ডiary: শুক্রাণু : একজন বিজ্ঞানী ও একটি প্রশ্ন : অ র্জু ন ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়






DIARY
AUTHOR

অ র্জু ন  ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়
শুক্রাণু : একজন বিজ্ঞানী ও একটি প্রশ্ন 

খেলার নাম ‘বলো তো আমি কে?’   

তিনটে আলাদা ঘর। তিনটে ঘরেই কম্পিউটার LAN দ্বারা সংযুক্ত। এই খেলায় তিনজন অংশগ্রহণকারী। প্রথম ঘরে একজন লোক। দ্বিতীয় ঘরে শুধুমাত্র একটি কম্পিউটার। আর তৃতীয় ঘরে একজন বিচারক (মানুষ)। প্রথম এবং দ্বিতীয় ঘর থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে টেক্সট মেসেজ আসবে তৃতীয় ঘরে থাকা বিচারকের কাছে। বিচারক মেসেজ টাইপ ক’রে এই দুজনের সাথেই কথা বলতে পারবেন। দুজনেই বিচারককে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করবে they are human. কোন্‌ মেসেজটা মানুষ আর কোন্‌টা কম্পিউটার পাঠাচ্ছে, বিচারক যতবার এটা বুঝতে ভুল করবেন, ততবার খেলায় জিতে যাবে কম্পিউটার।     


বড়ো হয়ে আমি অবাক হব

৮ই জুন, ১৯৫৪-এর সকাল। গ্রেট ব্রিটেন। বিজ্ঞানীর ঘরে এলেন তাঁর ঘর পরিষ্কার করেন যে মহিলা, তিনি। বিজ্ঞানী শুয়ে আছেন তাঁর নিজের বিছানায়। মৃত। পাশে রাখা আধ-খাওয়া একটি আপেল। সায়নাইড। চলে গেলেন থিওরেটিক্যাল কম্পিউটার সায়েন্স এবং আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সির জনক। চলে গেলেন একজন গণিতজ্ঞ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন দুঁদে ক্রিপ্টঅ্যানালিস্ট। ব্রিটেন কোডব্রেকিং সেন্টারের গভর্ণমেন্ট কোড এ্যাণ্ড সাইফার স্কুলের সবথেকে প্রতিভাবান অফিসারটি। বিয়াল্লিশতম জন্মদিনটা আসতে তখনও ষোল দিন বাকি। অ্যালান ম্যাথিসন টিউরিংকে চলে যেতে হ’ল। ব্রিটেনের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল ওঁকে, দু’বছর আগেই। ম্যাঞ্চেস্টারের এক উনিশ বর্ষীয় যুবক আর্নল্ডের সাথে সমাকামী সম্পর্ক রাখার অভিযোগে। ভাই এবং উকিলদের জোরাজুরিতে একটা মুচলেকা যদিও দিলেন, তবে বিজ্ঞানী কিন্তু অভিযোগ অস্বীকার করেননি। আত্মরক্ষার্থে কোনো ধুরন্ধর যুক্তিও খাড়া করেননি তিনি। বরং, প্রত্যেককে খোলাখুলিভাবে জানিয়েছিলেন, নিজের আচরণে তিনি কোত্থাও ভুল দেখতে পাননি। কঠিন ও অনমনীয় সময়ে, যখন চারপাশ থেকে কোনো সিম্প্যাথিই নেই তাঁর প্রতি, উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন তদন্তকারীদের সামনে নিজের সমকামী সম্পর্কের কথা। ’৫২সাল, ৩১ মার্চ। টিউরিং-এর বিচার শুরু হল। বেছে নিতে বলা হল যেকোনো দুটো। কারাবাস কিংবা চিকিৎসা। জেলে যাওয়ার পরিবর্তে চিকিৎসায় রাজি হলেন টিউরিং। শুরু হ’ল একবছরের জন্য ইস্ট্রোজেন ইঞ্জেকশন। এটা তাঁর লিবিডোকে শূন্যে নামিয়ে আনবে। চল্লিশ বছরের একটি মানুষকে করে ফেলা হল ইম্পোটেন্ট। শরীরে ফুটে উঠল স্তন। এরপর দু’বছরই টানতে পেরেছিলেন নিজেকে। গ্রেপ্তার হওয়ার পর এই শেষ দু’বছরের জীবন এক অত্যন্ত শ্লথ, অবাসাদময় এবং উন্মাদ-দশার জীবন। শেষে, আপেলে একটা কামড়। আজ কম্পিউটার সায়েন্স যে জায়গায় পৌঁছেছে, সারা দুনিয়া জুড়ে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সি নিয়ে যে তুলকালাম গবেষণা, তার শুরুই হয়েছিল এই মানুষটির হাত দিয়ে। টিউরিং-এর আত্মহত্যার মাত্র পঞ্চান্ন বছর বাদে, ২০০৯ সালে, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন, সরকারের তরফ থেকে জনসমক্ষে ক্ষমা চাইলেন, যে ‘প্রচণ্ড খারাপ পদ্ধতিতে ওঁর চিকিৎসা করা হয়েছিল’, সে জন্য। ১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে, টিউরিং-এর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়, ‘মাইণ্ড’ পত্রিকায়। ‘কম্পিউটিং মেশিনারি এ্যাণ্ড ইন্টেলিজেন্সি’। যেখানে তিনি তুললেন সেই অদ্ভুত একটা প্রশ্ন। যা নিয়ে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা আজও মাথার চুল ছিঁড়ছেন। 

‘ক্যান্‌ মেশিন্‌স্‌ থিংক?’ আরো অবাকের মগডালে উঠে ব’সি আমি, যখন দেখি আজ থেকে চৌষট্টি বছর আগে লেখা টিউরিং-এর গবেষণাপত্রে এই লাইনটা, ‘অল ডিজিটাল কম্পিউটারস্‌ আর ইন এ সেন্স ইক্যুইভ্যালেন্ট’। আয়ারল্যাণ্ডে ডাবলিন সিটি ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ কম্পিউটারে, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সি নিয়ে গবেষণারত আমার বাল্যবন্ধু রণি-র কাছে প্রথম শুনি এই টিউরিং-এর কথা। রণি বলছিল, ‘‘মেশিনকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে, তারপর ফেসবুক থেকে হিউম্যান ক্রিয়েটেড কবিতা নিয়ে, যদি মেশিন আর হিউম্যান ক্রিয়েটেড কবিতা— এই দুটোকে একসাথে ফেসবুকে ছেড়ে দিয়ে বলা হয়, নাও, ভোট আউট করো। ব’লে ফ্যালো কোন্‌ কবিতাটা মেশিন ক্রিয়েটেড। লোকে নির্ঘাৎ ভুল করবে। আর, যত ভুল করবে ততই আমার সিস্টেমের অ্যাকিউরেসি।’’ ১৯৫০ সালে দেখানো অ্যালান টিউরেং-এর এই-ই সেই বিখ্যাত ‘টিউরিং টেস্ট’।  
এখন তো লেখালিখির পুরো কাজটাই এই কম্পিউটারে করি। পড়াশোনাও সত্তর ভাগ এখানেই। এই যন্ত্রটিও বড়োই অবাক করেন আমায়। একে নিয়েই তো টিউরিং ভেবেছিলেন কতকিছু। খুব ছোটবেলায় সব বাচ্চাকেই যেমন জিগ্যেস করা হয়, বড়ো হয়ে কি হবে তুমি? আমাকেও করা হ’ত। ক্লাস-টু কি থ্রি-তে পড়ি বোধয় তখন। আমি নাকি বলেছিলাম বড়ো হয়ে অবাক হব। সেই বিস্ময় আজও গেল না আমার। ক্লাস টুয়েলভে যেমন অবাক হয়েছিলাম, জর্মন দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট প’ড়ে। সারাজীবনের জন্য যেমন অবাক করে দিয়ে গেলেন উপেন্দ্রকিশোর এবং সুকুমার। একচল্লিশ বছর তিনশো উনপঞ্চাশ দিন এই পৃথিবীর আবহাওয়ায় কাটানো একটা মানুষ, মরে যাওয়ার চার বছর আগে একটা, একটাই মাত্র প্রশ্ন রেখে দিয়ে গেলেন সভ্যতার কাছে। ‘ক্যান্‌ মেশিন্‌স্‌ থিংক?’ ব্যস্‌। মানব মেধার সামনে পুঁতে দিয়ে গেলেন আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সি নামের এক ব্রহ্মাণ্ড। 
     ওঁকে নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে জানতে পারি ১৯৩৭ সালের একটি ফিল্‌মের কথা। ওয়াল্ট ডিজনি প্রোডাকশনের ফিল্‌ম, ‘স্নো হোয়াইট’। দারুণ রূপসী রাজকন্যা স্নো হোয়াইট তাঁর সৎ-মায়ের কাছে বড়ো হচ্ছে। আর শয়তান এক জাদুকর রাণী চাইছে স্নো হোয়াইটের বাপ-মা ম’রে গেলে ওদের রাজত্ব কেড়ে নেবে। ম্যাজিক আয়নার মধ্যে সেই রাণী দেখতে পেয়েছে স্নো হোয়াইট এই রাজ্যের সবচেয়ে রূপসী মেয়ে। রাণী লোক পাঠালেন স্নো হোয়াইটকে মেরে ফেলতে। কিন্তু সে বেঁচে যায়। এরপর শয়তান রাণী নিজেই বিষমাখা এক জাদু-আপেল তৈরি করলেন। এটায় এক কামড় বসালেই স্নো হোয়াইট ঘুমের মধ্যেই চলে যাবে চিরঘুমের দেশে। আর এই ঘুম সেরে উঠতে পারে একমাত্র ভালোবাসার প্রথম চুমুতে। এবারে বিষে ডোবানো সেই আপেল খেয়ে স্নো হোয়াইট তো ঢ’লে পড়ল ঘুমে। আর রাণী নিজেকে ঘোষণা করলেন রাজ্যের সবচেয়ে রূপসী ব’লে। ওদিকে, এক রাজপুত্র প্রেমে পড়েছিল এই স্নো হোয়াইটের। সে জানতে পারে রাজকন্যার চিরঘুমের কথা। সে এসে স্নো হোয়াইটের কফিনের সামনে ব’সে থাকে মন খারাপ ক’রে। এবং চুমু খায়। আর ঘুম থেকে জেগে ওঠে রাজকন্যা। কি অদ্ভুত সমাপতন, অ্যালান টিউরিং-এর সবচেয়ে প্রিয় সিনেমা ছিল এই ‘স্নো হোয়াইট’। ওঁর বিছানার পাশেও ছিল অর্ধেক খাওয়া বিষমাখা একটা আপেল। অপেক্ষায় ছিলেন কি কোনো রাজপুত্রের?           

অ্যালান ম্যাথিসন টিউরিং
(২৩শে জুন ১৯১২ – ৭ই জুন ১৯৫৪)

Comments

Post a Comment