ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন | কেয়া
| | ...কী যে পেলাম! | কেয়া মুখোপাধ্যায়
[কোলাজ উৎসর্গ মান্না দে’কে | সৌরীশ মিত্র, কলকাতা]
সে অনেক বছর আগের কথা।
কলকাতার একান্নবর্তী পরিবার ছেড়ে যুবকটি তখন বম্বেতে। ভাগ্য-অন্বেষণে। গানই
তার ভালবাসা। কেরিয়ার তৈরির সময়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ডাক আসে জলসায়। সেবার ওইরকমই
এক জলসার আয়োজন করল বম্বের ইন্ডিয়া কালচারাল লিগ। রবীন্দ্রনাথের ‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্য হবে। ‘লহ লহ তুলে লহ নীরব বীণাখানি’ গানটি হবে দ্বৈতকন্ঠে। যুবকটি দেখল,
তাকে গাইতে হবে যে মেয়েটির
সঙ্গে, বাংলা তার মাতৃভাষা নয়। তবু কি চমৎকার দখল বাংলায়। গানেও।
রিহার্সালের দিনগুলো আর নৃত্যনাট্য শেষ হল একসময়। ততদিনে দুজনের পরিচয় বেশ
বেড়েছে। দেখাও হয় মাঝে মধ্যে। বম্বে ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স
পর্ব শেষ করে সেখানকারই একটি কলেজে পড়ায় মেয়েটি। মেয়েটির আসল বাড়ি কিন্তু ব্যাঙ্গালোরে। মাঝে
মাঝে বাড়ি যায়। পরিচয় পর্ব যখন অনেকটা গাঢ়, মেয়েটি একবার তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইল।
বাড়ির লোকদের সঙ্গে আলাপ করাতে।
ব্যাঙ্গালোরে যুবকটি আগেও গেছে। ব্যাঙ্গালোরের জল হাওয়া তার খুব পছন্দ। সকাল আর রাতটা বেশ ঠান্ডা।
কিন্তু দুপুরে ঠান্ডাও নেই, আবার বেশি গরমও
নেই। সারা শহরে যেন এসি চলে বছরভর। শহরটা খুব ভাল লাগে তার। কিন্তু সেখানে মেয়েটির
সঙ্গে যাওয়া মানে তো সব অন্যরকম। সে সঙ্গে থাকলে চারদিকটা কেমন যেন আলো আলো হয়ে
যায়।
ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরে এসে ছেলেটি ডায়েরিতে লেখে:
শহরটা বেশ সাজানো নানা ফুলের বাগানে। বেশি বাড়ি নেই। শুধু সবুজের ছড়াছড়ি।
অবশ্য আমাদের বয়সটাও তো সবুজ দেখারই বয়স। দুজনে হাত ধরাধরি করে কোনও দিন গেলাম
লালবাগ আবার কোনও দিন কাব্বান পার্কে। সূর্য আস্তে আস্তে লাল আভা ছড়িয়ে যখন চলে
যেত পশ্চিমের অন্য কোন জগতে, আমরা ফুলের ছোঁয়ায় আর সেই
কনে দেখা আলোতে নতুন করে দেখতাম নিজেদের। খুঁজে নিতাম পরস্পরের মনের সমস্ত অলিগলি।
সমস্ত রাজপথ।
পরের বছর বিয়ে করল দু’জনে। সে অনেক খুশি, সে
ভারি আনন্দ।
চমৎকার কাটছিল দিনগুলো দুজনের। গায়ক যুবকটির নামডাক বাড়ছে। ব্যস্ততাও। মেয়েটির
সঙ্গে তার বন্ধুতাও আরো গভীর দিনে দিনে। তারই মধ্যে সামান্য কি একটা কথায় মতান্তর
হল একবার। কেউ কারোর নিজের মত থেকে সরবে না। দুজনেরই মনে দুঃসহ ব্যথা। অভিমান।
ভাবছে অন্যজন কেন মানিয়ে নেবে না! অভিমান জমতে জমতে শেষে
বাড়ি ছেড়ে চলে গেল মেয়েটি। একেবারে বাপের বাড়ি। বলে গেল, আর ফিরবে না।
গায়কের এক বন্ধু চমৎকার গান লেখে। দুজনের বেশ মতের মিল। নানা জায়গায় যায়
একসঙ্গে। জমাটি আড্ডা হয়। ব্যথার পাহাড় আর কদ্দিন একা একা বয়ে চলা যায়। একদিন কথায়
কথায় গায়কটি সব জানাল তার বন্ধুকে। বন্ধু কিছু বলল না। সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেল। দু’দিন
পরে বন্ধু গায়ককে ফোন করে নিজের সদ্য লেখা একটা গানের কথা পড়ে শোনাল:
“...অন্তরে আলো জ্বেলে রেখে
দৃষ্টিকে গেছ শুধু আঁধারেতে ঢেকে
নিজেকে প্রশ্ন করে দেখো না
যার নাম তুমি আর লেখো না
কেন তাকে ধরে আছো হৃদয়ে
বিদায়ের পথ কেন ছাড়োনি!
কি তার জবাব দেবে
যদি বলি আমিই কি হেরেছি?
তুমিও কি একটুও হারোনি।”
তারপর দুজনে কিসব যেন পরামর্শ হল গান নিয়ে। গানের কথায় সুর দিল গায়কটি।
ওদিকেও অভিমান বাড়ছে। মেয়েটি ভাবছে, কি করে এতখানি কষ্ট দিতে
পারল তাকে! সে ভেবেছিল, যুবকটি
নিশ্চয়ই ছুটে আসবে। কিন্তু কোথায় কি!
ক’দিন পরে একটা বড় খাম এল। চিঠি লিখেছে? নিজে না এসে? নাঃ! খামে
কোন চিঠি নেই তো। কি যেন টেপ করে পাঠানো।
মনে মনে যত অভিমানই হোক, একবার শুনে তো দেখতেই হবে।
রাত্তির বেলা ভল্যুম কমিয়ে আস্তে আস্তে চালিয়ে দিল সেই টেপ। সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ল
অভিমানী সেই কন্ঠ:
“...সবুজ পাতাকে ছিঁড়ে ফেলেছো
ফুলেতে আগুন তুমি জ্বেলেছো
ফাগুনের সব কেড়ে নিয়েছো –
স্মৃতিটুকু তার কেন কাড়োনি...
কি তার জবাব দেবে যদি বলি আমি কি হেরেছি?
তুমিও কি একটুও হারোনি।”
চোখের জল বাধ মানে না! সব ব্যথা আর অভিমানের ওপর
ভালবাসার তুলি বুলিয়ে দিল ওই গান। মেয়েটি ফিরে গেল। পরদিনই।
অনেকদিন অবধি গানটি মেয়েটির একারই ছিল। ব্যথা ভোলানোর, অভিমান
ভাঙানোর গান হয়ে। তারপর সেই-ই একদিন বলল, এমন
গান মানুষের কাছে পৌঁছবে না! এ সৃষ্টি তো গান-ভালবাসা
শ্রোতাদের সঙ্গে ভাগ করে নেবার জন্যে!
দিন কাটে। আগের মত আর হঠাৎ অভিমানী হয়ে পড়ে না কেউ। দিনে দিনে ভালবাসা আরও
গভীর।
অসমান্য প্রতিভা নিয়েও, দারুণ কাজ করেও উপযুক্ত
সম্মান আর স্বীকৃতি মেলে না যুবকটির সবসময়। অনায়াসে অমন রাগ রাগিণী খেলে যায় যে
গলায়, সে গলা নাকি তত রোম্যান্টিক নয়! সেই অজুহাতে ভাল গান চলে
যায় আর কোন গায়কের কাছে।
একবার তো সেরা গায়িকার সঙ্গে যুবকটির ডুয়েট। রেকর্ডিং হবে। সঙ্গীত পরিচালক এক
বিখ্যাত জুটি। সবাই উপস্থিত স্টুডিওতে। ছবির নায়কও এসেছেন। রেকর্ডিং শুরু হতে যাবে, হঠাৎ
ছবির প্রযোজক ঢুকলেন এসে। এদিক ওদিক তাকিয়ে তাঁর প্রিয় গায়ককে খুঁজে পেলেন না। সে
কি হম্বিতম্বি। খেপে আগুন হয়ে বললেন,
এই নায়কের লিপে তাঁর প্রিয়
গায়ক ছাড়া আর কারও গান মানায় না। এক্ষুণি তাঁকে ডাকা হোক, না
হলে এ গানের রেকর্ডিং বন্ধ করা হোক।
সব কিছু কাচের ঘরের ভেতর থেকে দেখতে পাচ্ছে যুবক গায়কটি। হেডফোনে শুনতে পাচ্ছে
সব কথা। একা নয়। গায়িকা, মিউজিশিয়ানরা সকলে শুনছে।
কি অসম্ভব অপমান! যুবকটির সারা শরীর কাঁপছে। চোখ
ভর্তি জল। মুখ লুকোবার জায়গা নেই কোথাও। সবার সামনে প্রযোজকের কাছে এ অপমান তার কল্পনাতীত। শেষে
ছবির গায়ক বলে উঠলেন, আচ্ছা এখন ইনি গান। ভাল না
লাগলে না হয় সেই প্রিয় গায়ককে দিয়ে আবার গাওয়ানো হবে!
ভীষণ রোম্যান্টিক গান। কিন্তু অপমানের যন্ত্রণায় সব অনুভূতি তখন ভেসে গেছে
চোখের জলে। এমন সময় গায়িকা গিয়ে বললে,
‘আপনি এমন গান করুন যাতে
কেউ আর কিছু বলতে না পারে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে গাইল সে।
একবার নয়, দু’বার নয়, বার
বার বহু রকম ভাবে এমনসব ঘটনা ঘটে চলে তার সঙ্গে। ভীষণ অভিমান হয় তার। ভাবে, সারা জীবন কি তাকে এইভাবে পরীক্ষা দিয়ে যেতে হবে! এর
কি কোনও শেষ নেই!
সেই মানসিক যন্ত্রণার মুহূর্তগুলোতে পাশে থেকে মনের জোর দেয় মেয়েটি, তার
স্ত্রী। অবিরাম। বাইরে কারো কাছে নয়,
সব ব্যথা আর কষ্টের কথা
শুধু তার সঙ্গেই ভাগ করে নেয় গায়কটি। আর যা প্রকাশ করার, তা
ওই গানের মধ্যে দিয়েই করার চেষ্টা করে। বাঙালি স্ট্রাগলার, হেরে
গেলে চলবে?
************
অনেক বছর কেটে গেছে। যুবক গায়ক এখন প্রবীণ। অনেক বছর গান গাওয়া হল। দেশে
বিদেশে অনেক শ্রোতার মনে ভালবাসার জায়গা তাঁর জন্যে। শ্রদ্ধার জায়গা। এ তো কম
প্রাপ্তি নয়! কত গীতিকার, কত
সুরকারের সঙ্গে কাজ করা হল! শুধু বাংলা কি হিন্দি নয়।
আরো অনেক ভাষায়। পুরস্কার আর সম্মানও এসেছে। তবু ঘরোয়া আড্ডায় খুব নিকটজন কি
বন্ধুদের কাছে মাঝে মাঝে কোন গান প্রসঙ্গে পুরনো কথা ওঠে। তখন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন।
মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা ক্ষতে ব্যথা জাগে আবার। ম্লান হেসে কখনো বলেন,
‘পুরো জীবনটাই যেন স্ট্রাগল। সহজে কিছু হয়নি হে! তোমাদের
ভাল-লাগা অনেক গানের পিছনের গল্পটা যে বড় যন্ত্রণার, বড় ব্যথার!’
উচ্চশিক্ষিত। সঙ্গীত-প্রতিভায় অনবদ্য। তবু কেন এমন নিরন্তর পরীক্ষা দিয়ে যেতে
হল! জীবনভর এত যন্ত্রণা সহ্য করতে হল! প্রশ্ন
করলে বলেন,
“ছাড়ান দাও, ছাড়ান
দাও। দুঃখ পেয়েছি অনেক। অনেক ব্যথা জমে আছে মনে। তবু প্রচুর মানুষকে তো আনন্দ দিতে পেরেছি।
তাদের অকুন্ঠ ভালবাসা তো পেয়েছি। এ কথা ভেবেই আজ সুখ পাই। একজন গাইয়ে হয়ে আমি আর
কী-ই বা করতে পারি!
আর ক’দিন! যাঁদের
হাত ধরে গান গাইতে আসা, তাঁদের কথামতো যত গান
গেয়েছি, সবই গেয়েছি অন্তর থেকে,
ভালবাসা দিয়ে। আজ আমার আর
কিছুই পাওয়ার নেই। যা পেয়েছি ততখানি না পেলেও আমার কিছু বলার ছিল না।”
মনের ঈশান কোণে একটা আশঙ্কার কালো মেঘ জমা হচ্ছে। সেটা নিয়েই দুর্ভাবনা! বড়
মেয়ে অনেক দূরে। প্রথমে সবটা না বললেও এখন বুঝতে পারেন সব। খুব অসুস্থ সে। কঠিন
অসুখ। আর এত বছর ধরে সুখে-দুঃখে,
আনন্দে-বেদনায়
সব সময় যে মানুষটা পাশে ছিল, আছে- সেও
ভাল নেই। যতই লুকোতে চাক, তিনি কষ্ট পাবেন বলে আড়াল
করতে চাক- ঠিক বুঝতে পারেন রোগযন্ত্রণা বাড়ছে তারও।
খুব অসহায় লাগে। কোনো ম্যাজিক করে অসুখ তো সারিয়ে দিতে পারেন না! আসলে
গান ছাড়া আর কিছুই তো পারেন না! ওই একটা জিনিসই আঁকড়ে ধরেছেন ভালবেসে। চর্চা
করেছেন। পারফেকশনের চর্চা। শুধু সুর নয়। শুদ্ধ সুর, শুদ্ধ
সঙ্গীত।
তাঁর জীবনের ভরকেন্দ্রে
পারফেকশন। না, জনপ্রিয়তা নয়। তাঁর কাছে
বিশুদ্ধতাতেই সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠত্ব। সাফল্য আসুক, কিন্তু
তা যেন শুদ্ধতাকে বরণ করে আসে, শুদ্ধতাকে বাদ দিয়ে নয়।
বুঝতে পারেন, সারা জীবন ধরে এত পারফেকশনের চর্চা করেও জীবনটা আর পারফেক্ট থাকছে না! মনে
মনে বলেন, সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে! লাইফ ইজ নো হোয়্যার নিয়ার
পারফেকশন!
প্রথমে মনে হয়েছিল কলকাতা ফিরে গেলে হয়। অনেক বছর তো হল আরব সাগরের তীরে।
শহরটা নাম পাল্টে বম্বে থেকে মুম্বাই হয়ে গেল। কলকাতায় গেলে মানুষের কত ভালবাসা, শ্রদ্ধা।
জন্মদিনে কলকাতাতে থাকলে তো আর কথাই নেই। বাড়ির একতলার বসার ঘর আর রেওয়াজের ঘর
ফুলে ফুলে ভরে যায় সেদিন। একটা বাড়ি করলে না হয় দুজনে শেষ জীবনটা ওখানেই কাটাতেন!
পুরনো কথা মনে পড়ে যায়। সেবার সঙ্গীত-জীবনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি। বিশাল
অনুষ্ঠানের আয়োজন নেতাজি ইন্ডোরে। ক’জন সাংবাদিক আর খেলোয়াড় মিলে সব ব্যবস্থা করেছেন। কথা ছিল
রাজ্য সরকারের তরফে কলকাতায় বাড়ি করার জন্য তাঁকে জমি দেওয়া হবে। শেষ অবধি হয়নি। ভারতের অন্য শহরে তাঁর
বাড়ি আছে যে! সেই যুক্তিতে ওসব
আবেগাপ্লুত ঘোষণার প্রতিশ্রুতি বাতিল হয়ে গেল। কথাগুলো মনে পড়লে মৃদু হাসেন একা
একাই। কথার খেলাপ দেখতে দেখতেই জীবন কেটে গেল। ওসবে আর কষ্ট পান না। নিজের
কর্তব্যটুকু করে যেতে চান শুধু। ইন্ডোরের ওই টালবাহানার মধ্যেও নিজের কাজটা করে এসেছিলেন।
অনুষ্ঠান থেকে সংগৃহীত চল্লিশ লাখ টাকা ওই মঞ্চেই চ্যারিটিতে দিয়ে এসেছেন।
তবে বাড়ি নিয়ে একবার খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। মুম্বাইয়ের বাড়িটা বিক্রি করে
ব্যাঙ্গালোর-এ চলে আসার কথা চলছে। তিনি জেদ ধরেছিলেন এমন
কাউকে বেচবেন, যে ওভাবেই রেখে দেবে বাড়িটা। ভেঙেচুরে ফেলবে না। কখনো মুম্বাইয়ে
গেলে, একবার ঘুরে আসতে পারবেন। রেওয়াজের ঘর,
বসার ঘর, বাড়ির আনাচে
কানাচে কত বছরের টুকরো স্মৃতি ছড়ানো। দূরে গেলেই কি ভোলা যায়? খদ্দের
পাওয়া গেল। তাঁর গানেরও নাকি খুব ভক্ত। যখনই ইচ্ছে হবে, পুরোনো
বাড়িতে একবার ঘুরে যেতে পারবেন তিনি। এমনি সব কথা হল। বিক্রি হয়ে গেল বাড়ি।
চাইলেই তো আর যাওয়া হয় না। এক আত্মীয়ের বিয়ে বছর দুয়েক পর। এয়ারপোর্ট থেকে
পুরনো বাড়ি ঘুরে তারপর বিয়েবাড়ি যাবেন। স্মৃতির পথ বেয়ে একটু পিছু ফিরে চাইবেন।
গেলেন। কোথায় সেই সাবেকি বাড়ি! সেখানে দাঁড়িয়ে একটা মালটিস্টোরিড বিল্ডিং!
গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা ফিরে এসেছিলেন এয়ারপোর্টে। যেখানে যাবার ছিল, যেতে পারেননি। বড়
আঘাত লেগেছিল মনে।
*********
সুখে দুঃখে ষাট বছর একসঙ্গে কাটানোর পর চলে গেলেন স্ত্রী। বড় কষ্ট পাচ্ছিলেন।
চলে যাওয়াটা প্রত্যাশিতই ছিল। তবু মানতে পারেন কই! সব
ব্যথা সব যন্ত্রণার মুহূর্তগুলোতে যে পাশে ছিল, তাকে বাদ দিয়ে একটা দিনও কাটানো যে
কি কঠিন!
এ শোকের উপশম নেই। মেয়ের অসুস্থতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন এতকাল। মনের জোর
দিয়েছেন তাকে। সেও তো পেরেছেন ওই মানুষটা পাশে ছিল বলেই। কিন্তু এত বছরের প্রিয়
বন্ধু, যাবতীয় অভিমানের দিনের একান্ত সঙ্গী, তাঁর সব ভরসা আর
শক্তির উত্স যদি সরে যায়, তাহলে বেঁচে থেকে আর লাভ কি?
স্ত্রীর বিয়োগ ব্যথা দিনে দিনে বিপর্যস্ত করে তোলে বৃদ্ধ গায়ককে। পারছেন না!
দিনে দিনে বদলে যাওয়া পরিস্থিতি আর অপ্রত্যাশিত পারিপার্শ্বিক চাপের সঙ্গে আর
মানিয়ে নিতে পারছেন না। ভালবাসাহীন, প্রেমহীন
এ জীবন আর চান না। এবার প্রস্তুত তিনি। ডাক আসার অপেক্ষা শুধু।
না না, আর একটা কাজ করার আছে। শেষ কাজ। শেষ অ্যালবাম। স্ত্রীর
জন্য। এই কাজটা করে যেতেই হবে। আ ট্রিবিউট টু হার। গত পনেরো বছর ধরে অনেক গান তাঁর জন্যে
লিখেছেন যিনি, তাঁর সঙ্গে কথা বললেন।
স্ত্রীর কথা। ভালবাসার কথা। তাঁকে হারিয়ে অসহায় যাপনের কথা। প্রতি মুহূর্তে তাঁকে
খুঁজে চলার কথা। আবার দেখা হবার কথা। সেই সব থাকবে গানে।
‘জানি জানি আবার দেখা হবে
চোখের জলে দিন গোনা তাই
সে দিন আসবে কবে...’
একা একা গুনগুন করেন। মনের কষ্ট আর ব্যথা উপচে আসে দুচোখে। বাকি গানগুলোতেও
সুর করে ফেলতে হবে তাড়াতাড়ি। রেকর্ডিং করে ফেলে তারপর ছুটি।
শরীরটা সায় দিচ্ছে না একেবারে। ডাক্তার, ওষুধ, সুস্থ থাকতে নানা নিয়মকানুন
মেনে চলা। সেই অবধি ঠিকই ছিল। কিন্তু আরো কিছু আছে। খবরদারি। পাহারাদারি।
চিরস্বাধীন মানুষটার অদ্ভুত এক বন্দীদশা। শহরতলির এই বাড়ি থেকে বেরোনো যায় না। একা
পারবেন না। কাউকে যেতে হবে সঙ্গে। কিন্তু কার অত সময় আছে? সবাই নিজেদের নিয়ে
ব্যস্ত। বাইরের জগতের দরজা যেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুধু সেলফোনে একটু কথা বলা,
আর চাইলে টিভি দেখা। তার বাইরে আর কিছু নেই তাঁর জগতে। আত্মীয়-বন্ধু-পরিজন কেউ
দেখা করতে এলেও দেখা হয় না। তাঁরা যে ঢুকতেই পারেন না বাড়িতে! সকালবেলা যে যার
কাজে বেরিয়ে গেছে। বাইরে থেকে তালা ঝোলানো। তাঁর কাছে চাবি নেই কোনও।
অসংবেদনশীল পরিজনের মাঝে কি অসহায় নিঃসঙ্গ যাপন। কি নির্মম কারাবাস! অসহায়
বৃদ্ধ ছটফট করতে থাকেন। এই যন্ত্রণার মুহূর্তগুলোতে রবীন্দ্রনাথের গানের কথা মনে
হয়।
“না পেয়ে তোমার দেখা, একা একা দিন যে আমার কাটে না
রে ॥
বুঝি গো রাত পোহালো,
বুঝি ওই রবির আলো
আভাসে দেখা দিল গগন-পারে--
সমুখে ওই হেরি পথ,
তোমার কি রথ পৌঁছবে না মোর-দুয়ারে ॥
ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে...”
মনে মনে ভাবেন, রবীন্দ্রনাথের গান তিনি তত গাননি, অনেকে বলেন। রবীন্দ্রনাথের গান তো তানের নয়, প্রাণের।
মঞ্চে তত না গাইলেও তাঁর গানই তো প্রাণের সঙ্গী হয়ে আছে আজীবন। আর সবচেয়ে কাছের
মানুষটার সঙ্গে আলাপও যে তাঁর গান গাইতে গিয়েই! তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের
কীর্তনাঙ্গের গান মানুষের ভাল লেগেছিল। ওই ভাললাগাটুকুই তো রয়ে যায়। আর কি চাই!
মাঝে মাঝে ভেতরটা বিদ্রোহ করে ওঠে। চিরকালের আপরাইট মানুষটা ক্ষোভে দুঃখে
অন্তরের ব্যথার কথা বলে ফেলেন কাউকে কাউকে।
‘বাইরে, ওই পার্কে নিয়ে গিয়েও কি একটু বসানো যায় না আমাকে? কত মানুষ ঘিরে
থেকেছে। আর এখন একটা মানুষের মুখ দেখতে পাই না যে সারাদিন! এভাবে কি বাঁচা যায়?
এবার আমি প্রস্তুত। আমাকে নিয়ে যাক। এ কষ্ট আর নিঃসঙ্গতা আর বয়ে নিয়ে চলতে পারছি
না।’
আবার মনে পড়ে যায়, শেষ কাজটা তো করে যেতে হবে! অ্যালবামটা! কলকাতা যাওয়া হবে
না আর। কিন্তু গানের ট্র্যাকটা করিয়ে আনতে পেরেছেন কলকাতা থেকে। একতলা একটা
স্টুডিও নিয়ে রেকর্ডিংটা শেষ করে ফেলতে হবে। কি জানি, কবে, কখন ডাক এসে যায়!
ঘরের দিকে তাকিয়ে গুন গুন করে ওঠেন:
‘
..এই সেই ঘর
যে দিকে তাকাই সব কিছুতে
তোমার বড় যত্নের ছোঁয়া
কী করে মানবো বলো
একসাথে যেতে যেতে
তোমার এমন করে চলে যাওয়া
কী করে মানবো বলো…’
হারমোনিয়ামটা নিয়ে একটু রেওয়াজ করা যাক। কতদিন হয়নি।
কিন্তু হারমোনিয়াম কই?
নেই তো ঘরের কোথাও! এদিক ওদিক তাকান। নেই মানে
নেই! কোত্থাও নেই! কাজের লোক কোথায়
থাকে কে জানে। নিজেই খুঁজে দেখতে যান। অশক্ত শরীর। কান্না আসছে ভেতর থেকে। টাল
সামলাতে না পেরে পড়ে যান হঠাৎ।
কতবার যে এমন পড়ে গেছেন! কাকে বলবেন? কার কাছে অনুযোগ করবেন? সত্তর বছরের ওপর গান গেয়েছেন মঞ্চে। সঙ্গীতসাধনা শুরু আরো আগে। সেই
মানুষটার সঙ্গী হারমোনিয়ামটাও সরিয়ে রাখতে হল আজ! তাঁর রেওয়াজে সকলের এত অসুবিধে!
এই জীবনটাই কি প্রাপ্য ছিল তাঁর?
ভেতরটা বিদীর্ণ হয়ে যায় ব্যথায়।
***********
অসহায় নিঃসঙ্গ কারাবাস শেষ হল। বিপন্নতা থেকে মুক্তি এল। ব্যথার অবসান হল।
মৃত্যু এসে সব ব্যথায়,
যন্ত্রণায় শান্তি প্রলেপ বুলিয়ে দিল।
সঙ্গীত গবেষক অধ্যাপক লিখলেন:
‘মরমে মরে যাই। সারাদেশের সংগীতপ্রেমীদের প্রাণের ধনকে টেম্পোর দিকে নিয়ে
যাওয়া হচ্ছে একটি চাদরের চারটি খুঁট ধরে। শিল্পীর মরদেহ নিয়ে টেম্পো রওনা হয়ে যায়
হেব্বাল শ্মশানের দিকে। অনাদরে।’
শেষযাত্রা দেখে গলার কাছে কান্না দলা পাকিয়ে আসে। পোড় খাওয়া সাংবাদিক থেকে
গায়ক থেকে সাধারণ মানুষ- চোখ ভিজে যায় সবার।
কেমন কাটবে শেষ জীবন? বড় অনিশ্চিত। কেউ জানি না। শুধু কানে বাজতে থাকে তাঁর
গাওয়া একটা গান। নিজের ফোনের শেষ রিংটোনও করেছিলেন সেই গানটাকেই। শেষ জীবনের বড়
যন্ত্রণার উপলব্ধি। বড় ব্যথার উচ্চারণ:
‘সুখ নামের শুক পাখিটায় ধরতে গিয়ে
কিনেছি সোনার খাঁচা যা কিছু সব বিকিয়ে
সে পাখী আবার যায় উড়ে যায়
ভাবিনি সেই সে আশার এই পরিণাম...
কি চেয়েছি আর কী যে পেলাম…!’
|
|
যে কন্ঠ আমাদের মনে রঙের রোশনাই তুলেছে আজীবন, তা যে এত যন্ত্রণায় নীল, সেটা জানা ছিল না। মর্মস্পর্শী লেখাটির জন্য ধন্যবাদ কেয়া।
ReplyDeleteঋজু, আপনার মতামত জেনে ভাল লাগল। ধন্যবাদ আপনাকে।
ReplyDeleteআমরা বড় হওয়াটা দেখি,বড় হওয়ার পথটা দেখি না। যেটা প্রায়শই বন্ধুর। প্রতিভার বিচ্ছুরণে তা অনালোকিত হয়ে থাকে ঠিকই কিন্তু তার ওপর আলো পড়লে আমরা বিস্মিত হই, কখনও মর্মাহতও। আমার এক অতি প্রিয় গায়কের এহেন হেনস্থার অজানা কথা জেনে রাগ-দুখঃ-কষ্ট মিশ্রিত একটা অনুভূতি হচ্ছে। কিন্তু উনি স্বস্থানে স্থিত আছেন ও থাকবেন। চিরদিন। চিরকাল।
ReplyDelete