চতুর্থ গহ্বর ॥ মলয় রায়চৌধুরী ॥ কলকাতার মাটির তলায়

Click to Read all Interviews


চতুর্থ গহ্বর

মৃগাঙ্কঃ তোমার সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা দিয়ে তাহলে শুরু হোক এই গহবর।
মলয়ঃ পাটনায় আমাদের বাড়িতে সিনেমা দেখাকে খারাপ মনে করা হতো; চরিত্র খারাপ হয়ে যেতে পারে মনে করতেন বড়ো জ্যাঠা। তাই ছুটির দিনে দুপুরে বা সন্ধ্যায় বাইরে থাকা যেত না। তখনকার দিনে ইনটারভ্যাল হতো আর ইনটারভ্যালের সময়ে হলের বাইরে বেরোতে দেয়া হতো, সিগারেট ফুঁকতে, লেমোনেড খেতে, মুততে ইত্যাদি। কোনো ফিল্ম দেখার হলে একদিন ফিল্মটার প্রি-ইনটারভাল দাদা দেখে আমাকে পাস দিয়ে সিট নম্বর জানিয়ে বাড়ি চলে যেতো। আমি পোস্ট-ইনটারভ্যাল দেখতুম। পরের দিন আমি প্রি-ইনটারভ্যাল দেখতুম আর দাদা পোস্ট ইনটারভাল। দাদার কাছে এই ট্রিকটা শেখার পর স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে এই প্রক্রিয়ায় সিনেমা দেখতুম। বন্ধুদের সঙ্গে ইংলিশ ফিল্ম বেশি দেখতুম চুমু আর হাফল্যাংটো মেমদের দেখার জন্য; সংলাপ তেমন ধরতে পারতুম না, তবুও মৌজমস্তি হোতো। বন্ধু বারীনের সাইকেল ছিল; ও গিয়ে হলের শোকেসে লাগানো স্টিল ফোটো দেখে নির্ণয় নিত ফিল্মে কেমন মালপত্তর আছে। বাংলা ফিল্ম অনেক কম আসতো পাটনায়। উত্তম-সুচিত্রার ফিল্ম এলে লোকে বহুক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতো। আমার সহপাঠী বারীন গুপ্ত হিন্দি গান গাইতে ভালোবাসতো। কোনো দিন আমরা সকালে তাড়ি খেতে গেলে আমরা চার সহপাঠী মিলে তারস্বরে হিন্দি সিনেমার গান গাইতুম বারীনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে। তাড়ি খাওয়ায় তেমন নিষেধ ছিল না, কেননা বিহারিরা বলত যে তাড়ি খেলে স্বাস্হ্য ভালো হয়। চার-পাঁচ বছর বয়স থেকেই ইমলিতলা পাড়ায় তাড়ি খেয়েছি। হিন্দি সিনেমার টিকিট কাটার জন্যে অনেকসময়ে মারামারি হতো। বলাবাহুল্য যে একেবারে সামনের সিটের টিকিট কাটতে হতো, বাড়ি থেকে পাওয়া হাত-খরচ জমিয়ে। লাইন নিয়ন্ত্রণের জন্য উঁচু দেয়ালের মাঝে সরু গলি থাকত, সেই গলি দিয়ে ঢুকে টিকিট কাটতে হতো। কেউ-কেউ খালি গায়ে সর্ষের তেল মেখে ওই দুই দেয়ালের ওপর উঠে ভেতরে ঝাঁপ দিতো। আমরা কোনো তাগড়া বিহারি বন্ধুকে জপিয়ে ওই ঝাঁপাবার কাজটা করাতুম। তাকে লেমোনেড খাওয়াতে হতো পারিশ্রমিক হিসাবে। কলেজে ঢোকার পর এই সব কাণ্ড-কারখানা বন্ধ করতে হলো; কলেজে মেয়েরা পড়ত, তারা দেখে ফেললে হ্যাঙ্গাম। তাই আমরা মর্নিং শো দেখা আরম্ভ করেছিলুম, তাতে তেমন ভিড় হতো না। রিটা হেওয়ার্থ আর এলিজাবেথ টেলরের ফিল্ম আসলেই দেখতে যেতুম। হিন্দিতে মধুবালা, নার্গিস, মীনাকুমারী, সুরাইয়া, নাদিরা, কুলদীপ কাউর, রেহানা, বেগম পারা, কাক্কু। আমি চেষ্টা করেও সিটি মারতে শিখিনি; বারীন পারতো, -ই সিটি মারতো, সেরকম দৃশ্য এলে।
মৃগাঙ্কঃ বাড়িতে ধরা পড়েছ কখনো?
মলয়ঃ না, বাড়িতে ধরা পড়িনি। তবে একবার 'উড়নখাটোলা' নামে একটা ফিল্ম দেখতে গিয়ে দেখি আমার মেজজ্যাঠা আর বাড়ির পুরুতমশায় সতীশ ঘোষাল যাঁকে আমরা সতীশকাকা বলে ডাকতুম, ওনারাও ফিল্ম দেখতে এসেছেন। আমাকে দেখে সতীশকাকা বলেছিলেন, "তোর বড়োজ্যাঠাকে বলিসনি যেন আমরা সিনেমা দেখতে এসেছি; এতে নৌশাদের ভালো মিউজিক আছে, তাই দেখতে এলুম ।"
মৃগাঙ্কঃ সিনেমায় কার অভিনয় ভালো লাগত - বাংলা হিন্দি বিদেশী ? 
মলয়ঃ স্কুলে পড়তে অভিনয় দেখতে যেতুম নাকি ! নায়িকাদের দেখতে যেতুম ।
মৃগাঙ্কঃ সে তো ঠিকই অশোকা বেরলো যখন আমাদের ইণ্টারেস্ট ছিল করিনাকে নিয়ে। বাড়িতে বলতাম, ঐতিহাসিক ছবি। আর বড় বেলার সিনেমা? 
মলয়ঃ ব্যাপারটা মজার। এক বিহারি ক্লাসমেটের কাছে শুনলুম যে একটা বাংলা ফিল্ম দেখানো হচ্ছে পার্ল সিনেমায় যাতে কেউ "অভিনয়" করেনি। ক্লাসমেটটি নিম্নবর্গের। জানিয়েছিল যে ফিল্মটা একেবারে ওদের গ্রামের মতন। ফিল্মের নামটা ও বলতে পারেনি। আমরা চার বন্ধু মিলে গেলুম দেখতে। ফিল্মটার নাম "পথের পাঁচালি"ফিল্মটা আমাদের জন্যে ছিল অভিজ্ঞতার বাঁকবদল। বিভূতিভূষণের বই স্কুলের লাইব্রেরি থেকেই পড়তুম। কিন্তু ফিল্মটা দেখে আমরা চারজনেই নির্বাক। এই ফিল্মটা দেখার পরে নায়িকাদের মাইদোলানো আর পোঁদনাচানো দেখার অভ্যাস ছেড়ে গেল বলা যায়। দেখার আগে আমরা ফিল্মটার আর পরিচালকের নাম জানতুম না। পরে যখন ক্যাসেট হল তখন বাড়িতে আমি ফিল্মটার সাউন্ড অফ করেও অনেকবার দেখেছিলুম। কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন দাশগুপ্ত স্যার, তাঁকে ফিল্মটার কথা বলতে, ওনার কাছ থেকে আমরা ইতালির আর ফ্রান্সের "অভিনয়হীন" ফিল্মগুলোর প্রথম হদিশ পেলুম; তক্কে তক্কে থাকতুম কখন ফিল্মগুলো এলফিনস্টোন সিনেমাহলে আসবে। তবে আমার একটা অসুবিধা এখনও থেকে গেছে। সাবটাইটেল থাকলে ফিল্ম দেখতে বেশ অসুবিধা হয়, বিরক্তি হয়। সাবটাইটেল পড়তে গিয়ে ফিল্মটা ঠিকমতো দেখা হয়ে ওঠে না; ফলে অনেকসময়ে দুবার করে দেখতে হয়েছে ।
মৃগাঙ্কঃ ভারতের মধ্যে কি তাহলে সত্যজিত রায় প্রিয় পরিচালক ?
মলয়ঃ সত্যজিৎ রায়ের "পথের পাঁচালী" "অরণ্যের দিনরাত্রী" আর "অভিযান" ছাড়া অন্য ফিল্ম দেখেছি বলে মনে হয় না। ঋত্বিক ঘটকের "অযান্ত্রিক", "মেঘে ঢাকা তারা", "কোমল গান্ধার", "সুবর্ণরেখা", "যুক্তি তক্কো গপ্পো" দেখেছি। মৃণাল সেনের কয়েকটা ফিল্ম দেখেছি বটে কিন্তু ওনার ফিল্মগুলো ঠেক জেল করে না আমার সঙ্গে। তার চেয়ে তো রাজকাপুরের ফিল্ম বেশি দেখেছি; বাঙালি বুদ্ধিজীবিরা সেসময়ে সিনেমা দেখাকে খারাপ মনে করতেন। আমি পাটনায় পৃথ্বীরাজ কাপুরের নাটকও দেখেছি। রাজকাপুরের "বরসাত" থেকে "রাম তেরি গঙ্গা ময়লি" সব ফিল্মই দেখেছি পাটনায় থাকতে। তবে প্রিয় পরিচালক বলে আমার বোধহয় কেউ নেই। ফিল্ম জিনিসটা আমার অন্তজগতের ব্যাপার হয়ে উঠতে পারেনি। কলেজে পড়ার সময় থেকে আমি বেসিকালি একজন লোনার হয়ে গেছি। মদও আমি একাই খেতে ভালোবাসি। একটা বই পড়তে-পড়তে যেমন ভাবনা-চিন্তা জেগে ওঠে, তখন বইটা বন্ধ করে শুয়ে-শুয়ে মাথার তলায় দুহাত রেখে অনেককিছু চিন্তা করা যায়, নিজের ভেতরে ঢুকে পড়া যায়; ফিল্ম দেখার সময়েও নানা চিন্তা উদয় হয়, আর সেই ফাঁকে প্রচুর ফুটেজ বেরিয়ে যায়। তাছাড়া একা দেখার সুযোগ বাড়িতে বসে হতে পারে, ডিভিডি প্লেয়ারে, ভাবনা আসলে বন্ধ করে দেয়া যায়। কিন্তু বই পড়ার তুলনায় বা নেটে পড়ার তুলনায় তা ডিসটার্বিং। আজকাল অবশ্য ইংরেজি টিভি চ্যানেলগুলোয় প্রচুর বিদেশি ফিল্ম দেখানো হয়; তাও আমার ধৈর্য্য ফুরিয়ে যায়, কিছুটা দেখে আর এগোতে পারি না। আমার লেখালিখিতে কোনো পরিচালকের সেকারণে প্রভাব পড়ে না; ফিল্ম টেকনিকও আমি আমার লেখায় প্রয়োগ করি না ।
মৃগাঙ্কঃ তবে সিনেমার কথা থাক। আমরা কন্য কথায় যাই। হাংরির পর তুমি বেশ কিছু বছর লেখালিখির বাইরে। প্রায় আঠারো বছর। এরপর আবার লেখালিখি শুরু করলে। তখন এসে মনে হয়েছিল কি বাংলা সাহিত্যে আরো একটা আন্দোলনের প্রয়োজন ? 
মলয়ঃ হ্যাঁ, ৩৫ মাস ধরে মামলা চলার সময়ে খাওয়া নেই স্নান নেই রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, এমন অবস্হায় লেখালিখি ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল। এই অর্ডিয়ালের ভেতরেই জখম লিখেছিলুম, বহরমপুর থেকে ছাপিয়ে 'জেব্রা' নামে পত্রিকার দুটো সংখ্যা বের করেছিলুম। কিন্তু কেস এগোতে থাকলে যখন জানা গেল যে শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে চামড়া বাঁচিয়েছে আর হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে সব সম্পর্ক অস্বীকার করে মুচলেকা দিয়েছে, তখন খুবই নিঃসঙ্গ বোধ করা আরম্ভ করেছিলুম। তারপর দেখলুম সুভাষ, শৈলেশ্বর, বাসুদেব মিলে 'ক্ষুধার্ত' নামে পত্রিকা বের করার তোড়জোড় করছে যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আমাকে বাদ দেয়া। প্রতিটি সংখ্যা থেকেই ওরা আমাকে বাদ দিলে আর আমার বিরুদ্ধে যা-তা লেখা আরম্ভ করলে। আমাকে বাদ দিতে গিয়ে ওরা সুবিমল বসাক, দেবী রায় আর ত্রিদিব মিত্রকেও বাদ দিয়ে দিলে। এদিকে ওরা মাও জে দং, সাংস্কৃতিক বিপ্লব মানবতাবাদ ইত্যাদি কচকচি চালাচ্ছে। বাদ দেবার খেলাটা কী ধরণের মানবতাবাদ ছিল জানি না। উৎপলকুমার বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ও আমার বিরুদ্ধে পুলিসের পক্ষে সাক্ষী দিলেন। বস্তুত কফিহাউসে গেলে কেউ আমার টেবিলে বসতে চাইত না। এই অবস্হায় লেখার ব্যাপারটা ছেড়ে যেতে লাগল। ১৯৬৭ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত কিছুই লিখিনি। লেখালিখি শুরু করলুম লখনউ গিয়ে। ঢাকার এক পত্রিকা আমাকে খুঁজে চিঠি লিখে কবিতা চাইলেন; লিখেও ফেললুম। পরে কয়েক বছর ঢাকার পত্রিকাগুলোতেই লিখেছি। মীজানুর রহমান ওনার পত্রিকায় হাংরি স্মৃতচারণ করতে বললে, ধারাবাহিক "হাংরি কিংবদন্তি" লিখেছিলুম। উনি ওটা বই করে বের করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তারাপদ রায় আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ওনাকে শামসুর রাহমানের মাধ্যমে "হাংরি কিংবদন্তি" বই হিসাবে বের করতে বারণ করেছিলেন। বইটা পরে কলকাতা থেকে বেরোয়, মুর্শিদ বের করেছিল ।
পাটনায় থাকতে ব্যাংকনোট পোড়াবার চাকরি করতুম। ভিষণ টেনশনের চাকরি। তার ওপর পচা নোটের আবহে স্বাস্হ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। সুযোগ পেতেই সেই চাকরি ছেড়ে গ্রামীণ উন্নয়ণ বিশেষজ্ঞের চাকরিতে লখনউ চলে গেলুম। সারা ভারতের গ্রাম ঘোরার চাকরি, গ্রামীণ উন্নয়নের প্রজেক্ট তৈরি আর ইমপ্লিমেনটেশান ফলো আপ করতে হতো। তার আগে তো আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে যবের আর গমের খেতের পার্থক্য বলতে পারতুম না। গ্রামের মনুষের জীবনযাপন সম্পর্কে কিছুই জানতুম না। এই অভিজ্ঞতার ওপর বেস করে "ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস" সিরিজের চারটে উপন্যাস লিখেছি, জানি না একটাও পড়েছিস কিনা। সরকারি টাকায় ভারতের ইনটিরিয়র চষে ফেলার বেশ আনন্দময় জীবন ছিল। অনেক জায়গায় গিয়ে আমাকেও মাঠে হাগতে হয়েছে। পরে আমি স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়ে যেতুম, কেননা চাষি, তাঁতি, জেলে, খেতমজুর কেউ তো আমায় বাড়ির ভেতর ঢুকতে দিত না। স্ত্রীকে বলতুম ভেতরের জীবনটা খতিয়ে দেখে নিতে ।
মৃগাঙ্কঃ না তোমার গদ্য বলতে গেলে সবে শুরু করা। তোমার কবিতা অনেক আগে থেকে পড়েছি। তাও বেশী বছর না। সিনেমায় চলে যাওয়ায়, নিজের জন্য সময় দিতে পারতাম না তেমন। পড়া কমে আসছিল। সিনেমা যে বিষয়ের ওপর করছি, সেটা নিয়েই পড়ে থাকতে হত। তারপর আমরা টিমে সবাই এমেচার। খুটিনাটি সব কিছুই সামলাতে হত। এতো আর প্রোডাকশানের সিনেমা নয়, আলাদা আলাদা বিভাগ আলাদাজন দেখবে। এখন তো তোমার থেকে নিয়ে নিয়েই পড়ছি। পরে যখন লেখা শুরু করলে, তখন কি মনে হয়েছিল, আর কোন আন্দোলনের প্রয়োজন আছে? 
মলয়ঃ না, আমার মনে হয়নি যে আবার কোনো আন্দোলন করতে হবে। প্রযুক্তি এতো এগিয়ে গেছে, বঙ্গসমাজ এতো পালটে গেছে যে কোনো আন্দোলনই বেশি দিনের জন্য সম্ভব নয়। তরুণরা অবশ্য আমার কাছে এসে বলেছে যে হাংরি আন্দোলনের এজেণ্ডা এখনও প্রাসঙ্গিক, আবার শুরু করুন। আমার মনে হয়েছে তা আর সম্ভব নয়। এখনকার সমাজকর্তারাও বেশ অশিক্ষিত, তাদের প্রভাবিত করা অসম্ভব। এখন তুই মুখোশ পাঠিয়ে দ্যাখ, তোর লাশ পাওয়া যাবে কোনো জেলার মাটির তলায়, দশ বছর পর। ফেসবুকে অবশ্য দেখেছি একদল যুবক আমাদের বুলেটিনের ছবি দিয়ে হাংরি আন্দোলন নামে একটা কমিউনিটি পেজ খুলে ম্যানিফেস্টো, কবিতা ইত্যাদি লিখছে; তাদের লাইকও প্রচুর পড়েছে, কিন্তু সমাজে কোনো প্রভাব পড়েনি; তুই নিজেও হয়তো জানিস না। পথে নেমে কতোরকমের সামাজিক আন্দোলন চলছে, তারও ইমপ্যাক্ট কয়েকদিনেই ফুরিয়ে যাচ্ছে। তাই কলকাতায় ফিরে আমি বুঝতে পেরেছিলুম যে বঙ্গসমাজ পুরো ভোলাটাইল হয়ে গেছে। আমি পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর ঘুরেছি বলে সমাজটার বিশ্লেষণের দিকে নজর দিয়েছি, আর যেমন বুঝেছি, তেমন করে প্রবন্ধ লেখার চেষ্টা করেছি ।
মৃগাঙ্কঃ এবার একটু আলাদা একটা প্রশ্ন রাখি, ইদানিং এই ফেসবুক-এ চর্চা ব্যাপারটা তোমার কি মনে হয়? লেখালিখিটা লাইকে আটকে যাচ্ছে না? তোমাদের সময় যেমন আলোচনা হত। কে ভালো লিখছে, কে কমার্শিয়াল হয়ে গেল, কার লেখা আর দাঁড়াচ্ছে না। এখন কি আর সেই চর্চাটা বেঁচে আছে বলে মনে হয়?
মলয়ঃ বাংলায় 'গোলা পাঠক' আর 'গোলা লেখক' কথাগুলো শুনেছিস তো? গোলা পাঠক সারা পৃথিবী জুড়ে ছেয়ে আছে যারা বাংলা কমার্শিয়াল সংবাদপত্র আর পত্রিকা ছাড়া বিশেষ কিছুই হাতের কাছে পায় না। ফলে ক্রিয়েটিভ সাহিত্য সম্পর্কে তাদের ধারণা গড়ে ওঠে না, অথচ তারা নিজের সৃজনশীল একটা জগত তৈরি করে তাতে বসবাস করে আনন্দ পায়। আমি বেশির ভাগ পশ্চিমবঙ্গের বাইরে-বাইরে থেকেছি বলে বহু গোলা পাঠককে দেখেছি গোলা লেখক হয়ে উঠতে, যারা তাঁদের বই আমাকে দিয়েছেন পড়বার জন্য। এটা একটা আলাদা জগত। এনারা কোথায় গিয়ে নিজেদের তুলে ধরবেন? ফেসবুকে তুই এরকম অনেককে পাবি। গোলা পাঠকের যেমন সময় নেই তেমন গোলা লেখকেরও বুঝে ওঠার মতন পড়াশুনা নেই। সময় নেই বলে একবার পড়ে লাইক দেয়া ছাড়া আর কীই বা করতে পারেন। গোলা লেখক লিখে চলেছেন, একটা আনন্দ গড়ে তুলছেন নিজের লেখাকে কেন্দ্র করে। ওই লাইকগুলো আসলে তাঁদের আনন্দবোধের প্রতি সমর্থন। 
গোলা লেখক কি কলকাতায় নেই? অনেক পাবি। তারা বিশেষ পড়াশুনা করে না। কিছুদিন আগে আবীর মুখোপাধ্যায় নামে একজন সাংবাদিক আনন্দবাজারে শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে লিখতে গিয়ে অ্যালেন গিন্সবার্গকেই বলে বসল 'হাংরি আন্দোলনকারী' আর হাংরি ম্যানিফেস্টোগুলো শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা !  নির্মল সরকার নামে একজন গোলা লেখক ওই পত্রিকাতেই প্রতিভাস প্রকাশিত 'হাংরি আন্দোলন' বইটা রিভিউ করতে গিয়ে  লিখেছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন আমার 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটা অপছন্দ করেছিলেন তখন আমি কোন মুখে তাঁকে সাক্ষ্য দেবার জন্য বলেছিলুম। ইডিয়টটা ওই বইতেই পড়ে দ্যাখেনি সমীর রায়চৌধুরীকে লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠিটা যেখানে উনি বলছেন যে কবিতাটা উনি প্রথম পড়লেন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ।
সুতরাং ফেসবুকের গোলা পাঠক আর গোলা লেখকদের অবস্হানকে খাটো করার মানে হয় না। লেখালিখি নিয়ে ফেসবুকের বাইরে অবশ্যই মূল্যায়ন হয়, বহু সিরিয়াস লিটল ম্যাগাজিনে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়। আসলে কলকাতাকেন্দ্রিক যে ভাঙচুর হতো সেটা ছড়িয়ে পড়েছে। জেলাশহরগুলোতে অনেক কাজ হয় যা কলকাতায় পৌঁছোয় না। ফেসবুকে তুই ক্ষমতাবান কবিলেখকদেরও পাবি, যাঁরা সারা পৃথিবীতে নিজেদের কাজের সংবাদ পৌঁছে দিতে চাইছেন। ইনটারনেট এখন বেশ ইনটারেসটিং জায়গা। আমার মনে হয় কেবল গ্রন্হ সমালোচনার জন্য একটা বাংলা ওয়েবম্যাগ এবার হওয়া দরকার।

Comments