ডiary : শুক্রাণু ৫ : রিয়ালিটি শো - অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
DIARY |
AUTHOR |
আমার জীবন-যাপন দেখে, পড়াশোনা, লেখালিখি এসব লাভ-নেই কাজ নিয়ে রাতদিন প’ড়ে থাকা দেখে, এবং আসলে চাকরিতে-বাজারে আমার পরম অনীহা দেখে, কত লক্ষবার যে কত গম্ভীর মানুষকে আরও গম্ভীর হয়ে বলতে শুনেছি, ওহে তুমি যে-পথের পথিক ওটা রিয়ালিটি নয়, এই দ্যাখো বৎস, এই হল রিয়ালিটি। আমি সত্যিই ভীষণ খুশি হতাম, যদি সেই গম্ভীর মানুষদেরকে দেখে‘নীলঅঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায় সম্বৃত অম্বর, হে গম্ভীর হে গম্ভীর’ গানটি আমার মনে পড়তো। কিন্তু না, এ গম্ভীর সে গম্ভীর নয়। তো যাই হোক, গুছিয়ে চাকরি আমার আর হল না। লোকে যাকে চলতি কথায় বাস্তব বলেন, আমি বলি অ্যাপিয়ারেন্স, আমার সেই অ্যাপিয়ারেন্সজ্ঞানও আর হ’ল না। সেদিন দুপুরে, দোতলার ঘরে ব’সে আছি। জানলা দিয়ে দেখছি একটা কাক, ঠোঁটে ডিমের গোল খোসাটা মুখে ব’সে আছে গ্রিলের ওপর। খোসার মাথার দিকে একটা জায়গা ছোট্ট ক’রে ভাঙা। বাকিটা আস্ত। কালো কাকের ঠোঁটে ঐ শাদা গোল ডিম, কাক জানে সে তার বাসাটা বানাবে, বেশ কিছু মানুষও সেটা জানে। বাকি অল্প মানুষ ভাবে পৃথিবীটা ঠোঁটে তুলে নিয়ে যাচ্ছে কাক। বার্ট্রাণ্ড রাসেলের থিওরি মেনে হয়ত বলা যায়, প্রথম জানাটা অ্যাপিয়ারেন্স। আর দ্বিতীয় ভাবনাটি রিয়ালিটি। এই যে ফিজিক্যাল অবজেক্ট, যাকেআমি সংবেদনে পেলাম, এ’ তো ইন্দ্রিয় উপাত্ত (sense-data)। এর বিন্যাস চাই।চৈতন্য চাই। উপাদানের উৎস বস্তু নিজে। তা phenomena/অবভাস। তবু, শুধুসংবেদনে, শুধু ইন্দ্রিয়ে, শুধু অভিজ্ঞতায় সম্পূর্ন অবভাসকে কিন্তু পেলাম না। বাকিথেকে গেল। কেন না, কি সংবেদন কি ইন্দ্রিয় কি অভিজ্ঞতা, কোনো কিছুই তো‘পৃথিবীটা ঠোঁটে তুলে নিয়ে যাচ্ছে কাক’-এর ছবিটা দেখাচ্ছে না। তাহলে এটা কোথায় পেলাম? অবভাসকে ভেদ করে বস্তুর ভেতরে পাই বস্তু-স্বরূপকে। ব্যাপারটা শুনতে কেমন গোল গোল ধোঁয়ার মতো লাগছে, না?
বসে ভাবি আমার ঘুমের জ্যামিতিকে
ফ্রয়েড নকল করেছে।
ফ্রয়েড নকল করেছে।
চেয়ার টেবিলের কথাও ভাবি
কিভাবে কাঠের স্পর্ধা আমাদের
বসতে দিয়েছে;
কিভাবে কাঠের স্পর্ধা আমাদের
বসতে দিয়েছে;
দিয়েছে ল্যাম্প রাখার জায়গা।
এটা কবি অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতার অংশ। ওঁর ‘লোডশেডিং’ কবিতার বইয়ের। ‘কিভাবে কাঠের স্পর্ধা আমাদের / বসতে দিয়েছে ; / দিয়েছে ল্যাম্প রাখার জায়গা’, এইখানে ‘কাঠ’-এর সাথে এই ‘-এর’ বিভক্তিটি স্পর্ধার সাথে কাঠের যে সম্পর্ক দেখালো, এই স্পর্ধাটাই কাঠের রিয়ালিটি হ’ল। যে রিয়ালিটির অবদান হ’ল চেয়ারে আমাদের বসার জন্য বা টেবিলে ল্যাম্প রাখার জন্য যে জায়গাটি আছে, সেটি। এই হ’ল রিয়ালিটি। বাকিটা appearance। তার রঙ, তার শেপ—অ্যাপিয়ারেন্স। এই appearance বদলে যায়, কিন্তু বস্তুর চেতন, তার স্বরূপ বদলায়না। একটা কাঠের টেবিলকে ভেঙে চেয়ার বানিয়ে ফেলতে পারি। কিন্তু কাঠের কাঠত্ব তাতে বদলে গিয়ে জল হয়ে যায় না। এই রিয়ালিটি ব্যাপারটা একদম ঐ পরমাণুর মতোই। মতো বলছি কেন? পরমাণুই তো। তবে, এইটা ভাবার জন্যে মানুষের মনে অবকাশ চাই। এই অবকাশ ছড়িয়ে আছে জগতে অবিন্যস্ত। কোনো মানুষ তা’ কুড়িয়ে পায়। কোনো মানুষ পায় পরিশ্রমে। কোনো মানুষ চেনে না তাকে। কোনো মানুষ খোঁজে না। সকালে ঘুম থেকে আমার ওঠার সময় মোটামুটি দশটা। উঠে, কিছু না কিছু নিয়ে পড়তে বসে যাওয়াটা অভ্যেস। সেদিনও পড়ছিলাম কিছু। শুভদা এলেন ঘরে। শুভদা ব্যবসায়ী মানুষ। তোমার জন্য আমি আধ ঘন্টা বসতে পারি, যদি আমি সেজন্য পয়সা পাই। এই বিরাট বিপুল চিন্তা তিনি ধারণ করেন তাঁর মস্তিষ্কে। ঘরে এসে, আমায় পড়তে দেখে বললেন, কি এত পড়িস বল তো! কি লাভ এত পড়ে? কেনই বা তোরা লিখিস এত!? নিজের নাম ছাপাবার জন্যে এত কিছু করিস!? এর চেয়ে আলু বেচ না, পটল বেচ, সর্ষের তেল বানা। লাভ হবে। আমি হাসছি। কি আর বলব। সত্যিই তো। এবারে উনি গুছিয়ে বসলেন চেয়ারে। আবার জিগ্যেস করলেন, কি লাভ? বললাম, শুভদা, আমরা এখন যেখানে আছি, এই যে বরানগর, এখানেই এক ভদ্রলোক থাকতেন। ভাস্কর চক্রবর্তী। শুভদা, ভুরু কুঁচকে, সে কে? বললাম, একজন কবি। মারা গেছেন। তো, উনি একটা কথা প্রায়ই বলতেন ব’লে শুনেছি, লেখালিখি ক’রে জীবনটা বরবাদ হয়ে গেল। শুনে শুভদা হাসছে দেখি। বোধয় ভাবছে, দ্যাখ্, দেখলি তো, তোদের কবিও বলে গেছে এ’কথা। আমি একটু থেমে, ভাস্কর চক্রবর্তীর পরের বাক্যটা বললাম, লেখালিখি না করলে জীবনটা আরও বরবাদ হয়ে যেত। শুভদা গম্ভীর এবারে। ভাস্করের এই প্রথম বাক্যটাকে অ্যাপিয়ারেন্স আর দ্বিতীয়টাকে রিয়ালিটি মনে হচ্ছে না? যাই হোক, বছর বারো হল এই লেখালিখি করছি, এখনও প্রায়শই শুনি কেউ আমায় জিগ্যেস করছেন, তুমি যে এত লেখো, কি লাভ হয় এতে? পয়সা দেয় ওরা? এই যে আমরা কথায় কথায় বলি, এটাই রিয়ালিটি, এটাই বাস্তব, তো রাসেল মশাই একটা মজার রিসার্চ পেপার লিখেছিলেন এই রিয়ালিটি নিয়ে। প্রমাণ করে দিয়েছিলেন Sense information about objects fails to reflect the ‘real’ object। রবি ঠাকুর বলতেন শিল্পকর্ম হচ্ছে, অহৈতুকী কাজ। কোনো অ্যাকাউণ্টেন্টের খাতায় এর পাই পয়সা খরচের হিসেব নেই, সে জন্যেই দ্যাখো ফুলগুলোতে এই এত এত রঙ, আকাশ জুড়ে এত নীল। কেন করলো এত রঙের অপচয়? এই বিস্ময়ের অবকাশ তো বেশিরভাগ মানুষের কাছে গুরুত্বই পায় না। পাওয়ার কথাও নয়। বরং, দেখতে পাই অনেক অনেক মানুষ, যাঁদের মাথা থেকে পা, পুরোটাই পেট। দরবারীর কোমল ধৈবত আর ভৈরবের কোমল ধৈবত যে আলাদা, কতটা আলাদা, তা’ ভাববার দরকার কোথায় এই পেট-পৃথিবীর! কলেজে পড়ার সময় ফিলোসফিতে একজন স্যরকে পেয়েছিলাম আমরা। খুব অল্প ক’দিনের জন্যেই পেয়েছিলাম। প্রথম যেদিন এলেন উনি, কলেজে মেয়েদের মধ্যে প্রশ্নপত্র বিলি শুরু হয়ে গেল, ইনি কি বিবাহিত? অসামান্য রূপবান এক যুবক। কলেজ সোশ্যালে স্টেজে উঠে কিশোরের গান গাইছেন। দুর্ধর্ষ গলা। উড়িষ্যার মানুষ। স্পষ্ট বাঙলা বলতে পারতেন না। হিন্দি বা ইংরেজিতেই ক্লাস নিতেন। কিন্তু ইহা অ্যাপিয়ারেন্স। রিয়ালিটি হল, একদিন ক্লাসে জিগ্যেস করলেন, হোয়াট ইজ রিয়ালিটি? আমরা বেশিরভাগই বলছি, চার্বাক রেফারেন্স এনে। উনি একটা অদ্ভুত উদাহরণ দিলেন। ধরো, তোমার চোখের সামনে, আই লেভেল বরাবর একটি সুঁচ রাখা হয়েছে, টেবিলে গেঁথে। উল্লম্ব ভাবে। তুমি কী দেখছো? স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছো সুঁচের উল্লম্ব দণ্ডটি। যাকে তুমি সুঁচ বলেই চিনে নিতে পারছ। সুঁচ দেখার তোমার পূর্ব অভিজ্ঞতার ছবির সাথে এই ছবি মিলে যাচ্ছে। এবারে ধরো, তোমাকে কী দেখানো হবে সেটা আগে থেকে না জানিয়ে তোমার চোখ বেঁধে দেওয়া হল। আর ঝুলিয়ে দেওয়া হল তোমায় ঐ ওপরে সিলিং ফ্যানের মতো, উপুড় ক’রে। এবারেও তোমার চোখ বরাবর একটি সুঁচ উল্লম্বভাবে মাটিতে বা টেবিলে গেঁথে রাখা হল। তবে এবারে তুমি তাকে আই লেভেলে দেখবে না। তুমি দেখবে ওপর থেকে নীচে। এবং কী দেখবে? চোখ খোলার পরে কী দেখবে তুমি? দেখতে পাবে একটি বিন্দু। দ্যাখো, আগে যেটা দেখেছিলে, সেটা তোমার ঐ অবস্থানের বাস্তবতা। আর এটা, এখন যেটা দেখছো, এটা এই অবস্থানের। তাহলে, কী দাঁড়ালো? মানুষের অবস্থান তার চেতনাকে নির্ধারণ করে। চেতনা কখনো অবস্থানকে নয়। ইশকুলে পড়ি যখন, আসা-যাওয়া শুরু হয় অমিয়ভূষণের বাড়ি। সাহিত্যসূত্রে নয়। বন্ধুসূত্রে। ওঁর নাতি, সানি, মানে চন্দ্রহাস ক্লাসমেট। তখনও পড়িনি মধু সাধু খাঁ। ফ্রাইডে আইল্যাণ্ড। ওঁর কোনো লেখাই। দেখতাম গুরুগম্ভীর মানুষটি ব’সে আছেন বাইরের ঘরটায়। আমরা পাশ কাটিয়ে চলে যেতাম আড়াই তলার কোণের ঘরে। ওদের দেওয়ালে দেওয়ালে সানির বাকি ভাইদের আঁকা আবোল তাবোলের নানান ছবি। ইয়াব্বড়ো বড়ো। হ য ব র ল-এর বেড়াল, খুড়োর কল, গোমড়াথেরিয়াম। সব। এইভাবে ছড়িয়ে আছে অবকাশ, অবিন্যস্ত। ভাগ্যিস কেউ বলেনি কি লাভ এঁকে! ভাগ্যিস কেউ বলেনি দেওয়াল নোংরা হচ্ছে। বাড়িটার অ্যাপিয়ারেন্স খারাপ হয়ে যাচ্ছে এটা বোধয় ভাবে নি ওদের বাবা-মায়েরা। হয়ত ভেবেছিল ছেলেগুলোর রিয়ালিটি নিয়ে।
.........
এই যে হিন্দু vs. মুসলিম, ইণ্ডিয়া vs. পাকিস্তান, ইস্রায়েল vs. প্যালেস্তাইন, ব্রাসিল vs. জর্মনি লড়ছে, যুদ্ধের মাঠে কি খেলার মাঠে, রাসেল মশাই লড়াইটা বাধিয়ে দিলেন Common Sense Reality আর Philosophically Defensible Reality-র মধ্যে। পরীক্ষাটা করলেন একটা টেবিলের রঙ নিয়ে। Common Senseযেখানে বলছে, টেবিলের একটি stable color আছে, ভদ্রলোক সেখানে মাত্র ছ’লাইনে প্রমাণ ক’রে দিলেন, না শুধু প্রমাণই করলেন না, একেবারে কনক্লিউশন টেনে দিলেন, the table has no stable color। কে বলেছে ম্যাজিক রিয়ালিটি মানে খালি মার্কেজ?
তো, এহেন রিয়ালিটির সমর্থক এই আমি, এবং এহেন অ্যাপিয়ারেন্স-সুলভ বাস্তবতা বিমুখ এই আমি যে জগতের ভালো ছেলে হয়ে ভালো ছেলের আচরণাবলী মেনে চলার যোগ্যতা অর্জন পর্বেই পাশ করব না, এ’ তো বোঝাই যাচ্ছে। ঊননব্বই বছর বয়েসে শেষবার জেলে যেতে হয়েছিল বৃদ্ধ রাসেলকে। লণ্ডনের বুকে দাঁড়িয়ে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের সোচ্চার দাবি তোলায়। নোবেলজয়ী বৃদ্ধ দার্শনিককে বিচারক বলেছিলেন, মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে যান জেল থেকে। শুধু মুচলেকায় কথা দিতে হবে, বাইরে বেরিয়ে তিনি ভালোভাবে চলবেন। মানে ঐ গুড বিহেভিয়র আর কি। রাসেল উত্তর দিয়েছিলেন বিচারককে, ‘‘I won’t’’.
Comments
Post a Comment