মোহ (কবিতা) ১১- মতামত ১





মতামত
| |

মোহ (কবিতা) ১১’র প্রথম পর্ব- ঘুরে-ফিরে দেখা | সৌম্যজিৎ চক্রবর্তী


একটি কবিতার রিভিউ করে, কবির লেখা-কে বা কবিকে চেনার চেষ্টা না করাই শ্রেয়। কবিতার আদ্যোপান্ত একখানা বই যদি বা পাওয়া যায়, তবে তার রিভিউ করে একধরণের সুখ মেলে। তবে, আপাতত দায়িত্ব যেহেতু সীমিত, তাই পাঁচজন ভিন্ন কবি’র কবিতাই এই লেখার বিষয়বস্তু। এই পর্বের পাঁচজন কবি ও তাঁদের কবিতাগুলি– মৃত্যুতে | সৈয়দ সাইফুর রহমান, উচ্ছন্নে যাওয়া কবিকে বসন্তের | সুপ্রিয় মিত্র, সন্দিহান | সায়ন্তন সাহা, শ্যামকথা | মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায় আর সরীসৃপ এবং ১৮০ ডিগ্রি | মোনালিসা। কিভাবে কবিতার রিভিউ করে রিভিউয়ার, জানা নেই। বরং আমি কবিদের-কে আমার কিছু ভাবনার কথা জানাই।

প্রথমেই আসি কবি সৈয়দ সাইফুর রহমানের কাছে। কবিতায় যখন কোন গল্প বলা হয়, তখন কবিতার অনেক দায় থাকে। কেন সেই রাইটিং পিস্‌-টিকে আমি একটি নিপাট গল্প না বলে ‘কবিতা’ বলে ডাকব, সে দায় কবিকেই নিতে হয়। সেইখানে গল্পের সুতোগুলি ধীরে ধীরে যেমন ছাড়তে হয়, তেমন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে এলে আবার গুটিয়েও নিতে হয়। আপনি কবিতার সুতো ছাড়লেন আকস্মিকতায়, একটি অকালমৃত্যু দিয়ে। ঘুড়ি উড়ল, উড়তে চাইছে আকাশে, সবকিছু থেকে অনেকটা দূরে নিয়ে যেতেই পারতেন, কিন্তু আমাদের আটকে দিলেন সে যাত্রায়। বরং টেনে নামালেন অকালমৃত্যুর পরে এক পুরুষের ভাবতরঙ্গে। পুরুষটিকে দু’টি বেনাম দিলেন- একবার ‘মরা’, আরেকবার ‘অপদার্থ পিতা’। আর যে নামটি উহ্য রাখলেন, তা হল ‘যুবক’। পুরুষের স্ত্রী বিধবা হলে, বিবাহ করবেন- পুরুষকে খাটিয়ায় তোলা পুণ্যলোভীরা আবার সেই বিয়েতে পাত পেড়ে খাবেনও- এর মধ্যে পুরুষটির মহনীয়তা কেন খুঁজলেন, জানা নেই। যদি মনে হয়, এই সংসার, এই পৃথিবীটা- স...ব, সব মেকি, তবে অকালমৃত্যুর দিকে কবিতার পদক্ষেপ আমাকে কিঞ্চিৎ বেদনা দিল। কবিতায় বা কবিতার বাইরেও, এই মেকি জগতের উত্তরণ খুঁজে পেলে আবারও লিখুন জন্মগ্রহণের কোন না শোনা কবিতা।

এবারে উচ্ছন্নে যাওয়া কবির কথায় আসি। আপনি সেই জন্মগ্রহণের কথা বললেন। এ কবিতা অপেক্ষা করায়।  ‘বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার এই তো উচিত বয়স; সবার সামনে শেকল হবে হাত’- এটা কোনও একভাবে লোকনৈতিক ছন্দে আবদ্ধ হলেও হতে পারত, কিন্তু আপনি তা চান নি। ‘যেন অক্ষত জাহ্নবী তার, ঋতু ফেলে এসেছে হেমন্তের কাছে’- কবিতা পিপাসা বাড়ায়। হেমন্ত থমকে গেলেও কবিতা চলেছে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ায়- ‘মানতে চাইনি... মেনে নিতে বাধ্য করে কেউ’- এ কবিতা কেবলই ভুল ভাঙায়। এমনভাবে এগোয় কবিতা, সে চেনে নিজের অস্তিত্ব-কে, শব্দেরা কিছুকিছু বোঝাপড়া করে নেয় চেনা কলমের সাথে- ‘বৃষ্টি বারোমাসই’। শেষের দু’লাইন বড় ভালো লাগে- ‘একজন্মে অবনী বা সন্ত ছিলাম / অন্যজন্মে কট্টর ভাবে বসন্তে বিশ্বাসী’। যে কথা আর পাঁচজনে বলে, আমিও বলি সে কথা- কবিতা মানে তো কেবল কোথাও একটা পৌঁছে যাওয়া নয়, কবিতা এক ধরণের যাত্রা, জার্নি। এমন যাত্রায় আবারও বেরিয়ে পড়ুন সুপ্রিয়। আড়াল থেকে দেখব না হয় খানিক।

আমি রীতিমতো সন্দিহান, বয়সের সাথে ভাবনার কোন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে কি না। সায়ন্তনের কবিতায় এক ধরণের সদ্য কিশোরের ইমন রাগ শেখার সাথে আলাপ হল। আমি জানি না সায়ন্তনের পরিচিতি, তবু মনে হচ্ছে- লেখা আরও পরিণত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে। দুটি স্তবক দু’ধরণের এলোমেলো হলেও পড়তে ভালো লাগে, যদি সংযোগ দৃঢ় হয়। সেই দৃঢ়তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম সায়ন্তন।

মৃগাঙ্কশেখরের কবিতায় একটা ওষুধের মতো গন্ধ লেগে আছে। আছে, তিন ধাপে তিন পাহাড় পেরিয়ে যাওয়ার গল্প। যেভাবে, ঐ বিকেলের দিকটায় তন্দ্রা আসে শ্রাবণে, সেভাবে মৃগাঙ্কশেখরের শ্যামকথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে বিনুনিতে কতটুকু জট, কতটুকু স্বাধীনতা। এ কবিতা তো সংকীর্তন করে অক্ষরে অক্ষরে। অষ্টতর শত প্রজ্জলিত করে নীলটুকু জড়িয়ে থাকে গায়ে-হাতে-নাকে-মুখে। কবি লিখছেন, ‘দেখি মাগো আমারই জঠরে / সহমরণের পথে তুমি’- এভাবে কবিতায় খোল-করতাল পাঠ বিরল বলেই মনে হল শূন্য দশকের ঘরানায়। তিন পাহাড় পেরোতে হবে, তাই কবি নিয়ে এসেছেন নিষাদ-কে। জন্ম-মৃত্যুর ওধারেও যদি কিছু থেকে থাকে, এ কবিতায় পাঠক খুঁজবেন সেই ‘কিছু’-টুকু। ওষুধের গন্ধ ফিরে আসে শেষ স্তবকে। এলার্ম বেজে ওঠে, তন্দ্রা কেটে যায়। মথুরায় যে দেবকী পড়ে থাকলেন, তার ঘুম কে ভাঙাবে কবি, ভোর হয়ে গেলে? আধুনিক কবিতা মানেই কেবল রাজনীতি, বসন্ত আর স্বেচ্ছাচার নয়- শিখে নিতে হয় এ কবিতার কাছে। শুধু কবিকে একটিই জিজ্ঞাসা, হ্যাশ-ট্যাগের অভিপ্রায় ঠিক কী? পুনরাধুনিক কিছু, নাকি নিছকই তিন পাহাড় পেরনোর সাংকেতিক জ্যামিতি?

জ্যামিতির কথা ইচ্ছে করেই টানলাম মোনালিসা’র সরীসৃপ এবং ১৮০ ডিগ্রির জন্য। কবিতার টেক্‌নিক্যালিটি আমি বুঝিনা। অনেকে টেক্‌নিক্যালিটির বৃহৎ আয়োজন করে তারপর কবিতা লেখেন, দেখেছি। কিন্তু আপনার কবিতা সম্পর্কে কি বলব, জানি না। কবিতা নিজেই যদি টেক্‌নিক্যাল হয়, তবে বোধহয় ভ্যান গগের থেকেও ক্যালকুলাস-কে বেশি ভালোবাসা যায়। বাসতে পারেন হয়তো অনেকেই, আমি পারিনি। আপনি তো লিখলেন ‘মস্তিষ্ক, ফুল, গাছ বা কাটারি চিহ্নে’ আপনি ভোট দেবেন না। তবে, মস্তিস্ক বিগড়ালেই বা ক্ষতি কি? উলটো পথে চললেও তো ঘুরে দাঁড়ানো যায়।

| |

Comments