবু ভাল লাগে, বাইশে হুমায়ুন আহমেদ। এর জন্য মাথা খাটাতে হয়না। এগুলো ইন্সটিঙ্কট, ভাল লাগা আর মুল্যবোধ থেকে আসে। প্রায়োরিটি থেকে আসে। এটাকেই বলে কম্যুনিকেশন। যার সঙ্গে কমার্শিয়াল-আর্ট, মেইন স্ট্রিম-সাব স্ট্রিম ইত্যাদির ভেদাভেদ নেই। আমি থ্রি ইডিওটস দেখব না ফরেস্ট গাম্প তা আমার মুডের উপর নির্ভর করে। এই বিভেদীকরণ যেটুকু সাহিত্যপ্রেমী মানুষ আজকের দিনে বেঁচে আছে তাঁদেরকে শুধুমাত্র কনফিউজ করছে। আর কিচ্ছু না।


পরিশেষে বলব, এখনও অবধি আপনার লেখা পড়ে যা মনে হয়েছে, সৎভাবে বলতে গেলে ক্লান্তি এবং বিরক্তি ছাড়া আর কিছুই পাইনি। মনে হয়েছে এমন লেখালিখি বাংলা সাহিত্যের সর্বনাশ ছাড়া আর কিছুই করবেনা। তবে এই যে এতগুলো উত্তর লিখলাম নিজের লেখাটা ফেলে- কেন?

সেটা হল এটুকু বুঝতে পেরেছি আপনার পড়াশুনা বেশ ভালই আছে এবং আপনাকে অনেক চেষ্টা করেও পার্টিকুলার ভাবে ওই ক থেকে ঙ অবধি কোনো গ্রুপেই ফেলতে পারছিনা যা বাকিদের পারি। আপনার পোটেনশিয়াল আছে, চাইলেই সাহিত্যের উন্নয়নে আপনি নিজেকে কাজে লাগাতে পারেন। তাই দেরাজ থেকে লালমোহনবাবু বের না করে দেখুন না, একটা অসাধারণ লেখা আমাদের উপহার দিতে পারেন কিনা, সবাইকে আমিই সেদিন বলব, এই লেখাটা পড়ে দ্যাখো। কি যাতা ভাল।


সেই দিনের অপেক্ষায় রইলাম। :)


অনুপমঃ আমরা সকলেই কমবেশি প্রেজুডিসড। নির্মাল্যও আমাদের একজন। ওর তো আমার প্রতি ব্যক্তিগত রাগের জায়গা নেই। বিশ্বাস থেকেই ওগুলো লিখেছে। আর ও নিজের অজান্তেই আমার সম্পর্কে বেশির ভাগ কথাগুলো পজিটিভ বলেছে। আমার ধারণা ও আমাকে পছন্দই করে, নিজে জানে না।

আমি মনে করি সিনেমায় 'কিউ' যে কাজ করছেন, গানে রূপম, আমি যদি সত্যিই কবিতার কাজটাকে সেই মাত্রা বা গুণে নিয়ে গিয়ে থাকি, আমি ভুল জায়গায় নেই। কবিতায় কাউকে তো ওই কাজটা করতে হত।

নির্দিষ্ট কিছু পাঠক সকলেরই আছে, কারো কম কারো বেশি। আমার ক্ষেত্রে সংখ্যাটা হয়ত ৫০-৬০, একটা লোকাল বাসে চড়েই আমার সব পাঠক আমার বাড়ি আসতে পারবেন। জয় গোস্বামীর সেটা কয়েক হাজার। যখন ভাবি জয় গোস্বামীর সমস্ত পাঠক একটা লোকাল ট্রেনে চড়েই তাঁর বাড়ি যেতে পারেন, জায়গা কুলিয়ে যাবে, তখন আর গায়ে লাগে না সংখ্যার তারতম্যটা। আমি বাস, উনি ট্রেন। আমার স্টপেজ আছে, স্টেশন  নেই।

এবং, পৃথিবীর কালজয়ী কবিতাগুলোর মানে সত্যিই কবি তো দূরস্ত, বিধাতাও বোঝেননি। বিধাতা সেগুলো বুঝতে অনেক অনেক সময় নিচ্ছেন বলেই সেগুলো মুছে যাচ্ছে না। বিধাতা খালি মাথা নাড়ছেন, জল আর ন্যাতা ফিরিয়ে দিচ্ছেন।

এটুকু ভিলেনি আমি করে যেতে চাই, লোকের চোখে ধুলো... মন্দ কী? ধুলো কি কম কথা গা! আমি তো জলের সঙ্গে সঙ্গে ধুলোকেও জীবন বলি মৃগাঙ্ক।

অসামাজিকতা ব্যাপারটা ও বোঝেনি। ওর একটা গল্প পড়া দরকার মনে করি, তলস্তয়ের 'ফাদার সার্জিয়াস'। সন্ন্যাসী যেমন লোকালয়ে, কবিও তাই। কামুক যেমন কামের বাহিরে, কবিও তাই।

সুকুমার রায়ের লেখাকে 'পদ্য' বলা, আর ডাইনোসরকে টিকটিকি বলা প্রায় একই ব্যাপার, এ নিয়ে আর কী বলব?

দশ বছরে যাদের কাকাবাবু ভাল লাগে, বাইশে হুমায়ুন আহমেদ, আমি সত্যিই তাদের জন্য লিখতে পারি না। আমি অকালপক্ক। আমি অকালপক্কদের পাড়াতেই থাকতে চাই।

আর, নির্মাল্য শেষ অবধি আমাকে নিয়ে যে সময় দিয়েছে, সেটার জন্য ওকে অঢেল কৃতজ্ঞতা। ওর শুভকামনা আমি মাথা পেতে নিলাম। তবে ও যে কবিতাটা লিখতে বলেছে, সেটা সম্ভবত আমার লেখা হবে না। আশা করছি আমার লেখার প্রতি সাময়িক ক্লান্তি আর বিরক্তিটা ওর অভ্যাস হয়ে যাবে। ওগুলো তো পূর্বরাগের চিহ্ন। তারপর বুঝবে যেটার আমি সর্বনাশ করছি, সেটা হয়তো চরম সুখ পাচ্ছে। বিয়েটা ওর অজান্তেই হয়ে গেছে, লুকিয়ে-চুরিয়ে।

তোমার কি মনে হয় না, কোথাও একটা অহংকার কাজ করে নিজের লেখা নিয়ে?

অনুপমঃ  অহংকার তো ভালো জিনিস, হামি মনে করি। ওটুকু না থাকলে স্পর্ধা জন্মায় না। কিছু করার স্পর্ধা। ডাঁট আর অহংকার কেন যে ঘুলিয়ে ফেলি আমরা মৃগাঙ্ক! হামবড়াই অহংকার নয়। আবার সেই 'আমি'-র প্রশ্ন। এমন করে অহংকার হোক, যেন তা আমার নয়, সকলের হল। ভিক্ষু হই, ভিক্ষুক যেন না হই।

আর একটা বিষয় লিটল ম্যাগাজিন সাহিত্য করতে এসে পি আর টা কি একটা বিষয়?

অনুপমঃ লিটল ম্যাগাজিন করি, কাজেই নির্দিষ্ট সময়ে পত্রিকা বের না করলেও চলে। লিটল ম্যাগাজিন করি, কাজেই প্রুফ দ্যাখার ব্যাপারে অত আদিখ্যেতার দরকার নেই। লিটল ম্যাগাজিন করি, কাজেই পত্রিকা বেচে ১ লাখ টাকা কামালেও লেখককে পারিশ্রমিক দিতে হয় না। লিটল ম্যাগাজিন করি, কাজেই লেখককে লেখা পাওয়ার পরে একটা খবরও দিই না, কপি দেওয়ার তো প্রশ্নই নেই। এদিকে লেখকের সেরা লেখাটাই আমরা চাই, যদিও সেটা ২০ জনের বেশি লোকের কাছে পৌঁছে দেব না, সে দায় আমাদের নেই। লিটল ম্যাগাজিন করি, কাজেই ৫০ কপি ছাপাব, ২০ কপিই এদিক-সেদিক পাঠাব, 'ইম্পর্ট্যান্ট' লোকেদের, বাকি কপি খাটের তলায় থাকবে, কোথাও গেলে একে-তাকে দেব।

লিটল ম্যাগাজিন অত সস্তা জিনিস নয়। আজ প্রিন্টে লিটল ম্যাগের দিন ফুরিয়ে এসেছে। নেট পত্রিকাগুলোই আজকের প্রকৃত লিটল ম্যাগ। একটা লিটল ম্যাগের অনেক দায় থাকে তাতে প্রকাশিত লেখাগুলোর ব্যাপারে। লোকের কাছে সেই সব লেখা পৌঁছে দেওয়ার দায় যদি আপনার না থাকে আপনি কাগজ করছেন কেন?

পি আর তো করতেই হবে। একটা পত্রিকা প্রকাশ আর একটা সিনেমার রিলিজ, আমার মতে একই ব্যাপার। সেটার জন্য সম্যক প্রচার লাগবে। লোককে জানাতে হবে।প্রয়োজনে লোককে পড়িয়ে নিতে হবে।

সম্পাদক একজন সমাজকর্মী। রক্তদান শিবির চালাচ্ছেন তিনি। এলিটপনা তাঁকে মানায় না।

না আমার প্রশ্ন লিটল ম্যাগাজিনে লেখা ছাপাতে গেলে কি একটু সম্পর্ক গড়া জরুরি সম্পাদকের সাথে? আমি কিন্তু বাকের কথা বলছি না। তুমি অনেকদিন ধরে লিটল ম্যাগাজিনের সাথে যুক্ত। অনেক পত্রিকা দেখেছ। সেই দিক থেকে অভিজ্ঞতাটা বল।

অনুপমঃ মৃগাঙ্ক, একটা পত্রিকায় লেখা কিন্তু একটা স্টেটমেন্ট হতে পারে এখানে। 'কোথায়' লিখছি, সেটার ওটুকুই গুরুত্ব। কেন লিখলাম ওখানে? কবির সমর্থন তা থেকে বোঝা যায়, সম্পাদকের নির্বাচন তা থেকে বোঝা যায়। সেটা কবি এবং সম্পাদকের সম্পর্ক ও পারস্পরিক আগ্রহের উপরে নির্ভর করে। দ্যাখো, এমন সম্পাদক তো বিরল যিনি নিজে কবিতা লেখেন না, প্রায় সকলেই আজ কবি-সম্পাদক। আমি নিজে এমন পত্রিকায় লিখতে আজকাল উৎসাহিত নই যার সম্পাদককে আমি চিনি না। কবিতার ব্যাপারে যার প্রতি আমার শ্রদ্ধা নেই, তাঁর কাগজে লিখতে আজকাল ভালো লাগে না, আগ্রহই পাই না। বলতে পারো আমি কাগজের পাশাপাশি সম্পাদককেও গুরুত্ব দিই, তাঁকে চিনতে চাই। এটাকে কেউ যদি যোগাযোগ বলতে চায়, আমার আপত্তি নেই। যোগাযোগটা আছেই, কিন্তু সেটাই নির্ণায়ক নয়। আমি যে কাগজগুলোতে লিখি, সেখানে রদ্দি লেখা স্থান পাবে না, এটা আমার বিশ্বাস। যেমন 'দলছুট'। তোমরা যদি বুঝতে পারো আমি একটা ভুষোমাল, তখনও হয়তো 'অনুপম-দা' বলবে, কিন্তু আমার লেখা আর ছাপাবে না, তাই না? আমার লেখাটাই আমি। তুমি না লিখতে পারলে আমিও 'বাক'-এ তোমার লেখা আর চাইব না। হ্যাঁ, আমি আজকাল সেই কাগজেই লিখছি, চিরকাল লিখতেই চেয়েছি এমন কাগজে, যার সম্পাদককে আমি চিনি, তাঁর সঙ্গে আমি চাইলেই কথা বলতে পারব, এবং তিনি আমার কবিতার প্রতি উৎসাহী। এমনকি তিনিও একজন কবি, অনেক ক্ষেত্রেই, এবং কবি হিসেবে তাঁর প্রতি আমার কৌতুহল আছে। তুমি বা অংশুমান দে-ও তাঁদের একজন। এই আমার অভিজ্ঞতা।

প্রিণ্টেডে রিডারসিপ কম কিন্তু তাও তো লিখছ? কেন?


অনুপমঃ   কারন কিছুক্ষেত্রে কিছু পাঠকের কাছে পৌঁছনোর প্রিন্ট আজও পথ। সকলেই তো অনলাইনে উঠে আসেননি। সেটার জন্য আরো দু-একটা বছর লাগবে। অন্যথায় তাঁদের আমি হারাবো। পাঠকের সংখ্যার চেয়ে পাঠকের গুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেটা অনলাইনে যেমন, প্রিন্টেও তেমন। যে পাঠক না পড়েই লাইক দিয়ে চলে যায়, তার চেয়ে যে পাঠক কমেন্ট করে, তার মূল্য আমার কাছে বেশি। সম্ভবত তোমার কাছেও। তাই এখনও প্রিন্টে লিখি, আবার অনেক অনলাইন পত্রিকাকেও লেখা দিতে ইচ্ছে করেনা, কারন তাদের টার্গেট রিডারশিপের প্রতি আমার শ্রদ্ধা নেই, তাদের সম্পাদককে অপদার্থ মনে হয়, নামের কাঙাল মনে হয়। অনলাইনে ভিড় আজকাল বিশ্রীভাবে বাড়ছে। এমনকি সেটা সম্পাদকের ভিড়। ভিড়টা যত পাঠকের হয়, ততই মঙ্গল, এমনকি লেখকের। কিন্তু আজকাল লগ ইন করতে শিখেই অনেকে একটা ব্লগ বা ওয়েবপত্রিকা খুলে ফেলেন, আর দাদা-দিদিদের লেখা ছাপতে শুরু করে দেন।

তা এই সব 'ব্যাঙের ছাতা' লিটল ম্যাগাজিনের একটা সমস্যা বলছ?  এতে লেখালিখির চর্চা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেটা তো একটা ভালো দিক

অনুপমঃ লেখালেখির থেকে লেখাপড়ার চর্চাটা আমাদের এখানে বৃদ্ধি পাওয়া বেশি জরুরি মৃগাঙ্ক। ওটা একদম ঝুলে গেছে।

কি ভাবে সেটা বাড়ানো যায়?


অনুপমঃ শিক্ষাব্যবস্থার বদলের মাধ্যমে। সাহিত্যশিক্ষা আমাদের এখানে খুবই অবৈজ্ঞানিক উপায়ে চালানো হয়। পড়াটা যে একটা বিরাট ব্যাপার, এই বোধটাই জাগে না সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। অন্য মাধ্যম থেকে আসা লোকেদের কথা তো বাদই দিলাম।

আমি তিনজন কবির নাম বলছি, তুমি এদের লেখা নিয়ে কি মনে কর বলো। ১ মলয় রায় চৌধুরি ২ যশোধরা রায় চৌধুরি ৩ শ্রীজাত


অনুপমঃ মলয় রায়চৌধুরী বাংলা কবিতার একটা মেরুর নাম। সেই মেরুতে উনি নিজেই নিজের পাহাড়। আমি ওঁর মতো লিখিনা। লিখতেও চাই না। কিন্তু আমি যে আজ এভাবে লিখতে পারছি, সেজন্য একটা 'প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'-এর কাচ্ছে আমি ঋণী। হয়তো তুমিও ঋণী। মলয় না থাকলে আমাদের সমকালীন বাংলা কবিতা প্রাপ্তবয়স্ক হতনা। বাংলা কবিতাকে উনি একটা শক দিয়েছেন, আজ থেকে আদ্ধেক শতাব্দী আগে। সেই থেকে তার জড়তা অনেকটা কেটে গেছে। সে বেপরোয়া হতে শিখেছে। আমরা বেপরোয়া হতে শিখেছি। আমি শিখেছি। ওঁর কবিতা পড়তে কারো ভালো লাগে কি মন্দ, সেটা কোনো প্রশ্ন নয়। ওঁর গুরুত্ব সম্পর্কে আশা করি সকলেই নিঃসন্দেহ, একমাত্র অন্ধরা ছাড়া।

যশোধরা রায়চৌধুরী সেই কয়েকজন বিরল কবির একজন যাঁদের লেখা পড়লে বোঝা যায়, তা এক মেয়ের লেখা, এবং সেই লেখায় আমার সম্পূর্ণ প্রবেশাধিকার নেই। কোনো মেয়ের কবিতা সম্পর্কে একটি পুরুষের খুব বেশি কথা বলার উপায় থাকার কথা তো নয় মৃগাঙ্ক। ধরো, একটি মেয়ে যেভাবে 'স্তন' শব্দটি লিখবেন, বা 'দুধ' শব্দটি লিখবেন, 'মা' লিখবেন, বা পড়বেন, আমার পক্ষে সেটা লেখা বা পড়া কোনোমতে সম্ভব নয়। আমার স্তনবৃন্ত একটি ক্ষয়প্রাপ্ত ও অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ। আমার ক্লিটোরিস নেই, যোনি নেই, আমার পখে একটি মেয়ের ভাষা সম্যক বিচার করা স্পর্ধা ছাড়া কিছু নয়। মানুষ হিসেবে উনি আমার সঙ্গে একটা সামান্য অবস্থানে আছেন অবশ্যই, সেই সামান্য উচ্চারণগুলো আমি ধরার চেষ্টা করতে পারি। সেখান থেকে ওঁর কিছু  লেখা আমাকে স্পর্শ করে যায়। বলতে পারি, উনি পুরুষের হয়ে লেখেন না। সেই স্বাভাবিক রহস্য ওঁর লেখায় আছে, যা আমাকে প্রবেশের লোভ দেখায়, কিন্তু ওই লোভটুকুই সার।

শ্রীজাতর লেখা সম্পর্কে আমার কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। আমি যে চোখে কবিতাকে দেখি, উনি দেখেননা। আমরা সম্পূর্ণ এলিয়েন একে অপরের পৃথিবীতে। সাঁতারুকে ক্রিকেট নিয়ে প্রশ্ন করে লাভ নেই। হোক না দুটোই আউটডোর স্পোর্টস!

মাঝে মাঝে তুমি অন্য এক কবির সাথে তার এবং তোমার কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে বসো। কেন?


অনুপমঃ বুঝলাম না

ধরা যাক আমার আর তোমার মধ্যে কথা হচ্ছে। তুমি আমার কবিতানিয়ে কথা বলছ। আমি তোমার কবিতা নিয়ে।


  অনুপমঃ পাশাপাশি দুটো গাড়ি এসে দাঁড়ায়, কোনো সিগন্যালে, কোনো ধাবায়। এক গাড়ির চালক আরেক গাড়ির চালকের দিকে হয়তো তাকায়, কৌতুহলভরে, বা সময় কাটাতেই। তাদের রাস্তা এক হয়েও আলাদা। তাদের গন্তব্য আলাদা। তারা একে অন্যকে দেখতে পাচ্ছে। হয়তো কথাও বলল রাস্তার অবস্থা বা ট্র্যাফিকের হালচাল নিয়ে, যদি ততটাই কাছাকাছি হয় তাদের পারস্পরিক দাঁড়াবার ব্যাপারটা। কেউ হয়তো একটা খবরই শুনিয়ে দিল রাস্তা সম্পর্কে, বা কোনো ঘটনা সম্পর্কে। কেউ হয়তো জানতে চাইল আরেকটু এগিয়ে গেলে কী আছে। তারপর চলে গেল যে যার মতো। এরকমই ব্যাপার, তাই না? এটুকুই। একজন আরেকজনের গাইড হতে পারেনা। আরেকজনকে গাড়ি চালানো সম্পর্কে জ্ঞান দিতেও পারেনা। যে যার লাইসেন্স নিয়ে রাস্তায় নেমেছে, রাস্তাটাকে অর্জন করেছে যে যার নিজের মতো করে। খুব বেশি হলে কিছু খবর দিতে পারে, নিতে পারে, সতর্কতা আদানপ্রদান করতে পারে, একটু আড্ডাও দিতে পারে ওটুকু ফুরসতে।

এরকম আলোচনার ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায় কবিতা ছাড়িয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণের দিকে চলে গেছে ব্যাপারটা। এটাকে কি ভাবে দেখো। কবির মধ্যেও এতোটা প্রতিহিংসা?


অনুপমঃ কবিতালেখকও তো মানুষ। তার সবকিছুই আছে... কাম-ক্রোধ- লোভ-মোহ-মদ-মাৎসর্য। এগুলোর সংযমটাও কবিতালেখকের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কেউ পারে কেউ পারে না। কেউ কেউ মদ খাওয়ার জাঁক করে, সেই ছবি দেয় ফেসবুকে। কেউ যৌন সঙ্গমের সংখ্যা দিয়ে নিজের কবিখ্যাতি মাপে, সেটাও ফলাও করে বলে। কেউ পুরষ্কার চায়। কেউ অন্য কবিতালেখকের পিছনে ছুরি মারে। কেউ অন্যের উপর রাগ প্রকাশ করে তার কবিতাকে আক্রমণ করে। সবই আছে। শেষ অবধি এরা কি কবি? আমি জানিনা। সেদিন এক সম্পাদক আমাকে জানালেন আমার এক কবিবন্ধু তার এক কবিবন্ধুর মাধ্যমে তাঁকে জ্বালিয়ে মারছে যাতে তিনি তাঁর কাগজে আমার লেখা আর বেশি না নেন; সে জানতে চেয়েছে,'অনুপম কি শূন্য দশকের শ্রেষ্ঠ কবি? ওর এত লেখা ছাপার কী আছে?' এর মানে কী? আসলে সে শূন্য দশকের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে নিজেকে দেখে। সে ওটা হতে চায়। শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা থেকে সে বেরোতে পারছে না। সমস্যাটা এটাই। অনেকেই রবীন্দ্রনাথ হতে চায়, জীবনানন্দ হতে চায়, সুনীল হতে চায়। স্বপ্নটা জেগে থাকে, কিন্তু একটা স্তরের পরে সামর্থ্য জবাব দিয়ে দেয়, ঘুমটা ভেঙে যেতে থাকে। তখন ওসব করে। নিজেকেই নিজে ঠকায় বিবিধ ছলে। প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে ওঠে।

 | |

Comments