ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন | সুস্মিতা
| | অনাহূত | সুস্মিতা ভট্টাচার্য্য
দোতলার ঘরের লাগোয়া বারান্দাটায় এসে দাঁড়ালো মোহনা। শেষ কবে এই ঘরে এভাবে এসেছে মনে নেই। ঠাম্মি মারা যাওয়ার পর এই ঘরটা বন্ধই থাকত। মোহনারও কলেজ, বন্ধুবান্ধবের ভীড় পেরিয়ে এই ঘরটার কথা খুব একটা মনে পড়ত না। আজ হঠাৎ... হ্যাঁ, হঠাতই বহু পুরনো কিছু টেক্স্ট চেক করতে গিয়ে আবার ভীড় করে এলো সেই অশীতিপর এক ভাঙাচোরা বৃদ্ধা, কয়েকটা খুব প্রিয় বাঙাল শব্দ আর হাফ্রিম-ফ্রেমের সব্জেটে দাড়িওলা একটা মুখ। শাওন, শাওন মজুমদার। মোহনার এই একান্ত অনুভূতিটা একমাত্র ঠাম্মি ছাড়া আর কারো সাথে শেয়ার করা হয়ে ওঠেনি। শেষ যখন শাওনের সঙ্গে দেখা করেছিল, কোনো কথা বলতে পারেনি। খুব অচেনা লেগেছিল সবকিছু। হাতের আর্চিস কার্ডগুলো শুধু ফিরে আসবার সময় ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল।
তারপর দীর্ঘ এগারো মাস শব্দ হারিয়ে গিয়েছিল মোহনার জীবন থেকে, ডাক্তারী পরিভাষায় যার নাম ‘অ্যাফোনিয়া’। ডক্টর গুহ’র চেম্বার থেকে বেরিয়ে বাবার মতো চূড়ান্ত রাশভারী মানুষটাও একবার থমথমে মুখে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘কিসের এত অভিমান তোর, মা?’
মোহনা উত্তর দিতে পারেনি। শুধু বাবার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চোখ সরিয়ে নিয়েছিল। চূড়ান্ত মূল্যবোধ নিয়ে বড় হওয়া মেয়েটা বলতে পারেনি পৃথিবীতে প্রথম কাউকে সে নিজের ক’রে চেয়েছিল, জীবনের সবটুকু দিতে চেয়েছিল। মোহনা বলতে পারেনি, শেষদিন সবটুকু মিথ্যে প্রমাণ করে তাকে ফিরিয়ে দেবার কথা। আসলে এও এক অভিমানই বটে- শব্দের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ। সেই শব্দগুলো যেগুলো বহুবার বলা সত্ত্বেও মোহনাকে ফিরে আসতে হয়েছিল। “আমরা দু’জনে রচনা করেছি একে অপরের ক্ষতি/প্রবাসী প্রেমের পাথরে গড়েছি অন্ধ অমরাবতী/আমরা মিশিনি বিহ্বলতায় শুক্রে শোণিতে স্বেদে/আমাদের প্রেম পূর্ণ হয়েছে বেদনায় বিচ্ছেদে”..
ওহ্ পাঠক, বলা হয়নি। দীর্ঘ এগারো মাস শব্দহীন কাটানোর পর অদম্য মনের জোর অবশেষে মোহনাকে কথা যুগিয়েছে। মোহনা ব্যথা পায়নি। মোহনা-রা ব্যথা পায় না।
Comments
Post a Comment