বিশাখা - অনুপম মুখোপাধ্যায়











পুকুরটার চারপাশে বাগানের ছায়া স্যাঁৎসেতে হয়ে আছে। এটা মাঘের শেষ। বিকেলেরও শেষ। এ বছর শীতকালটা লাগাতার নিম্নচাপে জব্দ হয়ে আছে। বাতাস কিছুতেই শুকনো হচ্ছে না। এই যে আমরা বসে আছি, ঘাস আমাদের কোমর ছাড়িয়ে উঠেছে। দাঁড়ানোর পরে দেখতে পাব আমাদের জিনসের পশ্চাদ্দেশ ভিজে গেছে। সেটা হিম নয়, ঘাসে্র তলায় জমে থাকা অসময়ের জল। তিনদিন আগে হাল্কা বৃষ্টি হয়েছিল।

একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলাম না আমরা। বিশাখা অনেকক্ষণ চুপচাপ। ও ভয় পেয়েছে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই অবিশ্যি। ও এমনিতেই কথা কম বলে। আমরা যখন একা হই, কথা চালানোর ভারটা আমাকেই নিতে হয়। এখন আমিও কথা বলতে পারছিলাম না। গলা শুকিয়ে গেছে। জল আনতে ভুলে গেছি। বিশাখার সামনে সিগারেট খাওয়া চলবে না।

এইভাবে এর আগে কখনও একা হইনি আমরা। আসলে এইভাবে আমাদের একা হতে হয়নি এর আগে। এটাকে সুযোগ নেওয়া কি বলা চলে? প্রেম করার সুযোগ? আদর করার সুযোগ? এই সুযোগের জন্যই কি আমরা একাধিকবার চরম ফ্লপ সিনেমার টিকিট কাটিনি? জ্যৈষ্ঠ মাসের দুপুরে উঠে যাইনি ছাতের ঘরে?

না সম্ভবত।

এর আগে যখন একা হয়েছি, ভিড়ের মধ্যেই হয়েছি। সিনেমা হল যতই ফাঁকা হোক, জনশূন্য হয় না। একটা ফাঁকা ছাতেও একটা ছোট শহর তার যানবাহনের আওয়াজ নিয়ে ভিড় করে থাকে। একা হওয়ার জন্য আমাদের সুযোগ খুব বেশি খুঁজতেও হয়নি। আমার বন্ধুর বোন বিশাখা চক্রবর্তী। ওকে আমি ইংরেজি অনার্স পড়াই। তাছাড়াও আমাদের রীতিমতো ভাইফোঁটা আছে, রাখি আছে। ওগুলোই তো যথেষ্ট আড়াল! আমরা যদি সারা দুপুর ছাতে কাটিয়ে নেমে আসি, ফাঁকা সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে আসি, কে গায়ে পড়ে সন্দেহ করবে? সন্দেহ করলেও আমাদের কিছু যায় আসে না।

এই কুখ্যাত বাগানে আমরা সেজন্য আসিনি।

বিশাখা হঠাৎ আজ দুপুরে মুখ সরিয়ে নিয়ে বলেছিল, ‘খুব তোমার সাহস তাই না?’

‘সাহস তো আছে। তুই টের পাস না ?’ আমি বলেছিলাম।

‘একে সাহস বলে না। চুরি বলে।’

‘চুরি, না দিনে ডাকাতি?’

‘চুরি। ফালতু কিছু ছেলে আর মেয়ে এসব করে। আমাদের মতো যারা ফালতু, আর হ্যাংলা।’

‘তাই?’ আমার একটু চোট লেগেছিল। বলেছিলাম, ‘দামি ছেলেমেয়েরা তাহলে কী করে?’

‘লাহাদের বাগানে গিয়ে সন্ধেবেলায় আমাকে এভাবে চুমু খেতে পারবে?’

‘কী?’

‘তুমি শুনেছ।’

আমি শুনেছিলাম। বিশ্বাস করতে পারিনি। লাহাদের বাড়ির বাগান আমাদের শহরে কুখ্যাত। যারা বুকের পাটায় হাতি ওঠায়, তারাও সন্ধে হয়ে এলে ওই জায়গাটি এড়িয়ে চলে। দিনের আলোতেও পারতপক্ষে পা দেয় না। সোমনাথ লাহা আজ থেকে কুড়ি বছর আগে নিজের মেয়েকে কুপিয়ে মেরে ফেলেছিলেন প্রেম করার অপরাধে। সেই অস্ত্রেই স্ত্রীকে খুন করেন। নিজেও করেন আত্মহত্যা। সেই থেকে তাঁর বিরাট পৈত্রিক বাড়ি বিশাল বাগানসমেত পোড়ো হয়ে আছে। কেউ ভয়ে পা দেয় না। এখানে ভূত দেখেছে এমন দাবি আজ অবধি কেউ করেনি। এই ছোট শহরের সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনার সাক্ষী হিসেবেই আজ বাগানটি মানুষের ভয়ের প্রতীক হয়ে আছে। হয়তো সে নিজে অতখানি ভয়াবহ নয়। সাপখোপ ছাড়া আর কিছুই হয়তো সেখানে আতংকজনক নয়। শীতকালে সেই ভয়টাও নেই। তবু... বিশাখার কথা শুনে এবং স্থির চোখ দেখে আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। এই রোগা মেয়েটা মুখে কথা খুব কম বলে। বেশির ভাগ সময় চোখ দিয়ে কথা বলে। কিন্তু কথার নড়চড় হয় না। ওর ভয়ডর নেই, আমরা সকলেই জানি। সবচেয়ে বেশি জানি আমি। আমি জানি শুধু রোমাঞ্চের লোভে ও যেকোনো সীমা পেরিয়ে ঝুঁকি নিতে পারে। আমি ওকে উসকে দিই সেটা করতে মাঝেমধ্যেই।

তাই বলে লাহাদের বাগান ! কয়েক বছর আগে ওখানে একটি যুবকের অক্ষত মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। সে স্থানীয় ছেলে। নেশা করত। সাট্টা খেলত। আরো গোলমেলে কিছু ব্যাপারে যুক্ত ছিল। কিন্তু শোনা যায় ওটা খুন নয়। তার বন্ধুরা স্বীকার করেনি, কিন্তু অনেকেই বলে সে নাকি বাজি ধরে রাতে ঢুকেছিল ওই বাগানে। ডাকাবুকো ছেলেটা হার্টফেল করে মারা যায়।

ছেলেটা কি এখানে এসেই বসেছিল সেই রাতে? এই পুকুরটির ধারে, ঠিক এখানেই?

আপাতত আমরা পাশাপাশি। ছেলেবেলা থেকে এই জায়গাটির দিকে ভয়ের চোখে তাকিয়েছি। মা ঘুম না এলে এখানে নিয়ে আসার ভয় দেখাত। আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়তাম। বিশাখার মা অবিশ্যি ওকে ভয় পাওয়ার অভ্যাস করিয়েছেন বলে মনে হয় না। উনি খুব নিরীহ মানুষ। একমাত্র মুখ ছাড়া কোনো মিলই মেয়ের সঙ্গে নেই। আর একটা মিল হয়তো আছে। দুজনেই কথা খুব কম বলেন। বিশাখা যদি এখন প্রচুর কথা বলত, আমি একটু জোর পেতাম। আমি নিজে কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছি না।

কিন্তু, ও কি সত্যিই এখানে আমাকে চুমু খেতে চায়?

আমার দ্বারা হবে বলে মনে হয় না।

এখানে আর বেশিক্ষণ থাকতেও আমি পারব না। শরীর কেমন অবশ লাগছে। ভূতকে যে আমি এখনও ছেলেবেলার মতোই ভয় পাই, আজ বুঝতে পারলাম। বিশাখার অবিশ্যি খুব একটা বিকার নেই। আমার দিকে বেশি তাকাচ্ছে না। চারদিকটা এখনও কৌতুহলের সঙ্গে দেখছে। খুব দ্রুত বদলাছে চারদিক। অন্ধকার নামছে। তার ঘনত্ব বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটা আরো অলৌকিক হয়ে উঠছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুধু বড়ো গাছগুলোর মাথাতেই আলো লেগে থাকবে। বেশ কয়েক বিঘা জমি নিয়ে এই বাগান তৈরি করেছিলেন লাহাদের পূর্বপুরুষ। এখান থেকে বাইরের শহরের কিছুই শোনা বা বোঝা যায় না। আমরা যে পাঁচিলটি ডিঙিয়ে মাত্র আধঘন্টা আগেই ঢুকেছি, তার পাশেই একটা বড়ো রাস্তা। সেখানে যানবাহন ভালোই চলাচল করে। কিন্তু এখানে সেই আওয়াজ আসছে না। ঘন গাছপালায় ঘেরা একটা অন্য দেশে যেন আমরা চলে এসেছি। কিছু গাছ চেনা হলেও অনেক গাছই চিনি না। হয়তো সেগুলো বিলিতি গাছ। এখান থেকে রাস্তা চিনে ফেরার প্রশ্নটাও মাথায় আসছে আমার। খুব অন্ধকার হয়ে গেলে সেটার জন্য সময় লাগবে। অবিশ্যি পকেটে মোবাইলটা লুকিয়ে এনেছি। বিশাখা বারণ করেছিল। সাইলেন্ট করে রেখেছি তাই।

আশা করি বিশাখা নিজেই আর থাকতে চাইবে না। ভূত না হোক, অন্য ভয় তো ওর আছে!

আমি জোর করে স্বাভাবিক গলায় বললাম, ‘শখ মিটেছে? এবার যাওয়া যাক, কী বলিস?’

বিশাখা হেসে ফেলল, ‘তোমার খুব গা ছমছম করছে, তাই না? চুমু খাওয়ার ইচ্ছেটা আর আছে, না চলে গেছে?’

আমি শিউরে উঠলাম। এসব কথা এরকম জায়গায় সোচ্চারে বলা হয়তো একেবারেই নিরাপদ নয়। সেই মেয়েটির অতৃপ্ত আত্মা... সেই ভয়াবহ ঘটনার স্মৃতি এখানে বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে আছে। কত জীবন তৃষ্ণা নিয়ে যে সেই মেয়েটি নিজের বাবার হাতে খুন হয়েছিল!

আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘তোকে চুমু খাওয়ার অনেক জায়গা আছে। এখানে এতক্ষণ থাকলাম, এটাই যথেষ্ট। বাড়ি চল। মাসিমা ভাবছেন।’

বিশাখা খুব নির্বিকার মুখে বলল, ‘কেউ ভাবছে না। আমি বাড়িতে বলে এসেছি আমরা সিনেমা যাচ্ছি। এখনও একঘন্টা আমরা থাকতে পারি। কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না।’

বিশাখা কি আমাকে নিয়ে খেলছে? ওর এই চেহারা আমি আগে দেখিনি। অবিশ্যি অন্ধকারে ওর মুখ আমি দেখতে পাচ্ছি না আর। ও কি সত্যিই আরো একঘন্টা এখানে থাকবে নাকি?

বিশাখা হঠাৎ ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আজ যদি বিশাখা চুমুর বদলে তোমাকে সেই চরম জিনিসটা দেয়, যেটা তুমি এত বছর ধরে চেয়ে আসছ, নিতে পারবে এখানে?’

কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থ মনে হচ্ছে মেয়েটাকে ! ওর কন্ঠস্বর আমাকে হিম করে দিল। তবু আমি শরী্রের সব শক্তি একজোট করে উঠে দাঁড়ালাম। শক্ত গলায় বললাম, ‘আমি বাড়ি যাচ্ছি। তুই যদি চাস এখানেই সারারাত থাকতে পারিস।’

বিশাখা নীচু গলায় হেসে উঠল। তারপর আরো অদ্ভুত গলায় বলল, ‘আজ কিন্তু বিশাখা তোমাকে সেই চরম জিনিসটাই দেবে। সেটা ভেবেই এসেছিল এখানে। ও আসছে দ্যাখো...’

আমি অসাড় হয়ে যেতে যেতে বোজা গলায় বললাম, ‘কে?’

ও অন্ধকারে আঙুল তুলল পুকুরের দিকে, ‘দ্যাখো, ও আসছে!’

আমার চোখের সামনে অন্ধকার আরো কালো হয়ে গেল হঠাৎ।







---

Comments