ডiary : পত্রলেখা : ইন্টারভিউ : সৌম্যজিত চক্রবর্তী







DIARY
AUTHOR

ইন্টারভিউ


আচ্ছা, ‘ইন্টারভিউ’ শব্দটা শুনে আপনাদের প্রথমেই কি মনে আসে? একটা হাফ পর্দা টাঙানো, দরজা ভেজানো ঘরের ভিতর থেকে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসা চঞ্চল মুখার্জি? না কি ঐ দরজার দিকে গট্ গট্ ক’রে এগিয়ে যাওয়া শক্ত শিরদাঁড়ার সিদ্ধার্থ চৌধুরী? আমার কথার সুত্র ধরতে না পারলে সত্যজিতের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ একবার দেখে নেবেন। আমি এই দুটো উদাহরণ দিলাম এই কারণেই- ছোট্ট একটা নৈমিত্তিক আলাপে আমি কিছু মানুষের কাছ থেকে এই দুটো কথা বারবার শুনেছি। আমার যেটা প্রহমেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তা হলঃ সিগারেটটা ডান থেকে বাঁ হাতে নিয়ে রঞ্জিতের টুক্ ক’রে ট্রামে উঠে পড়া, স্যুট-পরিহিত ম্যানেকুইনকে নগ্ন করা- মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’। মৃণাল সেন সম্পর্কে আমার একটু বেশিই ভালবাসা বা আবেগ- এসব আমার কাছের মানুষরা বেশ ভাল করেই জানেন। তাই ঐ মানুষটার কথা না এলে কোথায় যেন কি একটা ‘খালি খালি’ লাগে! পত্রলেখা’র এই দ্বিতীয় কিস্তিও একটি ইন্টারভিউকে ঘিরে। এই কলাম যদি বাজারকাটতি ১ নং, ২ নং কোন খবরের কাগজে লিখতে হত, জানি- সম্পাদক আমায় লেখা থামানোর পরামর্শ দিয়ে ধবধবে সাদা একখানা খাম ধরিয়ে বলতেনঃ “ভাল থাকুন”। কেন? কারণ, আগের দিনের ডায়েরি ঠিক যে জায়গায় শেষ করেছিলাম, আজকের ডায়েরি ঠিক সেইখান থেকেই শুরু। কাঁহাতক একই জিনিস নিয়ে কচকচানি হপ্তায় হপ্তায় ভাললাগে বলুন তো! তবে আমার বিশ্বাস- আমার সম্পাদক মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায় আমায় দ্বিতীয় কিস্তি অবধি সহ্য করবেন, খিস্তি দেবেন না। আজকের কথাগুলোর সূত্রপাত একটা ইন্টারভিউ থেকেই। মৃণাল বাবু কে একটু ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করার জন্য। না, ইনি মৃণাল ‘সেন’ নন, গুহঠাকুরতা। যে জনা পঁয়ত্রিশ মানুষ আমার আগের লেখাটি পড়ে বোতাম টিপে তাঁদের ‘পছন্দ হয়েছে’ এমন জানিয়েছেন, তাঁদের কাছে নামটা চেনা ঠেকবে আশা করছি। আমি চেয়েছিলাম যে প্রথম কিস্তি ‘সাধারণ...তবু সাধারণ না’ পড়ে অন্তত একজন হলেও বলবেন বা চাইবেন যে কামরাবাদের অলিতে-গলিতে একটু যদি ঢুঁ মারা যায় সেই বইওয়ালা’র খোঁজে। কিন্তু ব্যস্তসর্বস্ব ডায়েরির পাঠকরা সেই উৎসাহ না দেখানোয় আমি ঠিক করি যে আমিই যাব ‘বিপ্লব’-এর খোঁজে- চেষ্টা তো করে দেখি। ঠিকানা বলতে ঐটুকুই সম্বলঃ কামরাবাদ, সোনারপুর। তবু মনের ভেতর থেকে জোর টা পেলাম। আমার সঙ্গী করলাম যাঁকে তাঁর নাম মালবিকা, আমার বন্ধু। এই প্রসঙ্গে ছোট্ট একটা কথা জানিয়ে রাখি, আগের কিস্তিতে প্রথমদিকে এক জায়গায় ‘বান্ধবী’ শব্দটা ব্যবহার করেছিলাম, কিন্তু তারপর থেকেই মনটা খচখচ করছিল যে ওটা ‘বন্ধু’ লিখলেই পারতাম। তাই দ্বিতীয় কিস্তিতে লিঙ্গবাদের উর্দ্ধে উঠে ‘বন্ধু’ই সম্বোধন করলাম। যাই হোক, মালবিকা ইংরেজি সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ছাত্রী, তাই উনিই আমার প্রথম পছন্দ ছিলেন। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, গত ১৮ই জুন। আশাবাদী ছিলাম না যে মৃণাল বাবুর বাড়ি আমরা খুঁজে পাবই, তবু বেরিয়ে পড়লাম। এবং কিঞ্চিৎ খোঁজাখুঁজির পর পেয়েও গেলাম তাঁর বাসা। ‘বাসা’- এই শব্দটাই ব্যবহার করলাম, কারণ রবীন্দ্রসরণি’র প্রথম যে বাড়িটার পলেস্তারা-খসা দেওয়ালের আদর খেয়ে লেটারবক্স বহন করছে একটা ঠিকানাঃ লেট্ মৃণাল গুহঠাকুরতা, অরুণা গুহঠাকুরতা; সেই বাড়িটা আসলে পূর্ব রেলওয়ের রেন্টালে খাটানো। সেই ’৭১ সাল থেকে ওঁরা এই বাড়িতে ভাড়া থাকেন। প্রাথমিক আলাপচারিতার পরে ‘দশ ফুট বাই দশ ফুট’-এর সোঁদা গন্ধওলা বিছানায় বসে অরুণাদেবীর সাথে যা যা কথা হয়েছে, তার কিছুটা আমি তুলে দিলাম, বাকীটা ব্যক্তিগত- অনেক গভীরের, অনেক আশার, অনেক আদরের। ইন্টারভিউ শুরু হল দুপুর ২টো বেজে দশ মিনিট নাগাদ। 
মালবিকাঃ মৃণালবাবু চলে গেলেন কবে? কোন অসুখ করেছিল? না কি বার্ধক্যজনিত কারণে? 
অরুণাঃ এই দু’বছর হল, ২০১২’র ৩রা মে। ২০১১ তে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমনিতেই অ্যাজমার অসুবিধা ছিল, তার ওপর প্রস্টেটের সমস্যা হল। কে.পি.সি.’তে (কালী প্রদীপ চৌধুরী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, যাদবপুর) ভর্তি ছিলেন বেশ কিছুদিন। বয়েস হয়েছিল ৭৮ বছর।
মালবিকাঃ আচ্ছা উনি তো পায়ে হেঁটেই নিজের লেখা বই বিক্রি করতেন? এই কাজটা করতেও তো ওঁনার শারীরিক পরিশ্রম হত নিশ্চয়ই।
অরুণাঃ হ্যাঁ, তা তো হতই। কিন্তু উনি সেই কষ্টটা করতেন। আমাদের বিয়ে হয় সেই ’৭১ সালে। উনি বিয়ে করতে চাননি। তখন ওঁর ৩৫ বছর বয়েস, আর আমি সদ্য মাধ্যমিক দিয়েছি। লেখক মানুষ। যাই হোক, সাহিত্য চর্চা করেন। গল্প, উপন্যাসের প্রুফ দেখেন। তখন প্রসাদ পাবলিশিংয়ে উনি নিয়মিত যেতেন। তাছাড়া আভা, বুক ট্রাস্ট, বিজয়ায়ন, পূর্ণ,  মৌসুমীতেও যাওয়া আসা ছিল। উনি নিজের লেখা বইগুলি নিয়ে কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো ট্রেনে চড়ে কোথায় কোথায় গিয়ে বিক্রি করতেন! এই ধর, ২০০৮-০৯ অবধি কিন্তু উনি এই কাজটা করে গেছেন প্রায় প্রতিদিন।
মালবিকাঃ আর সংসার? সংসার চলত কিভাবে? এখনই বা কিভাবে চলছে আপনার? যদি কিছু না মনে করেন, আপনাদের সন্তান কোথায় থাকেন?
অরুণাঃ আমাদের একটা ছেলে হয়েছিল, কিন্তু খুব অল্প বয়েসেই, ঐ ৩ বছরের মাথায় ও মারা যায় অসুখে। আর দেখো, সংসার চলত, কখনো না চলার মধ্যেই চলত। দুটো মানুষ ঠিক চালিয়ে নিতাম। এটুকু বলতে পারি, যে ওঁনার লেখার জগতের সাথে সাথে উনি প্রচণ্ড সংসারীও ছিলেন কিন্তু। বেশি কিছু বলতে হতনা, সময় করে সংসারের এটা-ওটা-সেটা নিয়ে আসতেন নিজেই। অল্প খরচেই সংসার চালিয়েছি আমরা। তবে খুব রেগে যেতেন যখন ঘরে অতিথি এলে তাঁকে বসিয়ে বাইরে বেরতে হত, বারবার বলতেন- ‘কেন আমাকে মনে করিয়ে দাওনি যে ঘরে চাল-ডাল নেই!’ এমন অভাবের দিন অনেক গেছে, তবু কোনদিন কোন অভাব টের পাইনি ওঁর সাথে এক ছাদের তলায় থাকতে গিয়ে। প্রথম দিকে প্রকাশকের কমিশনের পয়সায় সংসার চলত, শেষের দিকে সরকারের (পশ্চিমবঙ্গ সরকার) দুঃস্থ লেখকদের একটা সামান্য অনুদান পেতেন, তাই দিয়ে আমাদের দিব্যি চলে যেত। কিন্তু ২০১১ সাল থেকে ওটা আর পাচ্ছিনা আমরা। রাইটার্স থেকে নবান্ন- অনেক ঘোরাঘুরি করছি। বলেছে, একটা এনক্যোয়ারি হবে আমাদের বাসায়। ওঁনার লেখা বইপত্র- এই দেখো, সব গুছিয়ে রেখেছি।
... এই বলে আটখানা গল্প, উপন্যাসের বই এনে দেখালেন আমাদের। এই মুহূর্তের সাথে জড়িয়ে থাকা কিছু আবেগ আমি ডায়েরিতে লিখতে পারার উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পেলামনা। তাই ‘কাট্’ বলে ইন্টারভিউয়ের একেবারে শেষদিককার কথায় আসি-
মালবিকাঃ আপনার ঘরে এত ঠাকুর-দেবতার ছবি। এসব কি আপনার বিশ্বাসের, না মৃণাল বাবুর? 
অরুণাঃ একটা মজার কথা বলি তোমাদের। উনি প্রচণ্ড নাস্তিক ছিলেন। ভগবানকে এক্কেবারে সহ্য করতে পারতেননা। আমার ঠাকুর-দেবতাদেরকে পায়খানায় বসিয়ে দিয়ে আসবেন বলে মাঝে মধ্যেই ভয় দেখাতেন। (অনেক মেঘের পর মানুষটার মুখে হাসি) তবে পেরে উঠতেননা আমার সাথে, পারা যায় বল? হাজার হোক, পরিবার! (আবার হাসি) তবে জান, উনি ওঁর মা-বাবা’কে খুব শ্রদ্ধা করতেন, এমনকি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেও দেখেছি আমি।
মালবিকাঃ আপনি মৃণাল বাবুর লেখা পড়েছেন কোনদিন?
অরুণাঃ (অবাক হয়ে, একটু হেসে) হ্যাঁ, কেন পড়বনা? পড়েছি তো। অনেক লেখা পড়েছি। উনি তো লেখার পরে প্রথমে এসে আমাকেই শোনাতেন। 
মালবিকাঃ আপনার সে সব লেখা শুনে/পড়ে কি মনে হয়েছে? কেমন লেখক উনি?
অরুণাঃ (হাসি) মন্দ নয়। ওঁর লেখার ভাষা খুব সহজ-সরল। হয়তো ভেবেছিলেন নাম করবেন, বড় লেখক হবেন। হতে পারেননি। সে অন্য কথা। কিন্তু লিখে গেছেন। পড়াশোনা করতেন খুব।
... এই বলে মৃণাল গুহঠাকুরতা’র পড়ার ঘরটা দেখালেন, ছোট্ট একটা অন্ধকার ঘর। টেবিলটা একখানা শাড়ি দিয়ে ঢাকা। চকিতে মনে হয়, মৃণাল বাবু বুঝি লিখতে লিখতে চশমাটা খুলে রেখে উপুড় হয়ে একটু বিশ্রাম করছেন। আবার দেওয়ালের দিকে তাকাই- ভুল ভেঙে যায়। ঐ যে, ধুতি-পাঞ্জাবী পরে একটা ছবি তুলেছিলেন বোধহয় যৌবনের দিনগুলিতে, যখন ঊর্মিমালা ভাবতঃ “...রবিবার। আজ সারা শহরের বিশ্রাম। ...একজনের ছুটি নেই কেন তবু আজ?” আমার বইওয়ালা, আমার একটি ‘বিপ্লব’- উনি এবার সত্যি সত্যিই ছুটি নিয়েছেন। অরুণাদেবীকে দিয়ে গেছেন এক মুঠো ‘মন্দ নয়’ অক্ষরমালা, পিঁপড়ে-ধরা চিনির বয়ামের ভেতর একথালা সংসার, আর রাইটার্স-নবান্ন ঘুরে ঘুরে হারিয়ে যাওয়া একটা চেক্ খুঁজে বের করার অদম্য প্রাণশক্তি। কৃত্তিম পেসমেকারের দৌলতে দিব্য দাঁড়িয়ে আছে অরুণাদেবী’র ভেজা ভেজা ঘরদোর। 
এবার উঠতে হবে। বেরিয়ে পড়তে হবে আমাদের। আমি ‘প্রুফ-রীডার’ বইটায় হাত বুলিয়ে বলে ফেলি, আমরা আবার আসব কিন্তু একদিন। এই বইগুলি আমরা একটু ফটোকপি করে নিয়ে যাব, পড়ব। জড়িয়ে ধরলেন অরুণাদেবী। জড়িয়েই থাকুন। নিজের গায়েও আজ চামড়ার বয়েস হওয়ার গন্ধ পেলাম।
পরের কিস্তিতে আর এই নিয়ে লিখব না।
 |




 |
|

Comments