ডiary : পত্রলেখাঃ বিপ্লব বদল হল মধ্যগগনে ।১। - সৌম্যজিত





DIARY
AUTHOR
পত্রলেখার চতুর্থ কিস্তি ‘সব সংলাপ কাল্পনিক’ লোকে পড়েনি। কারণ, প্রতি সপ্তাহে প্রেমের গপ্পো, পরকীয়া এসব নিয়ে লিখলে তা একটু একঘেয়ে হয়ে যাবেই। তবু ঝুঁকি নিয়ে লিখেছিলাম। ক্ষমা চেয়ে নিলাম আমার পাঠকদের কাছে, সংখ্যাটা যাই হোক, পঁয়ত্রিশ কিংবা পঁয়ষট্টি।
একাই খেলছ।
একা একাই জিতছ।
একাই কুড়োচ্ছ সাংকেতিক হাততালি।
এ কেমন খেলা রুণু?
একটু তো অভ্যেস বদল কর!
এই অক্ষরমালা ঘরে ফিরে সেদিন লিখে ফেলেছিলাম। এপ্রিলের ২২ তারিখ, ২০১৪। ‘নকশালবাড়ি আন্দোলন’ বা ‘নকশাল’ এই শব্দবন্ধ সম্পর্কে যারা অবহিত, তাঁরা এই অক্ষরমালাকে প্রেমের কবিতা কিংবা অযথাই রুণুকে একটি প্রেমিকার চরিত্রে বসিয়ে দেবেন না, জানি। এই খড়দা’র বুকে ষাট-সত্তরের দশকে একটি সিনেমা হল ছিল, নাম শ্রীমা। পরে মালিকানা বদলের সাথে সাথে সেই সিনেমা হলের নাম কল্পনা, বন্দনা ইত্যাদি হয়। আমরা যখন বড় হচ্ছি, অর্থাৎ নব্বইয়ের দশক, তখন আমি মা-বাবা আর দিদির সাথে এই সিনেমা হলে গিয়ে শেখর কাপুরের ‘ব্যান্ডিট কুইন’ দেখে এসেছিলাম, খুব আবছা মনে পড়ে সেসব কথা। যদিও এখন সে হল আর নেই। পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের বাজারে তা এখন কলত্র নামের অনুষ্ঠানবাড়ী।
তিনটে কিস্তিতে আমি সায়কের মুখ থেকে শোনা ওঁর বাবার কথা বলব। শরত বোস কলোনিতে ওঁর জন্ম।  সায়ক আমার বন্ধু, অটো চালায়। ওঁকে আমরা হুতোম বলে ডাকি। ওঁর বাবার নামটা ভারী সুন্দর ছিল- ধ্রুবজ্যোতি সাহা, সবার জন্য ধ্রুবজ্যোতির ডাকনাম ছিল বুগাবুগা সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক করত ওই শ্রীমা হলে। হুতোমের সাথে একদিন ঠাণ্ডা ঘরে বসেছিলাম আড্ডা দিতে, সল্টলেক সিটি-সেন্টারের একটা বারে। হুতোম বর্তমানে ক্ষমতাশীল একটি রাজনৈতিক দলের অটো ইউনিয়নের সদস্য, ওঁর চিন্তাধারার মধ্যে সেসবের কিছু প্রভাবও পড়তে দেখি। কিন্তু রক্তমাংসের সহজ মানুষটা ধীরে ধীরে সব বাধা ঠেলে বেরিয়ে এলে ওঁকে খুব আদর করতে ইচ্ছে হয়, বুকে টেনে জড়িয়ে ধরি। হুতোম সেদিন নেশা করে হঠাৎ ওঁর বাবার কথা বলতে শুরু করল।
হুতোম কোনদিন ওঁর বাবাকে দেখেনি। ওঁর মা’র কাছে শুধু শুনে গেছেঃ বুগা সেই সকাল ৮ টার মধ্যে বেরিয়ে যেত, দুপুরে এসে স্নান করে, ভাত খেয়ে গলায় আর ঘাড়ে পাউডার মেখে একটু শুত। আধঘণ্টা পরই আবার বেরিয়ে যেত। ফিরতে ফিরতে রাত ৯ টা। বুগা বেশিরভাগ সময় সাদা রঙের ঢোলা প্যান্ট পড়ত, তখনকার দিনের সেই বচ্চন স্টাইল জামার কলারের নীচে খুব যত্ন করে একটা রুমাল রাখত। বুগা একদিন এসে হুতোমের মা’কে বলেছিল যে ‘শোনো, আর কোন চিন্তা করতে হবে না। রোজরোজ আর এ-গলি, ও-গলি পালাতে হবেনা। সব কথা হয়ে গেছে। পুলিশের ইনফর্মারের কাজ। কেস পিছু পেমেন্ট পাব। ’ সেটা তখন সত্তরের দশক। নকশাল-পিরিয়ড বলে আমরা যে সময়টাকে রেফার করে থাকি। পুলিশের খোঁজাখুঁজির খাতায় তখন অনেক বড়-মেজ-সেজ-ছোট নকশাল নেতার নাম ছিল। বুগার প্রথম আস্যাইনমেন্ট ছিল খড়দাতেই- প্রদীপ ধর ওরফে শুকু। বুগাকে রীতিমতো ভেক ধরতে হয়েছিল, এক মুখ দাড়িগোঁফ নিয়ে পাগল সাজতে হয়েছিল। বুগার সঙ্গে ছিল একটা চাদর, ছেঁড়াখোঁড়া একটা নোংরা তোশক, আর কিছু কাগজপত্র; ঠোঁটে ছিল একটা গানঃ ‘হাম তুম এক কামরা মে বনধ্ হ্যায়’ খড়দা স্টেশনে সে দেড় মাসেরও বেশি সময় ওইভাবেই কাটিয়েছে। অবশেষে ধরা পড়েছিল শুকু। এসব কথা বলতে বলতে হুতোমের চোয়াল শক্ত হতে দেখি আমি। ওঁর হাতে হাত রাখি। কিছু বলার আগেই ও বলে ওঠে, জানিস্ বাবা যাদের জন্য এতকিছু করেছিল, সেই পুলিশের বাচ্চাগুলোই ওঁকে মেরে ফেলেছিল। আমি এসব শুনতে শুনতে কোথাও যেন ফিরে যাচ্ছিলাম সত্তরের সেই না চেনা দিনগুলোতে। বইপত্র, কিংবা কয়েকটা লিফলেট, কিছু প্রিয় মানুষের লেখা, সাক্ষাৎকার, মৃণাল সেনের সিনেমা– এসব তখন আমার কাছে তুচ্ছ মনে হচ্ছিল।
হুতোম আর বুগা’র মধ্যে এই যে দেখা না হয়েও দেখা হওয়া, আমি শ্রদ্ধা করি সেই অনুভূতিকে। আমি নকশাল আন্দোলনের ভালোমন্দের দিক থেকে এই লেখা লিখছি না। আমি একজন নকশাল পিরিয়ডের পুলিশ ইনফর্মারের কথা বলছি। আমার বিশ্বাস, আমার পাঠকেরা ধৈর্য ধরবেন।
(ক্রমশ)
            

Comments