ডiary : কিছু বিপ্লব বদল হল মধ্যগগনে ।৩। : সৌম্যজিত চক্রবর্তী
DIARY
|
AUTHOR
|
।২।–এর পর...
বুগাকে যেদিন থেকে কোন এক পুলিশকত্তার বেশ ‘বিশ্বস্ত’ মনে হয়েছিল, সেদিন থেকে বুগা হয়ে গেছিল ‘নেউল’। নেউল-বুগা কে আর ভেক ধরতে হয়না, হাতে পয়সা একটু বেশিই আসে। মাঝেমধ্যে ইনফর্মারকে সিনিয়রের মত ক’রে শ্যাডো প্র্যাকটিস্ করানো, একটু খুচরো জ্ঞান এসব অনেক কিছুই বুগা আয়ত্ত করে ফেলেছে। বুগার প্রোমোশনের গপ্পো করতে করতে হুতোম হাল্কা হাসে। আমারও বেশ মজা লাগে – ইনফর্মারের প্রোমোশন, ইনক্রিমেন্ট এসব শুনে। মাঝেমধ্যে আবার মনে হয়, হুতোম এতকিছু বলছে, সবগুলোই কি সত্যি ঘটনা? না কি মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে বিপ্লবে খানিক জলও মিশিয়ে দিচ্ছে! কিছুতেই প্রশ্নটা ক’রে উঠতে পারছিলাম না।
সেটা ছিল আটাত্তর সাল। শ্যামনগর ঘাটের কাছাকাছি ঋতু গুহ নামে এক যুবতীকে গ্রেফতার করে কিছু পুলিশ। ঋতু গুহ কোনদিনই নকশাল-স্ট্যাম্পড ছিলেননা। তাঁর বাড়ির কেউ একটা নকশাল আন্দোলনের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন, যিনি ছিলেন বুগার নেউল-আস্যাইনমেন্ট। অনেক চেষ্টাচরিত্রের পর বুগা পারেনি তাঁকে ধরতে। খবর নিয়ে বুগা ঋতু গুহ’র কথা জানতে পারে, সে আস্যাইনমেন্টের বাড়ির মেয়ে- কলকাতার কলেজে পড়ায়, শিক্ষিকা। বুগা দেখেছিল অন্যায় ভাবে ঋতু গুহকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশের লোক। ঋতু’র মুখ দেখে নাম-না-জানা সেই মেয়েটার কথা মনে হত বুগারঃ কলোনি’র গলি... প্রজাপতি বিস্কুট... প্রায় প্রতিদিন খড়দা স্টেশনে তার অবাধ যাতায়াত... একদিন... বুলেটের শব্দ... চাপ চাপ রক্তের সাথে সেই পায়ের পাতলা পাতার সেই আমরণ সখ্যতা... সব মনে পড়ে যেত। বুগা জেনেছিল, সেই মেয়েটাকে মেরে ফেলেছিল তার ‘বাবু’রা। সেটা একটা খুন ছিলঃ এনকাউন্টার নামের গল্পকথার অর্থ ততদিনে সে বুঝে গেছে।
ঋতু’কে যেদিন হাত পিছমোড়া করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, বুগা ঘর ফিরে আসতে পারত- কতগুলো দিন সে ঘরছাড়া! কতদিন দেখা হয়নি বউয়ের সাথে! কতদিন দুপুরবেলা একটু মাংস কিনে ঘর ফেরেনি সে! শুনেছে শ্রীমা’র নাম বদলে হয়েছে বন্দনা, প্রজাপতি বিস্কুটের দাম বেড়েছে, সবাই বলছে একটা ‘বিপ্লব’ হচ্ছে চারিদিকে। সব কিছু বদলে যাবে। সবাই একটা রুটি ভাগ করে খাবে। যা হবে, সব ভালোর জন্য হবে এবার থেকে। বুগা ভালো চায়নি। বুগা মরতেই চেয়েছিল। যে মরণে অনেক প্রেম, অনেক বিশ্বাস, অনেক ভালোমানুষি, অনেক নোংরামি- সব... সব একসাথে ঘর বাঁধে, আনকোরা হাতে চাল-ডাল মিশিয়ে খিচুড়ি রাঁধে... সেই মরণ। মরণের সাজসরঞ্জাম কিনে সে ঘর ফিরেছিল আরও তিন-চার দিন পর।
চোদ্দ বছর পরের কথাঃ
উনিশশো বিরানব্বই সাল, কলকাতা হাইকোর্টে বুগা সাক্ষ্য দিল ঋতু গুহ’র হয়ে। বিখ্যাত খবরের কাগজে বুগার নাম ছাপা হল কোণার দিকে ছোট্ট করে-
পুলিশের গুপ্তচর ধ্রুবজ্যোতির সাক্ষ্যে রেহাই পেলেন মেধাবী ঋতু
এই শহর স্বপ্ন দেখেছে কেবল মেধাবী ঋতুদের নিয়ে। বুগাকে নিয়ে কোনদিন কোন স্বপ্ন দেখেনি এই শহর। একটা টিকিট ব্ল্যাকার, পুলিশ ইনফর্মার- তাকে ‘আপনি’ বলতে এই শহরের ঘুম পেয়ে যায়। তার কথা জানতে এই শহরের ক্লান্তি আসে। একদিন ভোরে এই শহরের প্রশাসন রক্ষীরা গাড়ি চড়ে আসে কলোনি’র গলিতে। চা... প্রজাপতি বিস্কুট... কিন্তু আর আর চা খেতে ডাকে না বুগাকে। একটা বুলেটই যথেষ্ট। হিন্দি ছবির মত ভিলেইন মরে যায়। স্বস্তি পায় এই শহর। স্বস্তি পায় মরণ।
কাট্...
স্মোকিং জোন-এ সিগারেট খেতে খেতে আমার সেই না-করা প্রশ্নটা করেই ফেলি হুতোম’কেঃ সবগুলোই কি সত্যি ঘটনা ?
বুগা আর হুতোমের রোজ কথা হয়, টেলিফোনে। হ্যাঁ, টেলিফোনে। হুতোম বলছিল, কোনও একটা ব্লু-ফিল্মে ও একবার দেখেছিল- এক বাবা তার জেল-খাটা ছেলের সাথে কথা বলতে গেছে... গিয়ে একটা কাঁচের জানলার ওপার থেকে টেলিফোনটা কানে ধরে এপারে ছেলের সাথে কথা বলছে। একটা ব্লু-ফিল্মের ফাঁকে এই দৃশ্যটা দেখে হুতোমের ভালো লেগেছিল, এবং সেটা ও মনে রেখে দিয়েছে- এটা যতবার ভাবি, ততবার ওর জন্য আমার ভালবাসা আরও বেড়ে যায়। কেন আমরা আজও বন্ধু হয়ে থাকতে পারছি, তাও টের পাই।
আমার কথা যেটুকু না বললেই নয়ঃ
এই লেখা নকশাল আন্দোলনের একটা চাপা থেকে যাওয়া দলিল হতে পারে , আবার না ও হতে পারে । তবে , এটা এমন এক বিপ্লব যা আমি নিজের মনে , মাথায় আপন করে রেখেছি । যেমন রেখেছিল বুগা , যেমন রেখেছেন মাসিমা । যেমন রেখেছে আমার হুতোম প্যাঁচাটা । এবার আপনাদের পালা । বুগার কথা লালন করবেন , না কি ছুঁড়ে ফেলে দেবেন , তা ...
(শেষ) |
Comments
Post a Comment