একুশের রিভিউ - তাপসকিরণ রায়
মতামত | |
দলছুট পত্রিকার ২১শে কবিতা সংখ্যাটি পড়লাম। প্রথম পর্বের কবিতার নির্বাচন প্রথম শ্রেণীর কবিদের নিয়েই হয়েছে বলে মনে হল। এঁদের কবিতাগুলি নিঃসন্দেহে গুণমানে শ্রেষ্ঠ। এঁরা হচ্ছেন, যশোধরা রায়চৌধুরী, বারীন ঘোষাল, মলয় রায়চৌধুরী, দেবারতি মিত্র ও আর্যনীল মুখোপাধ্যায় । এর মধ্যে যশোধরার কবিতার ভালো লাগা লাইনগুলি হল—
ফুচকা চাও, খুচরো পয়সা, চাও চৈত্র সেলের কাপড়
চৌত্রিশ
সাইজের ব্লাউজের মাপে মাপে চাওয়া
এত ছোট
চাওয়াগুলি বেঁধে রাখি কী করে হাওয়ায়...,
বারীন ঘোষালের--নব শব্দায়নের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান
ভাবনাগুলিকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম করে প্রকাশ করায় এঁর জুড়ি মেলা ভার--তাঁর সুন্দর
ভাবনাশব্দের চয়নে আমরা পাই—
সেদিন আদুরে
মাদুরে রোদ পোয়ালো আমার মরাল
ড্রপ খেতে
খেতে আকাশ বানালো মেঘ
মেঘ ফেঘ
বর্ণালী গোপন করতে পারল না
পাহাড় লেখার
পরে
পাখি আঁকার
আগেও
কী রঙ
যোনিপথের যুদ্ধে...
মলয়
রায়চৌধুরীর কবিতা—তিনি হাজার বছর
আগের লেখা প্রেম পত্রের খোঁজে পৌঁছে গেছেন হরপ্পার সভ্যতায়—তাঁর কবিতায় পাই--
ঝুঁকে পড়ো
খোলা চুল লিপ্সটিকহীন হাসি কপালেতে ভাঁজ
গ্যাজেটের
গর্ভ চিরে তুলে নিবি হরপ্পা-সিলের সেই বার্তাখানা
হাজার বছর
আগে তোর সে পুরুষ প্রেমপত্র লিখে রেখে গেছে।
দেবারতি
মিত্রের সাবলীল কবিতা, নীল আরও কত, তারই বিশেষ অর্থবহ কিছু অংশ হল--
অপরাজিতা
ফুল হালকা হ’তে হ’তে
কুমারীর
নিঃসঙ্গতা,
তারপর
উলুঘাসের বনে গোপনচারী সাপ,
নীল আরো কত
যে!
কতরকম জীবন---
নীলবর্ণ
ওঙ্কারের শব্দ সমস্ত প্রান্তর জুড়ে
এরপর আছে
আর্যনীলের কবিতা—পারীতে লেখা
কবিতা--অনবদ্য ভাব-ভাবনার উদয়াস্ত যেন এখানে—
গাছের নামে
না-জানা-মোনিক তোমার
শেষ চুমু কোঁকড়ায় বিসর্জিত মানচিত্রের কোমায়
নদীর ধারে যেসমস্ত কথা হলো
প্রত্ন সভ্যতার গির্জা বা
ঝর্ণার অপর আলোকিত সমাজের
নতুন ইশারার সমস্ত ট্রিঙ্কেট মোনিক
এক রাজপথের সাথে অন্য রাজপথের উল্লম্ব
কাটাকুটি –
২য় পর্বের
কবিরা হলেন--ঈশিতা, রঞ্জন, উমাপদ, সুবীর আর আষিক।
এঁদের প্রত্যেকের লেখাই মান সম্পন্ন সন্দেহ নেই। তবু ব্যক্তিগত ভাল লাগার কথা বলতে
গেলে বলব সুবীর ও আষিকের লেখা আমার মন বিশেষ ভাবে টেনেছে। সুবীরের, আধ শোয়া বালিশের মুখ, কবিতার নাম ও ভাবনার মিলানে তিনি লিখেছেন—
বিকেলের
মৃদু গ্লাসে অনাবিল ভেসে ওঠে পাইনের ছায়া
পুরনো
বাংলোর মেঝেতে উজিয়ে ওঠে
আধশোয়া
বালিশের মুখ...
...নুড়িপাথরের ছলে ভেসে উঠি শহিদের সুখ।
আষিকের
কবিতা মনে ধরে রাখার মত লেগেছে, তিনি তাঁর কবিতা, মাতাল পঞ্চবিংশতির এক জাগায় লিখেছেন--
কিন্তু যে
সব কথা তুমি স্বপ্নেও কাউকে বলতে পারনি
সেগুলি চড়াই
উৎরাই ভেঙ্গে ধুনের বোল হয়ে যাচ্ছে
তুমি ফোন
করতে চাও
তার নাম্বার
ডিলিট করেছ ।
বহুদিন
হল
৩য় পর্বে
আছেন--ইন্দ্রাণী, ঈশিতা, স্রোতস্বিনী, অনির্বাণ ও ইন্দ্রনীল। এঁদের লেখাতেও উন্নত মানের ছাপ পেয়েছি। তার মধ্যে আমার
ভাল লাগার ভাব পেয়েছি ইন্দ্রাণীর লেখায়, ফেলে আসার স্মৃতি ধরে তিনি এগিয়ে গেছেন তাঁর, অসুখ,
কবিতায়--
ছুটি হয়, গুড়কাঠি হাতে ওরা দাদা আর ভাই
কোথায় চলেছে
আজ ?
ওদের ঠিকানা চাই ইস্কুলের গাছেদের কাছে
গানের দিন
আমায় ছেড়ে যায়, পাঠ শেষে
শুকনো পাতা
খুব উড়ে আসে চোখেমুখে—বড় মায়া হয়
ছায়া পড়ে
এলে দেখি পথ সেও চলে যায় অন্য কোথাও—
অনির্বাণের
লেখা কবিতা, অসুস্থতার মাঝে আসা ভাবনার কথা নিয়ে
লেখা,
এ্যালবাম, থেকে পাই—
আমি অসুস্থ
হলে,
কতকটা স্বগতোক্তির ঢঙে বলা
বাবার স্মিত
সাবধানবাণী
লা
হিগুয়েরার স্কুলবাড়ি থেকে আসা
শহীদের শেষ
কথাগুলোর মতো শোনায় ।
সাগর থেকে
না ফেরা ক্যামিলোর গলায়
আমি ‘ঠিক আছে’ ব’লে সরে আসি...
৪র্থ পর্বের
কবিকুল হলেন--অর্জুন, রঙ্গীত, জয়দীপ মৈত্র, জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়, দীপ্তপ্রকাশ। সবার
কবিতাই বেশ লেগেছে।
জয়দীপ
চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা, যে ভাবে খুঁজেছ, ভাল লেগেছে।
অর্জুনের কবিতা--কথা হচ্ছিল শূন্যস্থান পূরণ নিয়ে, তিনি লিখলেন—
এগিয়ে আসে।
থপথপ। কাদা পা।
গর্তের ভেতর
লুকনো গুহাবাসীদের খসড়া।
প্রচুর
জন্মের ভেতর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছি পর্দার ওপাশে।
যেন স্যুইচ
অফ আর স্যুইচ অনের মাঝখানে যতটুকু গ্যাপ
তার মধ্যে
একটা ইউনিকর্ণ নিয়ে বসে আছি...
কিম্বা
অর্জুনের অন্য কবিতা, পাখটি,তে তাঁর জোরালো ভাবনার রেশ এমনি ভাবে এগিয়ে গেছে—
তাহলে
বেলুনের কিছু বিনির্মাণ করি হাওয়ার ভেতর
যেমন
ছদ্মবেশ আড়ালের পর ঘন সবুজ রঙের একটা জন্মান্তরএসে দাঁড়ায়।
অর্জুনের
তৃতীয় কবিতা, বিসর্গও সুন্দর ভাবনা শব্দের
সমন্বয়।
৫ম পর্বের
কবিবর্গ হলেন--শৌভ, উল্কা, আসমা অধরা, সুপ্রিয় আর দূর্বা।
উল্কার কবিতা--পোস্ট দি ক্যাফে কিম্বা আসমার--হাত ভর্তি কুয়াশার, কথা স্মরণ রাখার মত। সবার ভাল ভাল কবিতার মধ্যে উল্কার
পোস্ট ভি ক্যাফে—
নিজেকে
নিষ্ঠুর খুনের পর
ইশাদী সেজে
উল্টে দিলাম
দুপাতা চোখ...
আসমার
কবিতা--হাত ভর্তি কুয়াশা—এখানে কবিতার
নামটাই যেন একটা পূর্ণ কবিতা বলে মনে হয়—তাঁর ভাবনার
পাত্তাড়ি এমনি ভাবে এগিয়ে গেছে--
যোগমায়া
জানে ভিতরবাড়ীতে পুড়ে যাচ্ছে শুভ্রসঙ্গম, আকাশ
থেকে খসে
পড়া তারাদের ডানা অথবা আয়ুশাপে বিলম্বিত হয়
উল্কাপতন।
গায়ে অতিরিক্ত জ্বর পোহায় বেলাভূমি তবুও
কাঁকড়াদের
ছানাপোনা পিপীলিকার মতো ছড়িয়ে যায়, গুটিগুটি
হাঁটে।...
সব শেষে জানাই এটা আমার
সম্পূর্ণ নিজস্ব অভিমত। আমার বোধজ্ঞানের সীমা থেকেই আমার এ বিচার বিশ্লেষণ। মানুষ
মাত্রেই পছন্দ-অপছন্দের ভিন্নতা থাকবে আর
লেখক কবির সব লেখাই শ্রেষ্ঠ মানের হবে এমনটা হতে পারে না। লেখাতে ভাল মন্দ ত্রুটি
বিচ্যুতি থেকে যেতেই পারে। অজ্ঞানে কারও মনে ব্যথা দিয়ে থাকলে তাঁর কাছে আমি
ক্ষমাপ্রার্থী। |
Comments
Post a Comment