সিনেমা – Dogtooth (Kynodontas)




Cinema
সিনেমা – Dogtooth (Kynodontas)
নির্দেশক – YorgosLanthimos
দেশ – Greece

আমাদের জীবনে এমন ঘটনা প্রায় নেই বললেই চলে যা আমাদের সকল ইন্দ্রিয়ের সজাগতা দাবী করে। নিরলস জীবন আমাদের কেটে যায় রোজকার দশটা-পাঁচটা করতে করতে। ‘ডগটুথ’ সিনেমাটা এরকম একটা ঘটনা। হ্যাঁ, এই সিনেমাটা সামান্য একটা চলচ্চিত্র হিসেবেআমার জীবনে আসেনি, একটা ঘটনা হিসেবেই এসেছে। এবং সেটা সিনেমার প্রথম দৃশ্য থেকেই বুঝতে পারা যায়।

তবে প্রথম দৃশ্যেরওআগে আসতে হয় সিনেমার ওপেনিং টাইটলে। সিনেমাটার ওপেনিং টাইটল মাত্র চারটে স্টিল ফ্রেম। একটা হলুদ ব্যাকগ্রাউণ্ডের ওপর মাঝামাঝি একটা সরলরেখা। তারপর সেই জায়গায় দুটো ডিম্বাকৃতি পাল্‌স, একটা উপরের দিকে আরেকটা নীচের দিকে। তারপর সেটা একটা সাইন ওয়েভ হয়ে যায়। তারপর সিনেমার নাম। ইন্টারনেটে সার্চ দিলে প্রথম তিনটে ফ্রেম ওভারল্যাপ অবস্থায় একটা পোস্টার দেখা যায়। যে সব সিনেমার পোস্টার আইকনিক স্ট্যাটাস পেয়েছে তার মধ্যে এই পোস্টারটাও নিঃসন্দেহে জায়গা করে নিতে পারে। পুরো সিনেমাটা দেখা এবং বোধগম্য হওয়ার পর বোঝা যায় যে গোটা সিনেমাটার বর্ণনা ঠিক তিনটে ফ্রেমে সেরে ফেলেছে এর ওপেনিং টাইটল

এবার আসা যাক প্রথম দৃশ্যে।সিনেমার শুরুতেই দর্শককে স্তম্ভিত করে দেয় চিত্রনাট্য। এটা কী হচ্ছে? একটা ঘরের মধ্যে দুই বোন আর এক ভাই, যারা কৈশোর উত্তীর্ণ, তাদেরকে টেপ রেকর্ডারে কিছু শব্দের মানে শেখানো হচ্ছে, যেগুলো সেই শব্দের প্রকৃত মানে নয়। যেমন ‘সমুদ্র’ মানে হল বিশেষ আরামকেদারা, ‘শটগান’ মানে হল একধরনের বিশাল পাখি। কেন? কীসের জন্য এ ধরনের শিক্ষা? স্বভাবতই এই প্রশ্ন গ্রাস করে দর্শককে। সিনেমার মধ্যে পুরোপুরি ঢুকিয়ে নেওয়ার জন্য এই প্রথম দৃশ্যই যথেষ্ট। এরপর সিনেমা যত এগোতে থাকে, আমরা বুঝতে পারি যে স্যুইমিং পুল আর বিশাল বাগানে ঘেরা এই বাড়িটাই হল এই দুই বোন ও এক ভাইয়ের গোটা দুনিয়া। তারা কোনদিন সে জায়গা থেকে বেরোয়নি, এবং তাদের মা ও বাবা টেপ রেকর্ডারে তাদের যেরকম শিক্ষা দেয় তারা সেই শিক্ষা অনুযায়ীই বড় হয়েছেজায়গাটা থেকে একমাত্র পরিবারের যে কর্তা, অর্থাৎ ভাই-বোনেদের বাবা, সেই শুধুমাত্র বেরোতে পারে। সকালে সে গাড়ি নিয়ে কাজ করতে বেরিয়ে যায় আর বিকেলের পর গাড়ি নিয়ে ফিরে আসে। পুরো কম্পাউণ্ডটা একটা বিশাল দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। ছেলেমেয়েরাজানেযে দেওয়ালের অন্য দিকে পৃথিবী অতি ভয়ংকর, তাই তারা কখনই সেইদিকে যায় না। সেইদিকে যাওয়ার জন্য দেহমন তখনই তৈরী হয় যখন কারোর শ্বদন্ত (ক্যানাইন টুথ বা ডগটুথ)পড়ে যায়। এবং দেওয়ালের অন্যপারের দুনিয়ায় যাওয়ার একমাত্র উপায় হল গাড়ি, যা শ্বদন্ত আবার গজিয়ে যাওয়ার পর চালাতে শেখা যায়।

এইরকম একটা পরিবেশে বাইরে থেকে একমাত্র একজনের প্রবেশ ঘটে এই দুনিয়ায়সে হল ক্রিস্টিনা। বাড়ির যে কর্তা বাবা, তার ফ্যাক্টরিতে সিকিউরিটির চাকরি করে সে। বাবা তাকে চোখবন্ধ অবস্থায় বাড়িতে নিয়ে আসে ও ফেরত নিয়ে যায়। তার কাজ হল প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেটির যৌনভজনা করা। কিন্তু ছেলেটি ক্রিস্টিনার যৌনাঙ্গে মুখ দিতে চায় না বলে ক্রিস্টিনা সুখি হতে পারে না। দিনের পর দিন এরকম চলার পর একদিন সে বড় মেয়েটিকে বলে তার যৌনাঙ্গে মুখ দিয়ে তাকে যৌনসুখ দিতেবিনিময়ে তাকে একটা হেডব্যাণ্ড দেয় ক্রিস্টিনা। পরে আরেকবার যখন ক্রিস্টিনা তাকে একই জিনিস করতে বলে তখন সে ক্রিস্টিনার কাছে থাকা দুটো ভিডিও ক্যাসেট চায়। এই দুটিক্যাসেট দেখে বড় মেয়েটি যথেষ্ট প্রভাবিত হয় এবং তার আচার ব্যবহারে আমরা প্রচুর পরিবর্তন দেখতে পাই।সে বুঝতে শুরু করে তার অনুশাসনে কোথাও একটা গণ্ডগোল আছে। ভিডিও ক্যাসেটগুলো আবিষ্কৃত হওয়ার পর ক্রিস্টিনার এই বাড়িতে আসা বন্ধ হয়ে যায়। ছেলেটির যৌনমিলনে সঙ্গী হওয়ার জন্য তাকে দুই বোনের মধ্যে থেকে বাছতে হয়, কারণ বাবা মা পরামর্শ করে স্থির করে যে বাইরের কাউকে নিয়ে আসাটা তাদের শিক্ষার পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে যেতে পারে। তখন ছেলেটি বড় মেয়েটিকে বেছে নেয়। তাতে সে আরো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সিনেমা যখন ক্লাইম্যাক্সের দিকে পৌঁছয় তখন সে ডাম্বেল দিয়ে নিজের দাঁতে মেরে তার শ্বদন্তটি উপড়ে ফেলে। অতঃপর লুকিয়ে বাবার গাড়ির ডিকিতে ঢুকে যায়। বহু খোঁজাখুঁজির পরেও তাকে না পেয়ে পরদিন বাবা ফ্যাক্টরি চলে যায় গাড়ি নিয়ে। কিন্তু আমরা দেখি যে বাবা ফ্যাক্টরিতে ঢুকে যাওয়ার বহুক্ষণ পরেও ডিকি খুলে কেউ বেরিয়ে আসে না। সিনেমা এখানেই শেষ হয়।

সিনেমায় প্রায় সব শটই ফিক্সড ক্যামেরায় ধরা। যে চরিত্রগুলি দেখানো হয়েছে, তাদের নিস্তরঙ্গ জীবন এভাবেই আরো ফুটে উঠেছে দর্শকের কাছে। মূল গল্পের সারাংশ বাদ দিলেও এমন বহু দৃশ্য আমরা দেখতে পাই যা বস্তুত অদ্ভূত। কিন্তু সেগুলি সিনেমার বক্তব্য দর্শকের সামনে তুলে ধরার জন্য অনিবার্য রূপ ধারণ করে। যেমন আকাশে প্লেন উড়ে গেলে ছেলেমেয়েরা বাগানে দৌড়ে যায় দেখতে যে প্লেনটা সেখানেপড়েছে কি নাকখনও কখনও খেলনা প্লেন সেখানে ফেলে রাখা হয় এবং তারা সেটাকেই আসল প্লেন ভাবে। ছেলেটি একটা দৃশ্যে বাগানে বেড়াল দেখতে পায় এবং গাছের পাতা কাটার বড় কাঁচি দিয়ে সেটাকে কেটে ফেলে। সকলেই জানে যে তাদের আরেক ভাই দেওয়ালের অন্য পারে চলে গিয়েছিল। সিনেমার শুরুর দিকেই এটা দর্শককে জানিয়ে রাখা হয়। বেড়ালের মৃত্যুর সু্যোগ নিয়ে বাবা সবাইকে বলে যে এই বেড়ালটা তাদের ভাইকে মেরে ফেলেছে এবং প্রমাণস্বরূপ নিজের জামাকাপড়ে রক্তের দাগ লাগিয়ে আসে। এভাবে আরো ভালো করে প্রতিস্থাপিত হয় যে দেওয়ালের অন্য পারে জীবন অতি ভয়ংকর। যেহেতু সেদিক থেকে একটা বেড়াল ঢুকে আসে তাদের কম্পাউণ্ডে, তাই বাবা তখন সবাইকে বেড়াল তাড়ানোর জন্য কুকুরের ডাক ডাকার অনুশীলন করায়অন্যদিকে বাড়ির জন্য একটা কুকুর কেনেল (kennel) থেকে নিয়ে আসতে গেলে সেখানকার পরিচালক বাবাকে বলে যে কুকুরটি এখনও তৈরী হয়নি। পুরোপুরি তৈরী না হলে সে কারোর ভালো কাজে আসবে না, উল্টে হিতে বিপরীত হতে পারে। হয়ত গোটা সিনেমার মূল কথাটা এই ডায়লগের মধ্যেই ঢুকে আছে। একটা মানুষের বাড়ির থেকে বেরনো ও গাড়ি চালানো শেখার সঙ্গে তার শ্বদন্তের সম্পর্কটা এবার বোধহয় আরো ভালো করে বোঝা যায়। এবং সেই জন্যেই যে বড় মেয়েকে আমরা বিদ্রোহীর ভূমিকায় দেখতে পাই, সেও তার বিদ্রোহের প্রকাশ নিয়মের গণ্ডির মধ্যে থেকেই করে। তাকে গাড়িতে ঢোকার আগে নিজের শ্বদন্ত উপড়োতে হয়, এবং শেষপর্যন্তসে গাড়ির ডিকি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে নাকারণটা সিনেমায় আগেই বলে দেওয়া আছে – গাড়ি ছাড়া বাইরের দুনিয়ায় বেরনো ভয়ংকর। আর বড় মেয়েটি যে গাড়ি চালাতে জানে না সে কথা বলাই বাহুল্য। তাই তার বিদ্রোহের ফলে সে বাড়ি থেকে তো বেরিয়ে আসতে পারে, কিন্তু গাড়ি থেকে বেরোতে পারে না। পৃথিবীতে আমরাও এধরনের কতই না বিদ্রোহ দেখে থাকি। মাঝে মাঝে করেও থাকি। কিন্তু সিস্টেমের শেখানো নিয়মের গণ্ডির মধ্যে থেকে সিস্টেমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কি আসলে কোন বিদ্রোহ? শেষমেশ এই প্রশ্নই রেখে যায় সিনেমাটা। আমি চুপ করে বসে থাকি, ভাবি। কবে কোন মিছিলে হেঁটেছি, কবে কোন চিঠিতে সই করেছি, কোন কবিতা কোন গান শুনে বিদ্রোহী চেতনা জেগে উঠেছে আমার মধ্যে। এর সবকটাই তো সিস্টেমের বলে দেওয়া নিয়মের মধ্যেই পড়েসিস্টেম আমাকে টেপ রেকর্ডারে শিখিয়ে দিয়েছে বিদ্রোহ মানে কী। আমার বিদ্রোহ তাই নতুন কোনও মানে দিতে পারে না সমাজকে।সিনেমাটা শেষ হয়ে যাওয়ার পরএই কথাটাই মনে হতে থাকে বারে বারে। আর একটা বহুবার শোনা খুব সাধারণ প্রশ্ন মনে পড়ে যায় – ‘হাতির গায়ে শেকল ভাঙার শক্তি থাকলেওসে কেন শেকল পরে থাকে?’ উত্তরটা আমাদের সকলেরই জানা।

Comments