ডiary : পত্রলেখা : থর থর এই হিয়া, পরকীয়া ... : সৌম্যজিত চক্রবর্তী






|

DIARY
AUTHOR


|


“ভুল মানুষকেই খুঁজি, নিতান্তই যদি খুঁজি।
যার সঙ্গে দেখা হলে জীবন জীবন হত,
আকাশ আকাশ, সে নয়,
বারবার সামনে দাঁড়িয়েছে অন্য কেউ,
স্পর্শ করেছে হাত অন্য কেউ,
মেঘলা করেছে দিন অন্য কেউ।” – ভুল মানুষ, তসলিমা নাসরিন

তৃতীয় কিস্তি লিখতে বসার আগে বেশ দোটানায় ছিলাম যে পরকীয়া নিয়ে এই বাড়াবাড়িটা করা উচিৎ হবে কিনা? কিন্তু অল্প কিছুক্ষণ পর মনে হল, ‘পরকীয়া’ শব্দটাই তো এমন- একটু ‘বাড়াবাড়ি’, একটু ‘নিষিদ্ধ’ ইঙ্গিতকারী, একটু ‘ভুল-ঠিক’ ছোঁয়াছুঁয়ি জারি। এমনিতে পরকীয়া নিয়ে বহুল চর্চা হয়েছে পৃথিবীতে। ধর্মের হাত ধরে যদি এর পথ চলা শুরু হয়ে থাকে, তবে তা আরও উজ্জ্বল সাহিত্যে বা দর্শনে, কিংবা নিদেনপক্ষে উচ্চশিক্ষার একটি ক্ষেত্র হিসেবে। আসলে ধর্ম তো মানুষের জীবনযাপনেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তাই ধর্মের নাম করে যে কোন জিনিসকে খাওয়ানো যায়। আর ধর্মের নামে যে জিনিস খাওয়ানো যায়না, সেগুলিকে ‘মৌলিক চিন্তা’ বলে দেখিয়ে দাও গানে আর চলচ্চিত্রে। বুঝিয়ে দাও আমি ধার্মিক নই, আমি বেহিসেবি আহাম্মক! এতটাই কি সহজ মানুষের মন, মনের ঘরে বাস ক’রা আপনজনের হদিশ পাওয়া? মনে হয় না। আমি দুষ্মন্ত-শকুন্তলা বা রাধা-কৃষ্ণ নিয়ে এখানে কথা বলবনা। কেনই বা বলব বলুন? এঁদের নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা আছে, তর্ক আছে, বোধের উষ্ণতা আছে। আমি যেটুকু বলতে পারি, আমার কথা। এই কলকাতার কথা। এই শতাব্দীর কলকাতা।

প্রেমের আবার স্বকীয়া, পরকীয়া কি হে? প্রেম তো এমনই হয়। সে প্রেম, ক্লাস সেভেনেও ‘পরের প্রতি’ অনুভূত; আবার পঁয়তাল্লিশের দোরগোড়ায় এসেও সে ‘পরের প্রতিই’ নিবেদিত। এবার যদি অভিধান ধরে পথ হাঁটেন, তবে ‘পরকীয়া’র অর্থ ঐ এক ধরণের বিবাহ-বহির্ভূত কিংবা এক সম্পর্ক রক্ষা ক’রেও কোনো এক দ্বিতীয় সম্পর্কের আভাস দেবে আপনাকে। আর যেহেতু আমরা সুড়সুড়ি খেতে ও দিতে বড় ভালবাসি, তাই ঐ অভিধানকেই শিরোধার্য ক’রে নেমে পড়ি লুকোচুরি খেলতে। সেই কারণে পরকীয়া নিয়ে আমাদের এত উৎসাহ। একটা খুব সাধারণ গল্প করি? আপনি রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। একটু সিগারেট ধরাবেন বলে এ.ডি. কেবিনের সামনে দাঁড়ালেন। আর ঠিক তখনই দেখতে পেলেন আপনার শ্যালকটি অন্য এক স্ত্রী-মানুষের হাত ধরে বেরিয়ে আসছেন পেপার ন্যাপকিনে গোঁফ মুছতে মুছতে। কি আশ্চর্য! আপনার শ্যালক আপনাকে চিনতেও পারলেননা। সোজা বেরিয়ে গিয়ে ঐ মেয়ে-মানুষটিকে তাঁর দু-চাকার পিছনে বসিয়ে মুহূর্তে উধাও। ঘর ফেরার পথে আপনি ভাবছেন আপনার স্ত্রীকে গিয়ে তাঁর ভাইয়ের ‘কীর্তি’ জানাবেন, কি না! ভাবছেন, কিভাবেই বা বলবেন?- বলবেন যে একটা মেয়ের সাথে তোমার ভাইকে দেখলাম? না কি স্রেফ এড়িয়ে যাবেন? শ্যালককে কি আলাদা করে একদিন জিজ্ঞেস করবেন? এসব ভাবতে ভাবতে আপনি কিন্তু ‘স্ত্রী-মানুষ’ থেকে ‘মেয়ে-মানুষ’, ‘মেয়ে-মানুষ’ থেকে কেবল একটা ‘মেয়ে’- এই জায়গায় নিজের ভাবনাকে নিয়ে গেছেন, সেটাও মাথায় রাখবেন। তখন কি একবারও মনে পড়বে আপনার, “কনে-দেখা আলোয়” আপনিও কবে যেন একবার নেশা ক’রে পরস্ত্রী’র হাতটাকে নিজের বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে মিথ্যে বলেছিলেন, আমি তোমাকে ভালবাসি, সত্যিই ভালবাসি। সেই পরস্ত্রী আর কেউ নয়, আপনার সাথে সপ্তাহে ছ’দিন মেট্রোয় দেখা হওয়া কোন নারী-চরিত্র। আমার বিশ্বাস, আপনি ভাববেন সে কথা। আসলে আমরা সকলেই প্রেমিক। প্রেম করতে চাই। সেটা শরীরের হতে পারে, মাথার, মনের কিংবা শুধু গান বা কবিতার টানেও হতে পারে। প্রেম করতে চাওয়াটাকে আমরা প্রকাশ করি ‘ভালবাসা’ দিয়ে। কারণ, ঐ শব্দটাই অনেক ‘সেফ্’!

স্মিতা, আমার এক সাংবাদিক বন্ধু। একটা খবরের কাগজের অফিসে যে ছোটখাটো কাজ করতে এসে আমাদের দেখা হয়েছিল সেই ২০০৬ সালে, সেই কাজটা আমায় ছেড়ে যেতে হয় ২০০৭-এর মাঝখানে। আমি চলে আসি শান্তিনিকেতনে- আমায় গ্র্যাজুয়েট হতে হবে কিনা! স্মিতা পড়াশোনা ও চাকরি- দুইই দিব্যি চালিয়ে গেল। একটা সময় ওঁর সাথে রাস্তায় খুব হাঁটতাম। কখনো গড়িয়া, কখনো পার্ক স্ট্রিট, কিংবা কখনো কাঁচরাপাড়া নেমে অচেনা একটা গলি ধ’রে হেঁটেই যেতাম, হাঁটায় কোনদিন কোন ক্লান্তি ছিলনা আমাদের। ওঁকে কি কখনো ভালবেসেছি? জানি না, বলতে পারবনা। তবে হ্যাঁ, চুটিয়ে প্রেম করেছি। সেই প্রেম এমনই ঠুনকো ছিল যে কেউ কারো খবর রাখারও প্রয়োজন বোধ করিনি। তবে শত্রুর মুখে আগুন দিয়ে সেই প্রেম আবার জ্বলে উঠল বছর চারেক বাদে, এই ধরুন ’১১ নাগাদ। তখন শান্তিনিকেতনে এক বন্ধুকে আমি বেশ ভালবাসি-একটা সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। কি একটা কাজে শান্তিনিকেতন থেকে এসেছিলাম কলকাতায়! আবার কি ভাবে যেন স্মিতার সাথে দেখা হয়ে গেল সেই রাস্তাতেই, যে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একদিন রাস্তাবদল করেছিলাম। স্মিতা তখন অন্য একটা ছেলের সাথে ঘোরে। ছেলেটির নাম বলেছিল সে, কিন্তু আমি যথারীতি মনে রাখিনি। রবীন্দ্রসদন বহুবার গেছি, সেখানে বসে আড্ডা মেরেছি। নামকরা ব্যক্তিত্বদের হেঁটে-চলে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। কিন্তু কোনদিন উল্টোদিকের ঐ মোহরকুঞ্জে ঢোকার কথা মনে হয়নি। কেন হয়নি, বলতে পারবনা। এমনিই, হয়নি! স্মিতা সেদিন বলল, মোহরকুঞ্জের লাইট অ্যান্ড সাউন্ড দেখেছিস্ কোনদিন? আমার উত্তর- না। বেশ তবে, চল্। আমি কি ছাই জানতাম যে ওখানে লোকে প্রেম করতে যায়? গিয়ে বসলাম। লোকে হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, একটুআধটু ঘনিষ্ঠ হতে চাইছে। কেউ আবার কি অদ্ভুত সুন্দর চাহনিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গান গাইছে। একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতও যেন কোথাথেকে ভেসে আসছে! চার বছর কলকাতার প্রতি অভিমান ভুলে আমি যেন আমার চেনা কলকাতাকে একটূ একটু করে আবার ফিরে পাচ্ছি। যে কলকাতায় মানুষেরা ন’তলা মলে গিয়ে উইন্ডো শপিং করেনা, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে একটা নেপালি ছেলের হাত ধরে বাঙালি মেয়েটা রাস্তা পার হয়, আইসক্রিম বলতে এখনো কমলা-কাঠির ভালবাসা বোঝে, গোরস্থানে বসে কবিতা পড়ে দুটো কৈশোরঃ স্মিতার ঠোঁট আমার নাকের কাছে এলে মুহূর্তে পুরুষাঙ্গ তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জীবনের প্রথম চুম্বন ন্যানোসেকেন্ডের সাথে পাল্লা দিয়ে জয় করে নেয় পৃথিবীর যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট, অনাহার, অন্যায়। মন-মাথা-শরীর ঝিমঝিম করতে থাকে আরও কিছুক্ষণ। ‘আমাকে জাগাও’ পড়ে থাকে ঘাসের উপর। একটা কাঠপিঁপড়ে এসে মাথা গুঁজতে চায়, তবু আমি জাগি না... এসব হিজিবিজি পুরনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছে তখন। একটা ফাঁকা জায়গা দেখে আমি আর সে বসি। স্মিতা বলে, বিকেল হতে না হতেই এখানে সবাই পরকীয়া করতে আসে- এটাই মোহরকুঞ্জের বিশেষত্ব, বুঝলি। হঠাৎ দুটো মানুষের দিকে তাকিয়ে সে আমায় বলে, দ্যাখ্, ওঁদের পরকীয়া। আমি চেয়ে দেখি, আমার বহুদিনের চেনা এক প্রিয় মানুষের পাশে বসে একটা শাখা-সিঁদুরের স্ত্রী-মানুষ। আমার মাথায় মুহূর্তে যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। এ কী হচ্ছে, কী দেখছি আমি? নিজের সাথে অদ্ভুত লড়াইয়ে পড়ে গেলাম। স্মিতা বলেই চলেছে- ঐ যে লোকটা, ও কিন্তু লেখালেখি করে, টুকটাক বইপত্রও বেরোয় ওঁর। ওঁ কিন্তু বিবাহিত, জানিস্! মুহূর্তের খারাপ লাগা’কে যেই মাথার মধ্যে থেকে বের করে হৃদয় দিয়ে দেখলাম, বুঝলাম- আমিও বড় হয়ে গেছি। স্মিতাকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা- আমরাও কি তবে পরকীয়া করছি? পরকীয়া কাকে বলে? স্মিতা বলল, কেন! তোকে কি আমি চুমু খেতে যাচ্ছি নাকি? আমি- চুমু খেলেই তবে পরকীয়া হয় বুঝি? কই, ঐ যে ওঁরা তো চুমু খাচ্ছে না, তুই তবে কেন বললি যে ওঁদের পরকীয়া? স্মিতা- আরে, ওঁরা দুজনেই এক্সট্রা-ম্যারিটাল আ্যফেয়ার করছে, এইটুকু তোর মাথায় ঢুকছে না? উফফ। আমি- পরকীয়া মানে কি তবে এক্সট্রা-ম্যারিটাল আ্যফেয়ার? এরপর শুরু হল এক লম্বা বাগবিতণ্ডা। আমাদের গলার স্বর শুনে কিছু মানুষ বিচলিত। তখন পরন্ত বিকেল। মোহরকুঞ্জের আলোগুলো সব একে একে জ্বলে উঠেছে। প্রচুর অফিস-ফেরত মানুষ ভিড় করছে সত্যি সত্যিই, তবে পরকীয়া করতে কিনা জানি না। বাইরে বাস আর ট্যাক্সির হর্নগুলো ধীরে ধীরে বড় প্রেমিক হয়ে উঠেছে তখন। স্মিতাকে বড় কাছে পেতে ইচ্ছে করল, প্রেম করতে। সেই প্রথম ওঁকে বন্ধু না ভেবে পরস্ত্রী ভাবলাম আমি। পরস্ত্রীর হাত ধরা, নাকের উপর চশমার কাঁচে বাষ্প-হিসির মত উত্তেজনা। স্মিতার গলা কেঁপে গেল- আমার কিন্তু... পরস্ত্রীর হাতটা ছেড়েই দিতে পারতাম। মনেও হয়েছিলঃ “যাবো না আর ঘরের মধ্যে অই কপালে কি পরেছো”। কিন্তু পারিনি, সেও যেমন পারেনি। অনেক গান, আলো, ছন্দক ফোয়ারার মাঝে দাঁড়িয়ে সেদিন দুজনেই বুঝেছিলাম, আসলে পরকীয়া বলে কিছু হয়না। প্রেমটা প্রেমই। আমাদের অনুভুতিগুলোকে নিয়ে আমরা এমন একেকটা নাম দিয়ে ফেলি যে, সেইখান হতে বেরিয়ে আসতে আমাদের সময় লেগে যায় আরও একটা নতুন নাম না পাওয়া পর্যন্ত। আপনারা পরকীয়া বলতে কি বোঝেন? আমি কিন্তু কোন ভাল-মন্দ মূল্যবিচার করতে বলছিনা। একটু বলবেন। অনুরোধ রইল, জানাবেন।

পুনশ্চঃ আমি কোন সাহিত্যিক নই। আমি সাহিত্যের ধ্বজা ধরে পরকীয়াকে দেখাতে চাইনি। আমি এক্কেবারে অভিজ্ঞতার কথা বললাম। কেউ এই লেখাটির সাহিত্য-গুণ নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন। তবু আমার অনুরোধ, একটু মন-প্রাণ খুলে কথা বলুন। এই ডায়েরি কিন্তু স্রেফ ‘পছন্দ’ করার জন্য নয়। যাঁদের অপছন্দ হয়, তাঁদের জন্য ‘অপছন্দ’ করার কোন সুযোগ যেহেতু নেই এখনো, তাই চাইব মন্তব্যে অন্তত তাঁরা লিখুন যে আমার লেখা আপনাদের অপছন্দ হয়েছে, এবং কেন অপছন্দ, তাও। আমি উত্তর দিতে চাই। আমি আলোচনা চাই।   


|

Comments