বন্ধুদের কথাবার্তা


বন্ধুদের কথাবার্তা
-রাজর্ষি দাশ ভৌমিক


১.
এই কলামের প্রসঙ্গে বিভূতিভূষণ বলেছেন-
“প্রকৃতপক্ষে ঠিক মনের মত লোক পাওয়া বড় দুষ্কর।  অনেক কষ্টে একজন হয়তো মেল। অধিকাংশ লোকের সঙ্গে আমাদের যে আলাপ হয়, সে সম্পূর্ণ মৌখিক। তাদের সঙ্গে আমাদের হয়তো ব্যক্তিগত অভ্যাসে, চরিত্রে, মতে, ধর্মবিশ্বাসে,বিদ্যায় যথেষ্ট তফাত।কিন্তু একই অফিসে, কি কলেজে, কি কোর্টে,এক সঙ্গে কাজ করতে হয়, দুবেলা দেখা হয়-দাদা কিম্বা মামা বলে সম্বোধন করতে হয়, কৌটস্থ পানের খিলির বিনিময়ও হয়ত হয়ে থাকে-কিন্তু ওই পর্যন্ত। মন সায় দিয়ে বলে না তার সঙ্গে দুবেলা দেখা হলে গল্প করে বাঁচি। কোনো নিরালা বাদলার দিনে অফিসের হরিপদ-দার সঙ খুব কাম্য বলে মনে হবে না। “ ~ছায়াছবি



অল্পবয়েসের লেখালিখির উপর নিজের একটা মায়া থাকে। – বলি আমি। উত্তর আসে-প্রতিকার চাই? মানা করি, এখনি না। -প্রতিকার চাওয়ার মত পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি।সবে সমস্যাটা বুঝতে পারছি।
এবার জানতে চাওয়া হয়-তাহলে, এটা অন্তত বুঝতে পারছো যে এটা একটা সমস্যা।

-শিল্পের ক্ষেত্রেই নার্সিসিজম একটা সমস্যা।
-মায়া বললে যে, নার্সিসিজমে তো আত্মমুগ্ধতা।
-মুগ্ধতা নিয়ে তাকাচ্ছি না, করুনা নিয়ে তাকাচ্ছি। পুর্নেন্দু পত্রীর শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকাটা একবার উলটে দেখো।
-কথোপকথন পড়েছি শুধু, কলেজে পড়াকালীন, বান্ধবীর উপরোধে।
-নাহ্‌, তবে তোমার বয়েস হচ্ছে। করুনা, মায়া এসব বয়েসের দোষ।
-এই এতক্ষণে একটা ঠিক কথা বললে।আমার এক গুরু, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বলতেন-যার কৈশোর নেই, তার প্রতিভার নদীতে সাঁতার কাটতে নামা বৃথা, আবার যার শুধুমাত্র কৈশোর আছে সেও দুর্ভাগা।
-বুঝছি, মায়োপিক হয়ে পড়ছো, কিন্তু আমরা সবাই তো তাই। আমাকে দেখো, আমি ক্যালভিনো ছাড়া আর কি বুঝলাম!
-আপাতত ক্যালভিনোকে ছেড়ে দাও বাপ। দেশি সাহিত্যে এসো, ভাবো তো, জীবনানন্দ যদি বিছানায় থুতনি গুঁজে সারাজীবন ঝরা পালক পড়ে যেতেন।
-সেটা করলে অনেকের যদিও উপকারই হতো, শক্তি যদি সারাজীবন অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি অন্ধকারে পড়তেন...
-এত এত নেমড্রপ না করে সলিউশান দাও। মায়া কাটানো সম্ভব?

কিছু হাসির মধ্যে দিয়ে এই আলোচনা শেষ হয়। আমার বয়েস আজ আটাশ হলো। উচ্চতা ছ ফুট মতোন। ক’বছর আগেও, এই উচ্চতা নিয়ে কোন প্রবীন সাহিত্যিকের দরজার চৌকাঠ পেরলে শুনতে হতো, যতই লম্বা চওড়া হও, তুমি আসলে একটি বাচ্চা ছেলে। সে ধরনের ছাড় পেয়ে যাওয়ার বয়েসগুলো দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে। এই বয়েসগুলোতে দাঁড়িয়েই ভেবেছিলাম, কোন কোন বুড়ো সাহিত্যিককে সম্মাঞ্জনক মৃত্যুদন্ড দিলে নিজের খ্যাতির পথ সুগম হবে। মানুষ বোধহয় নিজেকে দিয়ে কিছুই মাপে না, নিজের সমবয়সীদের দিয়ে মাপে। নিজের হচ্ছে না তো হচ্ছে না, সেই না-হওয়াকে মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু যেই সমবয়সী কারুর হয়ে গেল তো চিন্তা শুরু হলো। সেদিন মাথায় এলো, কি কি হতে পারতো, কি কি হলো না!আনন্দবাজারে রিটেন টেস্ট ছিলো। সম্পাদকীয় বিভাগে লোক নেবে। ব্যাচেলার্সে ফাস্ট ক্লাস থাকলেই হলো। পরীক্ষা দিতে এসেছে ছশো-সাতশো ছেলেমেয়ে। প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের বাড়ির চারতলা জুড়ে সকালে পরীক্ষা চলছে। জানতাম, কিন্তু সেদিনই প্রথম দেখলাম খবরের আপিস সকালে ফাঁকা থাকে। স্টাফদের ডেস্কে বসেই উত্তর লিখছি।টেবিলে নিউজরিলের পাশে ফ্যামিলির এলবাম, রামকৃষ্ণদেব।একটা প্রশ্ন পারিনি-আর্ট কুটুর কি!তারপর দিন যায় দিন যায়, কোন ফোন নেই, চিঠি নেই; ফেল করে গেছি এমন নিশয়তা মনে বসে গেছে। একদিন মোবাইলে অজানা নাম্বারের মিসড কল দেখে ফিরতি ফোন, ওপাশে অটোমেটিক ভয়েস শুনলাম। বিভিন্ন লাইন কানেকশানের পর আসল তথ্যটি হলো-ইন্টারভিউর জন্য ডেকেছে। তো গেলাম, সেখানে বাকিরা সবাই হিস্টি অনার্স, ইকনমিক্স, প্রেসি বা যাদবপুর। রিসেপশানে দেখে আলাদা করে বোঝা যায় না, সবাই ফর্মালে। দরজা নক করে ঢোকার সময়েই ভুল, আসতে-পারি এর বদলে মে আই কাম ইন।নিজ ঘরে যে রাজা হতে পারে না সে পৃথিবীর কি রাজা হবে! যে এঞ্জিনিয়ার নিজে একটা মাল্টিন্যাশনালে চাকরি জোটাতে পারলো না সে খবরের কাগজে চাকরি পাবে! স্বধর্মে বেঁচে থাকাটাও যে কতটা কষ্টের সেটা কি আনন্দমেলার সম্পাদিকাকে বোঝানো যায়, এককোনের রাজনৈতিক সংবাদদাতা কি বিশ্বাস করবেন-যে চাকরিটা পেলেও আমি ছেড়ে দেব না! বেড়িয়ে কিছুতেই চ্যাং ওয়া খুঁজে পেলাম না, হারিয়ে গেলো, নিউ ক্যাথের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বুঝেতে পারলাম আমি আনমনা হয়ে গেছি। চোখের সামনে তখন মিুজিয়ামের গেট, পাঁচ টাকা টিকিট। ফেরার তাড়া থাকলে কেউ কি আর ইন্টারভিউ দিতে আসে। কয়েন এর ঘর, ভারতমাতাকে দেখে মমির ঘরে ঢুকেছি, দেখি মমির মাথার সামনে বসে সিকিউরিটি গার্ড বর্তমান পড়ছে।

এই গল্পটা ফুলুকে যতবার বলি, ও হেসে ফেলে। বলে-তোর আর সন্দীপনের মধ্যে কি পার্থক্য জানিস। আমি এড়িয়ে গিয়ে বলি- আমি আর সন্দীপন যে তুলনায় এসেছি এই ঢের, আর পার্থক্য জেনে কাজ নেই। ফুলু বলে- তুই সিরিয়াস নোস, তুই রিডিকিউল ছাড়া বুঝিস না, কেবল শ্লেষ দিয়ে সাহিত্যটা হয় না।
 
-সন্দীপন রিডিকিউল করেননি?
-করেছেন, তাই বলে সিরিয়াসনেসটাও হারাননি। মিউজিয়ামে ওয়ার্ল্ড ম্যাপ পেতে সেক্স করিয়েছেন। আর তুই মমির দারোয়ানকে বর্তমান পড়াচ্ছিস।
-আমাদের নিয়তিকে অস্বীকার করিসনা, সন্দীপন এর গল্পের ক্যারেকটার দেখ আর আমি এই পোড়া দেশে তোদেরকে নিয়ে গপ্পো ফাঁদছি।
-নিজেকে নিয়েই লেখনাকো একখানি গল্প।

একদম এরোটিক একখানি গল্প।আমি বান্ধবীকে একা বাড়িতে পেয়ে মেলডম করবো বলে ঠিক করেছি। বাজারে গেছি হাতকড়া কিনতে। অথচ ওপেন মার্কেটে কোথাউ হাতকড়া পাওয়া যায় না। অনেক খোঁজাখুঁজি জাস্ট জলে গেল।নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরছি, এমন সুযোগটা নষ্ট হলো, সামনে দেখি এক ফুলওলা। গোল গোল ফুলের মালা বানিয়ে বিক্রি করছে।তাকে বললাম-ফুল দিয়ে একখানা রিং বানিয়ে দাও তো কাকা, বেশ শক্ত হওয়া চাই। গাঁদা তো নেই বাবু। বললাম –গোলাপই চলবে। দোকানদার গোলাপের ছোট কিন্তু শক্ত একটা রিং বানিয়ে দিলে।আন্দাজে দেখলাম-তাতে বান্ধবীর হাতদুটো গলে যাবে অথচ বাঁধন শক্ত হবে। ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে এনে রাখলাম। খাওয়াদাওয়া কথা বার্তার শেষে মোক্ষম মুহুর্তে তাকে রাজি করিয়ে ওই গোলাপের মালা। যত এগুচ্ছে তত রক্ত ঝরছে।কিন্তু থামছি না, সেও থামতে বলছে না। কবজি রক্ত-এ ডুবে যাচ্ছে। কেনার সময় দেখিনি গোলাপের মধ্যে লুকানো কাঁটাগুলোকে।নিজের অজান্তেই যে যন্ত্রনাগুলি দিয়ে চলেছি, আমিও পারছি না সরিয়ে নিতে, সেও পারছে না পরিত্যাগ করতে।

-নিজেকে নিয়ে লিখতে এসে কেমন দেখলি ইয়ার্কি সরে গিয়ে শুধুমাত্র সিরিয়াসনেস পড়ে থাকলো! তাও এত কাঁচা!
ডিমের পোচের দাম মিটিয়ে উঠে পড়াই এখন একমাত্র কাজ। |

Comments