হারাতে হারাতে একা ( কিস্তি ২২ ) - বারীন ঘোষাল

click me
বাকি পর্বগুলি
১৯৬৬’র আগস্ট মাস থেকেই পাস-আউট ফাইনাল পরীক্ষার চাপ শুরু। অঙ্ক, ড্রয়িং, ইলেক্ট্রিকাল... সব গুলে খেতে হবে। অঙ্ক আর ড্রয়িং সবচেয়ে বেশি বিজি রাখলো আমাদের। ক্লাসের পড়াশুনোর চাপ কম। বাকি পড়াশুনো নাকে মুখে। অবসর নেই আড্ডার। ক্লাস, যাতায়াত, স্নান, খাওয়া আর পড়াশুনো কত ব্যস্ত রাখতে পারে ছাত্রদের, না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। ফার্স্ট ইয়ারের দাদাদের দেখেছি এই করতে। তারা, দাদারা ছিল বন্ধুর মত। আমাদেরটা সেকেন্ড ব্যাচ। একজায়গায় থাকা হয়নি বলে র‍্যাগিং দিয়ে নয়, হাত মিলিয়ে সখ্যতা হয়েছিল। তারা এবার মার্কশিট সার্টিফিকেট নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে কোন অনিশ্চিত জীবনের সন্ধানে। একে একে হাত মিলিয়ে বুকে জড়িয়ে চলে গেল সবাই। আর কখনো দেখা হবে কিনা জানিনা। একে একে তারা চলে যায় আর আমরা তৃষিত নয়নে চেয়ে থাকি। আমরাও এরকমভাবে একদিন চলে যাবো। সেদিন যাতে হাসিমুখে যেতে পারি ভাল রেজাল্ট নিয়ে তাই তো দাঁতে দাঁত চেপে নেমে পড়া। পাশ তো করতেই হবে এবং ভাল নম্বর নিয়ে। চাকরির কম্পিটিশনের চিন্তায় কেঁপে উঠি। একবার মিলিটারিতে চান্স পেয়েছিলাম শরীর দেখিয়ে। ইন্ড্রাস্টিতে তো তা হয় না। এরমধ্যে শুনছি ইন্ডাস্ট্রির বাজার খারাপ। স্লাম্প চলছে। সরকার কলেজ বাড়িয়েছে, ইন্ডাস্ট্রির ধকল সামলাতে পারেনি। শালা। চাকরি মেলাই কঠিন। তাই জোর লাগাও হেঁইসা। আমার কিছুটা আত্মবিশ্বাস ছিল যে জামশেদপুর পুরোপুরি শিল্পাঞ্চল। সেখানে কি আর জুটবে না কিছু ? কিন্তু সেই বাড়ির শাসনে ফিরে যেতে ইচ্ছা করছিল না। বেরিয়ে যেতে হবে, সেজন্য চাই ভাল রেজাল্ট। সবাই তাই ভাবে। তাই কম্পিটিশন হবে ভারতের সব ছাত্রদের মধ্যে। অতএব লেগে পড়ো বারীন।
    পুজোর ছুটিতে বাড়ি গেলামনা। বরং একটু টেনশনমুক্ত হবার জন্য ভাবলাম বাইরে বেরিয়ে পড়া যাক। ডুয়ার্স ডাকছে। হয়ত এই শেষ বার। ভীম সঙ্গে চলল। পথে ভীমকে ভাল লাগে কারণ সে বকবক করে না। বলি, চল ময়নাগুড়ির দিকে যাওয়া যাক। ওখানে গিয়ে ঠিক করব কোথায় যাওয়া যায়। তিস্তা, নৌকা আর ময়নাগুড়ি। এবার জল বেশি। নৌকা দুলছে। আমি আঁকড়ে ধরি কাঠের বেঞ্চ। করলার কথা মনে পড়লেই শিউরানি আসে। ভুলতে চাই। সিগারেট ধরানো যাচ্ছে না। যা হাওয়া। আসলে টেনশনমুক্ত হবার জন্যই এই বেরিয়ে পড়া। আমাদের কাছে ওপারটাই ময়নাগুড়ি। কিন্তু আসলে ময়নাগুড়ি আরো ৫ কিলোমিটার পুবে। পৌঁছে একটা চায়ের দোকানে লুচি ফুলকপি আর জমিয়ে চা খেলাম। সিগারেট। আঃ। 
    --- বুঝলি ভীম, দু-বোতল রক্সি কিনে নেবো। দুজনে একটা একটা। কম বেশি খাবার প্রশ্ন থাকবে না। সঙ্গে রাখব আর খাবো যখন খুশি। তুইই ভরসা। 
    --- শালা, রক্সির বেলায় আমাকেই জোগাড়ে পাঠাবি কেন ?
    --- নেপালি মাল, না ? তুই চিনবি ভাল, তাই। যাক গে। নেতাজীর শেষটা মনে আছে ? 
    --- হ্যাঁ। প্লেনে জাপান যাবার পথে উত্তর আসামে পাহাড়ের ওপর গুলিতে প্লেন ভেঙ্গে গেলে আর তাঁকে পাওয়া যায়নি। আরো অনেক গল্প আছে। কোনটা যে ঠিক জানি না।
    --- লেটেস্ট শোন। শোলমারি আশ্রমের সাধু নাকি নেতাজী। এই নিয়ে কাগজে হল্লা। চল আমরা নেতাজীর দর্শন করে আসি। একজন মহাপুরুষের দর্শন তো পাওয়া যাবে। আমরা যা ফালতু, অন্তত একবার জীবনটা সার্থক করি। চাই কি পরীক্ষার জন্য আশীর্বাদও পেতে পারি। উনি অনেক পড়াশোনা জানা মানুষ। খুশি হবেন। চল। যাবি ?
    --- এক পায়ে দাঁড়াবো ? অফ কোর্স। একটু উত্তেজনা চাই গুরু। গাটা ম্যাজম্যাজ করছে। মাল আনা যাক। কি বলিস ?
    ভীম গিয়ে রক্সি জোগাড় করে আনলো দু বোতল। মানে পাঁইট। নিয়ে এলে বোতল খুলতে যাবো, খাবারের দোকানদার হাঁ হাঁ করে উঠল। --- এখানে না এখানে না ভাই। বাইরে যান।
    --- ব্যাটা বোঝে না ফুর্তি কাকে বলে। কাউকে খেতে দেখলেও তো সুখ হয়। হয় না ? ভীম ?
    সামনের গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে দু ঢোঁক খেয়ে আমরা সাইকেলে উঠলাম। বোতলটা দড়ি বেঁধে সাইকেলের রডে ঝোলানো। কোন ব্যাগ বা জামাকাপড় কিছুই তো নেই সঙ্গে। দশটা বাজে। রোদ তেমন নেই। কোথাও কোথাও ঢাক বাজছে শুনে পুজোর কথা মনে পড়ে। আমরা হোস্টেলে মাত্র জনাকয়েক বলে পুজোয় জলপাইগুড়ি শহর চষতে যাবার সাহস ছিল না। উৎসাহও নেই। দেখলাম পুবদিকে চলেছি আমরা। ডুয়ার্সের পথ নয় এটা। নেই সেই আকাশ মাটির সবুজ আর সুগন্ধ। রাস্তা ভাল না। চুড়া-ভান্ডার চা বাগান এসে গেল। ছোট। হুসলুরডাঙ্গা। জলঢাকা নদী। আরে ! সেই ঝালুং-এর জলঢাকা ! অরেঞ্জ তো নেই, মনে পড়ল। নেমে পাড়ে বসে খানিকটা রক্সি খেলাম। --- তিস্তার মতো এই নদীকেও আমি ভালবাসি ভীম। কত স্মৃতি ! ঝালুং-এর কথা মনে পড়ছে। কিছুক্ষণ পর ভীম বলল --- সাড়ে বারোটা বাজে রে। আমরা প্রায় ২০ কিলোমিটার এসে গেছি। 
    --- ইঞ্জিনীয়ারের ওই হিসেব। আমার জন্য না। নো চিন্তা। ডু ফুর্তি ম্যান। নেতাজীকে দেখতে হলে চোখ মন সব হাইটে নিয়ে যেতে হবে না ? দাঁড়া কাউকে জিজ্ঞাসা করি শোলমারির রাস্তা কোনটা। এবার কোন মেয়েকে জিজ্ঞাসা করব। যা এক একখানা চেহারা। ভগবান এদের সুন্দরী করেনি কেন বলতে পারিস ভীম ?
    বদখত দেখতে একটা মেয়ে ইশারায় দেখিয়ে দিলো। বললাম --- তুমি কথা বল না ? নাম কি তোমার ? এই গ্রামে থাকো ? স্কুলে পড়ো ?
    --- না কলেজে। আমার নাম সুমনা। 
    আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। বলে কী ! সুমনার এই ছিরি ! তাও কলেজের মেয়ের সাথে খাপ খোলা ? ভীম হেসে উঠল। মেয়েটা সেই বিটকেল হাসিতে অপ্রস্তুত হয়ে কেটে পড়ল।    
    তবু উঠলাম। আবার সাইকেল। হুসলুরডাঙ্গা থেকে জলঢাকার ডাউনস্ট্রিমে চললাম, পুব দক্ষিণ বোধ হয়। সূর্য ছায়া দিচ্ছে তাই দেখে অনুমান। আরো ঘন্টা খানেক চালিয়ে পৌঁছলাম জাবারামলি। নামও শুনিনি এসব জায়গার। পুরোটাই জঙ্গল প্রায়। পাকা সরু রাস্তা। কোন গাড়িঘোড়ার চিহ্ন নেই। মাঝে মাঝে সাইকেল। পথে মানুষজনও কম। ডুয়ার্সের থেকে উল্টো দিকে যাচ্ছি। ডুয়ার্সের কথা স্মরণ হতেই মনে হল শুধু চা বাগান আর শালের জঙ্গলই কি ডুয়ার্স ? এর জনজীবনের কিছুই তো দেখলাম না। শুনেছি এসব জায়গায় কেবল বাঙালরা নয়, বেশির ভাগ মানুষই ট্রাইবাল। রাজবংশী, টোটো, কামতাপুরি, আরো কত মানুষ থাকে তাদের বিভিন্ন কালচার নিয়ে। সে সব দেখলাম না তো ! আবার শুরু করতে হবে এই ভ্রমণ। কিন্তু সময় যে ফুরিয়ে এল। কয়েকমাস পরেই তো জলপাইগুড়ি ছেড়ে চলে যাবো চিরতরে। হায় ! 
    অবশেষে এসে পড়লাম একটা বেড়ায় ঘেরা বড় জমির পাশে। ভেতরে চাষবাসের চিহ্ন। দু একটা কুটির। গেটে লেখা “শোলমারি আশ্রম”। সারা পথে কোথাও কোন দিকচিহ্ন বা সাইনবোর্ড ছিল না। কাউকে জিজ্ঞাসাও করিনি আশ্রমের কথা। বললাম 
    --- ভীম, কি দারু খাওয়ালি রে ! আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে বাবাজীর টান। জয় নেতাজী। জয় নেতাজী। গড় করি আয়। ইনি দয়া করলে আমাদের পড়াশোনার চাপ কমবে।
    --- নাটক না করলে বারীন তোর চলে না। বোতলটা শেষ করে দেয়া যাক, চল। সে সাইকেল স্ট্যান্ড করেই শুরু করল। আমিও। চোঁ চোঁ। গেটের বাইরে বসে সিগারেট ধরিয়ে দম নিচ্ছি, ভেতর থেকে একজন বলল --- কি চাই ? এখানে কেন ?
    --- আজ্ঞে, অনেকদূর, সেই জলপাইগুড়ি থেকে এসেছি সাধুজীর দর্শন করতে। আমরা ইঞ্জিনীয়ারিং স্টুডেন্ট। পরীক্ষা সামনে। আশীর্বাদ নিতে এসেছি।
    --- আসুন। সিগারেটটা ফেলুন। উনি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বিশ্রামে যাবেন। 
    ভেতরে সাইকেল লক করে এগোলাম আমরা সেই লোকের সঙ্গে। একটা দোচালা ঘরের দাওয়ায় আমাদের বসতে বলল। ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন সাধুজী। মাঝারি হাইট, দোহারা চেহারা, গেরুয়া পরিধান, সৌম্যকান্তি। তার জন্য একটা আসন এনে দিলো সেবকটি। আমরা তাকে স্পর্শ না করে, মেঝেতে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। তিনি বসে বললেন 
    --- বলুন, কে আপনারা। আগমনের হেতু ? খবরের কাগজের নয়তো ?
    --- আজ্ঞে, আমি বারীন ঘোষাল, আর এ ভীম প্রধান। আমরা জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের ছাত্র। সামনে পরীক্ষা। এলাম আপনার কাছে আশীর্বাদ নিতে।
    --- অবাক করলেন ভাই। নাকি অন্য কিছু ? এই ৪০ কিলোমিটারের মধ্যে আর কোন সাধু পেলেন না ? আমি তো দক্ষিণা না নিয়ে আশীর্বাদ দিই না। আসল কথাটা কি ?
    --- কলকাতার কাগজ বলছে আপনিই নাকি নেতাজী। সেই টানেও এসেছি আরকি। তিনি মহান পুরুষ। বিদ্বজন। দেশের জন্য কত লড়াই, ত্যাগ ! চোখের দেখা দেখবো না ?
    --- আমার বয়েস দেখেছো। নেতাজী বেঁচে থাকলে ১৯৬৬-তে কত হতো ? আর আমি ?
    আমাদের নস্যাৎ করে দিলেন। এখানে মন্দির দেখে আশা হয়েছিল হয়তো হিমালয়ের শিব ঠাকুর তার প্রাণ রক্ষা করেছিল, তাই এখানে শিবমন্দির তৈরি করে তার আরাধনা করা হচ্ছে। বাবাজী হয়তো শৈব এখন।  আমরা মিথ্যে গল্পও বানাতে পারছি না। মোটেই আলাপি নন তিনি। তার ওপরে নাক চাপা দিলেন আমাদের মুখের গন্ধ পেয়ে। উঠে যেতে হবে। এখানে খাবার দাবারের গন্ধও নেই। পেটে খিদে। উঠে পড়লাম আর বিলম্ব না করে। মোটেই নেতাজীর মতো দেখতে না, সিওর। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে আশীর্বাদ না নিয়েই বেরিয়ে এলাম সাইকেল নিয়ে। বিদায় শোলমারি। বিদায় নেতাজী। 
    একটাও ভাতের দোকান নেই আশেপাশে। আবার সাইকেলে উঠে এগিয়ে চললাম জলঢাকার পাশ দিয়ে দক্ষিণমুখী। আরো ২ কিলোমিটার গিয়ে পৌঁছলাম রানিরহাট-এ। এখানে দোকানপাট আছে। একটা দোকানে খেতে বসলাম। ৪টা বাজে। ভাত ডাল ঘ্যাঁট, বোরোলি মাছের ঝোল। শেষবেলায় তোফা খেলাম। সাড়ে চারটা বাজল। এরপর ৪২ কিমি সাইকেল চালিয়ে ফেরা যাবে ? রাতের বেলা তিস্তায় নৌকা পাবো ? ইতস্তত করে রওনা দিলাম। যা থাকে কপালে।
    ফেরার পথে আমরা কথা বলছিলাম না। চুপচাপ। আমাদের সাথে সাথে আমার মনও চলেছে। নেতাজীর সাথে পেঁয়াজি মারতে যাওয়া ঠিক হয়নি। যদি সত্যিই নেতাজী হতেন তাহলে ? ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। বাপরে ! সাক্ষাৎ নেতাজী ! কথা বলার যোগ্যতাই নেই আমার। রক্সি না খেলে এতটা হিম্মৎ হতনা এমনকি ভাবারও। রিল্যাক্স হলাম, তবুও মনের খচখচ কি করে যাবে ? একটু ভাল ভাল কথা ভাবা যাক। আশেপাশের জঙ্গল একটু পরেই অন্ধকার হয়ে যাবে। এই আজকের আসাটায় কোন সুন্দর দেখলাম না। একটু সুন্দরের কথা ভাবা যাক। সুমনার কথা। ধরা যাক ভীম নয়, আমার পাশে সাইকেলে সুমনা। না না। আমার সাইকেলে। সামনের রডে বসা। শালোয়ার কামিজ। সুগন্ধ যেমন তার গায়ে। নাকে ফুল। ঠোঁটে লিপস্টিক, না লিপস্টিক নেই। চুল খোলা, পিছনে উড়ছে, আমার মুখে, আমি নাক ঘষে দিলাম মাথায়, ...... থাম শালা। আর ন্যাকামি করতে হবে না। নিজেকেই বকলাম জোরে। ভীম চমকে উঠল।
    --- কি বলছিস রে ?
    --- চা খাবো।
    --- খা না।
    --- কোথায় খাবো ?
    --- চালাতে চালাতে লক্ষ্য রাখ। দোকান পাবি। আমিও টায়ার্ড হচ্ছি। রক্সি হলে হতো না ?
    --- তাই হোক। আর পারছি না। এরকম বোর কখনো হইনি আগে।
    --- মাইরি। বলতে বলতে শোলমারি ছাড়িয়ে এসে পড়েছি জাবরামালিতে আবার। ভীম জোগাড় করে নিয়ে এল দু বোতল রক্সি। আগে চা খেলাম। সিগারেট। তারপর জলঢাকার পাড়ে বসে আমরা বোতলে মুখে। সুমনার মুখের টেস্ট মনে পড়ল। জয়তীর। মায়ের কথা। পরীক্ষার কথা। রেজাল্টের কথা। মুখ ব্যাজার হচ্ছে টের পাচ্ছি। ঘন্টা খানেক। বোতল শেষ। একটু দ্রুতই খেলাম। ময়নাগুড়ি পৌঁছে দেখি শেষ নৌকা চলে গেছে, এবার এপারে থেকে যেতে হবে দেখছি। পকেটে তো পয়সা নেই। অগত্যা চল থানায় যাই। সেখানে গিয়ে বড়বাবুকে জানালাম আমাদের আর্জি। থানার বারান্দায় শুতে চাই বললাম। দারোগার কি গন্ধবোধ নেই ? হতেই পারে না। ভয়ে ভয়ে ছিলাম, এই বুঝি হাঁকিয়ে দেয়। কিন্তু এসব অঞ্চলে ইঞ্জিনীয়ারিং-এর ছাত্র শুনলে খানিকটা রেয়াৎ করে। জলপাইগুড়ির মারকুটে হিংসুক ছেলেদের মতো না। রাজি হইয়ে গেলেন। আমরা সেই বারান্দায় শুয়ে পড়লাম। রাতে মশার চোটে স্বপ্ন দেখার জো কি ? 
    পরের দিন সকাল সকাল রওনা। পথে চা। নৌকায় বসে ভাবছিলাম এযাত্রার কথা। পুরো ট্রিপটায় কখনো মনে হয়নি পকেটে পয়সা নেই। অথচ তোফা দুদিন কাটল কোন জামাকাপড় গামছা, রেস্ত ছাড়াই। এ সেই আমার বাবার শিক্ষা। ফালতু খরচ করার পয়সা পকেটে না থাকাই ভাল। পকেটে বেশি পয়সা থাকলে কামড়ায় কিনা একবার দেখব নাকি ? একবার অন্তত হয়ে যাক টেস্ট। ঠিক করলাম, নৌকার দুলুনিতে ভয়ের ভাবনা বিদায়ের জন্য, এবার বাবাকে চিঠি লিখব ---- পূজনীয় বাবা, আমার স্লাইড রুল ঘষতে ঘষতে ফুরাইয়া গিয়াছে। কাজ হইতেছে না। এদিকে পরীক্ষা সামনে। ৪৫০ টাকা শীঘ্র পাঠাইও। একটি নতুন কিনিতে হইবে।
    ১৯৬৬-তেও আমরা এই ভাষায় চিঠি দিতাম। মনটা ফুরফুর করছে আনন্দে।
    তারপর আর কি ? একদিন ১৯৬৭ এপ্রিলে পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। নিজেদের মধ্যে গল্পগাছা কড়ে, সবার ঠিকানা লিখে নিয়ে, আবার দেখা হবে আশ্বাস দিয়ে ভারাক্রান্ত মনে জলপাইগুড়ি ছেড়ে বিদায় নিলা। বিদায় জলপাইগুড়ি। বিদায় সুমনা। বিদায় ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ।

( চলবে)

Comments