ডiary : শুক্রাণু ৬ : অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়


DIARY
AUTHOR

শুক্রাণু ৬ :

“”অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়   


'দিন আগেই মানুষ ভাগ হয়েছিল কং-তৃণ-সিপিএম-বিজেপি-তেআবার হবে। মাঝে ভাগ হ'ল পাঞ্জাব চেন্নাই পুনে কোলকাতায়রপরে ভাগ হ ঘানা চিলি ইতালি স্পেন ব্রাজিলেসেদিন দুপুরে হাঁটছিলাম রাস্তা দিয়েবরানগরেরোব্বারের দুপুরল্যাদ খেতে খেতে বেলা গড়িয়ে গেছেখাবারের দোকানের সব হাঁড়ি ফাঁকাকি যে খাব ভাবতে ভাবতে হাঁটছিদেখলাম, বিরাট একটা খেলার মাঠ, দু'ধারে যার গোলপোস্ট পোঁতাআগের রাতের বৃষ্টিতে কাদা হয়ে আছে মাঠচারটে বাচ্চা ছেলে, হাফ প্যান্ট প'রে, একটা ফুটবল নিয়ে মাঠে দাপাচ্ছেআমিও দাঁড়িয়ে গেলাম দু'দণ্ডদেখলাম ওরা লুটোপুটি খাচ্ছে কাদায়এ ওকে জড়িয়ে ধরছে কাদার মধ্যেগোল করার দিকে, পয়েন্ট হাসিল করার দিকে, গোলপোস্টের ত্রিসীমানার মধ্যেও বলটাকে নিয়ে যাবার দিকে, কাউকে টপকে কাউকে ড্রিবল ক'রে এগিয়ে যাওয়ার দিকে ওদের কোনো লক্ষ্যই নেই দেখলামওসব করতে নামেই নি ওরা মাঠেশুধু এই বন্ধুসঙ্গ, এই পড়ন্ত বিকেল, এই যে লীলা, এটারই শরিক হতে চাইছে ওরামনে আসছিল অমিয়ভূষণের 'মধু সাধু খাঁ'র সেই লাইনটা... 'এমত দৃশ্য দেখিয়াছ আরু? এমত প্রেম এমত খেলা!' শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আবার আরেকটা গোওওওওওওওওওল ব'লে ক্রুর আনন্দ পাওয়ার কোনোই অভিলাষ নেই ওদের বড়োদের বড়োমাঠের বড়ো খেলাগুলো কেন যে এর'ম হয় নাজীবনের সব জায়গায় একটা শত্রু দাঁড় করাতে হবে আমার সামনে!? এ কেমন খেলা!! তোমার হাত থেকে কিছু ছিনিয়ে আনতে পারলে তবেই আমি জয়ী!? তবে যে শুনেছিলাম, শেষ জয়ে যেন হই আমি বিজয়ী তোমারই কাছেতে হারিয়া!?
ইংরিজিতে একটা কথা আছে, Life is nothing but a competition to be the criminal rather than the victim. খেলার বিরুদ্ধে আমি নই। জীবনের বিরুদ্ধেও না। আমি বিরুদ্ধে এই কিলার ইনস্টিংক্টের। এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার। তার মাঠ যেটাই হোক না কেন। একটা সময়ে, যখন ছাত্র পড়াতাম, প্রায়ই তাদের বাবা-মাকে বলতে শুনতাম অভিযোগ করছেন আমায়। তোমার ছাত্র তো বাড়িতে একদম পড়াশোনা করে না। এটা শুনলেই, আমি উলটে বলতাম, ঠিকই তো করে, কেন পড়বে! আপনারা কেউ পড়েন বাড়িতে? ও তো কোনোদিনও আপনাদের কাউকে কিছু পড়তে দেখেনি। তাহলে ও কেন
পড়বে! মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা একটা বিখ্যাত বই আছে, দক্ষিণের বারান্দা। জোড়াসাঁকোর ঠাকুবাড়ির দক্ষিণ দিকের বারান্দা আর অবন ঠাকুরকে নিয়ে লেখা। মোহনলাল অবন ঠাকুরের প্রপৌত্র। কিশোর মোহনলাল এবং বাড়িতে আরও অনেকগুলি শিশু একসাথে বড়ো হচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই তারা দেখছে বাড়িতে কেউ ছবি আঁকে, কেউ লেখে। আর নানান লেখক আসেন বাড়িতে। এই দেখে ছোটদেরও খুব ইচ্ছে হয়েছে গল্প লিখবার। কিন্তু, কি করে লিখবে? গল্প লিখতে গেলে তো প্লট চাই। প্লট পাবে কোথা থেকে? সবাই গেল দাদামশায়, মানে অবন ঠাকুরের কাছে। সব শুনে দাদামশায় বললেন, এই নিয়ে ভাবছিস? কেন? স্বপ্ন দেখিস না? লিখে ফেল সেগুলো। গল্প হয়ে যাবে। শুরু হয়ে গেল বাড়িতে স্বপ্ন লেখার পাঠ। তৈরি হল খাতা। দাদামশায় বলে দিলেন পরদিন সকালে সবাই ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসার আগে চলে আসবে আমার কাছে। আগে স্বপ্ন লিখে তারপরে পড়তে বসা। ঘুম চোখে পরদিন সবাই হাজির স্বপ্ন লিখতে। একের পর এক বাচ্চা খাতায় লিখে যাচ্ছে স্বপ্ন। একটু পরে ওদের মাস্টারমশাই এসে গেছেন পড়াতে। তিনি এসে দেখেন বারান্দা জুড়ে চলছে স্বপ্ন লেখার ক্লাস। ভদ্রলোক অবাক। অবন ঠাকুর বললেন, ওরে, মাস্টারমশাইকে দিয়েও একটা স্বপ্ন লিখিয়ে নে। হ্যাঁ, তিনিও লিখলেন। সেই খাতার নাম ছিল স্বপ্নের মোড়ক। অবন ঠাকুরও লিখেছেন সেখানে স্বপ্ন। কিন্তু কেন বলছি এ গল্প? বলছি এই কারণে, একটি বাচ্চার বেড়ে ওঠার সময়ে তার যে অপার প্রশ্ন আর কৌতূহল থাকে তার চারপাশ নিয়ে, একজন প্রকৃত অভিভাবক কিভাবে লালন করেন সেই শিশুর মনটিকে, কিভাবে তাকে আলো দেন, জল দেন, তার হাতে তুলে দেন এক স্বপ্নের মোড়ক, তাকে যুদ্ধে নামান না। বইটিতে, এই স্বপ্ন লেখার জায়গাটিতে মোহনলাল লিখছেন, পড়ার ঘন্টা শেষ হয়ে গেল। বই খোলা আর হল না। স্বপ্নে স্বপ্নে ভরে গেল আমাদের শ্রীরামপুরী কাগজ, আমাদের দক্ষিণের বারান্দা আর আমাদের পড়ার ঘন্টা।  রিয়েল এস্টেট কোম্পানি আর পার্টির প্রোমাটারেরা এক এক করে সব মাঠগুলো যত নিয়ে যাচ্ছে, সাথে খুন করছে কতগুলো শৈশবকে। এই যজ্ঞের হোতায় মা-বাবাও। সাথে ইংলিশ মিডিয়াম ইশকুল। সাথে ইউনিট টেস্ট। সাথে আরো নম্বর আরো নম্বর। সাথে আরো কতজন, কত কি। এ কি আজব খুড়োর কল!  
থিয়েটারের সূত্রে একসময় সুযোগ হয়েছিল শিশুদের সাথে মেশার। নান্দীকারের সাথে তখন চিল্ড্রেনস্‌ থিয়েটার প্রোজেক্টে রয়েছি। ইশকুলের বাচ্চাদের নিয়ে, নদীর চরের বস্তিতে থাকা বাচ্চাদের নিয়ে, যৌনকর্মীদের পাড়ায় তাদের বাচ্চাদের নিয়ে নাটক, নাটকের নানান ওয়ার্কশপ। আসলে কিন্তু খেলা। আসলে কিন্তু হৈ-হৈ। বাচ্চাগুলোই নাটকের গল্প লিখছে, কেউ বাজাচ্ছে, কেউ গাইছে। যাঁরা থিয়েটার কর্মী, থিয়েটারের ওয়ার্কশপগুলোর সাথে পরিচিত। বিশেষ করে বাচ্চাদের নিয়ে যেগুলো হয়। একটা খুব মজার খেলা ছিল। তোমাকে একটা বাক্স দেওয়া হল। তুমি কল্পনা করে নাও সেই বাক্সটা কেমন। বড়ো, না ছোট। বড়ো হলে কিরকম বড়ো। স্যুটকেস না ট্রাঙ্ক। তুমি ভেবে নাও মনে মনে। বাক্সটা নতুন না পুরনো। পুরনো হলে তাতে হয়ত ধুলো জমে আছে। ভারী না হাল্কা। ভারী হলে বাক্সটা টেনে আনবে খুব কষ্ট করে। সবটাই মনে মনে ভেবে নাও তুমি। সেটা খুলতে হয় কিভাবে। কিরকম তার তালা। কি আছে সেই বাক্সের ভেতরে। সব তুমি জানো। আমি খালি তোমায় একটা বাক্স দিলাম। দেখা যেত, কারোর বাক্স থেকে বেরোচ্ছে পরীক্ষার কোয়েশ্চেন পেপার। কারোর বাক্স থেকে ক্যাডবেরী। একবার একটা ছেলের বাক্স থেকে বেরিয়েছিল সাপ। ছেলেটা তো ভয় পেয়ে দৌড়। সাপও তাড়া করেছে তার পেছন পেছন। ছেলেটাও দৌড়চ্ছে প্রাণপণে। শেষে সাপটা কামড়েই দিল ওকে। পড়ে গেল ছেলেটা। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। এবারে নাটকের দলের একজনকে বাধ্য হয়ে যেতে হল ডাক্তার সেজে। সে গিয়ে ইঞ্জেকশন দিয়ে বাঁচালো তাকে। এর কোনোটাই কিন্তু আগে থেকে ভেবে নিয়ে করা নয়। সব তাৎক্ষণিক। প্যালেস্তাইন কিম্বা কাশ্মীরের একটা বাচ্চাকে এরম বাক্স দিলে, তার বাক্স থেকে কি বেরোবে? কল্পনা করা যায়?                    
সেদিন একজন ভদ্রমহিলা ফোন করেছেন। আমার পরিচিত। এবং কাছের মানুষ তিনি। দুই ছেলে ওনার। বড়ো ছেলে ন বছরের। ছোটটি বছর পাঁচ-ছয়েক। তো, এই ছোট্ট মানুষটি টিভিতে নাচের প্রোগ্রামগুলো দেখতে খুব ভালোবাসেন। নিজে নাচতেও ভালোবাসেন খুব। এতটাই তাঁর আগ্রহ নাচে, রাতে ডিনার টেবিলে বাবা-মা-দাদার সাথে বসে যদি তাঁর হঠাৎ খেয়াল হল, আরে, আজকে তো নাচ করা হয়নি, তিনি তক্ষুনি খাওয়ার টেবিল থেকে উঠে একটু নেচে আসবেন আগে। তারপরে খেতে বসবেন। মায়ের ওড়না লিপস্টিক দিয়ে সাজুগুজু করে খেলবেন দুপুরে। তো, কদিন ধরে তিনি তাঁর মাকে বলছেন, মাম্মি মাম্মি আই ওয়ান্ট টু বি এ গার্ল। আমাকে একটা গার্ল বানিয়ে দাও। এই বার্বি  ডলটার মতো আমাকে একটা পিঙ্ক ড্রেস কিনে দেবে, আর গোল্ডেন হেয়ার হবে আমার। শুনে মায়ের তো মাথা ঘুরে যাওয়ার অবস্থা। এ ছেলে বলে কি! বাবা রেগে আগুন তেলে বেগুন। বলছেন, এই ছেলেকে আমি ছেলে বানিয়েই ছাড়বো। পুরুষ হতে হবে ওকে। ওকে আমি ফুটবল কোচিঙে ভর্তি করাব। মা বলছেন, না না, ওকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাব। কাউন্সেলিং করাতে হবে।
আমি মনে করি না শুধু আল-কায়দা, তালিবান, শুধু নরেন্দ্র মোদী, আডবাণীই মৌলবাদী। শুধু অ্যামেরিকাই সাম্রাজ্যবাদী নয়। এই চাপিয়ে দেওয়া আগ্রাসন, যিনিই করছেন, যেখানে করছেন, তিনিও মৌলবাদী। তিনিও একজন অ্যামেরিকা। সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক বলে যখন হাতের মুঠি শূন্যে তুলে মিছিলে নামছে মানুষ, নিজের ভেতরের অ্যামেরিকাটি মিটিমিটি হাসছে তখন, দেখুন হাসছে।    





Comments