লোকটা - আকাশ দত্ত




দোকানটা খুলতে না খুলতেই দূরে দাঁড়ানো ভদ্রলোকটি কাউন্টারের একদম সামনে চলে এলেন। ভদ্রলোক না বলে ভিখারী বলাই ভালো। মুখচেনা। আমাদের মার্কেটে অনেকদিন ধরেই ভিক্ষাটিক্ষা করেন। পাশের বস্তিতেই থাকেন। সারাদিন এইভাবেই চেয়ে চিন্তে দু'বেলা দু'মুঠোর সংস্থান করেন আর কি!

বয়স এই পঞ্চান্ন ষাট হবে। এমনিতে ভালোই। যে যা দেয় খুশীমনে তাই নেন। বাঁ পায়ে কিছু একটা প্রবলেম আছে। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। যাই হোক সাতসকালে এইভাবে দোকানের মধ্যে চলে আসাতে একটু বিরক্তই হয়েছিলাম। ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলাম, এখন কি? সবে ধূপ দিয়েছি। ঘুরে এসো।..

লোকটা শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠল। না না বাবু। আমি ভিক্ষা চাইতে আসিনি গো। আসলে কমলার মা টা কাল রাত থেকে খুব বমি করছে। তাই একটা ওষুধ যদি দেন। মেয়েটা বড় কষ্ট পাচ্ছে গো।..

আমি এবার আরও বিরক্ত হয়ে উঠলাম। বমি মানে? কি রকম বমি? টক টক গন্ধ? কি খেয়েছিল কাল রাতে?.. না গো বাবু। ওসব কিছু না। লাল লাল!...

সজোরে মাথা নেড়ে বললাম, উঁহু!! তাহলে ডাক্তার দেখাও। এভাবে না জেনে না বুঝে মেড দেওয়া যাবে না। মনে হচ্ছে ফ্যাটাল কিছু!...

লোকটা ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। আমি উপযাজক হয়ে বললাম, আরে দূর! এত ভাবছো কেন? তোমার বিয়ে করা বউ নাকি!! কোথাকার কোন মেয়ে! হুহ্!!! বাদ দাও তো! ফেলে দিয়ে এসো কোন সরকারি হাসপাতালের চৌহদ্দিতে। আর তারপরে হাত ধুয়ে ফ্যালো!

অযাচিতভাবে বেশ কিছুটা জ্ঞান দিতে পেরে বেশ একটা ইয়ে ইয়ে লাগছিল! এর মধ্যে বিনোদ চা দিয়ে গেছে। আনন্দবাজার টা কাউন্টার মেলে দিয়ে চায়ের কাপে একটা সুখ চুমুক দিলাম।

নজরে পড়ল উনি ততক্ষণে দোকানের এককোণে বসে পড়েছেন। পেপার থেকে চোখ না সরিয়েই বললাম, কি হল? আবার বসে পড়লে কেন? যা বলছি তাই কর। আজকের দিনে কে কার ঠেকা নেয়!!

মাথা নীচু রেখে বিড়বিড় করে বলে উঠল লোকটি। গত বছর তার আগের বছর কেঁদুলীর মেলায় পেয়েছিলাম কমলার মা'কে। অকারণে যখন চোরের অপবাদ দিয়ে সবাই ক্ষ্যাপা কুকুরের ঝাপিয়ে পড়েছিল আমার ওপরে, ওই শুধু আগলে ছিল গো আমায়। ঝগড়া করে বাঁচিয়েছিল ভুল বোঝা পাগলগুলোর হাত থেকে। আমার নষ্ট হয়ে যাওয়া পায়ের চুঁইয়ে পড়া রক্ত নিজের ছেঁড়া কাপড়ে মুছে দুব্বো ডলে দিয়েছিল গো।

মেলার বাকী দিন ক'টা ওরই পয়সাতে কাটিয়ে একটু সুস্থ হলাম। তারপরে ভালবেসে এখানে নিয়ে এলাম ঐ মেয়েটাকে। আর আজ ওর এই অবস্থায় ওকে ছেড়ে দেবো? ফেলে দিয়ে আসবো সরকারী হাসপাতালে? না গো বাবু। এ আমি পারবো না। কখনওই না।..

ওর কথার কিছু একটা উত্তর বোধহয় দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু..!

কিন্তু মর্ডানিটি আর ভ্যলুসের রমরমা পেরিয়ে গলার মধ্যে ওর 'ভালবাসা' শব্দটির পরিব্যপ্তি কোথায় যেন দলা পাকিয়ে গেল। ডাক্তারবাবু তখনও আসেন নি।
ওর ছলছল আর্তিতে সামনের নোটবুকটা টেনে নিয়ে কোন রকমে এইটুকুই বলতে পারলাম। ..এই শুনছো? কমলার মায়ের ভালো নাম কি জানো??....


---

Comments