আমি - শুভ্রনীল সাগর






পৌনে ছ-ফুট পাঁচিল বেয়ে উঠতে হাস-ফাঁস অবস্থা হয়ে এলো বাবুর। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে কোনো মতে উঠে পাঁচিলের উপরেই বসে থাকল খানিক্ষণ। ভাবছে উঠলো তো একভাবে, এবার নামবে কি করে। নানান তরিকা মনে মনে আউড়ে দেখল আসলে ঠিক কোনটা সুবিধা হয়। শেষে যা থাকে কপালে বলে চৌষট্টি কেজি বডিটা ছুড়ে দিল মাটির দিকে। ধপ করে প্রকাণ্ড একটা শব্দের পাশাপাশি দুকান দিয়ে ঝা করে বেরিয়ে গেল বিকেলের রোদ।

সবে তো ছাবিবশ, এখনই এই- ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়ায় সে। অথচ এই সেদিনও চোখের পলকে পার হয়ে যেত। বছর ছয়েক হলো পাঁচিলটা উঠেছে। ছিল হাজী সাহেবের জমি, ওদের খেলার মাঠ- সংক্ষেপে হাজীর মাঠ। পরে হাজী সাহেব মহিলা কলেজকে দান করে দিলে সামনের জমি, পেছনের জমি, চারপাশে পাঁচিল- সব মিলিয়ে মহিলা কলেজের মাঠ। পাঁচিলের পেছনে আধবিঘে মত বাঁশঝাড়। তার পেছনেই ওর বাড়ি। ছোটবেলায় বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে কখনো নিচু কখনো উঁচু হয়ে দৌড়ে দৌড়ে খেলতে আসত ও, ওরা- পাড়ার আর সবাই। ঢুকেই একটু সামনে ডানপাশ জুড়ে ছিল একটা বয়স্ক বরই গাছ। সে গাছের বরই কখনও কৈশোর পোরোতে পারেনি, ওরাই দেয়নি। গাছের গা ঘেষে হাত দশেক দূরে ক্রিকেট পিচ করত ওরা। অনড্রাইভের জায়গায় ফিল্ডার লাগত না বরই গাছের জন্য। কত চার-ছয়ের মার যে আটকে গেছে ইয়ত্তা নেই! মাঠের ডান কোনায় ছোটখাটো ডোবা মত। বৃষ্টি হলে ঘোলা জল জমে। ডোবায় বল পড়লে দুই রান, এটাই চিরন্তন নিয়ম। পাড় ঘেষে বাবার বয়সী জোড়া রয়না গাছ। মাঠটা সে অর্থে সিজনাল। মানে শীতে ক্রিকেট, বর্ষায় ফুটবল- তারপর ঝোপ বুঝে গল্লাছুট, বউচি, সাতচাড়া, বোমবাস্টিং আরও কত কি।

চাকরির সুবাদে বাবুকে বাইরে থাকতে হয়। ছুটিতে বাড়ী এসেছে। বহুদিন পর মাঠে আসা। শুনেছে সাড়ে পাঁচটার দিকে মাঠে খেলা হয়। খেলতে তো নয়, এমনিই আসা। কেউ আসেনি এখনো। বোধ হয় সে একটু আগেই এসে পড়েছে। তার কি একা লাগা ঠিক? ওইতো বামপাশে দুটো জলপাই গাছ, সারি সারি কাঁঠাল, নারকেল গাছগুলো তার কত দিনের চেনা। কত আপন এই মাটি, ঘাস-লতা- সকাল-সন্ধ্যার স্মৃতি।

দু-একজন আসতে শুরু করেছে। নতুন মুখ, নতুন প্রজন্ম। তার যারা খেলার সাথী ছিল- কেউ এখন মালয়েশিয়া, কেউ গার্মেন্টেসে কাজ করে, কাঠ ব্যবসায়ী, দুজন ইন্ডিয়া, একজন খুন। গোল্লাছুটের মেয়েগুলো বিয়ে-থা হয়ে মা-মাসি বনে গেছে। আর কোনোদিন জোট বেঁধে ছড়ানো সাতচাড়া জড়ো করা হবে না ভাবতেই চোখ ভিজে ওঠে ওর। লেখাপড়া সেই অর্থে সে আর হাতেগোনা কজনই ধরে রেখেছিল বলা চলে। কদাচ দেখা হয় পথে-ঘাটে। কিরে, কেমন আছিস? কবে এলি, কবে যাবি?


দিনগুলো শুকনো পাতার মতো ঝরে গিয়ে গাছে-গাছে এসেছে নতুন ফুল-পাতা। বরই গাছটাও নেই। এইতো নিয়ম। মাঠেও নতুন মুখ। এর মাঝে সে কোথা? 




--

Comments