হারাতে হারাতে একা - বারীন ঘোষাল - পর্ব ২১

click me
সকল পর্বগুলি
পর্ব ২১

সদ্য ফোর্থ ইয়ারে উঠেছি, কতগুলো অদ্ভুত ঘটনায় জড়িয়ে পড়লাম যা ছাত্র হিসেবে মোটেই কাম্য ছিল না। জুন মাসের শেষে কলেজ খুলতেই কেউ বা কারা আমাদের হোস্টেলের পোর্টিকোর ছাদ থেকে এক কাঁদি কাঁচকলা ঝুলিয়ে দিলো। পোস্টার লেখা হল ---মুখ্যমন্ত্রী, ভাত দাও। আঁকা হল প্রফুল্ল সেনের কার্টুন ছবি যেখানে তিনি নিজে ভাত খাচ্ছেন, আর অতিথির পাতে কাঁচকলা। ছেলেরা ঢোকার বেরোবার পথে থুতু ছিটিয়ে যেত কাঁদিটাতে। সরকারি কলেজ, প্রশাসনের টনক নড়লো। প্রিন্সিপাল স্বয়ং এসে হুকুম দিলেন কাঁদিটা নামিয়ে নেবার জন্য।
   ১৯৬৫ সাল। যুদ্ধ পাকিস্তানের সঙ্গে। আকাশে জেটের ডাক। রাত্রে সাইরেন, ব্ল্যাক আউট। হাসিমারায় মিলিটারি এয়ারপোর্ট তৈরি হচ্ছে। চারিদিক থমথমে। পাকিস্তান বর্ডার কাছেই। কলেজের রিডিং রুমে খবরের কাগজ নিয়ে কাড়াকাড়ি। আমার না রেডিও, না ট্রানজিস্টার। অত হৈ-চৈ-এর সময়েও কাগজ পড়া, মুখে মুখে তার চর্বিত চর্বণ, গালগল্প ভাল লাগে না। সবাই তাই  আমাকে ইডিয়েট ভাবছে হয়তো। ওদিকে খরার কারণে নাকি বাজারে চালের কাড়াকাড়ি, দারুণ অগ্নিমূল্য। হোস্টেলেও ভাতের বদলে দুবেলা রুটি চালু হল। বাঙালির রেশন থেকে গম কেনা আর রুটি খাওয়ার সেই চলন হল। হাঁড়িমুখে সবাই তা মেনে নিলো অগত্যা। ছেলেরা প্রতিবাদ করলো। প্রিন্সিপালকে বলা হল আমাদের ভাত দিন, আমরা কাঁদিটা নামিয়ে নেবো।
   প্রিন্সিপাল বললেন --- আমাদের ভাত আমরাই উৎপাদন করবো। আমাদের মাঠের বিশ বিঘায় ধান লাগাবো। এই বর্ষায়ই শুরু হবে। আপাতত কাঁদিটা নামিয়ে নাও তোমরা। গভর্ণমেন্ট কলেজ। সাবসিডি নিয়ে ঝামেলা হতে পারে।
   কিন্তু প্রবলেমটা হল কেউ আর কাঁদিটায় হাত দিতে চায় না। এই কদিনে অন্তত হাজার বার থুতু মেখেছে। নতুন হোস্টেলে সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেরা থাকে। তাদেরও খুব উৎসাহ এই থুতু খেলায়। এক সপ্তাহ আগে সেকেন্ড ইয়ারের একটা ছেলে স্বপন মুখার্জি, সবার সাথে করলা নদীতে চান করতে গিয়ে কুয়োর মতো একটা আন্ডারওয়াটার গর্তে ঢুকে আটকে যায়। সঙ্গে সেই সুশান্ত প্রতিহার ছিল। সুশান্ত রোজ নদীতে সাঁতার কাটতে যেতো। সে ছিল চাম্পিয়ান সাঁতারু। জলে কেউ বিপদে পড়লে হেলপ করতে এগিয়ে যেতো। শোনা গেল করলা নদী স্রোতের কারণে একটু একটু সরে যেতে থাকে। বহুদিন আগে একটা গ্রাম ছিল সেখানেই যেখান দিয়ে এখন নদী বইছে। গ্রামের খানা খন্দ, মায় কুয়ো পর্যন্ত জলের তলায়। ওপর থেকে বোঝার উপায় নেই। কোন সতর্কীকরণও নেই। ডাকা হল দমকলকে। ডুবুরি এল। ততক্ষণে সুশান্ত ডুব সাঁতারে টের পেয়ে গেছে স্বপনের অবস্থান কুয়োর ভেতরে। সে দমকলকে জানাতে ডুবুরিরা নেমে পড়ল দড়ির ফাঁস নিয়ে। সুশান্ত কুয়োতে নেমে ফাঁস লাগিয়ে টেনে তোলার ইশারা করলো। স্বপনের বডি থেকে আগাছা সরাচ্ছিল সুশান্ত। সে আর ফিরলো না। আটকে গেল। স্বপনের ডেডবডি বেরিয়ে তো এল, কিন্তু সুশান্ত ফেরে না। কী টেনশন আমাদের ! তখন ডুবুরিরা আবার নেমে খোঁজাখুজি করে সেই কুয়োতেই পেলো সুশান্তকে। তাকেও তুলে আনা হল। স্বপনের মৃত্যু সবাইকে দুঃখ দিয়েছিল, কিন্তু সুশান্তর মহান আত্মত্যাগ কাঁদালো সবাইকে। আমি ওকে পায়ে ধরে প্রণাম করলাম। শিহর আমার থামেই না। আমার চোখে তখন করলার সবুজ জলস্রোতে ভেসে যাবার দুঃস্বপ্ন। এই সুশান্তই আমাকে উদ্ধার করেছিল মৃত্যুমুখ থেকে। সবাই তখন, চোখে জল, ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ঘটনাটা আমাদের আর নেক্সট ইয়ারের ছাত্রদের বন্ধু করে তোলে। ওরা র‍্যাগিং-এর বিরাগ ভুলে আমাদের হোস্টেলের কলাকান্ডে যোগ দিয়েছিল। ফলে বোঝাই যায় কি পরিমাণ প্রলেপ লেগেছে। কাঁদির গায়ে ধূলো লেপে নামানো হয়েছিল টুলের ওপর দাঁড়িয়ে। যে এটা করল সেও কম মহান ছিল না। তার নাম বারীন ঘোষাল। হুঁ হুঁ।
   তারপর সবাই মিলে আমাকে চান করাবেই। আমিও হুল্লোড়ে ভেসে গেলাম। হোস্টেলের বাথরুমে একসাথে মাত্র চারজনই ঢুকতে পারে। প্রথমে আমি উদোম হয়ে জামাকাপড় বাইরে রেখে ঢুকলাম। তারপর তিনজন করে বাই রোটেশন আমার গায়ে জল ঢালা, সাবান লাগানো, ঘষামাজা করে গেলো। আর যে জায়গাটায় সাবান জল দেবার উৎসাহ সবার --- হি হি হি ! ভেবে হেসেছি বহুদিন।
   আপাতত কলামুক্ত হোস্টেল। দুদিন পরেই এসে পড়ল ট্রাক্টার। সুপারভাইজার, ড্রাইভার, একটা বড় হল খালি করে ডিজেল স্টোর, লাঙ্গল, মুনিষ তিনজন। কলেজের মাঠে নেমে প্রথমেই তারা তুলে ফেলল গোলপোস্ট। আমরা হায় হায় করলাম। কিন্তু ভাত খাওয়ার স্বার্থে মেনে নিলাম তখনকার মতো। মাটি তৈরি করে বীজধান ছড়ানো, জল, সার, এই সব কিছুই আমার অদেখা ছিল। কলকাতায় পড়ার সময় সেই যে লোকাল ট্রেনে যে কোন দিকে যেতে যেতে দুপাশের সবুজ মাঠ দেখেছিলাম, ভাল লাগা, তার বাইরে কিছু জানি না। পড়াশোনার ফাঁকে দিনের অবসর সময়ে আমার কাজই হয়ে গেল চাষের মাঠের ধারে বসে ওদের কার্যকলাপ দেখা। ট্রাক্টার দিয়ে অবশ্য গ্রামে কাজ করার রেওয়াজ ছিল না তখন। আল বানাবারও একটা কায়দা আছে। জলের জন্য পাম্প আর পাইপ লাগানো হল করলা থেকে। একটু একটু করে ধানগাছ বেড়ে উঠছে। মুনিষরা রোজ কি করছে, কিভাবে আগাছা বাছছে, সার দিচ্ছে, মাসের পর মাস। হাওয়ায় কেমন লাগছে ধানগাছের দোলা। ক্রমে ধান, তার দুধ ও সোনালী দোলন। মেশিনে ধান কাটা, ঝাড়া, নিড়েন দেওয়া। তারপর শহরের মিল-এ গেলো। ফিরে এল বস্তাবন্দী চাল। বৃষ্টি পেরিয়ে যেতে আবার চাষ। সে বছর তিন বার চাষ হয়েছিল মনে আছে। আমাদের ভাত খাওয়া শুরু হল। আমরা ইঞ্জিনীয়ার হবো। টাকা দিয়ে চাল কিনবো বাজারে। কিন্তু মাঠের থেকে শুরু করে পায়খানা পর্যন্ত ধানসরণীর কথা কোন ছাত্র ভাবে ?
   পড়াশুনো বাদ দিয়ে এই সবই চলছিল কলেজে। পুজো এসে গেল। কদিনের জন্য বাড়ি গেলাম। প্রেমিকাটি নেই। জয়তী কোথায় বেড়াতে গেছে ফ্যামিলির সাথে। আমার স্কুলের আর পাড়ার বন্ধুরা অলমোস্ট বাইরে। বাবা মা ভাই বোন আত্মীর স্বজন এই চক্রে বোর হয়ে গেলাম। পুজো আর আমার জন্য নয়, বোঝা গেল। শেষ হতেই ফিরে এলাম সেবার।
   হোস্টেলের কটি ছেলে টাউনে পুজোর সময় হিড়িক দিতে গিয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিল। তারা এবার টাউনের ছেলেদের কাছে মার খেয়ে কাটা হাত পা মুখ নিয়ে ফিরে এল। সবিস্তারে রঙ চড়িয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কাহিনী শোনাতেই ছাত্রদের মাথা গরম হয়ে গেল। হুঙ্কার উঠল -- চল সবাই টাউনের মালগুলোকে দেখে নিই। নেমে আয় সবাই। পলিটেকনিকে খবর দে কেউ। সন্ধায় হাল্লা আর থামতেই চায় না। পিটুবক্সী আর বাচ্চুকে ঘিরে সবাই চল শালা দেখে আসি চল চল চল রব উঠল। পেছনে যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা ব্যাপারটা তেমন জানেও না। হৈ হৈ করতে করতে পলিটেকনিকের ছেলেরাও হোস্টেল থেকে ছুটে এল। সবাই হাতে কিছু না কিছু নিয়েছে। মশারির রড, হকি স্টিক, লাঠি, ছোরা। আমার রামপুরিয়াটা পকেটে নিলাম। এখন খুলবে কিনা জানি না। প্রায় শচারেক ছাত্র স্লোগান দিতে দিতে এগোলাম মাষকলাইবাড়ি হয়ে কদমতলার দিকে সোজা পথে। কদমতলায় তিনটে সিনেমা হল থাকার কারণে খুব ভিড় আর চাঞ্চল্য থাকে। ঝাড়পিটটা ওখানেই হয়েছিল রেলগুমটির ওধারের পান্ডাপাড়ার ছেলেদের সঙ্গে।
   এই শান্ত শহরে এত উত্তেজনা মনে হয় আগে কেউ দেখেনি। বাড়ি ঘরের দরজা বন্ধ। গোলমালের আশঙ্কায় দোকানপাটের ঝাঁপিও প্রায়ই ফেলা হয়েছে। মিছিলের মুখের দিকে যারা মার খেয়েছিল, পিটু বাচ্চুরা। তার পিছনে স্লোগানীয়াররা। পেছনে বিশৃঙ্খল মিছিল। সবাই চার্জড। একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। সে সব দিনে রাস্তায় আলোও অপ্রতুল। সরু রাস্তা। পথে পদচারী, সাইকেল বা রিক্সা অদৃশ্য। কোন ছেলেপুলের গ্যাঞ্জাম নেই। স্লোগান উঠছে -- কোন হারামী মারতে চায় / সামনে আয়, সামনে আয়বন্ধু নয়, শত্রু চাই। গান উঠল – “ উই শ্যাল ওভারকাম ...” --- এই কথাগুলো ঠিক ফিট করে কিনা কেউ জানে না। প্ল্যান করে তো কিছু করা হয়নি। মনে হচ্ছে জনসমুদ্র। স্রোত। আমি লক্ষ্য করলাম স্লিপ করে পিছনের দিকে চলে এসেছি কখন। ছোটবেলার মারপিট হাঙ্গামা, অ্যাকশন আর ভাল লাগে না। আমি আর অ্যাক্টিভিস্ট নই।
   বেগুনটারিতে পৌঁছে দেখি চার কোম্পানি সশস্ত্র পুলিশ হাজির। তারা আমাদের বাধা দেবার চেষ্টা করলো, বোঝাবার চেষ্টা করলো, ফিরে যাবার অনুরোধ করলো, এফ আর আই করার কথা বললো। কে শোনে কার কথা। এসে পড়লেন বিধায়ক খগেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। তিনিও থামাবার চেষ্টা করে হাল ছাড়লেন। ছাত্ররা কিছুতেই শুনবে না। খুব হাই স্পিরিট আর আবেগ। বহুদিন ধরে এই ফ্রিকশন চলছিল। এবার একটা হেস্ত নেস্ত করতেই হবে। বিধায়ক কলেজের গভর্নিং বডির চিফ। নিজ দায়িত্বে তিনি মিছিলের মাথায় গিয়ে হাঁটতে লাগলেন। লক্ষ্য তাকে হাজির দেখে মিছিলের মাথার উত্তেজনা যেন রাশে থাকে।  মিছিলের সামনে আর দু-পাশে পুলিশ বন্দুক হাতে হাঁটছে, মিছিল যাতে উপচে না পরে। থমথম করছে জলপাইগুড়ি।
   কদমতলা ছাড়িয়ে গিয়েও কোন ট্রেস নেই দুর্বৃত্তদের। সঙ্গে স্লোগান শুরু হল – “মেরে বাপের নাম খগেন করে দেবো। খগেনবাবুর কানে তুলো দেয়া ছাড়া উপায় কি ? গুমটির দিকে আর একটু এগোতেই সামনের গর্জন কমে এল। মিছিলে হল্ট প্রায়। শোনা গেল পান্ডাপাড়ার দিকেও একটা জনস্রোত এগিয়ে আসছে বাধা দেবার জন্য। তাদের চিৎকার আস্ফালন কিছু কম যায় না। পুলিশ তখন দু পক্ষকেই থামাবার চেষ্টায় ক্লান্ত। লাউড স্পিকারে সতর্কতা। হঠাৎ দুম দুম করে বন্দুকের গুলির আওয়াজ এল তখন। তিনবার। চিৎকার চেঁচামেচি হায় হায় শোনা গেল। ওদের ফ্রন্টলাইনে কেউ আহত হয়েছে। মিছিলের চলন শিথিল হয়ে দ্রুত পিছন ফিরলো। ঘোরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে কখন হোস্টেলে ফিরে এসেছি, হুঁশ নেই। কারো সাথে কথা বলতে একটুও ভাল লাগছিল না। তাহলে কাউকে ঠ্যাঙাবার জন্য মিছিলে গেলামই বা কেন ? একটা অন্যায় থেকে আরো অন্যায়ের জন্ম হয়। খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লাম।
   স্বপন ঘরে ঢুকে বলল –- মশারি টানালি না ? ব্লাড ব্যাঙ্ক খুলেছিস নাকি ?
   --- খাটিয়ে দে না প্লিজ। আমি বলি। আজকে কিছু ভাল লাগছে না। কাল কথা বলব।
   পরের দিন ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখি হোস্টেলে গুঞ্জন গুলতানি চলছে। খবরের কাগজে নাকি বেরিয়েছে আমাদের কালকের পদযাত্রার গল্পকথা। কাল যে গুলি চলেছিল তাতে নাকি পান্ডাপাড়ার ১৬ বছরের এক ছাত্র, নাম জহর ****, গুলি লেগেছিল পেটে, হাসপাতালে মারা গেছে রাতেই।  মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। সমস্ত উৎসাহ উদ্দীপনা নিভে গেল আমাদের সবার। সবাই নিষ্প্রভ। যেন শোকের ছায়া নেমেছে হোস্টেলে। কৃতকর্মের জন্য সবাই অনুতপ্ত। বোঝা গেল কান্ডজ্ঞানের অভাব আছে আমাদের। তেমন নেতাও নেই যে সঠিক পথ দেখাবে। তাই আবেগের বশে হুজুগে নেমে পড়া ছাত্রদের পক্ষে যে ঠিক নয়, সেটা দেরিতে বুঝলাম। পড়াশোনার বাইরের কাজকর্মে লাগাম থাকা দরকার। আমাদের দৃষ্টিবিভ্রম হলে অন্তত দেরিতে হলেও শুধরে নেয়া দরকার।
   ভাবলাম হাসপাতালে গিয়ে খোঁজখবর নেয়া দরকার। জহরের পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়ে সমবেদনা জানানো উচিত। কিন্তু সে পথও যে বন্ধ, অচিরেই টের পেলাম। হোস্টেলগুলোর বাইরে পুলিশ মোতায়েন হয়েছে। সারা ক্যাম্পাসে আর মেন গেটে পুলিশ। তারা কাউকেই ক্যাম্পাস ছেড়ে বেরোতে দিচ্ছে না। শহরেও পুলিশের টহল। কিছুটা স্বচক্ষে দেখা, কিছু কাগজ থেকে। ফিসফাস চলছে। নাকে খৎ দিলাম। জীবনে কোনদিন অ্যাক্টিভিজম এ নামবো না। কারো মৃত্যুর কোন কারণ ঘটাবো না। কিছুদিন পর থেকে পুলিশ উঠে গেলে আমরা কাজ পড়লে গ্রুপ করে শহরে যেতাম, সতর্ক থাকতাম আমাদের ব্যবহারে। সিনেমা বন্ধ। কেবল শহরের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেই আড্ডা। অবশ্য কোন প্রতিক্রিয়ার চাপ পাইনি। আমার মানসিক বেদনা কাটতে সময় লাগল।
   এই উত্তেজনা কমে এলে আমাদের ফোর্থ ইয়ারের ফাইনালের টেস্ট পরীক্ষা এসে গেল। পরীক্ষা হয়ে যাবার পরে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ নেবার জন্য এল মিলিটারি সিলেকশন বোর্ডের লোকেরা। আমাদের পরিবারে বা জানাশোনার মধ্যে কাউকে দেখিনি মিলিটারিতে যেতে। আমাদের শহর কারখানার শহর। দেখে অভ্যস্ত। সাধারণ লাইফ থেকে বেরিয়ে যেতে চাই আমি। মনযোগ দিয়ে ইন্টারভিউ দিলাম। শরীর স্বাস্থ্য মজবুত। মেডিকালও হল। খুব সাটিসফায়েড। একমাস পরে চিঠি পেলাম আমার সিলেকশন হয়ে গেছে। ফিফথ ইয়ারে উঠলে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়ে যাবে সেকেন্ড লেফটেনান্ট (ট্রেনি) হিসেবে। স্টাইপেন্ড পেতে থাকব। জব্বলপুরে ফাইনাল ট্রেনিং-এর পরে পোস্টিং হবে কোন ইউনিটে জয়েন করার জন্য। আমি যেন চাঁদ পেয়েছি হাতে। নিষ্কৃতি এই ঘসটানো জীবন থেকে। আবার একা হয়ে থাকব অন্য পৃথিবীতে। কী মজা !
 আমি চিঠি লিখলাম বাড়িতে। কিছুদিন পরেই জবাব এল মায়ের ... স্বপন তোমার বাবার শরীর খুব খারাপ। যত তাড়াতাড়ি পারো বাড়ি এসো। ওনার নড়াচড়া বন্ধ, শুয়ে আছেন, কারখানায় যেতে পারছেন না, তোমাকে দেখতে চাইছেন। আমি মাথায় হাত দিলাম। চিঠি দিলাম, সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা। তারপরেই আসছি। পরীক্ষা কোনমতে দিয়ে বাড়ি ছুটলাম। গিয়ে দেখি বাবা বেশ আছে। কারখানা যাচ্ছে। মা বলল --- এখন একটু ভাল। তোর চাকরির খবরে ভেঙ্গে পড়েছিলেন উনি।
   আমি বুঝলাম মা মিথ্যে বলছে। আমাকে কখনো মিথ্যে বলেনি মা। তার কথায় কোনদিন কোন চাতুরি ছিল না। বাধ্য হয়ে বাবার কথা নিজের মুখে বসিয়েছে মা। সেদিন বাবা কারখানা থেকে ফিরে আসতেই আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
   --- কি ব্যাপার ? আমার চাকরি হওয়ায় তোমার তো খুশি হবার কথা, আর সেইখানে ...
   --- তুই এখন যে অবস্থায় আছিস সেই পর্যন্ত তুলে দিতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আমি চাই তুই আমার কাছে থাকবি। অ্যাডভেঞ্চারের জন্য নয় জীবনটা। অনিশ্চিত জীবনে যাবার কথা ভুলে যা। আমি অ্যালাও করব না --- বাবা বলল।
   এরপর ঝোঁকের মাথায় যে বিদ্রোহের কথা বলেছিলাম সে সব ভুলে গেছি। শুধু মনে থেকে গেল হতাশা। ভেঙ্গে গেল মনটা। অত ভারি মন নিয়ে অন্যমনস্কের মতো কলেজে ফিরে এলাম। মিলিটারিকে ডিনায়াল চিঠি দিয়ে কাঁদলাম খুব, অনেকদিন লাগল সুস্থ হতে। পরীক্ষার পরে কলেজ ছুটি হয়ে গেলেও বরাবরের মতো হোস্টেলে সামান্য ব্যবস্থা ছিল। দুমাসের ছুটি। আমি বাড়ি গেলাম না ফিরে। মন ভীষণ খারাপ। ১৯৬৬ সালের গরমের ছুটি এত বিষাদময় ছিল যে, শেষে বিষাদকেই এনজয় করা শিখে গেলাম। মন সুস্থ হয়ে উঠল।

(ক্রমশ)

Comments