Cinema: Stalker - Discussion




cinema

Film: Stalker
Director: Andrei Tarkovsky
- Titir Mukherjee 




যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না। এই অমোঘ সত্য বারবার ফিরে ফিরে আসে আমাদের নিয়তিতাড়িত জীবনে। আন্দ্রেই তারকোভস্কির ‘স্টকার’-ও সেই ভাগ্যেরই হাতে এক পুতুলমাত্র। পেশায় সে যাকে বলে ‘টুরিস্ট গাইড’, যে ইচ্ছুক যাত্রীদের নিয়ে যায় শহরের বাইরে এক বিশেষ নিষিদ্ধ অঞ্চলে, যার নাম ‘দ্য জোন’। সেখানে আছে এক সবপেয়েছির ঘর, যা কল্পতরুর মত পূরণ করে মানুষের গোপনতম ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষাগুলোকে। ছবির ঘটনা শুরু হয় স্টকারের জীবনের আর পাঁচটা অভিযানের মতই একটা গাইডেড ট্যুরের প্রস্তুতিকে কেন্দ্র করে। স্ত্রী-র মিনতি, সাবধানবাণী, অসুস্থ মেয়ের কাতর চাউনি উপেক্ষা করে ঘুম থেকে উঠে সে প্রস্তুত হয়। আজ তার খদ্দের রাইটার্স ব্লক থেকে মুক্তিখুঁজিয়ে এক লেখক আর সত্যান্বেষী এক অধ্যাপক। সেনাবাহিনীর কড়া নজরদারি এড়িয়ে তিন অভিযাত্রী এগিয়ে চলে জোন-এর দিকে; কোনো চলতি পথে নয়, ভাগ্যের আঁকাবাঁকা বন্ধুর পথে, যেখানে শুধু নিজের ষষ্ঠেন্দ্রিয়-ই সহায়। পরিত্যক্ত খাদান, অন্ধকার সুড়ঙ্গ, ভাঙা রেলপথ পার হয়ে এগিয়ে চলে তারা। স্টকারের অতিসাবধানী ভঙ্গি সন্দিগ্ধ করে তোলে তার সহযাত্রীদের।  ছবি যত এগোতে থাকে, এক অজানা আশঙ্কায় মন ভরে উঠতে থাকে। কী যেন একটা নামহীন জিনিস অপেক্ষা করে আছে ওই কোণে, কে যেন অলক্ষ্যে থেকে নজর রাখছে প্রতি পদক্ষেপের উপর। কে যেন চায় না আড়াল সরে যাক; তাই আশ্চর্য কৌশলে পথ ভুলিয়ে দেয়। বাস্তব- পরাবাস্তবের সীমারেখা ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকে; ঠিক নয় ভুল নয়, “মাথার ভেতর কোন এক বোধ কাজ করে”। নিষিদ্ধ অঞ্চলের প্রতিটি সূক্ষ্ম বর্ণনা যেন নিয়ে আসে দমবন্ধ করা একটা অনুভূতি, মনে করিয়ে দিতে থাকে চেরনোবিলের স্মৃতি। সে হারানো গ্রামে মানুষ বাস করে না আর, সেখানে শিশুরা হাসে না আর। মৃত্যুপুরীর নিস্তব্ধতায় একা পড়ে থাকে জোন। 
 
অবশেষে তিন চরিত্র এসে পৌঁছায় সেই ঘরের সামনে। সেখানে পূরণ হবে তাদের প্রার্থনা। আনমনা স্টকার শুরু করে এক গল্প, তারই পরিচিত এক মানুষের, পর্কুপাইনের, যে তাকে শিখিয়েছিল এই জোনে চলার অন্ধিসন্ধি। তার কাছ থেকে সে শুনেছিল যে এই ঘর যেন একটা অদ্ভুত ভানুমতীর খেল। ইচ্ছেঘর মানুষের ইচ্ছাপূরণ করে বটে, তবে তা নিজের প্রাপ্য মূল্য আদায় ক’রে। তার নিজের ইচ্ছের পুতুল সবাই। তাই পর্কুপাইনের ধনী হওয়ার প্রার্থনা সফল হয় বটে, কিন্তু লোভের কাছে ছোট হয়ে যায় মৃত ভাইয়ের প্রতি তার ভালোবাসা। চরম অপরাধবোধে আত্মহত্যা করে পর্কুপাইন,আকাঙ্ক্ষাপূরণের খেসারত তাকে দিতে হয় নিজের জীবন দিয়ে। অতএব “হে পথিক, উদ্বেল হইও না, ভাবিয়া চিন্তিয়া দেখ কী চাহিতেছ, যাহা চাহিতেছ তাহা সত্যই প্রয়োজন আছে কি?”

ছবির শেষার্ধে আমরা দেখি চিরঅজানার প্রতি মানুষের অদম্য কৌতূহল এবং ভয়মিশ্রিত সমীহের এক অপূর্ব মিশেল। আশ্চর্য ঘরের খোঁজে সকলেই আসে তাদের ইচ্ছাগুলোকে সফল করতে। রাইটার্স ব্লকে ভোগা লেখক আসে গল্পের রসদ খুঁজতে। বিজ্ঞানের অধ্যাপক আসে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে। আমাদের জীবন-ও তো এরকমই এক লুকোচুরি খেলা। জীবনের নানা চড়াই–উৎরাইকে জোনের মাটিতে পোঁতা ল্যান্ডমাইনের মত এঁকেবেঁকে এড়িয়ে আমরা এগোতে থাকি, জাগতিক আকাঙ্ক্ষার বোঝাকে সযত্নে লালনপালন ক’রে। অবুঝ প্রশ্নের উত্তর খুঁজি জীবনভর। কিন্তু যখন সময় আসে, তার উত্তর থেকে যথাসাধ্য মুখ ফিরিয়ে থাকি। কারণ সে উত্তর যে বড় বিষম, বড় নগ্ন, বড় সত্য। অবচেতন মনের নির্লজ্জতা ঢাকতে তাই চোখ বেঁধে নিই কাপড়ে, হয়ে উঠি এক একজন ধৃতরাষ্ট্র। গোপনতম ইচ্ছাটির স্বরূপ প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে তাই আবারও পিছিয়ে আসি দু’পা। বোঝা হয়ে ওঠে না আমরা আসলেই কী চাই।

অথচ কোথায় যেন কেউ একজন নির্নিমেষে দেখে চলেছে সবকিছু। আমাদের প্রার্থনা, আমাদের লোভ, আমাদের আশঙ্কা-কিছুই তার নজর এড়ায়না। তার সুতোর টানে পুতুলেরা ওঠে, পড়ে, হাসে, কাঁদে।  ছবির শেষে তাই স্টকারের মেয়ের টেলিকাইনেসিস ক্ষমতার রূপকদৃশ্য আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় সেই অদেখা অনামা শক্তির সামনে। নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব শিকেয় তুলে আমরা অপেক্ষা করতে থাকি এক ঐশী ভবিতব্যের।  আর এখানেই তারকোভস্কি ছবিটা শেষ করেন ট্রেনের হুইসল আর চাকার শব্দকে ব্যাকগ্রাউণ্ড স্কোরে রেখে। নিশ্চিত অথচ অজানা ভবিষ্যতের দিকে ছুটে চলা অসহায় জীবনের দৃশ্যকল্প তৈরি হয়।  | |

Comments