২১ শেঃ রিভিউ ৫




রিভিউ
|

দলছুট পত্রিকার ২১ শে কবিতার পর্ব ১১ থেকে পরবর্তী সব লেখার রিভিউ দেবার চেষ্টা করলাম।  - তাপসকিরণ রায়


১১ পর্বে আছেন কবি অনুপম, সূর্য স্নাত, নন্দিনী, পার্থ বসু, শুভ্রদীপ। অনুপমকে এ পর্বে পেলাম, তাঁর, দাস্তাইয়েভস্কির প্রতি কবিতায়। মাঝে মাঝে তাঁর ভাষাকে বুঝতে গেলে উর্বর মস্তিষ্কের প্রয়োজন হতে পারে। কিছু যেন বুঝেছি এটুকুই এখানকার বেশীর ভাগ লেখার সার সংক্ষেপসিনেমার চিত্র কল্প নিয়ে তিনি বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন--এখানে কি কিছু সিনেমার উন্মোচন কথা ধরে রাখা আছে--
//সিনেমা। থাকছে। লেখক থাকছেন
না। উপন্যাস। থাকছে। পরিচালক
থাকছেন না অথবা,ফর্সা। মহিলারা। শেকলবাঁধা ইঞ্জিনের রং
ঘুরে ফিরে দেখছেন আর
কাটটটটটটটটটটটটটটটটটটটটটটটটটট্--//
কিম্বা
//ফিমেল ন্যুড... ফিমেল ন্যুড...
আমার বাইক লোকাল, আর
ধর্মের ষাঁড়... কাটটটটটটটট্--//
//স্টার্ট নিচ্ছি হেলমেট খুলে। পিছনের পাহাড়
আমার চোখে পড়ছে না। চোখে পড়ছে না
মেয়েদের ট্র্যাফিক। আর
আভাঁ গার্দ খাবারের নুনঝালটক//
অথবা
//এইসব আছে ঢের জানি আমি অন্য কোনোখানে । রৌদ্রাভ
কাবেরীর মতো তারা নয়//ব্যাসদেব চড় মারছেন অম্বালিকার গালে। অম্বিকা
ন্যাংটো হচ্ছেন। প্লেন থেকে বোমা বেরনোর
সাদাকালো সিনে
আমার এই তো কেমন
পটি পাচ্ছে মিশকিন//
এ ধরনের লেখা বুঝে ওঠার বুঝমান পাঠক সীমিতই থেকে থাকবেন বলে আমি মনে করি। মানে আমি বলতে চাইছি যে সর্ব সাধারণের বোঝার জন্যে এ কবিতা নয়।  সাহিত্যের বিশ্বমানের কিছু কথা কি ধরা আছে তাঁর বক্তব্যে ? আর এই যে কাটাকুটির বহর ? এটা কি পুনরাধুনিক পর্যায়ের কিছু ? কিছু বোদ্ধা পাঠকের মার্জিনেই থেকে যায় এ ধরণের লেখা।
সূর্যস্নাত বসুর, বম ভাল লেগেছে। ভুক্তভোগী - নন্দিনীর লেখাও ভাল। ভাষা দিবসের কবিতা - পার্থ বসুর ছন্দ তালের কবিতা মন্দ লাগেনি। শুভ্রদীপ রায়কেও তাঁর মাতা প্রজাপতি কবিতার ভাবনায় এভাবে পেলাম--
নতুন আকাশ গড়ছি দ্যাখো, সে এক মস্ত আকাশ
তোমার প্রতিটি অভিমান-প্রজাপতি পাখিজন্ম নিক
তাদের ডানা বেয়ে আসুক ভোরের মিছিল
একটি কালো প্রজাপতি আমার খাতায় বসুক...    
১২ পর্বের কবি মিলনের, শরীর ভাল লেগেছে। অরিন্দমের তিনটি কবিতাই সহজ বোধ্য--দৈনন্দিন জীবনের কথাগুলি কবিতায় ধরেছেন তিনি--তাঁর কবিতা--যুবক--এর একাংশ এমনি--
//একাকী রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন
সঙ্গীহীন, যেন এক অনন্ত ভ্রমণ
গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা মব্যবিত্ত ইগো
ট্যাগলাইন সেঁটে দেয় ব্যক্তিজীবনে।
প্রত্যাশা আর ব্যর্থতা যেন
মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ মনে হয়! //
উদয় সঙ্করের প্রেম জাতিয় কবিতা--বেশ ভাল লাগলো--ভাব সমৃদ্ধ শব্দের সুন্দর ছবি ফুতে উঠেছে তাঁর কবিতায়--
ভায়োলিন বাজে অবিরাম কবিতায় উদয় শঙ্কর দুর্জয় লিখেছেন
//এমন করে ভেবে দেখেছো কি
এমন করে করেছো কি বিষপান?
আমাকে ভাবলে তোমার মধ্যেও
মাতানের জমাট বরফ গলে যাবে, সূর্যাস্তের শেষে
চিলন ক্যাসলের সামনে এসে নিজেকে খুজে  পাওয়ার
ইচ্ছেরা জেগে উঠবে।|//
শুভাঞ্জন লিখলেনজীবনের এক অথবা অনেক নারী প্রেমের ব্যর্থতার কথা। ভাল লেগেছে তাঁর কবিতা। এ পর্বের শেষ কবি হলেন, চয়ন ভৌমিক। তাঁর কবিতার নাম--আলাপ, সামান্য পরিচিতির বাইরেও যে অব্যক্ততা তার সঙ্গে পরিচয়ের আকুলতা  সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায়--
//বইয়ের পাতা ওল্টালেই যত কবিতা খেলা করে,
প্রথম, দ্বিতীয় আর তৃতীয় পুরুষেরা যেই অবয়ব পায়-
       রহস্যের অশরীরি জমাট ধোঁয়ায়,
স্মৃতি-মনোজালে বাঁধা পড়া ব্যাকরন মুখ-
---স্বপ্ন বুদবুদের মত উড়ে উড়ে,
         ফিরে আসা শুরু করে

             অনন্ত ইচ্ছার বাসর ঘরে।//
১৩ পর্বে--মূক চাঁদ--নির্মাল্য বিশ্বাসের কবিতা। ভাল লেগেছে। জ্যোতির্ময়ের ছোট্ট কবিতা, সংলাপ ও অসংলগ্ন, স্মৃতিকে ধরে রাখার অদম্য প্রয়াস এ কবিতার বিষয়বস্তু। ভাল লেগেছে। অভ্র্দীপ তাঁর কবিতা প্রাপ্তবয়স্কের আলপনার সংলাপ পেলাম এভাবে --
//বহুদিন আগে শিকার ছেড়েছি তবু
পোড়া মাংসের গন্ধ শোঁকা নাক এখনও
কি সুন্দর ঘ্রাণ নেয় দুধে-আলতায়
আঁকা বঙ্কিম আলপনায়...বান্ধবীর পরি হয়ে ভেসে বেড়ানোয়  ...//
রুক্মিনিকুমারের কবিতা--প্রকাশনী, লেখকের মনে নিজেকে প্রকাশের যে ভঙ্গিমা থাকে তাকে সুন্দর ভাবে প্রকাশ করেছেন কবি। লেখা শুধু কাগজে সীমাবদ্ধ থাকুক এটা কোন লেখকই চান না। তাঁর আতুর ইচ্ছা থাকে তা পাঠকের সামনে তুলে ধরার। কবির নতুন ধরণের লেখা ভাল লেগেছে। এর পরের  মাছরাঙা দ্বীপ, শুভদীপ মৈত্রের কবিতা।
১৪ পর্বের লেখক তালিকায় আছেন--অঙ্কুর, রাজেশ, রাহুল, স্বাতি, নিখিল। বাতাসে মৃত্যু ভেসে বেড়ায়, কবিতায় অঙ্কুর কুণ্ডুর উপলব্ধিতে পাই
//ক্লান্ত বৃষ্টির ম্যাগনেটিক
ধারার মধ্যেই ওর আসা-যাওয়া -
ও যে দেবী ! দেবী আটকে থাকে না ,
ক্যামেরার ফ্ল্যাশের মত ঝলসে ওঠে
. . . তারপর ছবি। ...//
সমর্পণে--রাজেশ চট্টোপাধ্যায় লিখলেন--
//ব্যালকনি আর করিডোরের
 যে শূন্যতা
সেটাই তোমার আমার...//
কবি তুমি, রাহুল রায়চৌধুরীর লেখা সুন্দর একটি কবিতা পেলাম। প্রেমের সাথে কবিতার মুক্ত মিলে তিনি রাজ পথ ছেড়ে হেঁটে গেছেন ঘাস বিছানো পথ ধরে--
//কবি তুমি আজ নতুনের কথা বল
বিষে নীল বুক অমৃত নিক খুঁজে
রাজপথ ছেড়ে হাঁটছি যে ঘাসপথে
সেই ঘাসপথ আমার কবিতা হোক
কবি তুমি দাও টুকরো সকাল রোদ...//
অথবা,
//‘রোজকার মরাছুঁড়ে ফেলি ডাস্টবিনে
যত কালো আছে দুহাতে সরিয়ে পথ
পাশাপাশি হাঁটি তোমার স্পর্শ নিয়ে
কবি হবো কবে তোমার আঙুল ছুঁয়ে
দুপঙক্তি প্রেম ভালবাসা হয়ে ওঠা|//
আবার অংক, কবিতায়--স্বাতী বিশ্বাস ভাব গভীরতায় এবং কিছুটা গুরুগাম্ভীর্যে ডুব দিলেন
//আবারও সেই থিওরির পোকা নড়ে ওঠে
যদি না মেলাতে পারি তবে কেন পিছুটান
মনুষ্যত্ব তবে কোন তত্বের ওপর দাঁড়িয়ে
কেন বার বার শুধু বিনিময় প্রথার জয়গান
দায়বব্ধতা বিয়োগ করলে হাতে তবে থাকে কি।|//
দ্বিতীয় জোসনায় লিখেছেন-নিখিল নওশাদ। অনবদ্য লিখেছেন তিনি। তাঁর ছোট বড় সব কটি কবিতাই মনে ধরে রাখার মত--
//আমি ছেড়ে এসেছি ভুলে একটা জোসনার ফতুয়া
প্রতিদিন চাঁদ খেয়ে খেয়ে সুতোকাটা মাকড়সারা
প্রসব-প্রসঙ্গে মরে গেছে বলে--
আমায় দিয়েছো রুটি,ভগ্নাংশে,ভূগোলের ভুল ভগ্নস্তুপে।
কবিতার আর এক জাগায়--
'অন্তত পৃথিবীতে,চাঁদ কখনো একটি নয়
না হলে আমার মা দ্বিতীয় জোসনার ফতুয়া হাতে
গোধূলীর গ্রামীণ কপাটে দাঁড়িয়ে আছে কেন?

দূর দেয়ালে কেন ঝুলে আছে
চাঁদ খেকো মৃত মাকড়সারা?//
নওশাদের সহাবস্থান, কবিতা অন্তর্গত ছোট ছোট কবিতাগুলিও বেশ ভালো লেগেছে। 

১৫ পর্ব মানে কবিতার শেষ পর্ব, এ পর্বের চারজন কবি হলেন--কোয়েল, সৌরভ, সৌম্যজীৎ ও সেলিম। কোয়েলের কবিতা ভালো লেগেছে। সৌরভের গতানুগতিক, তাল ছন্দের কবিতা, নিয়ম। তাঁর কবিতার ভাবগত দিকটা সুন্দর বলতে হবে--
//কীভাবে ফুরিয়ে যায় নিজেকে নিবিড় ভালোবেসে
উঠোন ধোওয়ানো গন্ধে আমি রোজ ক্লান্তি শুনি তার
মনে পড়ে, অরণ্যের পথে যেতে যেতে একবার
এক আর্ত সুর শুনে ছুটে গিয়ে দেখি বহুদূর।...//
সৌম্যজীৎ তাঁর কবিতা, অকিঞ্চিতে লিখেছেন লিখেছেন--
//জয়দেব আওড়াবে তুমিঃ ভ্রষ্ট কম্যুনিস্ট’, ন্যাকা ন্যাকা আবৃত্তি।
অকিঞ্চিৎ রাগ হবে।
আমিও যদি ভ্রষ্ট কবি সেজে নিই
সাদা জামায় সাজিয়ে রাখি বিপ্লবের
দুডিজিট তথ্য। //
২১ শে পর্বের শেষ কবি সেলিম, তাঁর, মুখ কবিতায় সারা পৃথিবীর মানুষকে তিনি বিভেদের দ্বার ভেঙ্গে একই আদল ছাঁচে ঢালতে চেয়েছেন।    
এ ছাড়া স্থান পেয়েছে একটি অনুবাদ কবিতানাম, আমি একা নই, মূল রচনায় গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রায়েল, অনুবাদ করেছেন রোশনি কুহু চক্রবর্ত্তী। একাধারে একা ও একাকারের মাঝে সব কিছু, বোঝাতে কবি এখানে লিখেছেন--
যে সব মাংসপিণ্ড আমাকে দেখে শোকাহত,
কিন্তু আমিই সে ,
যে তোমাকে জড়িয়ে রাখি
সে আমি তো একা নই ।
গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রায়েলের কবিতার সহজ সুন্দর রূপটি বাংলায় তুলে ধরেছেন রোশনি কুহু চক্রবর্তী।
সবশেষে সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে হচ্ছে যে এটা আমার সম্পূর্ণ নিজস্ব অভিমত। আমার বোধজ্ঞানের সীমা থেকেই আমার এ বিচার বিশ্লেষণ। মানুষ মাত্রেই পছন্দ-অপছন্দের ভিন্নতা থাকবে  আর লেখক কবির সব লেখাই শ্রেষ্ঠ মানের হবে এমনটা হতে পারে না। লেখাতে ভাল মন্দ ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে যেতেই পারে। অজ্ঞানে কারও মনে ব্যথা দিয়ে থাকলে তাঁর কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।|

Comments