ডiary : শুক্রাণু ৪ : অ র্জু ন ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়
ছবি : ফ্রিডা কাহলো (মাই বার্থ, ১৯৩২)
কত যে ছোট তখন মনেই নেই। কিন্তু সময়ের গায়ে ক্যালেন্ডারের দাগগুলো অনেক মুছে গেলেও, তারিখের ভেতরে যে সময়, আর সময়ের ভেতরে যে আঁচড় রেখে যায় মানুষ, মানুষের মন, মানুষের মনই আবার ফিরে দ্যাখে তাকে, ফিরে শোনে, ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরে শোয় মানুষের মন। সকালে উঠে দ্যাখে কতকাল আগের আঁচড় লেগে আছে ঘুমের ভেতর। শব্দ বোধয় সেইরকম আঁচড়ক্ষম এক নখ। শব্দের উচ্চারণ, উচ্চারণের ভেতর নয়নতারা ফুলের মতো মানুষের মিহি গলা, সেইরকম কিছু কিছু শব্দ হঠাৎ শুনলে কিছু একটা মন্ত্র দিয়ে বুঝি সেই পুরনো কালটা এসে হাজির হয় চোখের সামনে রাজার মতো। এই যেমন, কেউ আমার কানের সামনে সারাদিন 'পানি পানি পানি' ক'রে গেলে আমি হয়তো বুঝবো জল খেতে চাইছে কেউ। কিম্বা পা আর নি স্বর দুটো লাগাতে চেষ্টা করছে খুব ক’ষে। কিন্তু, যখনই তুমি বলবে, 'পানিয়া', ব্যস্। আমার তক্ষুনি বারোটা চোদ্দটা এবং আরও যা যা বাজার সব বেজে গেল। মা খুন্তি নাড়ছেন কড়াইতে। বাবাকে হয়তো পাঠিয়েছেন দোকানে, জিরে গুঁড়ো হঠাৎ ফুরিয়ে যাওয়ায়। আমি পড়াশোনার নামে বিছানায় ব'সে কীই যে করছিলাম ছাই মনেও নেই। কানে আসছে মা-র গুনগুন। তারপরে আস্তে আস্তে ছেড়ে দিলেন গলা। 'বসিয়া বিজনে কেন একা মনে পানিয়া ভরনে চল লো গোরী'... সে গলা কড়াইয়ের ওপর কাঁপতে থাকা ধোঁয়ার আঁচ টপকে চলে গেল রান্নাঘরের পাশে তেজপাতা গাছটার দিকে। আজ, একটু আগে দীপান্বিতা’র একটা কবিতায় এই শব্দটা দেখে বুঝলাম এই 'পানিয়া' শব্দটা আসলে সেই ফেলে আসা কতকাল আগের আমার একটা প্রিয় মুহূর্তে ফিরে যাওয়ার স্যুইচ। এইরকম আরো একটা শব্দ বা স্যুইচ আছে, 'গোঠে'। 'রাখাল' বা 'বৃন্দাবন' শব্দটা শুনলে কিন্তু এর'ম হয় না। কেন যে হয় না, কে জানে! কিন্তু এই 'গোঠে' শুনলেই এইরকম আরেকটা দিন চলে আসে জাদু-বোতলের ছিপি খুলে। যেদিন মা গাইছিলেন 'গোঠের রাখাল ব'লে দে রে কোথায় বৃন্দাবন'... এই দুটো দিনের কোনো একটা দিন তো আমার জন্মদিন হতেই পারে!? মানুষের স্মৃতি পেছন দিকে ঘোরালে, ঘোরাতে ঘোরাতে ঘোরাতে ঘোরাতে ঘোরাতে ঘোর রাতে তার ঘুম ভেঙে যায়। পেছন দিকে ঘুরিয়ে নেওয়া এই স্মৃতি ঠিক যেখানটায় গিয়ে থামে, মানে যেখান থেকে আসলে সে শুরু হয়েছিল, সেই প্রথম স্মৃতির প্রথম ডেবিট অ্যাকাউন্টের প্রথম যে এন্ট্রিস্লিপটা পাওয়া গেল, সেই দিনটাই তো হতে পারে আমার জন্মদিন। যেমন এই দিনটা, তখন 'শ্রীরাধার মানভঞ্জন’ হবে। মা নাচ শেখাচ্ছেন বাড়িতে। আমি বিকেলে ঘুম থেকে উঠে দেখতাম, উদ্ভিন্নযৌবনা বড় বড় দিদিরা ভারী বুক নিয়ে নিচু হয়ে ঘুঙুর বাঁধছে, ঘুঙুরের রিনিঠিনি আওয়াজ হচ্ছে.. ক্যাসেটে বাজছেন মান্না দে.. আমার মনকিন্তু চলে যেত ওই দিদিগুলোর দিকেই। মান্নাবাবুর গলা আমাকে সেখান থেকে নজর সরাতে পারেননি। এরকম একটা দিন, এরকমই একটা সময় তো আমার জন্মদিন হতে পারে, আমার জন্ম-মুহূর্ত? জন্ম বলতে মনে পড়লো মৃত্যু। ক’দিন আগে পড়ছিলাম মলয় রায়চৌধুরীর একটি কবিতা। সনেট। বন্ধু অর্ক চট্টোপাধ্যায় শেয়ার করেছিলেন লেখাটি। মলয়দা কবিতাটিকে যোগচিহ্ন দিয়ে সাজিয়েছেন। নীচে, দু’লাইনের ফুটনোটে লিখেছিলেন সারিবদ্ধ যোগচিহ্নগুলোকে দেখে যুদ্ধ-শেষের কবরখানার দৃশ্যের কথা। এই ছিল কবিতাটি...
+++
+++ +++++
++++ ++ ++++ ++++
+++ +++ ++ +++ +++
++ ++ ++ ++++ ++++
++++ ++ +++ +++ ++
+++ +++ ++ +++ +++
++++ ++ ++++ ++++
++++ ++ ++++ ++++
+++ +++ ++ ++++ ++
++++ ++ ++++ ++++
+++ +++ ++ +++ +++
++ ++ ++ ++++ ++++
++++ ++ +++ +++ ++
++ ++ ++ +++ +++ ++
++++ ++ ++++ ++++
জানি না মলয়দা কি ভেবে লিখেছিলেন, আমার কিন্তু কবিতাটি প্রথমবার দেখে মনে এসেছিল যুদ্ধ শুরুর দৃশ্য। সারি সারি সৈন্য এগোচ্ছে, হাতে বন্দুক পায়ে বন্দুক। পরে, আবার কবিতাটিকে ফিরে পড়তে গিয়ে দেখেছি, দেখতে পাচ্ছি পৃথিবীর সব দেশের সব সীমান্তের সব কাঁটাতার উপড়ে এক জায়গায় জড়ো ক’রে এনে ফেলেছেন কেউ। শুধু অত অত কাঁটাতারে জায়গাটা বড্ড বিশ্রী হয়ে ছিল ব’লে কেউ সেগুলোকে সাজিয়ে রেখেছেন ভালোবেসে। এরও পরে যখন খেয়াল করলাম কবিতাটির নীচে মলয়দার যুদ্ধ-শেষের কবরখানার দৃশ্যের কথা, মানে সেই ফুটনোটটি, অজান্তেই কানে কিন্তু এবারে বাজতে শুরু করলেন পীট সীগার, হোয়্যার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ার্স গন, লং টাইম এগো। আমার কিন্তু সত্যিই মনে হল মৃত্যুকে একমাত্র যোগচিহ্ন দিয়েই প্রকাশ করা সম্ভব। ধরো, তুমি আমার জীবন থেকে চলে গেলে। ধরো আমাদের বিচ্ছেদই হয়ে গেল। এটুকু বললে কিন্তু সত্যিই অসম্পূর্ণ বলা। আসলে আমার জীবনে যোগ হ’ল তোমার চলে যাওয়া। আমার জীবনে যোগ হ’ল তোমার না-থাকা। মৃত্যু একটা যোগ চিহ্নই। জীবনের সাথে যোগই তো হল আরেকটা চ্যাপ্টার। আমি যখন চলে যাব, তখন আমার মরে যাওয়া, আমার চলে যাওয়াটাও যোগ হ’ল আমার জীবনে। আরও একটা সংযোজন হল। এই মরে যাওয়া শুনলে আমার মনে পড়ছে অঘ্রাণের অনুভূতিমালা, মনে পড়ছেসেই লাইনগুলো, গাছ মরে গেলে যা পড়ে থাকে তা গাছ। পাখি মরে গেলে যা প’ড়ে থাকে, তা-ও পাখি, মৃত ব'লে অন্য কিছু নয়। একইভাবে মানুষের মন মরে গেলে যা থাকে, তা-ও মন। মৃত্যুর নিয়মে। মনে পড়ছে, রবি ঠাকুর, আষাঢ়। প্রবন্ধ। বস্তু থেকে অবকাশ চলে গেলে তখন তার মৃত্যু। বস্তু যখন যেটুকু, সেটুকু হয়েই থাকে তখন তার মৃত্যু। ‘হাসিরাগঅভিমানঝগড়াআপোষে’ হেঁটে চ’লে-কথা ব’লে বেড়ানো মানুষ এরকমভাবে কতবার মরে সারা জীবনে? কতবার তার জীবন থেকে চলে যায় অবকাশ। একজীবনে কতবার সেরে নিই নিজেই নিজের পারলৌকিক ক্রিয়াদি। কতবার পুনর্জন্ম হয় এই জীবনের ভেতর আমাদের। যেদিন তুমি প্রেমে পড়লে, সেদিনও কি আমি জন্মাই নি আবার!?
..........
তোমার জন্ম-সন কত? জন্ম তারিখ? জন্ম বার? আরও জানতে হ’লে জন্ম সময়? কিন্তু জন্ম-পঙক্তি? যতবার আমি পড়তে গেছি এই লাইনটা, বা মনে মনে আওড়েছি, স্পষ্ট বুঝেছি, এই স্বদেশ সেন নামের লোকটি একটা হোমটাস্ক দিয়ে গেলেন যেন আমায়। তোমাকেও কি দিলেন না? ছোট্ট সাদা খাতায় লেখা প্রশ্ন—
জন্ম-পঙক্তি থেকে একটা লাইন পড়ো
এবারে জীবনের সিলেবাস মুখস্থ ক’রে আসা ব্যাপারী মানুষ আমরা যখন খুঁজতে বসছি যে কোথায় আছে এই জন্ম-পঙক্তি জিনিসটা, খুঁজতে খুঁজতে বুঝতে পারছি, ওওও আচ্ছা... তাহলে ওটা জন্ম-পঙক্তিমালা, সেখানে অনেকগুলো লাইন আছে, সেখান থেকে একটা লাইন পড়তে বললেন উনি। কিন্তু কোথায় লিখে রেখেছি আমি আমার এই জন্ম-পঙক্তিগুলো? উনি যদি বলতেন সোনার তরী থেকে একটা লাইন পড়ো, কিম্বা বনলতা সেন থেকে একটা, তা’লে না-হয় হ’ত। এমন একটা হোমটাস্ক দিয়ে গেলেন উনি যেটার উত্তর বের করতে কলম্বাস হতেই হবে। নতুনের খোঁজে ও আবিষ্কারে এক সত্য-সন্ধানী ব্যোমকেশ হয়ে খুঁজতে হবে এই জন্ম-পঙক্তিমালা। উত্তর খুঁজে পেলে সবার খাতায় হবে আলাদা উত্তর। সবার জন্ম-পঙক্তিমালা যে ভিন্ন। সেই ভিন্ন ভিন্ন জন্ম-পঙক্তি থেকে সবার আলাদা আলাদা ভিন্ন লাইন উঠে আসুক যার যার নিজের সাদা খাতায়। পৃথিবীতে সবার খাতায় আবিষ্কার হোক জন্ম-পঙক্তি থেকে একটা লাইন। তারপর—
‘..
জন্ম-পঙক্তি থেকে একটা লাইন পড়ো
সারা সৃষ্টিতে এই প্রথম একবার কাজ
পড়ো এমন ক’রে, এমন অসাধারণভাবে পড়ো
যা মৃত্যুচিৎকার থেকে বড়ো ও সমানে ছড়িয়ে যায়’
DIARY |
AUTHOR |
Comments
Post a Comment