ডiary : অচলায়তন - আমাদের প্রথম চলচ্ছবিঃ মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়





ছেলেটা বুঝতে পারছে দেড় মাসের বেশী সময় নেই। পরীক্ষা ভালো হয় নি। সব সাব্জেক্টে পাশ করবে কি না ঠিক নেই। বাবার অনেকগুলো টাকা খরচ হয়েছে পড়ার পেছনে। দেড় মাস পরে রেজাল্ট। ভাবে। অনেক ভাবে। মনে পড়ে জোকস্‌টা-ফাঁসির আসামিকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, তার শেষ ইচ্ছে। নাহ্‌ এই সময়টা নষ্ট করলে চলবে না। এই ক’বছর প্রচুর বই কিনেছে।
পড়া হয় নি সব। সেগুলো শেষ করবে। খাওয়া-দাওয়া, জামা-কাপড়, ঘোরাঘুরির শখ নেই তেমন। একটা ইচ্ছে ছিল। একদিন একটা সিনেমা বানাবে। হাতে তো সময় বেশি নেই। তাই এই দেড় মাসের মধ্যেই। সে তো অনেক খরচ! এতোটাকা কে দেবে! প্রোডিউসারের খেয়ে দেয়ে কাজ নেই তোর মত একটা আনকোড়াকে সিনেমা বানাতে টাকা দেবে। লাইট সাউণ্ড ক্যামেরা একশান। একটা টেবিল ল্যাম্প, হোল্ডারে ঝোলানো ১০০ ওয়াট জ্বলে উঠল। একটা দেড়শো টাকার মাইক্রোফোন। আর একটা হ্যাণ্ডিক্যাম। শুরু হল অচলায়তন। এর আগে কিছু ঘটনা ঘটেছে। সিনেমা করতে টাকা লাগে না। আর্জেণ্টিনায়, মোবাইলে সিনেমা করা হয়, তন্ময় বলেছিল। এই সিনেমার আর একজন ডিরেক্টার। যে মেয়েটি আগের দিন রাতেও জানিয়েছে, তুমি চিন্তা কোরো না মৃগাঙ্ক দা। আমি ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবো। শুটিং শুরুর একঘণ্টা আগে সে এস এম এস করেছে, সে আসতে পারবে না। সারারাত জেগে শুটিংয়ের সমস্ত ব্যাবস্থার পর সকালে জানতে পেরেছি যে বাড়িতে শুট হওয়ার কথা, সেখানে হবে না। ভেবেছিলাম, ছেড়ে দেব। কিন্তু পাগলামিটা ছাড়তে দেয় নি। এস এম এস করেছি, প্লিস ভাই এই কাজটা করে নিতে দে, সব ঠিক হয়ে গেছে। কারণ একা ছেলেটাই জানে, চলে যাওয়ার আগে একটা সিনেমা।

 সমীর দের বাড়ির দোতলাটা সবে হয়েছে। এখনো প্লাস্টার হয় নি। সমীরদের একটা জানলা লাগানো হয় নি। জয়দীপের একোরিয়ামে আর মাছ নেই। খালি কাঁচ পড়ে আছে। সমীরদের রান্নার বড় কড়াই। প্রথম দৃশ্য শুরু হল শুটিংয়ের। কড়াইতে জল ঢালা হল। মেয়েটির মুখের ছায়া পড়ল সেই জলে। পরের দৃশ্যে, লোহার জানলার ফ্রেমে ঝুলিয়ে দেওয়া হল একটা হ্যারিকেন। জয়দীপের একোরিয়ামে ছাড়া হল চারটে মাছ। এই সব নিয়েই তৈরী হল অচলায়তনের সেট। তিন দিন শুটিং হল। দুই দিন এডিটিং। এডিটিং করা হল একটি এডিটিং সফটোয়ারের ট্রায়াল ভার্সানে। যেদিন কাজ শেষ হল, সেদিন একটা ফেস্টিভেলের পাঠানোর প্রায় শেষ মূহুর্ত। অনলাইন প্রিভিউ কপি পাঠাতে হবে। আমার নেট নেই। তন্ময়ের আছে রাত্রি বারোটা অবধি। কোন মতে রাত্রি এগারোটার সময় ওর বাড়ি পৌঁছলাম। কি ভাবে পাঠাবো তাও জানি না। নেট ঘেটে ঘুটে বুঝলাম। তুলতে গিয়ে দেখি নেয় না। আমাদের দুজনেরই অবস্থা করুণ। অনেক চেষ্টার পর উঠল। আপ্লোড কম্‌প্লিট হল, সেভ দেওয়ার সাথে সাথেই নেট এক্সপায়ারড। আমাদের মোট বাজেট দাঁড়ালো ৫০০ টাকা।

 ভেবেছিলাম রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন। কিন্তু হুবহু নাটকটাই সিনেমা করলে, আজকের সময়ে সেটা কি প্রাসঙ্গিক। যদিও রূপক। ঠিক করলাম, সরাসরি বিষয়ে আসবো। রূপকটা আরো স্পষ্ট করব। এই সময়ের কথা ভাবতে মাথায় এলো, পঞ্চকের প্রতিবাদ হোক ধর্ষণের বিরুদ্ধে। মহাপঞ্চককে দেখানো হল, তিনি শুদ্ধিকরণ করেন ধর্ষিতার। তার কথায়, শুদ্ধিকরণে ধর্ষিতার পাপ ধুয়ে যায়। সাথে এলো মিডিয়া বুদ্ধিজীবি। ধর্ষণ-সচেতনতার বিজ্ঞাপন। জনগণকে বলা হল, ধর্ষণ করে ধর্ষিতার পিঠে সই করে যান। সেই সই গুণে তাকে ধর্ষণ ভাতা দেওয়া হবে। নিরক্ষর হলে টিপ সই দিন। এই ভাবে চলছিল। সিনেমাটা মাঝ বরাবর এসে জানা গেল যাকে এতক্ষণ আমরা নারী ভাবছিলাম। সে নারী নয়। ট্রান্সজেণ্ডার। ব্যাস সমাজ চুপ। মিছিল বন্ধ। ‘শুনলাম তুই নাকি মাইয়া নোস্‌’। জাঙিয়া ও ব্রা জ্বলে গেল একতারে একসাথে। পাশে ঝুলে রইল পুতুল। সরাসরি কোন মেসেজ দিতে পারি নি। চাই নি। ছেড়ে দিয়েছি দর্শকের ওপর। দর্শক চিন্তাশীল।

 আমি তখন ক্লাসে বসে আছি। ফেল করি নি কোন সাব্জেক্টে। আমাদের একটা ট্রেনিং চলছে। তখনই তন্ময়ের এস এম এস টা এলো। কানাডার ইণ্টারন্যাশানাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে (ইস্টার্ণ ব্রিজ) আমাদের ছবিটা সিলেক্ট হয়েছে। ফিকশান ক্যাটাগরিতে একমাত্র ভারতীয় ছবি। এর কিছুদিন পর। তন্ময়ের ফোন, মৃগাঙ্ক দা পাসপোর্টটা এবার করে ফেলো। মেল এসেছে জার্মানি থেকে। ওখানেই ইণ্টারন্যাশানাল ফেস্টিভেলে (আপ এণ্ড কামিং) ৫৭ টা দেশের ২৯৮২ টা ছবির মধ্যে থেকে আমাদেরটা সিলেক্ট হয়েছে। এখানেও একমাত্র ভারতীয় ছবি। ওখানে থাকা খাওয়া ওরাই দেবে। তারপরেই তন্ময় চুপ করে গেল। মেলের পরের অংশটা পড়ছে। ডিরেক্টারদের একজনকে যেতেই হবে ওখানে। প্রতিটা ফিল্মের পর একটা ডিসকাশান সেসান রেখেছে ওরা তার জন্য। প্লেন ফেয়ারটা ওরা দেবে না, ওটা আমাদের জোগার করতে হবে। না যেতে পারলে হয় তো ছবিটা দেখানো হবে না। আমরা থেমে গেলাম। এতোগুলো টাকা! একদম সস্তার প্লেনে গেলেও আসা যাওয়া সত্তর হাজার। কোথায় পাবো! অনেক দৌঁড়াদৌড়ি করেও কিছু হয় নি এখনো। স্পনসর পাই নি। ক্রাউড ফাণ্ডিং করে এসেছে সাত হাজার। দশ ভাগের একভাগ। জানি না এখনো। যেতে পারবো কিনা কেউ ওখানে। ভারতের এই সময়ের পরীক্ষামূলক ছবির চেহারাটা জার্মানির দর্শকের কাছে পৌঁছবে কি না।

(লেখাটার বয়স হয়ে গেছে বেশ কয়েক মাস। পরে ছবিটা দেখানো হয়েছিল জার্মানিতে। এরপর থাকে কান ফেস্টিভেলের FESTIVAL DE CANNES 2014 ।| Festival Corner | Short Film Catalog -এ । এবং vagrant film festival ( Belarus, Europe ) -এ নির্বাচিত হয়।)

DIARY
AUTHOR

Comments