বন্ধুদের কথাবার্তা ৪


রাজর্ষি দাশ ভৌমিক
৪.

যে মানুষের জীবনে কোন উদ্দেশ্য নেই সে মানুষের জীবনেও রাজনীতি থাকে। এমন চরিত্রদের শহরের ঘোলাতে পাকস্থলীর মধ্যে খুঁজলেই পাওয়া যাবে, তাদের নিয়ে দু-দশটা গল্প বা মাঝারি মাপের একটা উপন্যাস লিখে ফেলা কোন ব্যাপারই না। তবে কিনা এ কলামের নিয়তি চরিত্রদর্শনের নয়, চরিত্রদের খোঁজে ব্যাগপ্যাক নিয়ে অযোধ্যা থেকে বাগডোগরা ঘুরে বেড়াইনি-বন্ধুতার খোঁজে ঘুরে বেড়িয়েছি। তারা নাটকীয় না হতে পারলে সে তাদের দায়, তারা অসফল হলে তা তাদের দায় তারা বাগাড়ম্বরহীন হলে তা তাদের দায় আমি কেবল বন্ধুকৃত্যে হাত পাকিয়ে রাখছি। না হোক তারা লেখার মত জবরদস্ত চরিত্র, তাদের সঙ্গগুলিকে লিখনযোগ্য মনে হয় তবু। এমন এক বন্ধু রাজনীতিও করে। নাম তার কাকাদা।

আমি জানি না ইনিই সেই আদি অকৃত্রিম কাকাদা কিনা!প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের দরদালানের আড়ালে, অচলায়তনের ঘুগনি যার খাদ্য, সুউচ্চ ডিসি পাখার ঘর্ঘর যার কর্ণকুহরের সঙ্গীত, যেকোন ডিকলেজিয়েটের যিনি মসিহা, সদ্য পার্টি ইউনিটে নাম লেখানোর যিনি আদর্শ, চাপদাঁড়ি রাখাদের যিনি প্রতিদ্বন্দ্বী, বহুকাল মেস বাড়িতে থেকে যাওয়ার যিনি গোপন ভয়। তিনি মুখে বলবেন তিনি নবারুণকে চিনতেন, স্বাতীদিকে নিয়ে দুতিনটে মুখরোচক গপ্পো তার নখদর্পণে, রাজনীতিতে আগ্রহী বুঝলে বাতলে দেবেন সেকেন্ড হ্যান্ড রেডবুক কোথায় পাওয়া যায়, সিনেমায় ন্যাক দেখলে এ কে হাঙ্গলের কথা পাড়বেন, গায়ক বুঝলে গাইবেন-হ্যামে তো লুঠ লিয়া মিলকে হুসনেওয়ালোঁ নে, গোরে গোরে গালো নে, কালে কালে বালোঁ নে, ম্যাথ অনার্স দেখলে শকুন্তলা বড়ুয়ার বইয়ে পড়া ধাঁধার উল্লেখ করে চমকে দেবেন। তিনিই যাদবপুরে সুসি, প্রেসিতে আইসি আর শিবপুরে সিপি। তাঁর বর্ণনায় আমি বৈশম্পায়ন হয়ে যাব তবু তাঁর অবতারকল্প শহরের তৃতীয় ধারা রাজনীতিকে সিডিউস করে চলবে। তরুন কবি কমিউনে মদ খেয়ে জীবাশ্মের ভাষা পড়বে-বিপ্লব যখন করেছিল সবে তুমি ছিলে পুরোভাগে, ধরপাকড়ের মাহেন্দ্রক্ষণে তুমিই ভেগেছো আগে!

সেবার মাঝরাতে রাম খেয়ে আবেগজর্জর হয়ে একটা বেফাঁস মন্তব্য করে বেশ ফেঁসে গেছি। প্রানাধিক প্রিয় বন্ধুরা অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে। অধিকার্থে ক্যান্টিনে গাঁটের কড়ি খরচা করে চাউমিন খাওয়াতে চাইলেও কেউ আমন্ত্রন গ্রহন করতে রাজি হচ্ছে না। এমন একটা ভাব চোখেমুখে যেন ভাজা-ম্যাগগির প্লেট থেকেও বিশ্বাসঘাতকতার গন্ধ আসছে। সন্দীপন খুলে দেখাচ্ছি-যা বলেছি তা তো আর আমার কথা নয়, সন্দীপন এমনটাই লিখে গেছেন। আমি মওকা বুঝে গুঁজে দিয়েছি মাত্র। সেকথাও কেউ মানবে না, যদি বিশ্বাস নাই করি তবে মন্তব্যটাই করবো কেন!সম্পর্কের ভিত্তিগুলিই টলমল হয়ে গেছে-যা বন্ধু পাতিয়েছিলাম তাতে যেন রক্তের টান ছিলই না। মনমরা হয়ে ছাদে বসে থাকি, দূর দূর গেরস্থবাড়ির আলো দেখা যায়। ভালোই লাগে। মনে পড়ে হইহুল্লোড়ের বাইরে মফস্বলেও আমার একটা বাড়ি আছে। সুপারি গাছের ছায়া পড়ে সেই বাড়ির দেওয়ালে। সব হেরে যাওয়ার পরেও সেই বাড়ির দুজন মানুষ আমাকে বুকে টেনে নেবেন।

কাকাদা আমার খোঁজ করতে করতে ছাদে উঠে আসে। কাঁধে চাপড় মেরে বলে-কাল পরশু তো বনধ্‌, সেটা আরো বাড়তে পারে-অনির্দিষ্টকাল। চল বাজারটা গুছিয়ে রাখি।

হস্টেলের টেলিভিশানে জিতেন্দ্র-ধর্মেন্দ্র চলে শুধু, তা বাদে ঝিরঝির। বাইরের দুনিয়ার খবর রাখা হয় না। অবাক হয়ে জানতে চাই-হলোটা কি?

কাকাদা বলে-নন্দীগ্রামে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। এই তো হাজরার মিছিলে হেঁটে এলাম। চল বেলাবেলি থাকতে বেড়িয়ে পড়ি।

কাকাদার সঙ্গে পথে নেমে আসি। ঘরেবাইরে এমন অশান্তি, ভাবি এসবের খুব কাছাকাছি থাকাই শিল্পের ধর্ম। লড়াই, বনধ্‌, টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটছে আর ছত্রিশ ইঞ্চির ছাতি নিয়ে প্রেমিকাকে আড়াল করছি কোন অফিসবাড়ির সিঁড়িঘরে-চোখেমুখে ধোঁয়া হয়ে ফিরে আসছে ঘরের দিকে মুখ করে রাখা বিপ্লবীরা। হয়তো একটা কালবেলা লিখে ফেলবো বা চেক ভাষার উপন্যাস, হাসি ও বিস্মৃতির। হয়তো কোন সতীর্থ নড়বড়ে হাতক্যামেরা দিয়ে বানিয়ে ফেলবে কোলকাতা শূন্য সাত। এমন অশান্তির মধ্যে গোফদাঁড়ি গজালো বলে ভাগ্যবান মনে হলো।

কাকাদা টুক করে একটা ট্যাক্সি ডেকে ফেলে। আমি হাঁ হাঁ করে উঠি-বাস ধরলেই তো হত, কিম্বা রিকশা।

কাকাদা বললো-বাজার কি আর শুধু একরকম। যা মাল টিপেটুপে বুঝতে হয় সে সব মালই দেখবি বাজারে আসে। এটা ওপাড়ার বাজার।

আমি সামান্য ইঙ্গিত ধরে চুপ, কাকাদা মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে ফুলস্লিভের হাতার আড়ালে ঢোকাতে শুরু করলো। আমিও দেখাদেখি।

-পুলিশ ধরলে বলবি মেট্রো স্টেশানের পথ হারিয়ে ফেলেছিস, না শুনলে মুচিপাড়ার থানায়  আমার জন্য ওয়েট করবি।

ট্যাক্সি গঙ্গা পেরিয়ে, আমাদের পুণ্যের চৌহদ্দি পেরিয়ে ছুটলো। ভাবছিলাম ধর্মতলা এলেই লাফিয়ে নেমে ফিরতি বাস ধরবো। কাকাদা বললো-এই কেসেও কিন্তু রেজোনেন্সের একটা ভূমিকা আছে।

-সে তো ফিজিক্সে থাকে। সমান সমান তরঙ্গ মিশে গেলে প্রবলতর তরঙ্গের সৃষ্টি হয়, ইলেভেনে পড়েছিলাম।

-এখানেও আছে।

-কিরকম?

-একজন নিঃশ্বাস ছাড়লে সেই নিংশ্বাস আরেকজন নেবে, প্রশ্বাসে। সে আবার নিঃশ্বাস ছাড়লে অন্যজন নেবে। এইভাবে নিলে আর দিলে দাতা-গ্রহীতার আদানপ্রদান পোক্ত হয়।

-যে নিঃশ্বাস গ্রহন করছে সে তো তাহলে কার্যত কার্বন ডাই অক্সাইড নিচ্ছে? আমি বলে ফেলি।

এ দিকটা ভেবে দেখেনি বুঝে কাকাদা চুপ রইলো। ময়দানের হাওয়া তখন গায়ে লাগছে, অর্থহীন কথোপকথনের ফলে বুকের ভার কমে এসেছে। ভাবছি ধর্মতলায় না নামলেই বা ক্ষতি কি!যেমন সন্দীপনে পরেছিলাম-সব সম্পর্কেরই একটি নিজস্ব রাজনীতি থাকে তেমনি এটাও সন্দীপনেই পড়েছি-যৌনতা আসলে প্রতিবাদেরই এক রূপ। ট্যাক্সির জানালা দিয়ে দেখলাম আপাততুচ্ছ ঘটনাগুলির যৌক্তিকতা ময়দানে সারি সারি গাছ হয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
হপ্তা দুয়েক পরে ম্যাগগির লোভে মীরজাফরে সিরাজে ফের ভাব হয়ে গেল।
 | |

Comments