আড্ডা, সাবেকী ভাষায় Interview | পারমিতার একদিন
পারমিতার একদিন | পারমিতা & সৌম্যজিৎ
[paromita ray with a guitar bigger than her]
ব্যথা কি?
- ব্যথা হচ্ছে চলে যেতে দেওয়া। হাতছাড়া হওয়ার ছিল, এটা বুঝে ফেলার নাম হল ব্যথা।
এটুকুই?
- এটা একটা বিশাল বড় জায়গা। শারীরিক ব্যথা ছাড়াও, যে ব্যথাটা কোনও আঘাতে অনুভব করি। আমরা রিগ্রেট করতে থাকি যা নিয়ে, ভাবতে থাকি যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি, সেটাই ব্যথা। যদি এরকম না হয়ে অন্যরকম হতো। একটা রেকারিং ডিপোসিট অ্যাকাউন্টের নাম ব্যথা। আমার পিশেমশাই, ভুল চিকিৎসায় চলে গেলেন, তবু এখনো ভাবি, ওটা বোধহয় স্বপ্ন ছিল। ব্যথা। বলো, আর কত বলব ব্যথা নিয়ে! (অল্প হাসি)
কিন্তু, এই ব্যথাগুলো তুই মেনে নিয়েছিস এবং নিচ্ছিস তো, তাহলে আর রেকারিং কেন?
- হ্যাঁ, রিগ্রেট হয়। তুমি-আমি দুজনেই অর্থনীতির মানুষ। তাই অর্থনীতির ভাষায় বলি, একটা ওয়ার্স অফ্ অঞ্চলে বসে থাকা হলো ব্যথা যেটা বেটার অফ্ হলেও হতে পারতো।
সঙ্গীত?
- সঙ্গীত হলো ইউনিভার্স। সব জায়গায়, সবকিছুতে সঙ্গীত রয়েছে। সঙ্গীতকে তুমি সংজ্ঞা দিয়ে বোঝাতে পারবেনা।
এটা কবে থেকে তোর মনে হতে শুরু করল যে সঙ্গীত ইউনিভার্স?
- আমি ছোটবেলা থেকেই মিউজিক নিয়ে প্যাশনেট। মা গাইতেন। তাই শুনে শুনে আমিও গাইতাম। কোনও শব্দ ভালো লাগত যখন, মিউজিক হয়ে উঠত। রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতাম। ফোক গাইতাম। বাংলা ফোক। এখনো গাই। হয়তো বাইরে গাইনা। তবে খুব ভালোবাসি। মিউজিক ব্যাপারটা সব কিছুর মধ্যেই আছে। শ্রুতিটা ছোটবেলা থেকেই ছিল। এখন হয়তো একটু বেড়েছে। তোমার আশেপাশে লোকজন যাই করছেন, সেটাই সঙ্গীত। এই যে এয়ার কন্ডিশনারের আওয়াজটা হচ্ছে, রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময় যে হৃৎকম্পন শুনতে পাচ্ছি, এটাই মিউজিক হয়ে উঠছে আমার কাছে।
সঙ্গীত আর ব্যথার সম্পর্কটা বেশ মিষ্টি, না?
- অনেক সময় হ্যাঁ, আবার অনেক ক্ষেত্রে নাও হতে পারে। যখন আমি খুশি আছি, তখন মিউজিক আমাকে আরও আনন্দ দিতে পারে। আবার উল্টোটাও হতে পারে। গোটা আনন্দটাই মাটি হয়ে যেতে পারে। (জিভ কেটে) আমি আবার বেশি আবেগপ্রবণ, অল্পেই কেঁদে ফেলি। অনেক সময় কাঁদার জন্যই সঙ্গীত বেছে নিই। নিজেকে ব্যথা দিতেও ইচ্ছে হয় অনেকসময়। সঙ্গীত বন্ধু হয় তখন। মিউজিক হলো ‘লেট ইট বি’। ওটাই সবকিছু দিয়েছে এবং দেবে। সঙ্গীত আর ব্যথাকে পরিপূরক বা বিকল্প হতেই হবে, তার কোনও মানে নেই। সবই মুহূর্তের জন্য।
হ্যাঁ, এটা ঠিক বলেছিস। আমার ক্ষেত্রে যেমন ব্ল্যাক কফি আর বিয়ার। অনেকসময় কমপ্লিমেন্টারি আবার অনেকসময় সাবস্টিটিউট। তবে সবসময় নয়। ঠিক ঠিক, মুহূর্তের জন্যই সত্যি। আচ্ছা, মিউজিক তোকে উদ্বিগ্ন করে তোলে?
- উদ্বিগ্ন? (আকাশ থেকে পড়ে গিয়ে) না না। কখনোই না।
হিপ্পি আন্দোলন আর সঙ্গীত? কিভাবে দেখিস?
- হিপ্পি আন্দোলনের একটা বিশাল জায়গা জুড়ে মিউজিক। একটা মানুষ আরেকটা মানুষের প্রেমে পড়ছে তার গীটার শুনে, নিজের বন্ধুকে ছেড়ে তার কাছে চলে যাচ্ছে শুধু গানের টানে। এটা তো একটা ব্যাপার নিশ্চয়ই। তারপর যদি হিপ্পিদের কথাই ভাবা যায়, বার্তাটা কি?- আমি যেরকম, সেরকমই থাকতে ভালোবাসি এবং থাকব। স্বাধীন প্রবনতার একটা প্রাণভোমরা হিসেবে তৈরি হচ্ছে সঙ্গীত। এটা একটা ফেনোমেনাল!
আচ্ছা, নতুন ঘরানার বাঙলা গান যদি মানুষের ভাবনা-চিন্তার বদল ই না ঘটাতে পারল, তাহলে বাঙালীর কৃতিত্ব কোথায়?- এটা অনেকেই বলে থাকেন। কিভাবে দেখিস?
- এটা যারা ভাবেন, তারা গান্ডু। নচিকেতা চক্রবর্তী যখন রবীন্দ্রনাথের গান গাইছেন নিজের মতো করে, তখন সব গেলো গেলো রব উঠে গেল। লোকে কুৎসিত মিমিক্রি দেখে আনন্দ করছে, আর আমি রবীন্দ্রনাথের গানে নতুন কিছু খুঁজে পেলেই রবীন্দ্রনাথকে হেয় করা হয়ে যায়? বাঙালীর এই দ্বিচারিতা আমি নিতে পারিনা। পিপল শুড গ্রো আপ। আমি একই কথা নতুন সুরে বললে বা নতুন কথা একই সুরে বললে আমি অযৌক্তিক হয়ে যাই। রবীন্দ্রনাথ কোন টেম্পোতে গেয়েছেন, সেটাই আমাকে অনুসরণ করে যেতে হবে, আর শাড়ি পরে হারমোনিয়াম নিয়েই গাইতে হবে, এটা আমি মেনে নিতে পারিনা। রবীন্দ্রনাথ তোমার, আমার মধ্যে আলাদা আলাদা করেই আছে। ওটা আমি আমার মতো করে বুঝব। তুমি তোমার মতো করে। আজ যদি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কথা না হয়, রবীন্দ্রসঙ্গীতের যে একটা ইন্ডাস্ট্রি আছে, যারা রবীন্দ্রনাথ বেচে খায়, সেটা জাস্ট ফুরিয়ে যাবে। আজও আমরা যারা rhythm and blues, guns n roses শুনছি, আমরা যদি এই গানগুলো না গাইতাম, বাঙালী শুনত না। এরা হারিয়ে যেত বাঙালী শ্রোতাদের কাছ থেকে। যখন চয়েস্/অপশন বাড়তে থাকবে শ্রোতার কাছে, তখন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় মানুষ শিফট্ করবে, করবেই। কিন্তু সেখানেই চিরন্তন রবীন্দ্রনাথ, বা নজরুল।
তুই কি করে বুঝছিস যে তুই রবীন্দ্রনাথকে নিজের মতো করে গাইতে গিয়ে একেবারে খুন করে ফেলছিস না? রোদ্দুর রায়ের গান শুনলে আমার জলে ডুবে মরতে ইচ্ছে করে। অথচ মানুষ তাঁকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন। পাবলিসিটি পজিটিভ হোক বা নেগেটিভ, তিনি পাবলিসিটি পেয়ে গেছেন। তেমনই আবার নীল দত্ত ‘পাগলা হাওয়ায়’ নতুনভাবে মিউজিক বানালে অনেকেরই মনে হতে পারে যে তিনি রবীন্দ্রনাথকে খুন করছেন। হু অ্যাম আই টু জাজ ইউ?
- নো ওয়ান। তাহলে বলি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভগবান নন। নীল দত্তও নন। নিজের মতো করে কোন জিনিসকে দেখা, শোনা এবং শোনাতে চাওয়ানোটা নন-ভগবান বিহেবিয়র। এর মধ্যে আমি কোনও অপরাধ খুঁজে পাচ্ছি না।
তাহলে, মিউজিক ইজ ভেরি মাচ পার্সোনাল অ্যান্ড বাই পার্সোনাল আইডেন্টিফিকেশন, মিউজিক ওয়ান্টস টু বি পাবলিক? তাই তো?
- হ্যাঁ, ভীষণ সত্যি কথা। আর সেই কারণেই আমরা বাউল থেকে নজরুলগীতি, ডিলন থেকে আর.ডি. শোনার সাহস রাখি। সবটাই আমার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট।
তোর গানের ঘরানা কি?
- কান্ট্রি মিউজিক। ট্র্যাডিশনাল কিন্তু অলওয়েজ সেলফ্ ডিফাইনিং একটা ঘরানা। অ্যান্ড আমি তার সঙ্গে সঙ্গে একটু ইলেকট্রনিকা যোগ করি। এটাই।
একতারা তো ইলেকট্রনিকা নয়। তবু একতারা যে মিউজিক ক্রিয়েট করার ক্ষমতা রাখে, সেটা কাজে ধরার কথা ভাবিস না? বাঙালী হয়ে ট্রিং ট্রিং করে গীটার বাজিয়ে ইংরিজি গান গাস পাবে, ইচ্ছে করে না নিজের রুটে ফিরতে?
- (হেসে) ইংলিশ মিউজিক আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। ওটা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি, হচ্ছি। তাই ওটাতেই স্বচ্ছন্দ। বাঙলা গান নিয়ে একদম যে ভাবছিনা তা নয়। হ্যাঁ ভাবি। ইদানীং বাঙলা গান গাইতে ইচ্ছেও করে। অনেকেই বলেওছেন। দেখা যাক। তবে এক ধরণের সমালোচক আছেন যারা এটা নিয়ে নাক সিঁটকান। কি আর করা যাবে? আমি ইংরিজি মিডিয়াম স্কুলে পড়েছি। দশটা শব্দ বললে আপনা আপনিই পাঁচটা শব্দ ইংরিজি বেরোয়। এই নিয়ে আমার কোন অসুবিধে নেই। তোমার থাকলে বল? আমি ন’টা বাঙলা শব্দও বলে দিতে পারি গড়গড় করে। বয়জোন-এর ‘ওয়ার্ডস’ শুনেছি প্রথম প্রেমিকের দেওয়া সিডিতে। তো সে হেন আমি আইরিশ কান্ট্রি নিয়ে তো চর্চা করব, এটাই স্বাভাবিক। ব্রায়ান অ্যাডামস বুড়ো হয়ে গেলেও আমার ইংরিজি গান শোনাটা বুড়ো হবে না। আবার পাশাপাশি পরশপাথর ও শুনেছি রীতিমতো। জতুগৃহের ‘অর্জুন সেন’ শুনেছি। আবার ডাইডোর গান শুনছি। একটা মানুষ নিজে গীটার বাজাচ্ছে, মিউজিক অ্যারেঞ্জ করছে, আবার এতো ভালো গানও গাইছে। এগুলো দেখে গান গাওয়ার সাহস পাই। নিজে গান লিখেছি, লিখছি। গান গেয়েছি, গাইছি। ‘পপ্ টক মেশিন’-এর সঙ্গে এই সদ্য কাজ শুরু করেছি।
তোর কাছে মিউজিক ব্যান্ড কি?
- আ গ্রুপ অফ মিউজিশিয়ান হু শুড অ্যাক্ট ফর দ্য সেম ইন্টারেস্ট। সেটা হারিয়ে গেলে খুব মুশকিল। যেটা আজকাল প্রায়ই দেখি।
বাঙলা মিউজিক তোকে কি দিল?
- মহীনের ঘোড়াগুলি নিয়ে আমি খুব দুর্বল। ওটা না থাকলে বাঙলা গান আজ এখানে আসত না। তুমি সুমন, অঞ্জন, ভূমি, চন্দ্রবিন্দু যাই বল না কেন, গৌতম চট্টোপাধ্যায়রা না থাকলে বাঙলা গান এই স্ট্যাচারে পৌঁছতেই পারতনা। একটা সময় গেছে যখন বাঙলা গানে প্রেম আর রাজনীতি একসঙ্গে ঢুকতে পারছে না। আলাদা আলাদা করে ক্ল্যাসিফায়েড হয়ে যাচ্ছে- এটা প্রেমের গান, ওটা জনগনতান্ত্রিক গান। এখন তো সেটা বদলেছে। ভীষণ ভাবে বদলেছে। আর এই বদলটা এনেছে মহীনের ঘোড়াগুলি। আর প্রতুল মুখোপাধ্যায়। প্রথম ভাবতে শিখিয়েছে যে খালি গলাতেই মিউজিক হয়। যাই হোক, আমার হাসি পায়, যে এতো মানুষ কবীর সুমনের জন্য প্রাণপাত করে ভালোবাসা বেচে বেড়ান, আবার সুমনকে রাজ্য সরকারের পুরস্কার নিতে দেখলে সুমনকে গালাগালি করেন। বাঙালীর দ্বিচারিতা নিয়ে বলতে গেলে আড্ডাটা মাটি হবে। বাদ দাও ওসব।
চল, সিগারেট খেয়ে আসি।
- চলো।
[বিরতির পর]
এখন বাঙলা সঙ্গীত মুভি ইন্ডাস্ট্রি বেসড্ হয়ে গ্যাছে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিউজিক সেভাবে হচ্ছে না। এটা আমার ধারণা। আজ অনুপম রায় সোলো এ্যালবাম বের করলে যত মানুষ শুনছে, তার থেকে বেশি শুনছে ওর প্লে-ব্যাক।
- কি করা যাবে? মানুষ নিচ্ছে। তাই হচ্ছে। সত্যি, ফ্রি মিউজিক হচ্ছে না। আমি যদি আমার চারটে গান একটা ফিল্মে ঢুকিয়ে দিতে পারি, কমার্শিয়ালি আমার সাকসেসের সম্ভাবনা বেশি। এই ফর্মুলায় সবাই ঢুকে পড়ছি। সেটা ভালো না খারাপ আমি এখুনি বলতে পারবনা। সময় বলবে। এই যে পার্ক স্ট্রীটে বসে আছি আমরা, আজ মিউজিক ওয়ার্ল্ড উঠে গেল। বাঙালী কিছু বললনা। এসব নিয়েই চলছি। হয়তো বেটার কিছু আসতে চলেছে। হয়তো গান হিসেবে আমরা খুব খারাপ কিছুই করছি বা করতে চলেছি। কিন্তু মনে রেখো, মিউজিক উইল বি দেয়ার। তুমি গান না লিখতে পারলেও তখন যে ব্যথাটুকু থেকে যাবে, ওইটার একটা মিউজিক আছে। ঐটুকু নিয়েই কোনও একদিন ফিনিক্সের মতো কেউ একটা দুর্দান্ত গান লিখে ফেলবেন। আমি, নয়তো তুমি। লিখবে, লিখবেই। আমার বিশ্বাস। এই বিফোর আই সাউন্ড ড্রাঙ্ক, এই রেকর্ডারটা বন্ধ কর। অনেক কথা বললাম। ওরে বাবা, উফ! চল, সামপ্লেস এলস্ থেকে ঘুরে আসি।
Listen to paromita ray @ the link below
সূচীব্যথাপত্র
Pain-একটু হোক ইংরিজি
অনুগল্প
এটা গল্প হলেও পারত
কী-ওয়ার্ডে ব্যথা
ব্যথার অ্যাবস্ট্রাক্ট
Bong Pen-এর মডেল পৃথিবী
পার্ট ভুলে গিয়ে
সি রি য়া স ঋ সা র্চ
আড্ডা, সাবেকী ভাষায় Interview
আমার জীবন থেকে উঠে আসা সুর
এখনো অ্যানাউন্সমেন্ট হয় নাই, আসবে কি না জানা নাই
Comments
Post a Comment